জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই ধারাবাহিকের আগের পর্ব- পর্ব ১, পর্ব ২ পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব ৫
স্যার অরেল স্টাইন ছিলেন একজন ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক। ১৮৬২ সালের ২৬ নভেম্বর তাঁর জন্ম হাঙ্গেরিতে। তিনি ব্রিটিশ সময়কালে নানা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ায় একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি শুধু একজন প্রত্নতাত্ত্বিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিক, ভূগোলবিদ, ভাষাবিদ এবং জরিপকারী। ডানহুয়াং গুহা থেকে উদ্ধারকরা পুথি এবং পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ মধ্য এশিয়ার ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্মের শিল্প ও সাহিত্যের অধ্যয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর অভিযান এবং আবিষ্কারের উপর বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন খোটান, সেরিন্ডিয়া এবং আভ্যন্তরীণ এশিয়া বিষয়ক বই। সংস্কৃত থেকে রাজতরঙ্গিণীর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন তিনি। চিরকুমার অরেল স্টাইন ১৯৪৩ সালের ২৬ অক্টোবর কাবুলে দেহত্যাগ করেছিলেন। এই নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর তাকলামাকান মরুভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক খোটান অভিযানের কথা।
কাশগড় থেকে যাত্রা শুরু
৪ সেপ্টেম্বর সকালে আবার দীর্ঘ পথ চলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। কাশগড়ে পাঁচ সপ্তাহ এত ঝড়ের গতিতে কেটে গিয়েছিল যে শেষের দিকে মনে হচ্ছিল আগামীর প্রস্তুতির জন্য আরও কিছুদিন বোধহয় দরকার ছিল। সামনের গন্তব্য খানুই, যেখানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের উপস্থিতি বিষয়ে আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম। কাশগড় থেকে উত্তর-পূর্বে এটা একটা লম্বা পথ। খানুই পর্যন্ত গেলেই বুঝে যাওয়া যাবে আমাদের মরুযাত্রার প্রস্তুতিতে কোনও খামতি রয়ে গেছে কি না।
কাশগড়ে আমার বন্ধু তথা শুভানুধ্যায়ীরা আচমকা আমার ৪ তারিখে পরবর্তী যাত্রা শুরুর ঘোষণা শুনে খুশি ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সবাই আমার যাত্রা শুরুর সময় থাকতে চাইছিল। এর আগে এখান থকে মধ্য এশিয়ার পথে যত যাত্রা শুরু হয়েছে তা হয়েছে বেশ বেলায়, দুপুর পার করে। আমি সেটা করতে চাইনি। যতটা সম্ভব সকাল সকাল যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলাম। যত রোদ বাড়বে তত আমার দলের লোকজন ও পশুদের কষ্ট বাড়বে। ‘ওস্তাদ’-এর দল আগের সন্ধ্যাতেই সব কাজ শেষ করে দিয়েছিল। কোনও ছুটি না নিয়েই ওস্তাদেরা দীর্ঘদিন ধরে টানা কাজ করে গেছে।
ভোর হতে না হতেই মালপত্র ওজন করে উট আর ঘোড়ার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে আমার দল যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে ব্রেকফাস্টের টেবিলে যোগ দিলাম তখন সবাই আমার ক্যারাভান যাত্রার জন্য প্রস্তুত শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
উটগুলো মনে হয় খুব সময়ানুবর্তী। পিঠে মাল চাপানোর পরই আমার অজান্তে কে জানে ওরা কার নির্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছিল। ব্রেকফাস্ট শেষ হতে না হতেই মিস্টার ম্যাকার্টনি তাঁর সদ্য আসা ক্যামেরায় আমার ক্যারাভানের ছবি তোলার প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখনই টের পাওয়া গিয়েছিল ব্যাপারটা। ওরা অবশ্য সামান্যই গিয়েছিল। আবার ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসাতে হয়েছিল। চিনা কর্তৃপক্ষ পুরোদস্তুর সামরিক সাজে সজ্জিত একটি দল পাঠিয়েছিল আমাদের খানিক দূর পর্যন্ত পাহারা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। সম্মান প্রদর্শন আর কি! তাদের বর্ণময় উপস্থিতি ছবিতে একটা আলাদা মাত্রা জুড়েছিল।
পিঠে অনেক ছোটো ছোটো পুঁটুলির বোঝা নিয়ে উট আর চাকরের দল মাইল কয়েক এগিয়ে যাবার পর সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমিও চিন্নি-বাগের বাংলো ছেড়েছিলাম। খানিক পরে টের পেয়েছিলাম বন্ধুদের বিদায় জানানো এখনও শেষ হয়নি।
ইয়ারবাগ গেট পার হয়ে শহরঘেরা পাঁচিলের ধার ঘেঁষে টারবুগাজ সেতুর ওপর দিয়ে নদী পার হবার পর শহরের চৌহদ্দি শেষ হয়েছিল। নদীর সেতুর দু-পাশেই সুদৃশ্য মিনার রয়েছে। আজ শহরের হাটের দিন নয়, তবুও দলে দলে চাষিরা গাধা আর ঘোড়ার পিঠে মাল চাপিয়ে চলছে। হয়তো শহর ছেড়ে অন্য কোনও বাজারে চলেছে। বা আশেপাশে কোথাও বড়ো ধরনের মেলা-টেলাও হচ্ছে। পথের ধারে অজস্র কবরস্থান। রাস্তা এগিয়ে গেছে হযরত আপকের মাজারের দিকে। আমি আমার উটের দলকে পেছনে ফেলে ঘোড়ার চেপে এগিয়ে চললাম শহরতলির গ্রামের বাগানের মধ্যের ছায়া ছায়া পথ দিয়ে—কবরস্থান আর মাজারের পাশ দিয়ে চললাম উত্তরদিকের বেশকারিমের দিকে।
পথের দু-ধারে একের পর গ্রাম পড়ছিল। এই গ্রামগুলো ১৯০২ সালের ভূমিকম্পে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুপুর নাগাদ পৌঁছেছিলাম এই অঞ্চলের সবচাইতে বড়ো গ্রাম বেশকারিমে। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমাকে স্বাগত জানাতে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। সে এক এলাহি কাণ্ড। হটল প্রদেশের বেগ, কাশগরি রঙিন ঝলমলে পোশাকে আমাকে পুরোদস্তুর চিনা কায়দায় সম্ভাষণ করে নিয়ে তাঁর সরকারি বাসভবন ইয়ামেনের বিশাল বড়ো ছাদে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ইলম গাছের ছায়া আর ফুরফুরে হাওয়া শরীরকে জুড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানে বিশাল ‘দস্তরখান’ সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল তাঁর লোকজন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানারকম সুস্বাদু ফল, মিষ্টি আর চা হাজির ছিল সেখানে। ফুরফুরে হাওয়ায় খোলা ছায়াময় ছাদে বসে, নানা জাতের স্বাদু ফল খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছিলাম তারিয়ে তারিয়ে। আমার সঙ্গী ও চাকরদের জন্য ছিল স্যুপ, মাটন আর কেকের পাহাড়। ছাদ থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম সামনের বিস্তীর্ণ বাজার থিকথিক করছে বাহারি পোশাক পরা পুরুষ আর ঘোড়ায়। আমাকে সংবর্ধনা জানাতে আশেপাশের প্রতিটি গ্রামের প্রধানকে হাজির থাকতে বলা হয়েছিল। সব গ্রাম-প্রধানরা এসেছিলেন, সঙ্গে গ্রামের বিশিষ্ট লোকজন নিয়ে ফুলের তোড়া হাতে। এই অঞ্চলের আর্থিক দিক থেকে দুর্বল লোকেরা মূলত পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করেন। বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অনেককেই যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিল। বেশকারিম বাজার সংলগ্ন বেগের আতিথেয়তায় কেটে গিয়েছিল একঘণ্টার বেশি সময়। আমিও খুব একটা হুড়োহুড়ি করতে চাইনি। রোদ্দুরটা খুব চড়া। মালপত্র নিয়ে আমার লোকেদের গন্তব্যে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে।
আমি ঘোড়ার পিঠে উঠে বসতে একটা বিশাল দল আমাকে খানিক সঙ্গ দেবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে চলল। সেই দলে স্থানীয় বেগ যেমনি ছিলেন, তেমনি ছিলেন আশেপাশের গ্রামের প্রধান ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা যাকে বলে, ঠিক সেভাবেই যাত্রা করেছিলাম পূর্বমুখী। প্রায় আট মাইল মতো পথ আমরা চললাম চাষের ক্ষেতের মধ্যবর্তী পথ দিয়ে। এঁকে-বেঁকে চলা পথের দু-পাশে পপলার আর উইলো গাছের সার। ছায়াময় পথের দু-ধারে অগণিত ছোটো-বড়ো সেচ খাল চলে গেছে চাষের জমির মাঝে। তিনটে নাগাদ আমারা পৌঁছলাম চাষের ক্ষেতের ধারে একটা বিশাল পপলার ঘেরা বাগানের কাছে। এই বাগানের মাঝে আছে স্থানীয় জনপ্রিয় সাতক বঘরা খানের স্ত্রী মরিয়ম খানের মাজার।
জায়গাটা উঁচু মাটি-পাথরের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আমরা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। চারপাশে অজস্র ফুলের ঝাড়। তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে একটি ইলম গাছ। বাগানের একপাশে স্তূপ করে রাখা ছিল তরমুজ আর নানাবিধ ফল। আমার সঙ্গে শোভাযাত্রা করে আসা অধিকাংশ সাথীরা ফলের স্তূপ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উদরপূর্তি করতে। আমি খানিক অবাক হয়ে গিয়েছিলাম—এত তাড়াতাড়ি খিদে পেয়ে গেল কী করে? আমি বাগানের ভেতরের অংশের দিকে হাঁটা লাগিয়েছিলাম। বাগানের ভেতরের অংশে বেশ কয়েকটা ছোটো ছোটো জলের ডোবামতো আছে। সেগুলো ছাড়িয়ে একটি কাঠের ছোটো প্রার্থনা ঘর। পুরো বাগানটাই ছায়াময়। কানে আসছিল কোরান পাঠ করার শব্দ। এখন কোনও নির্দিষ্ট তীর্থযাত্রার সময় নয়। প্রার্থনা ঘরে উপস্থিত ছিল কয়েকজন স্থানীয় ভ্রমণকারী আর ‘তালিব-ইলম’ —ধর্মতত্ত্বের ছাত্র।
বাগান শেষ হতে সার সার কবর আর সমাধি। আর এর ঠিক কেন্দ্রে পবিত্র মারামিয়াম (মরিয়মের সমাধি)। ইয়াকুব বেগ, যিনি বেদৌলত নামে এই অঞ্চলে অধিক পরিচিত, তিনি মারামিয়ামকে পোড়ামাটির ইট দিয়ে সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন যা খুব ভালো অবস্থায় আছে। এছাড়া অন্যান্য সমাধিগুলোর ভগ্নদশা। প্রায় ধ্বংসস্তূপই বলা চলে। অধিকাংশই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে প্রায়। হিতৈষীদের খানিক দানের জমি থেকে চাযবাস করে যা আয় হয় তা লেগে যায় দরিদ্র তীর্থযাত্রী আর দরবেশদের খাওয়াতে।
চারটে নাগাদ আমার সঙ্গে এই পর্যন্ত আসা সবার তরমুজ-টরমুজ খেয়ে প্রার্থনা সারা হয়ে গিয়েছিল। এবার আমার একা এগিয়ে যাবার পালা। যে বড়ো খালটার ধার ধরে আমরা এসেছিলাম সেই খালটার ধার ধরে খানিক এগোতেই প্রবেশ করেছিলাম খান-উইতে। এখান থেকেই বলতে গেলে মরুভূমির আভাস শুরু। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছেছিলাম মরুর আগে শেষ গ্রামের ধারে।
আমি যেখানে ক্যাম্প করব বলে আগে থেকে ঠিক করেছিলাম, সেখানে ক্যাম্প করার পরিকল্পনা বাতিল করলাম জলের অভাব শুনে। গ্রামের আশপাশটা খানিকটা জলাভূমির মতো। গ্রামের ধারে একটু উঁচুমতো জায়গায় ক্যাম্প করার প্রস্তাব পেতে তা লুফে নিয়েছিলাম। দু-পাশে পপলারের সার দেওয়া রাস্তাটা জলা থেকে বেশ উঁচুতে। আমি এগিয়ে গিয়ে জায়গাটা দেখে সেখানেই ক্যাম্প করব বলে ঠিক করেছিলাম। সন্ধে নাগাদ মালপত্র নিয়ে উটের দল পৌঁছনোর আগেই ঘন নীরবতার মাঝে আমি গাছপালার ফাঁক দিয়ে জলার জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি উপভোগ করছিলাম। মনেই হচ্ছিল না যে আছি মরুভূমির এত কাছে।
পরদিন সকালে ঘোড়ায় চেপে রওনা দিয়েছিলাম কাছের এক ধ্বংসস্তূপের উদ্দেশ্যে। ক্যাম্প থেকে পুবদিকে মাইল খানেক যাবার পর শুধু চাষবাস নয়, পুরো সবুজের চিহ্ন উধাও হয়ে গিয়েছিল। আরও মাইল দুয়েক এগোনোর পর নজরে এসেছিল পোড়ামাটির ভাঙাচোরা, কাচ আর জীর্ণ হয়ে পড়া ধাতুর টুকরোর ঢিবি। কোনও সন্দেহ নেই এখানে কোনও প্রাচীন বসতি ছিল। কিন্তু কোনও ঘরবাড়ির চিহ্ন দেখতে পেলাম না। মাটির দেওয়াল, রোদে শুকানো ইট—সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সম্ভবত এগুলো সব বালি আর হাওয়ার ঘর্ষণে ক্ষয়ে গিয়ে মরুর বুকে মিশে গেছে। এই অঞ্চলের জনগণ এই ধ্বংসস্তূপকে হাসা-তামা বলে। এটা নাকি এক ‘চাইনিজ খাকান’ অর্থাৎ চিনা সম্রাটের রাজধানী ছিল। সেই রাজধানী ‘হজরত সুলতান’ বা সাতক বঘরা খান এসে ধ্বংস করে দেয়।
দেখি খানিক উঁচুমতো জায়গায় আমার জন্য একটি সামিয়ানা খাটানো আর তার নীচে রীতিমতো দস্তরখান বসানো—তাজা খাবার ভর্তি। শুনলাম কাশগড়ের নগরপ্রধান সিয়েন কুয়ানের নির্দেশে এই আয়োজন। আমি খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রামে লিপ্ত হয়ে সময় নষ্ট করিনি। গতকাল প্রায় সারা রাস্তা পিকনিক করতে করতে আসা আমার গাইডের দল আমার এহেন আচরণে যে খানিক ক্ষুণ্ণ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই।
উঁচু জায়গাটা থেকে দক্ষিণের দিকে তাকিয়ে ধু ধু মরু দিগন্ত ছাড়া আর কিছু নজরে এল না। কিন্তু উত্তর-পূর্বদিকে বহুদূরে বেশ কিছু মাউন্ড বা ঢিবি বালির ওপরে জেগে আছে দেখতে পেলাম। সোপ নিয়াজ বাবা, বেশকারিমের সুদর্শন জ্ঞানীবৃদ্ধ লোকটি এই অঞ্চলকে ভালোভাবেই চিনতেন। তিনি এই জায়গাটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এই ঢিবিগুলো আসলে বালির আস্তরণে চাপা পড়ে থাকা প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ।
আমি সোজা পুবদিকে ঢিবিগুলোর দিকে রওনা দিলাম। মাইল তিনেক ঘোড়া দুলকি চালে ছুটিয়ে ওই ঢিবির কাছে পৌঁছে নিঃসন্দেহ হলাম, আমি আসলে বালির তলায় চাপা পড়ে থাকা বৌদ্ধ স্তূপের সন্ধান পেয়েছি। দীর্ঘকাল ধরে ধুলো আর আর বালির তলায় চাপা পড়তে পড়তে বৌদ্ধ উপাসনালয় পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। রোদে শুকনো ইটের টুকরো যা থেকে এই স্তূপ তৈরি হয়েছিল তা বেশ কয়েক জায়গায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমি দ্রুত ঢিবিটা ঘিরে প্রদক্ষিণ শুরু করলাম। মাপ নিয়ে দেখলাম এটি ২৬০ ফুট বাই ১৭০ ফুটের একটি চতুর্ভুজ। কোনও সন্দেহ রইল না যে এটি একটি বৌদ্ধমঠ ছিল।
বিস্তারিত সার্ভের কাজ সবে শুরু করেছি, এমনি সময় উত্তরের দিক থেকে ঝোড়ো বাতাস বয়ে আসতে শুরু করল। দূরে যে পাহাড়ের রেখা দেখা যাচ্ছিল, নিমেষে সেগুলো সব মরুর ধুলো আর বালির পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এমনকি খানিক দূরের ঢিবিগুলোও। কিন্তু আমার গাইডরা জায়গাটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। টোপা টিম-এর (যেই জায়গায় আমরা কাজ করছিলাম) কাজ শেষ হতেই আমার ইচ্ছেয় আমার গাইডরা আমাকে বালু ঝড়ের মধ্যে দিয়েই নিয়ে চলল। মাইল চারেক বালু ঝড়ের দাপট উপেক্ষা করে এগোনোটা মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। তবে চলার পথে একটু ঘুরে যাবার কারণে এক নদীখাতের চিহ্ন দেখতে পেলাম। প্রায় ৫০০ ফুট চওড়া নদীখাতে জলের কোনও আভাস ছিল না। কিন্তু একসময় এই নদী যে জল বয়ে আনত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই শুকনো নদীখাত প্রমাণ করে যে এখানে একসময় জীবন্ত থাকা জনবসতিতে জলের অপ্রতুলতা ছিল না। এই নদী ছিল জনবসতির প্রাণের উৎস। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এক সাম্রাজ্য। আমার গাইডরা আমাকে বলেছিল পাহাড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি হলেই তবে এই নদীখাতে এখন সামান্য জলের দেখা পাওয়া যায়।
বালির ঝাপটা খেতে খেতে ঘোড়া থেকে নামার পর সমস্ত অবসাদ নিমেষে কেটে গিয়েছিল। খানিক বালির স্তর সরাতেই দেখা পেয়েছিলাম স্তূপের। স্তূপটি একটি অসাধারণ বৌদ্ধ স্তূপের অনেকটাই অবিকৃত কাঠামো। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম উত্তর পাঞ্জাবের আফগান সীমান্তের বৌদ্ধ স্তূপের সঙ্গের সাদৃশ্য দেখে। বর্গাকার তিনতলা বিশিষ্ট ভিত্তির ওপর গোল গম্বুজ। প্রায় অক্ষত স্তূপের উচ্চতা চল্লিশ ফুটের কাছাকাছি। পাহাড়ের পাদদেশে ঢালু জমির ওপর তৈরি স্তূপটি। স্তূপের পেছনের অংশের ইটের ওপরকার পলেস্তারার আবরণ অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। এই স্তূপের ঠিক পেছনেই আর-একটি আয়তকার ঢিবি আছে। সেখান থেকে উঁকি মেরে থাকা কুলুঙ্গির অংশ বুঝিয়ে দিচ্ছিল সেগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থার কথা। এটা সম্ভবত স্তূপ সংলগ্ন মঠ ছিল। দুই কাঠামোর মধ্যে সংযুক্ত থাকা জীর্ণ হয়ে প্রায় বালিতে মিশে যাওয়া ছোটো ছোটো ঘরের ভাঙা দেওয়াল দেখতে পেলাম।
বেশকারিমের সেই বৃদ্ধ আমাকে এই অঞ্চলের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন এই স্তূপের কথা। এই অংশটিকে এই অঞ্চলের লোকেরা মাউরি টিম নামে চেনে।
সাতক বঘরা খান এসে এই শহরটি ধ্বংস করার আগে এই গম্বুজের চূড়াটি নাকি ছিল মহান চিনের রাজপ্রহরীদের ওয়াচ টাওয়ার। স্তূপটি যে প্রাক-মহম্মদ যুগের, এতে আমার খুব একটা সন্দেহ নেই। এর আকার আর অনুপাত বিচার করলে আমার মনে হয় এটি ইসলামের আগমনের কয়েক শতাব্দী আগেই তৈরি হয়েছিল। এই ধ্বংসস্তূপ মানুষের লালসার হাত থেকে রেহাই পায়নি। ধ্বংসস্তূপের পশ্চিমদিকে আমি একটি সুড়ঙ্গ খুঁজে পেয়েছিলাম। সম্ভবত সেই পথ ধরে এই মঠে রক্ষিত অনেক ধনসম্পত্তি লুণ্ঠিত হয়েছে। এই সুড়ঙ্গটি গেছে গম্বুজের মাথায়। যেখানে সাধারণত মঠের ধনভাণ্ডার ও দুর্মূল্য নথি রাখা থাকে। এর আগে সোয়াট আর বুনেরে এইধরনের মঠ পরিদর্শনকালে গম্বুজের মাথায় ধনসম্পদ ও নথি রাখার ব্যবস্থা দেখেছি। গোল গম্বুজকে ধরে রাখা তেঁতুল কাঠের খুঁটিগুলো শুকনো হাওয়া নষ্ট হয়ে যেতে দেয়নি। শত শত বছরের পুরোনো কাঠগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল সদ্য সদ্য লাগানো হয়েছে। প্রবল বালি ঝড় আর ধুলোকণা ছবি তোলা আর ঠিকঠাক মাপজোক করার অনুকূল ছিল না।
পরদিন আমরা মাউরি টিমের আট মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এস্কি নামের এক গ্রামের ভুট্টাক্ষেতের ধারে আমাদের ক্যাম্প গেড়েছিলাম। মাউরি টিম থেকে মাইল তিনেক দূরে একটা বাইশ বর্গফুটের কাদামাটির কাঠামো আমাকে চমকে দিয়েছিল। স্থানীয় লোকেরা এটাকে কাপ্তার-খানা (পায়রার ঘর) বলে। কাঠামোটার ছাদ খোলা। পুরো কাঠামোটার দেওয়াল দশ ইঞ্চি খুপরিতে ভরা। জমি থেকে প্রায় আঠারো ফুট উঁচু পর্যন্ত অজস্র খুপরি। কাঠামোর ভেতরের জমি মানুষের হাড়ে পরিপূর্ণ। স্থানীয় লোকেরা এটাকে এইভাবেই দেখে আসছেন বলেছেন। শুধু কাঠামো দেখে এর বয়সকাল নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে জনহীন প্রান্তরে এর আকৃতি আর ভেতরের দৃশ্য দেখে একে কলাম্বেরিয়াম (একটি কাঠামো যা মৃত ব্যক্তির দাহকৃত দেহাবশেষ ধারণ করে ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কলশগুলিকে শ্রদ্ধার জন্য রক্ষা করে) বলে মনে হল। কেননা বৌদ্ধ বা মহম্মদি অন্ত্যেষ্টি প্রথাতে এরকম কিছু নেই। তবে এই অদ্ভুত ধ্বংসাবশেষ নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টানদেরও হতে পারে। কেননা একসময় কাশগড়ে উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা ছিল।
সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে রাম সিংকে পাঠানো হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্বদিকে জরিপের কাজের জন্য আর আমি দলবল নিয়ে ফিরেছিলাম কাশগড়ে। এই ক’দিনের মরুপ্রান্তরে চিনাদের সৌজন্য আর সহযোগিতায় আমরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মূল মরুতে প্রবেশের আগে খানুই অঞ্চলে এই স্বল্প ক’দিনের ভ্রমণে আমাদের অভিযানের প্রস্তুতির খামতি অনেকটাই স্পষ্ট করে দিয়েছিল। দলের লোকেদের জন্য আরও খানিক পোশাক আর উটের পিঠে মালপত্র বাঁধার আরও কিছু সরঞ্জাম অবশ্যই প্রয়োজন।
উটের পিঠের জিন ঠিক না থাকায় বাক্সের খোঁচায় উটের পিঠে হালকা ক্ষত তৈরি হয়েছিল। কাশগড়ে ‘ওস্তাদ’রা আবার লেগে পড়েছিল জিনগুলো ঠিক করার জন্য। দিনরাত পরিশ্রম করে দু-দিনের মধ্যে ওস্তাদরা ভুল শুধরে প্রয়োজনীয় জিন বানিয়ে দিয়েছিল।
১০ সেপ্টেম্বর আমরা আমাদের মূল অভিযানের জন্য কাশগড় থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল খান-আরিকের দিকে। পরিকল্পনামতো রাম সিংও খানুই থেকে তার কাজ সেরে সরাসরি খান-আরিকের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। আমি একটা রাতের জন্য থেকে গিয়েছিলাম কাশগড়ে কিছু কাজ থাকায়।
১১ সেপ্টেম্বর সকালে যখন আমি কাশগড় থেকে ইয়ারকান্দ হয়ে খোটানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম, তখন আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য আর কোনও সুবিশাল শোভাযাত্রা ছিল না। ফলে সময় নষ্ট না করে আমি দ্রুত এগোতে পেরেছিলাম। আগের দিন সন্ধেতে ম্যাকার্টনিদের দেওয়া নৈশভোজে কিছু ইউরোপিয়ানদের সমাবেশ হয়েছিল আমার অভিযানের সাফল্য কামনা করে। আমাকে বিদায় জানানোর কোনও সমাবেশ যে হয়নি তা নয়। কাশগড়ে যাদের অদম্য সহযোগিতা প্রতি পদে পেয়েছিলাম, তারা প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। মি. ম্যাকার্টনি নিজে আমাকে শহরের বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।
ইয়ারকান্দ-এর দিকে যাবার জন্য আমি পরিচিত ক্যারাভান রুট না ধরে তার পূর্বদিকের একটা পথ ধরেছিলাম। এই পথে মরুভূমির ভেতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে ইয়ারকান্দ পৌঁছানো যায়। আমার দলকে এই পথ ধরেই এগিয়ে যেতে বলেছিলাম। এই পথ ধরার আরও একটা কারণ ছিল। এই পথ গেছে বিখ্যাত তীর্থস্থান ওরদম-পাদশাহ-এর পাশ দিয়ে। এর আগে স্যার ডগলাস ফোরসিথের মিশনের সদস্যরা এবং ডক্টর সোভেন হেডিন পরিদর্শন করেছিলেন ওরদম-পাদশাহ। কিন্তু কেউই এই তীর্থস্থানের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করেননি। ফলে আমার সামনে সুযোগ ছিল এই অঞ্চলের টপোগ্রাফি নিয়ে খানিক কাজ করার। তাছাড়া দীর্ঘ মরু-ভ্রমণের আগে এই সংক্ষিপ্ত পথে যাত্রা নিজেদের তৈরি করে নেবার জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল।
প্রথম কয়েক মাইল রাস্তা ‘নিউ সিটি’ যাবার পথ ধরে এগোতে হয়েছিল। ব্যস্ত বাজারের ভেতর দিয়ে চিনা সৈন্য ঘাঁটির পাশ দিয়ে খানিক এগিয়ে জেলার চিনা আধিকারিকের মনোনীত এক পথপ্রদর্শক আমাকে নিয়ে তুলেছিল গ্রামের গলিতে। ধুলো আর রাস্তার কোলাহল থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। এই পথ ছিল পপলার আর উইলো গাছের ছায়া-ঢাকা।
কাশগড় থেকে মাইল বারো পথ পার হয়ে এসে পৌঁছেছিলাম ইয়োনডুমাতে। এখানে তাসমালিক থেকে প্রবাহিত হয়ে আসা একটি নদী ইয়ামানিয়ার অতিক্রম করতে হয়েছিল। নদী পার হয়ে ভুট্টাক্ষেতের মাঝ দিয়ে একটা চওড়া পথ ধরে আমরা এগিয়েছিলাম। ছোটো ছোটো সেচ-খাল দিয়ে জল চলে গেছে ক্ষেতের ভেতরে। বিস্তৃত চারণভূমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দাঙ্গালচি গ্রামের একটা ছায়াময় বাগানে খানিক বিশ্রাম নিয়ে প্রায় আটাশ মাইল পথ ঘোড়ার পিঠে চেপে পৌঁছেছিলাম খানারিকে।
খানারিকের বাজারে পৌঁছে জানতে পারলাম এটা খানরিকের পাঁচটা বাজার গ্রামের একটা। এই বাজার তথা গ্রামটার নাম সোমবারের বাজার। আর আমার দল যেখানে গিয়ে তাঁবু ফেলেছে সেটার নাম ‘রবিবারের বাজার—ইয়াক-শাম্বা’, এখান থেকে আরও দশ মাইল পূর্বে। প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘ যাত্রার পর এ-কথা শুনে খানিক বিরক্তি লেগেছিল। কিন্তু কোনও উপায় নেই, আবার ঘোড়ায় চেপে বসেছিলাম। সন্ধে ছ’টা নাগাদ উঁচু-নীচু পথ পার হয়ে ইয়াক-শাম্বা গ্রামের কাছে পৌঁছে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সুন্দর পোশাকের সুঠাম চেহারার কিছু মানুষকে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
এরা ছিল খানারিকের হিন্দু বাসিন্দা। আদতে পাঞ্জাবের শিকারপুরের লোক। এখানে মহাজনি কারবার করে। ‘সাহেব’-কে স্বাগত জানাতে গ্রামের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। জন্মভূমি থেকে বহুদূরে প্রত্যন্ত গ্রামে এই জনগোষ্ঠীর দেখা পাব আশা করিনি। যদিও মধ্য এশিয়ায় সঙ্গে শিকারপুরের ব্যাবসায়িক যোগাযোগ বহু প্রাচীন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরস্টার এই জনগোষ্ঠীকে সমরখন্দ ও কাস্পিয়ানে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী-রূপে দেখা পান। গত ত্রিশ বছরে বাণিজ্যের টানে ভারতীয় ব্যাবসাকে এরা পূর্ব তুর্কিস্তানে প্রসারিত করেছে। যে আমাকে ইয়াক-শাম্বা গ্রামে সাদর সম্ভাষণ করেছিল, তার কাছ থেকেই শুনেছিলাম, এই গ্রামে শিকারপুরের লোকের সংখ্যা আঠারো। একটা গ্রামে এতজন সুদে টাকা খাটানোর ভারতীয় হিন্দু ব্যবসায়ীর উপস্থিতিতে আমি অবাক হয়েছিলাম। শুধুমাত্র চাষিদের ঋণ দিয়েই টিকে আছে এরা এবং গত আট বছরে বসতি গেড়ে যথেষ্ট সচ্ছল হয়েছে।
যে বেগের বাগানে আমাদের ক্যাম্প করা হয়েছিল সেটি আকারে বিশাল ও নির্জন। সারাদিনের দীর্ঘ যাত্রার পর বিশ্রাম নেবার জন্য আদর্শ। হিন্দুরা তাদের দেশিয় রীতি অনুসারে ডালাভরা ফল আর মিষ্টি হাজির করেছিল। যতক্ষণ না আমি নিজের হাতে তুলে কিছু খাচ্ছিলাম আর আমার লোকদের মধ্যে বিতরণ করছিলাম ততক্ষণ হিন্দু মহাজনরা কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তাই আমি ডালি থেকে বাদাম আর বেদানার দানা তুলে মুখে দিয়ে আমার লোকেদের তরমুজ, ফল আর মিষ্টি বিতরণ করেছিলাম।
পরমানন্দ এই ব্যবসায়ীদের গিল্ডের মুখপাত্র, সুদূর আকসু থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল কিছু অনাদায়ী ঋণের বিষয়ে দেখভাল করতে। পরমানন্দ আকসুর এক ধনী মহাজন। সে আমায় আগাম বলে দিল যে আকসুতে আমার চেকগুলো ভাঙিয়ে টাকা পেতে কোনও অসুবিধা হবে না। খানিক হাঁফ ছেড়েছিলাম।
পরেরদিন সকালে খানারিকের শেষ গ্রাম আচিক পার হয়ে দক্ষিণদিকে যাত্রা শুরু করলাম ওরদম-পাদশাহ-এর দিকে। দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। বারো মাইলের মতো। কিন্তু পথের মাঝে এক গভীর নদীখাত আমাদের উটগুলোর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াল। ইয়ামানিয়ারের ওপরকার শীর্ণ জরাজীর্ণ সেতুটি দিয়ে কোনোক্রমে ঘোড়াগুলোকে পার করানো গেলেও, উটদের পার করা সম্ভব ছিল না। নদীতীরের উইলো গাছের ছায়ায় আমাদের উটগুলোর পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকতে হল। উটগুলো পৌঁছানোর পর ওদের পিঠ থেকে মালের বাক্সগুলো খুলে নদীর ও-পাড়ে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল। মাইল খানেক নদীর ধার ধরে এগিয়ে একটা জায়গা পাওয়া গিয়েছিল যেখানে নদীর পাড়ের ঢাল খুব একটা খাড়া নয়। অন্তত উটগুলোকে নিরাপদে জলের ধারে নামিয়ে আনা যাবে। কিন্তু উটকে জলে নামানো খুব কঠিন কাজ। একবার জলে নামানোর পর দেখলাম, আমি যেরকম ভাবছিলাম তার থেকেও ভালো সাঁতার কাটতে পারে জন্তুগুলো। স্থানীয় দুই গ্রামবাসী সাঁতরে উটগুলোকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে নদীর অন্য পাড়ে তুলেছিল। এই উটগুলো কিনতে আমাকে সাতশো টাকা খরচ করতে হয়েছিল। ওদের নিরাপদে পার হতে দেখে খানিক স্বস্তি পেয়েছিলাম। প্রায় ঘণ্টা তিনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল নদী পার হয়ে উটের পিঠে আবার মালপত্র চাপিয়ে রওনা হতে।
কমে আসা আবাদ আর বেড়ে চলা অনুর্বর জমির পরিমাণ বলে দিচ্ছিল যে আমরা মরু প্রান্তরের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। আচিক গ্রামে পৌঁছে দেখলাম এটা একটি খুব সুন্দর সাজানো গ্রাম। ইজবাশি অর্থাৎ গ্রাম-প্রধান আমার থাকার জন্য তাঁর বাড়িটি প্রস্তুত রেখেছিলেন। দেওয়াল সদ্য সদ্য প্লাস্টার করে রঙ করা হয়েছে। মেঝেতে পুরু খোটান থেকে আনানো চামড়ার কার্পেট। কিন্তু ঘরে আলো-বাতাস খুব একটা খেলছিল না। তাই আমি পাশের সদ্য ফসল কেটে তোলা জমিতে আমার ছোটো তাঁবুটা খাটিয়ে থাকতে মনস্থ করলাম। হাওয়ায় দুলতে থাকা পপলার, তুঁত, ক্ষেতের গম আর ভুট্টা আমাকে হাঙ্গেরির আলফোল্ডের গ্রামের দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছিল। পুরোনো স্মৃতি মনে আসাতে আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল।
আচিকেই আমি একটি ধ্বংসস্তূপের কথা শুনলাম। জায়গাটার নাম বাইখান। স্থানীয় লোকেরা জায়গাটাকে ‘কোনে-শার’ বলে। জায়গাটা মরুর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। জায়গাটা কতদূর তার সঠিক তথ্য দিতে পারল না স্থানীয়রা, কিন্তু এটা বলেছিল, ওই জায়গাটা ঘুরে একদিনেই ওরদম-পাদশাহে পৌঁছানো যাবে। স্বল্প সময়ের জন্য একবার দেখে যাবার ইচ্ছে হল। শুনলাম কোনও ঘরবাড়ি জাতীয় কিছু নেই, খানিক ইটের টুকরো আর মাটির ভাঙা পাত্রের স্তূপ। আমার দলবলকে এক গাইডকে নিয়ে রওনা হয়ে যেতে নির্দেশ দিলাম সোজা মরুতীর্থ ওরদম-পাদশাহের দিকে। আমি আর রাম সিং এক গাইডকে নিয়ে চললাম কোনে-শার দিকে, ওখান থেকে আমরা ওরদম-পাদশাহ চলে যাব।
আচিক গ্রামের আবাদের সীমানা ছাড়াতেই আমরা প্রবেশ করলাম বালির সমভূমিতে। ছোটো ছোটো ঝোপ আর বালির সাম্রাজ্যের শুরু। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মাইল চারেক এগিয়ে খুরুজ নামের ছোট্ট একটি গ্রামে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত কোনও মানুষজন বা পশুপাখির দেখা পাইনি। একটি খুদে জলের ধারাকে ঘিরে গোটা কয়েক কুঁড়েঘর বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে। সামান্য চাষ হয়েছে ওই জলের উৎসকে ঘিরে। গ্রামের লোকেরা মূলত পশু চারণদার। এক-একটি গাছ এখানে এক-একটি স্বতন্ত্র ল্যান্ডমার্ক বা দিকনির্দেশক। প্লেন টেবিল নিয়ে জরিপের কাজ করতে করতে যেতে তাই আমাদের কোনও জটিলতায় যেতে হচ্ছিল না।
দুপুর নাগাদ, যখন তাপ দুঃসহ তখন আমরা পৌঁছেছিলাম বেখতৌরুতে। একটি নালার ধারে খানিক জলাশয়কে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি গ্রাম। গ্রামে কিছু দেখার ছিল না। শুধু তাই নয়, এখান থেকে বাইখানের দূরত্ব সম্পর্কেও পরিষ্কার কিছু আঁচ মিলল না। পথের হদিসও সেরকম কিছু পাওয়া গেল না, তাই আমি ওই ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শনের পরিকল্পনা সরিয়ে ওরদম-পাদশাহের দিকে এগিয়ে যাওয়াই স্থির করেছিলাম।
এখান থেকে এক মেষপালককে গাইড হিসেবে নিয়ে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে একের পর এক সাদা বালির ঢিবি পার হয়ে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আসল মরুতে প্রবেশ করেছিলাম। ছোটো ছোটো গাছের ঝোপগুলোও উধাও হয়ে গেছে। খানিক পরপর কুশ জাতীয় শক্ত ঘাসের গোছা চকচকে বালির বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। দূর পর্যন্ত দেখার জন্য আমরা মাঝে-মাঝেই উঁচু বালির পাহাড়ের মাথায় চড়ছিলাম। দক্ষিণে যতদূর পর্যন্ত নজর যায় শুধু বালির ঢেউ এগিয়ে গেছে। উড়তে থাকা বালির ধুলোকণার মধ্যে দিয়ে সুদূর দক্ষিণ-পশ্চিমে খানিক কালচে পাহাড়শ্রেণির আভাস দেখা গিয়েছিল। দ্রুত চলার তাগিদে ম্যাপ তৈরির কাজ আমরা করতে পারিনি। খানিক পর এক-একটা বড়ো নিশানা বালির বুকে উঁচু হয়ে থাকতে দেখা যেতে শুরু করেছিল। সেই নিশানা ধরে আমরা এগোতে শুরু করেছিলাম ওরদম-পাদশাহের দিকে। গাইড জানিয়েছিল, এই চিহ্ন ধরেই সহজে পৌঁছানো যায় দোস্ত-বুলাক, সুলতানিম এবং কিজিল-জাইমে-এর মাজারে।
গাইডের পিছুপিছু দক্ষিণদিকে এগোচ্ছিলাম যতক্ষণ না তীর্থযাত্রার প্রচলিত পথে পৌঁছাই। অবশেষে দেখা মিলেছিল এ-পথের এক বিশ্রামাগার উফতু ল্যাঙ্গার-এর। কেউ ছিল না সেখানে। ভেবেছিলাম আমাদের আগেই আমাদের দলবল যাদের অন্য পথে এখানে আসতে বলা হয়েছিল তারা পৌঁছে যাবে। উৎকণ্ঠায় বার বার মরুপথের দিকে তাকাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ প্রতীক্ষার পর উত্তরের এক বালু-পাহাড়ের পেছন থেকে একে একে বেরিয়ে আসছিল আমাদের ক্যারাভান। হাঁফ ছেড়েছিলাম। অনেক দেরি হয়ে গেলেও গোধূলির আলোয় আবার রওনা দিয়েছিলাম আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
সামনে যে বালির পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল সেগুলোর উচ্চতা যথেষ্ট। টপকাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। পড়ন্ত আলোয় সামনের ঢেউয়ের মতো বালি পাহাড়ের ঢল নজরে আসছিল শুধু। বাতাসে শুকনো সাদা বালির উড়ে বেড়ানো দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। হাওয়ার দাপটে শুকনো একদিকে থেকে বালি—বালিয়াড়ির গা থেকে সরসর করে খসে পড়ছিল, আর অন্যদিক থেকে উড়ন্ত বালি এসে চেপে বসছিল বালি পাহাড়ের গায়ে। বালি যেন চলেফিরে বেড়াচ্ছে এখানে। এই অঞ্চলের বালির দানা সাদা, মোটা আর লবণযুক্ত। ঘোড়াদের (পনি) পা আলগা বালির মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল; তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট উঁচু বালির চড়াই ভাঙতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। চলমান বালির অঞ্চলে মাইল পাঁচেক এগোনোর পর টের পেয়েছিলাম আমরা এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার পর আমাদের অভীষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। টিলাগুলোর মাঝে এক প্রশস্ত উপত্যকা। উত্তরদিকে বালি সাম্রাজ্যের মাঝে খানিক গাছের ঝাড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সামনে পৌঁছতে পপলার গাছগুলো স্পষ্ট হয়ে গেল। কাঠের আচ্ছাদনের তলায় পপলার গাছগুলো যত্নে রক্ষিত একটি নোনা জলের কুয়োর কাছে। কুয়োর জল ভূমিপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ফুট ছয়েক নীচে।
ওখানে যখন পৌঁছেছিলাম তখন রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল। কুয়োর জলের স্বাদ এত বিস্বাদ আর সঙ্গের বিশ্রামাগারের অবস্থা এত খারাপ যে খুব ক্লান্ত হলেও আমি ওখান থেকে আরও এগিয়ে মরু-মাঝের ওরদম-পাদশাহের মূল ক্ষেত্রের কাছে পৌঁছতে মনস্থ করেছিলাম। আধমাইলমতো পথ যাবার পর কতকগুলো কুঁড়ে আর সরাইখানার দেখা পেয়েছিলাম। আমাদের দেখে এক স্থানীয় তত্ত্বাবধায়ক মুজাভির এগিয়ে এসেছিলেন। আমাদের জন্য তীর্থযাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট কুঁড়েগুলো পরিষ্কার করে রাখা হয়েছিল। আমাদের ঘোড়াগুলোর জন্য ঘাস আর জলও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এই কুঁড়েগুলো কাছে জমে থাকা আবর্জনা থেকে এমন দুর্গন্ধ আসছিল যে আমি অস্বস্তি বোধ করছিলাম। কুঁড়েগুলো থেকে খানিক দূরে একটা জায়গা খুঁজে পেলাম যেখানে অনায়াসে আমার তাঁবু খাটাতে পারি। আমি কুঁড়ের পরিবর্তে তাঁবু খাটিয়ে থাকতেই সাব্যস্ত করেছিলাম। উটের পিঠে মালপত্র চাপানো আমাদের ক্যারাভান যখন পৌঁছেছিল তখন আটটা বেজে গেছে। ততক্ষণে মরুভূমির ঠান্ডা হাওয়ায় আমার ক্লান্তি অনেকটাই চলে গিয়েছিল। রাতের খাবার প্রস্তুত হবার পর খেয়েদেয়ে শেষ পর্যন্ত যখন তাঁবুতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম তখন ক্লান্তি একদম চলে গিয়েছিল। মনেই হয়নি এটাই ছিল মরুভূমিতে আমাদের প্রথম যাত্রার দিন।
ওরদম-পাদশাহ ছাড়িয়ে
পরদিন ভোরের আলোয় চারপাশটা ভালো করে দেখতে পেলাম। আমার তাঁবুর চতুর্দিকে খালি বালি আর বালি। উঁচু-নীচু বালির টিলার মাঝে খানিক সমতলের মাঝে তাঁবুটা লাগিয়েছিলাম। আশেপাশের মাটির জীর্ণ কুঁড়ে আর সরাইগুলো সব বালিময়, ফ্যাকাশে, বর্ণহীন। এমনকি সূর্যের আলোকেও মনে হচ্ছে যেন আশেপাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধূসর। আমার খুব মজা লাগছিল আমার খাকি তাঁবু আর জামাকাপড় অদ্ভুতভাবে আশেপাশের রঙের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল বলে। মসজিদের খানিক পেছনে একটা ফুট পঁয়ত্রিশ উঁচু বালির পাহাড়। মনে হচ্ছিল যে-কোনো সময় ওই পাহাড়ের বালি উড়ে এসে মসজিদকে গ্রাস করে নেবে। ওই বালি-টিলার মাথা আমাদের প্লেন-টেবিল নিয়ে কাজ করার জন্য আদর্শ ছিল। উঁচু টিলার মাথা থেকে উত্তরের দিকে একের পর এক তীর্থযাত্রীদের জন্য তৈরি লঙ্গর আর উপাসনালয়গুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ফলে ম্যাপে এদের সঠিক অবস্থান বসাতে কোনও বেগ পেতে হচ্ছিল না। আগে তৈরি এখানকার যা মানচিত্র হাতে এসেছিল তাতে এই ওরদম-পাদশাহের যে অবস্থান দেখানো হয়েছে তা এর প্রকৃত অবস্থানের থেকে আধ ডিগ্রি বেশি দ্রাঘিমাংশে ছিল।
স্থানীয় এক মুজাভির আমার সঙ্গে সঙ্গে বালি-পাহাড়ের মাথায় গিয়েছিল। সেখানে বসে সে আমাকে শুনিয়েছিল এখানে সুলতান আরসলান বোঘরা আর তাঁর অনুগামীদের মুসলিম বিরোধী বৌদ্ধদের সঙ্গে লড়াইয়ে মারা যাওয়া আর অলৌকিক শক্তিতে ভর করে প্রতিটি মৃতদেহের মাথা মক্কার দিকে ঘুরে থাকার কথা। শুনিয়েছিল কাফেরদের মৃতদেহ বালিতে চাপা পড়ে যাওয়ার কাহিনি। এখান থেকে আধমাইলমতো পশ্চিমে পপলারের খুঁটি ঘিরে রাখা খানিক জায়গা সুলতান আরসলান বোঘরার কবর বলে কথিত। তীর্থযাত্রীরা ওই জায়গায় রঙিন কাপড়ের টুকরো ও চাদর চড়িয়ে যান শ্রদ্ধা জানাতে। সেখান থেকে আধমাইলমতো দূরে আসল মাজার। দেখভাল করার জন্য বেশ কয়েকজন আছেন। যাঁরা এখানে থাকেন তাঁরা সবাই নিজেদেরকে সুলতানের বংশধর বলে দাবি করেন। সামান্য সমতল জমিকে ঘিরে নীচু মাটির দেওয়াল। সেখান থেকে বেশ কয়েকটা বালির পাহাড়ের শেষে পশ্চিমের দিকে কিছু মাটির বাড়ির অংশ দেখা যাচ্ছিল। ওগুলো এখানকার প্রাচীন বসতির চিহ্ন। এই বাড়িগুলো বালি-চাপা পড়ে গিয়েছিল একসময়, আবার হাওয়ার ধাক্কায় বালি সরে যাওয়াতে বেরিয়ে এসেছে। বর্তমান থাকার জায়গাগুলোরও একই হাল হতে পারে। চাপা পড়ে যেতে পারে বালির তলায়। এখানে বালির অপসরণ হয়েই চলেছে সর্বক্ষণ।
স্থান মাহাত্ম্য নিশ্চয় আছে, আছে তীর্থস্থানের পবিত্রতার প্রতি অনুরাগ, তা সত্ত্বেও আমার দলের লোকেরা দ্রুত রওনা হবার জন্য ব্যাকুল ছিল। তাই আমি এখানে খানিক সময় থাকলেও আমার লোকজন খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েছিল। আমি ওরদম-পাদশাহ থেকে যাত্রা শুরু করার আগেই ওরা অনেক পথ এগিয়ে গিয়েছিল। ইয়ারকান্দ যাওয়ার পথটি মরুভূমির প্রান্তের আর-একটি পবিত্র স্থান হযরত বেগিম হয়ে গেছে। এই পথ আগের দিনের থেকেও ভয়াবহ। বালির পাহাড়গুলো প্রায় একের সঙ্গে আর-একটা লেগে ছিল। ফলে মধ্যবর্তী শক্তপোক্ত পথ ছিলই না বলতে গেলে। হাওয়ার দাপটে বালি একদিক থেকে যেমন ঝরে চলছে, পাহাড়গুলো থেকে তেমনি আবার এসে জমা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমার প্রিয় পোষ্য ছোটো কুকুরটি উটের পিঠে একটা ঝুড়িতে চেপে চলছিল। উটের পিঠের দুলুনিতে বেচারা এতই অস্বস্তিবোধ করছিল যে ওকে ঝুড়ি থেকে বের করে বালির বুকে নামিয়ে দিয়েছিলাম হেঁটে যাবার জন্য। কিন্তু বালি এত তেতে ছিল যে মাইল চারেক যাবার পর ইওলিচ বেগকে আবার উটের পিঠে ওর ঝুড়িতে তুলে দিয়েছিলাম। ঝুড়ির মাথায় একটা ছোটো গর্ত ছিল যেখান দিয়ে মাথা বের করে ও চারপাশ দিব্যি দেখতে পারত, কিন্তু কেউ ঝুড়ি না খুলে দিলে ও বেরিয়ে আসতে পারত না।
আমরা যতই দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে এগোতে লাগলাম ততই আরও উঁচু উঁচু বালি পাহাড় আসতে লাগল। বালিতে হাঁটা খুবই কষ্টকর। মানুষ বা জন্তু সবার জন্যই। খানিক বাদে পায়ের তলায় শক্ত মাটি আর পাথরের ছোঁয়া পেতে শুরু করেছিলাম। চলাটা সহজ হয়ে গিয়েছিল অনেক। আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম এক পাহাড়ি অঞ্চলে। দূর থেকে আবছায়ায় যে পাহাড়গুলোকে অনেক উঁচু মনে হয়েছিল, কাছে পৌঁছে দেখলাম বালির বুক থেকে পাহাড়ের উচ্চতা শ-তিনেক ফুট মতো। পাহাড়ের ঢাল আর আলগা পাথরের গায়ের অজস্র ক্ষয়ের চিহ্ন বুঝিয়ে দিচ্ছিল এখানকার বাতাস আর বালির তেজ।
তীর্থযাত্রীদের জন্য কোনও পথনির্দেশ না থাকলেও চূড়ার খানিক আগে থেকেই পথটি সুচারু-রূপে পরিষ্কার করা। যেন কেউ ঝাড়ু দিয়ে গেছে খানিক আগে। পাহাড়ের মাথায় পৌঁছতেই দেখলাম সার সার পতাকা উড়ছে। এটা দিকনির্দেশের চিহ্ন। এই জায়গাটার নাম উলুগ-নিশান; উঁচু নিশান। কথিত, এখানেই আরসলান পাদশাহ তাঁর গুরুকে উদ্দেশ করে শেষ প্রার্থনা করেছিলেন। হযরত বেগিমে রয়েছে সেই আরসলান পাদশাহের গুরুর সমাধি। হযরত বেগিম ওখান থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। উলটোদিকের পাহাড়ের ঢাল বেশ খাড়া থাকায় বালির আধিক্য খুব কম ছিল। ফলে আমরা দ্রুত এগোতে পেরেছিলাম।
হযরত বেগিমে এমন কিছু আকর্ষণ নেই যে সেখানে তীর্থযাত্রীরা অনেক সময় কাটাবেন। দরবেশের সমাধির কাছে কয়েকটা ভাঙাচোরা মাটির ঘর যেখানে মুজাভিররা থাকেন। ঘরগুলোর পাশে খানিক হাড় আর আবর্জনার স্তূপ। উটগুলো গভীর বালি-পথে মাইল দশেক হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কিজিল এখান থেকে বেশ দূরে। তাই এখানেই রাত কাটাতে মনস্থ করেছিলাম আমরা। মাজারের পাশে যেখানে আমার তাঁবুটা খাটালাম, সেই জায়গাটা দেখে আমার মনে হিয়েছিল এটা কোনও প্রাচীন গোরস্থান। কাছের কুয়োর জল যেমনি বিস্বাদ তেমনি নোনা। জলকে ফিল্টার করেও তাতে স্বাদ ফেরাতে পারিনি।
১৫ সেপ্টেম্বর সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হল সমতল জুড়ে। খানিক এগোতেই আমরা গিয়ে পড়লাম ‘দশত’-এ—শক্ত মাটি, ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় পরিপূর্ণ অঞ্চলে। মাইল চারেক যাওয়ার পর আমরা পৌঁছেছিলাম সাদুক-লাঙ্গারে। মরুভূমির মাঝে এক মরূদ্যান। একটা নালা বেয়ে আসা জলাশয়কে ঘিরে গড়ে ওটা খানিক সবুজের সমারোহ। তীর্থযাত্রীদের জন্য এটি একটি ওয়াকফ বা দান। আমাদের ঘোড়াগুলোকে পাশের লুসার্ন ক্ষেতে ছেড়ে দিলাম খানিক চরে বেড়াবার জন্য।
দুটো নাগাদ আমরা পৌঁছেছিলাম কিজিলে। কাশগড় ইয়ারকান্দ সংযোগকারী মূল রাস্তার ধারে এটি একটি বড়ো গ্রাম। ধূসর মরুভূমিতে কয়েকদিন কাটানোর পর বাগানের পর বাগান আর সবুজ মাঠ চোখ আর মনকে ভরিয়ে দিয়েছিল। আমার চাকরবাকরেরা সোজা ছুটেছিল কিজিলের চাইনিজ সরাইখানায়। কিন্তু আমি ওদের সরাইখানায় যেতে মানা করাতে ওরা খানিক অবাক হয়ে গিয়েছিল। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর, ক্যারাভানের ঘোড়া, উট, গাধা আর গাড়িতে বোঝাই জায়গাটা। লোকজনে থিকথিক করছে। সাদাক আখুন খানিক গম্ভীরভাবে বলেছিল, কাশগড় থেকে আসা সাহেবরা সবসময় এখানেই থামে। কিন্তু আমি এসেছি হিন্দুস্থান থেকে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জানি যেখানে সবাই থাকে সেই জায়গাটা সবসময় মোটেই সুখপ্রদ হয় না। কাজেই আমি একটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলাম। খানিক সময়ের মধ্যে যা খুঁজছিলাম তা পেয়েও গিয়েছিলাম। চারপাশে খোলা সবুজ মাঠের মাঝে একখণ্ড বাগান! আমাদের তাঁবুর খাটানোর জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল বাগানটাতে। বাগানের মালিক আমাদের সসম্মানে নিয়ে গেল কাছেই ওর বাড়িতে। ঝুড়িভরা আঙুর আর পিচ ফল এগিয়ে দিল আমাদের খাওয়ার জন্য। মরুভূমিতে প্রথম সফর শেষে এ ছিল আমাদের জন্য এক অসাধারণ ভোজন।
পরের দিন ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে শুকনো জমির ওপর দিয়ে আমাদের চলা শুরু হয়েছিল। আমাদের গন্তব্য কোক-রোবাতে। এটি ইয়ারকান্দ মরূদ্যানের পশ্চিম সীমান্ত। প্রায় চব্বিশ মাইল রাস্তায় না ছিল কোনও গাছ, না ঝোপঝাড়। ধূসর ঊষর নুড়িভরা প্রান্তর। যে রাস্তা ধরে আমরা এগিয়েছিলাম, সেটি ছিল ডাক যাবার রাস্তা। খানিক বাদে বাদে রাস্তার ধারে মাটির মাইল ফলক ছিল। প্রতি ‘পোটাই’ পরপর একটা করে ফলক ছিল। চায়নার মাপ—এক পোটাই সমান দশ ‘লি’। এক পোটাই মানে ইংলিশ দু-মাইলের থেকে সামান্য কম দূরত্ব। এই ‘লি’ পরিমাপক এখনও তুর্কিস্থানে ব্যবহার করা হয়। হিউয়েন সাং ও অন্যান্য চাইনিজ পরিব্রাজকরা তাঁদের ভারতযাত্রার রেকর্ডে দূরত্বের পরিমাপ ‘লি’-তেই বর্ণনা করেছিলেন। এই পরিমাপক আরও একটি প্রমাণ যে তাঁরা এই পথেই ভারতে গিয়েছিলেন। দুপুরে উটের দলের পৌঁছনোর অপেক্ষায় আক-রোবাটে (হোয়াইট স্টেশন) বলে এক জায়গায় থেমেছিলাম খানিক। ঊষর প্রান্তরে এক নির্জন সরাই। সরাইয়ের চৌহদ্দিতে মাটির পাঁচিল ঘেরা একটি ছোটো বিশ্রামাগার ছিল। ভীষণ পরিষ্কার। এটি শুধুমাত্র চিনা উচ্চপদস্থ আধিকারিক আর উচ্চশ্রেণির ভ্রমণকারীদের জন্য উদ্দিষ্ট। আমি ছাউনি দেওয়া বারান্দায় গিয়ে খানিক বসলাম।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম খানিক সবুজের মাঝে। জায়গাটার নাম কোকরোবাট (গ্রিন স্টেশন)। এখানে পর্যাপ্ত জল পাওয়া যায় পশ্চিমের বহুদূরে হালকা দেখা যায় এমন এক পাহাড়শ্রেণি থেকে আসা এক জলস্রোত বেয়ে। এই জলস্রোত এই জায়গাটাকে উর্বর করেছে। গ্রামের ভেতরকার সোজা রাস্তা ধরে মাইল খানেক জায়গা যাবার পর গাছে ছাওয়া খানিক উঁচু জায়গা পেলাম। তাঁবু খাটানোর জন্য একদম আদর্শ। অন্য জায়গা খোঁজার কথা আর ভাবিনি। কিন্তু জায়গাটা ছিল খানিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আর তার ভেতরে ঢোকার কোনও দরজা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখনই জমির মালিক এসে উপস্থিত হল। রোদে শুকনো ইটের ওপর ইট সাজিয়ে তৈরি পাঁচিলের এক জায়গার ইট ঝটাপট হাত দিয়ে সরিয়ে আমাকে ভেতরে ঢোকবার পথ করে দিল। ফাঁকা জায়গাটা ঘিরে আখরোট আর অন্যান্য ফল গাছের ঝাড়। ঝরে পড়া হলুদ পাতায় আশপাশটা কার্পেট বিছানোর মতো লাগছিল। আমার চাকরদের তাঁবুর জন্য সে তার তরমুজ ক্ষেতের পাশটা দেখিয়ে দিয়েছিল।
ক্রমশ