আগের পর্বগুলো
পিয়ালী চক্রবর্তী
ধুলোময় রাস্তায়
ছাগলের ব্যাপারে অনেক কিছু প্রচলিত আছে। কিন্তু পশুটা বাকিদের থেকে অনেক কম ইঙ্গিতপূর্ণ। ওদের স্বেচ্ছাচারিতা আর পাশ কাটিয়ে যাওয়া দেখে অনেকে বলে, ‘কিছুতেই কিছু এসে যায় না তো? যাও, ছাগল কিনে আন।’
সাধক মানুষদের লোভকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয় –
ভগবান ছাগল বোধহয় সাধু ছিল
তার শিষ্য ছিল তুলোর গাছ
তাই তাকে ঠুকরে খেল আজ
এক মসজিদে এক দাড়িওয়ালা মৌলবির অনেকটা ছাগলের মতো ধারালো দাঁত ছিল। ‘তুমি আমার সাথে কথোপকথনে প্রভাবিত হয়েছ। আমি বিশ্বাস করি এটা তোমার ভালো করবে।’ মৌলবি বলছিল। গ্রামের লোকটি বলল, ‘ঠিক বলেছেন। আমি তো প্রায় কেঁদে ফেলছিলাম যখন আপনি বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আপনার দাড়ি দোলাতে দোলাতে কথা বলছিলেন। একদম আমাদের বুড়ো পাঁঠাটার মতো লাগছিল।’ এটা একটা ইউরোপিয়ান গল্পও বটে। গ্রামের লোক ‘খুব কান্না আর অল্প উল’ বলতে বোঝায় যে ‘একটা ছাগল সারারাত ক্ষীণ স্বরে ব্যা ব্যা করে শেষে একটাই বাচ্চার জন্ম দেয়’ – দুটো যেখানে হওয়ার কথা।
লোককথায় বলা হয় যে দুগ্ধবতী ছাগল যখন শুকনো স্তন নিয়ে বাড়ি ফেরে, তখন সবাই সেই জায়গা খুঁজে বেড়ায় যেখানে সে তার দুধ ফেলে এসেছে। পরে নাকি সেখানেই ভগবানের পীঠস্থান বানানো হয়। আবার ছাগলরা নাকি সেইসব গুহার রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে রহস্যময় বা আশ্চর্য কিছু ক্ষমতা বা আত্মা থাকে। মরুভূমিতে নাকি আগে যেসব জায়গায় কুয়ো ছিল, এখন বুজে গেছে, যা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় না, ছাগল নাকি সেটা ঠিক বুঝতে পারে আর ঐসব জায়গাতে তারা গোল হয়ে বসে বিশ্রাম নেয়। হয়তো ওরা যে স্থির হয়ে বসে সবাই একসাথে বিশ্রাম নেয়, তার থেকেই হয়তো এই ধারণাটা এসেছে। এদের শিংজোড়া আর ঘোড়ার মতন অমন সুন্দর দেহভঙ্গিমা নিয়ে কিন্তু কেউ কোনও কথা বলে না। ভারতীয় ছাগল, ইউরোপের ছাগলদের থেকে অনেক লম্বা এবং মজবুত গঠনের হয়।
প্রশাসনিক আর আর্থিক দিক দিয়ে দেখলে ছাগলের ব্যাপারে প্রচুর অভিযোগ আছে, আর যেটা সবচেয়ে বেশি বন দফতরের কাছ থেকে আসে। এরা গরিব লোকের পোষ্য আর এদের প্রায় নিখরচায় পালন করা সম্ভব। কিন্তু একটাও সবুজ পাতা বা চারা মিটি থেকে মাথা তুলেছে কি ছাগলে তা মুড়িয়ে দেবে। এমনকি একটু লম্বা গাছেদেরও ছাড়ান নেই। এরা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে প্রায় মানুষের মাথার সমান দাঁড়াতে পারে, আর ওভাবেই অনেক কিছু চিবিয়ে খেয়ে নেয়। লম্বা জমি যেখানে শস্য ফলানো সম্ভব বা যেসব রাজ্যে সংরক্ষিত বনজঙ্গল আছে, সবকিছুই প্রায় ধ্বংস হতে বসেছে। এরা কিছু ক্ষেত্রে বেশ বিপদ ডেকে আনছে। আর বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে চাষের জমি এমনিতেই কম, তা দিন দিন আরও কমছে। পরবর্তীকালে দারিদ্র ও অনুর্বর জমির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে এইসব অঞ্চলে।
অপরাধী ছাগল
ছাগল যে কী খায় তা বোঝা দায়। বাংলাতে একটা কথা আছে ‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়’। বোম্বের দু’জন ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে দরাদরি শেষ করে টাকা মেটাতে যাবেন, এমন সময় একটা ১০০০ টাকার নোট পড়ে গেল মাটিতে আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ছাগল সেটা খেয়ে নিল।
যে টাকাটা নিচ্ছিল সে বলল, টাকা তো তার কাছে পৌঁছয়ইনি। সুতরাং, ক্ষতি তার নয়। এদিকে অন্যজন বলল, এটা যে টাকা নিচ্ছিল তারই গাফিলতিতে হয়েছে। একজন ইংরেজ থাকলে হয়তো বলত ছাগলটার একটা ময়না তদন্ত করতে। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে এ স্বপ্নেরও অতীত। সুতরাং তারা কে অপরাধী তা সাব্যস্ত করার জন্য সরকার খাজাঞ্চিখানায় অভিযোগ জানাল তদন্তের জন্য। আমার মনে হয় শেষমেশ ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছিল।
ছাগল মৃত্যুর পরেও যেন আমাদের সাথেই জীবন কাটায়। চামড়াটা তুলে নেওয়া হয় ভিস্তি বা জলবাহিকা বানানোর জন্য। পাগুলো একদম খাপে খাপে সেলাই করা থাকে। যাতে থলিটা ভিস্তি বহনকারীর পিঠ থেকে যেন ঠিকঠাক ঝুলে থাকে। আর গলাটা যেটা একদম সঠিক মাপের ওই বিশাল বোতলের মুখ হয়ে থাকে, যাতে করে তেষ্টা পেলে যদি কারুর গলায় জল ঢালা হয়, যাতে সরু হয়ে জল পড়ে। অথবা একটা জলের পাত্র ভরার সময় জল যাতে বাইরে না পড়ে। অথবা রাস্তায় জল দেওয়ার সময় দূর অবধি জল ছড়িয়ে দেওয়া যায় অথবা কোনও স্নানাগারে তাড়াতাড়ি খালি করেও দেওয়া যায়।
ভিস্তি মানেই স্বর্গের দূত, এক রাজপুত্র এবং তার অর্ধ-শ্লেষাত্মক উপাধি। যেমন দর্জির কাছে এক খলিফা, মেথরের কাছে এক রাজপুত্র, নাপিতের কাছে এক ঠাকুর আর রাজা বা রাজকীয়, একজন রাজমিস্ত্রির কাছে। এরা আগে এতটাই কদর পেত। কিন্তু এখন একটা ইংরেজ বাচ্চা হয়তো দেখলে বলবে, ‘ভিস্তি যেন একটা জন্তু’। যেন একটা অসহায় জন্তু, ছাগলের থেকেও বেশি, যেন শুশুক। সত্যিই মাঝে মাঝে কুয়োর পাশে পড়ে থাকতে দেখলে মনে হয় আকাশের দিকে পা উঁচু করে যেন একটা মানুষ একটু সময় নিচ্ছে এটাকে পিঠে নিয়ে উঠবে বলে। অনেকটা ইজরায়েলের বেদি থেকে লেভাইটের মতো দেখতে লাগে।
ছাগলের চামড়া দিয়ে যারা ব্যাগ তৈরি করে তাদের আশ্চৰ্য ক্ষমতা থাকে। একবার একজন একটা বাচ্চা ছাগলের কালো নরম চামড়া নিয়ে এল আমার কাছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কী?’ সে এমনভাবে আমার সামনে মেলে ধরতে শুরু করল মনে হল যেন কায়দাটা ডন মিগুয়েল দ্য সার্ভান্তেস শিখিয়েছে। একটা ছাগলছানা যার পা, কান এমনকি চোখও কাচ দিয়ে তৈরি করে ঠিক ঠিক বসানো। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি ওই অবাক ঘরে রাখা যায় না?’ অবাক ঘরটা আসলে সংরক্ষণশালা। হ্যাঁ, সত্যিই ওটা সংরক্ষণ করার মতোই একটা জিনিস ছিল। কিন্তু আমার কোনও ধারণা ছিল না কীভাবে বানানো হয়েছে।
ইউরোপে ছাগলরা মদের সাথে জড়িয়ে গেছে। বাইবেলেও দেখা যায় এদের চামড়া ওয়াইনের ব্যাগ বা বোতল তৈরিতে কাজে লাগে। এমনকি স্পেন আর সাইপ্রাসেও এখনও এরকম ব্যাগ ব্যবহার হয়। এথেইনসের লোকেরা ডিওনিসাস উৎসবের সময় একটা দারুণ খেলা খেলে, এসক্লিয়াসমাস। মানে, একটা ওয়াইনভর্তি ছাগলের চামড়ার গায়ে ভালো করে তেল মাখিয়ে তার ওপর লাফানো আর নাচ করা। ভারতের নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর জন্য এখানে ওয়াইন তৈরিই হয় না, তাই এইরকম ব্যাগে রাখার প্রশ্নই নেই। এটা একধরনের ভেলার মতো বানানো হয় ছাগল বা হরিণের চামড়া দিয়ে বাতাসে ফুলিয়ে নিয়ে।
এটা একটা নৌকার মতো কাজ করে, বিশেষ করে পাহাড়ি নদীগুলোতে। মানুষ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড় টানে আর পাটা অনেকটা রাডারের কাজ করে। আমি দেখেছি, একজন শক্তপোক্ত মহিলাকে চুপচাপ শূন্যে চেয়ে বসে থাকতে। একটু জল ভেতরে ভরে গেলে এই ছাগলের চামড়ার ভেলা বা মশক একটু বিশেষরকম হয়ে যায়। যারা পাহাড়ি এলাকায় সকালবেলা কাঁধে জলভরা মশক নিয়ে হাঁটে, সূর্যের এলে পরে যার পিঠে ঠিক লাগে যেন খাপ খোলা তলোয়ার। যদিও মশক রাস্তা ধোওয়ার নোংরা জলে ভর্তি থাকে।
হিমালয়ে ফল-খাবার দোকান থেকে বাড়ি বয়ে নিয়ে আসার জন্য এই ছাগলের চামড়ার ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। আগেকার দিনে যারা কুলির কাজ করত বা রাস্তা তৈরি করত, তারা তিন-চারদিনের খাবার, কম্বল এইসব ব্যাগে ভরে চলে যেত পাহাড়ি অঞ্চলে। অনেক হিন্দুরা আছে যারা এই চামড়ার ব্যাগ থেকে জল খায় না। এটা একদিক থেকে ভালোই হত যদি সবার একই কুসংস্কার থাকত। যদিও এগুলো খুব সহজলভ্য আর উপযোগী, তবুও স্বাস্থ্যকর নয়। এখন পাইপের মধ্যে দিয়ে যে কলের জল আসে তা ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সবাইকে। এর ফলে সংক্রমণের হার কমবে, মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষা হবে, মৃত্যু কমবে আর পাশাপাশি এই চামড়ার ব্যাগের ব্যবহারও কমবে।
ভেড়ার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে দেওয়ার প্রথা শুধুমাত্র ভারত আর পেরুতে দেখা যায়। বোরাক্স, আসাফেটিদা এইসব নানান জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে ভেড়ার পিঠে চাপিয়ে তিব্বত থেকে ব্রিটিশ-অধ্যুষিত এলাকায় নিয়ে আসা হত। একেবারে পাহাড়ের প্রত্যন্ত কোনায়, যেসব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা আগে যেত, তারা ওই লোমশ ভেড়াগুলোর গায়ে ক্লিপ দিয়ে ব্যাগগুলো আটকে দুইপাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিত। রাস্তা সরু হলে এদের এক জায়গায় লাইন দিয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়া হত। প্রাণীগুলো হাঁফাতে হাঁফাতে মালপত্র নিয়ে যেত, কিন্তু এইসব যাত্রায় ফেরত আসত শুধু মেষপালকরা। কারণ, এদের এই শ্রমের বদলে এদের মাংসই নিয়ে আসত এবং লোককে এই দারুণ মাংস খাওয়াত।
ভারতে প্রচুর সংখ্যায় ভেড়া পাওয়া যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে এদের শুধু চাষের কাজের জন্য প্রতিপালন করা হয় না। কোনও কোনও শহরে ভেড়ার লড়াই হয়, আর সেটা দেখে মজা নিতে লোকে ভিড় করে। কোনও সম্ভ্রান্ত মুসলিম তার পোষা ভেড়া যে এইসব মারপিটে অংশ নেয়, তাকে নিয়ে যখন বেরোয় তখন তাকে রীতিমতো ফুলবাবুটি সাজিয়ে রাখে। বেশ একটা তার মাথার দু’পাশ থেকে গেরুয়া বা হালকা বেগুনি রঙের পালকের গোছা ঝুলতে থাকে। আর গলায় একটা বড়ো নীল দানা দিয়ে তৈরি হার থাকে। আর ছোটো ছোটো ঘন্টা দিয়ে তৈরি বকলস ঝোলে গলায়। তার মালিকও গলা থেকে কাঁধ অবধি লম্বা রুমাল জড়িয়ে রাখে। রুমালের রং সমুদ্র নীল বা গাঢ় নীল হয়, তারপর সুতোর আর সোনার কাজ করা থাকে। পা’দুটো ঢাকা থাকে পাজামায়, মাথার একদিকে থাকে সোনার কাজ করা টুপি। মাঝখান থেকে ভাগ করে আঁচড়ানো চুলে সুগন্ধি তেল লাগানো থাকে। তার চুল এসে পড়ে কানের পিছনদিকে, কানে থাকে একজোড়া সোনার দুল। পায়ে চামড়ার জুতো, গলায় মোটা সোনার চেন। সে সূর্যের আলোতে একেবারে ঝকমক করতে থাকে আর বিজয়ীর ভঙ্গিতে তার ভেড়াটিকে নিয়ে যায় যেখানে লড়াই হবে। তবে ফেরার সময় তাকে সবসময় এত উজ্জ্বল লাগে না। অনেকসময় ক্লান্ত মেষটিকে টানতে টানতে নিয়ে আসায় এক যন্ত্রণার কাজ।
দেবরাজ ইন্দ্র ভেড়ায় চেপে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু প্রচুর মানুষের কাছে আজ ইন্দ্র একজন মৃত ভগবান।