বাংলার মুখ-দগ্ধ দিনের দেখা-তমোঘ্ন নস্কর-বর্ষা ২০২২

বাংলার মুখ -আগের লেখা –পিসির বাড়ি, মকর সংক্রান্তি ও আলুর দম মেলা , মকরসংক্রান্তির পরব ভেজা বিঁধা,আমাদের বৈশাখী, চুবড়ি মেলা

banglamukh81

সে-সব দিন বড় মিঠে ছিল। চৈত্রের তাতে তেতেপুড়ে বাইক দাঁড় করাতাম পথের ধারে কোনও পান্থশালায়। কখনো কোন গ্রামের ঘরে রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটে যেত। কখনো হাইওয়ের ধাবায় রাত্রি যাপন। বোহেমিয়ান জীবন কী জানি না… মধ্যবিত্তের সে বিলাস নেই। তবে জানি, তখন ঘুরতে পারতুম ইচ্ছামতো। এখনকার মতো গুচ্ছের ওষুধ, রোগ এসে আচ্ছন্ন করে দেয়নি বেঁচে থাকা। 

বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তুম তিন বন্ধু দূর দূর। ঠিকানা, হিসাব কিছুই থাকতো না। শুধু দেখার নেশা থাকত দু’চোখ ভরে। 

যুক্তি ফুলের নরম তুলতুলে থকের থেকে উঠে আসা মিঠে কষা গন্ধ নিতে নিতে নির্জন, অজানা খাল পাড়েই শেষ করে ফেলতাম ক্যামেরার রীল। পুকুরের মরে আসে ঘোলা জল আর শুকিয়ে আসা  নরম পলির ফাটা বুকে পানকৌড়ির তপস্যা দেখেই কাটিয়ে দিলুম হয়তো সারা বেলা। লজ্জাবতীর রোঁয়া ওঠা শ্যামলা বুকে আঙুল ছোঁয়ানো, তার আবেশে কুঁকড়ে যাওয়া যেন কল্পলোকের নিষিদ্ধ শিহরণ। 

আমি চালাতে পারতুম না, সওয়ারি হতাম পালা করে এর, ওর গাড়িতে। স্যাকে থাকত মামুলি কিছু যোগাড়যন্তর আর জামাকাপড়। 

সেরকম এক দিনে, মিটির গাঁওয়ের বুড়ির বাড়ি পাত পাড়ার সুযোগ জুটেছিল। অনেক গল্প আঁজলা করে ভরে এনেছিলাম  স্যাকের অন্ধকার পেটের ভেতর জমিয়ে—  জামাকাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে, মোবাইল চার্জার, হেডফোন কর্ডের ভেতর কুন্ডলী পাকিয়ে ভরে এনেছিলাম গল্পদের।

সারাদিন রোদে তেতেপুড়ে বিরাজের তখন গা গুলোতে লেগেছে। মাঠের পিছনে গ্রামের চিহ্ন দেখতেই হাই রোড থেকে গাড়ি বামে ঘুরিয়ে গ্রামের ঢুকে পড়েছিলাম। সীমানায় ঢুকতে না ঢুকতে বাইক থামিয়ে বিরাজ হড়হড় করে উগরে দিয়েছিল সব। চাপা কল টিপে আঁজলা আঁজলা জলে গলা, ঘাড় ভিজিয়ে উলটে গিয়েছিলাম বটতলার চেড়ার বেঞ্চে।

একটা দুটো করে লোক জমেছিল কৌতূহল বুকে নিয়ে। এরকম অদ্ভুত বড় বড় বেখাপ্পা স্যাক আর উলোঝুলো চুলের ছেলেগুলোকে দেখে কী বুঝেছিল কে জানে…. বুড়ো মতো একজন এগিয়ে এসে শুধু বলেছিল, “ক্লাব ঘরটোতে বিশ্রামটো নিতে পারেন। গুরান খুলেন দিছে। ” 

মায়ের কোলের ঠান্ডা মসৃণ লাল মাটির দেওয়াল। ইচ্ছে করে বুক পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকি। কিন্তু না, স্নান করতে হতো। 

গোটা কতক কুঁচো অনেকক্ষণ ধরে দরজার কাছে উঁকি মারছিল। ব্যাগের ভেতর থেকে মুঠো মেরে পালস বের করে মুঠোটা খুলে দিতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। ঘুষ দিয়ে বললুম,  “চান করব। পুকুর পাড়ে নিয়ে চল।”

দুপুরে খাওয়া খাওয়া-দাওয়া ব্যবস্থা হয়েছিল গুপি বুড়োর বাড়িতে। নামকরণ পর্ব তোলা থাক। আমরা যখন গেলাম দিদা তখনও রাঁধছেন। আমরা দাওয়ায় বসলাম। বুড়ো চাটাই পেতে দিল। ঝিমঝিমে কুবো ডাকা দুপুর।

ভাত এল খানিক পর,  কানা উঁচু স্টিলের থালায় লাল চালের মোটা ভাত। সর্ষের তেল ছড়া দেওয়া। ঝাঁঝালো গন্ধ ছাড়ছে। প্রথম পাতে পড়ল, গাজর আর হাঁসের ডিম সিদ্ধ, লবণ, তেল আর শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে মিহি করে মাখা। ভর্তা এতই মোলায়েম যেন ভাতকে জারিয়ে দেবে, বেশিক্ষণ মেখে রাখলে।

কলাই এর ডাল আর শানচে, নটে শাকের বড়ার এমন সাংঘাতিক ষাঁড়াষাঁড়ি এই প্রথম খেলাম। মনে হচ্ছিল নখের ডগা অবধি চেটে নেব। 

শেষপাতে এল, টোপা কুল সেদ্ধ- নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা। এই প্রথম দিদা মুখ ফোটালে, বললে, “তাত লেগেছে। গাছের শেষ কুল, খাও, ভালো লাগবে।”

ভালো লেগেছিল বললে হয়তো সেই রান্নাকে বর্ণনা করা যায় না বরং বলা যায় কুলের মতো হড়কে গিয়েছিলাম। খাওয়ার পর শালপাতার বড়ো সাদা সুতো  বিড়ি এনে দিল বুড়ো, “দাদা তোরা আসছিস কলকাতা থেকে.. লয়?” তারপর গল্পে গল্পে গড়িয়ে গেল বেলা। অদ্ভুত সেসব গল্পের ঢেউ; পালা করে উঠে আসছে— বেঁচে থাকা, জীবনযাত্রা, ইতিহাস। একটু দূরে শাপলা পুকুরটা থেকে ‘হুক্কু হুক্কু’ করে একটা আওয়াজ আসছে। ক্লান্ত ডাহুকটা ডাকছে কি?  কে জানে! শুনতে শুনতে কখন যে বুড়োর দাওয়ায় শালের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েছি জানি না। 

বুড়ো দাদা ওখানেই বড় সলাই পেতে দিলে। আমরা ঘুমোলাম। শান্তির ঘুম….বাইক, ব্যাগ, খোলা দরজা, গন্তব্য সব পড়ে রইল। এ যাত্রায় দেখা শেষ। এবার বিশ্রাম, দুটো দিন এখানে, এইগ্রামেই বিশ্রাম নেব। এই খেজুর, তাল গাছের গোড়ায় জমে থাকা থির ছায়ার মতো বিশ্রাম। গাছে ঝোলানো রসের হাঁড়ির ভিতর জমুক গল্পেরা। পাটালির মতো জাল দিয়ে তুলে আনা যাবে কখনও….. 

অলঙ্করণ- লেখক

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s