গল্প-তুমি অন্নপূর্ণা- দীপক দাস শীত ২০২০

দীপক দাসের আগের লেখাঃ তোমরাও ভালো থেকোসমুকাকের বাসায় কোকিল ছা, যমধারার জঙ্গলেআবার যমধারার জঙ্গলে, শিয়াল চরা সেই রাত, একটি অনৈতিহাসিক সার্জিকাল স্ট্রাইক

এক

“স্যার, বিপুল-টুবলুরা আজকে খেতে চাইল না কেন?” সবুজ হঠাৎই প্রশ্ন করল শমীককে।

সবেমাত্র কৌশিকী নদীর উত্তর পাড়ের ছাতিমগাছটার নীচে শতরঞ্চিটা বিছিয়ে ছিলেন শমীক। প্রতি শনিবার এখানে আসেন তিনি। তাঁর ছাত্রছাত্রী দলবল নিয়ে। এসেই শমীকদের প্রথম কাজ হয় ঘাসিবাবার মাজারে সবাই মিলে ফুল দেওয়া। শমীক ঘাসিবাবার জীবনী বলেছেন বাচ্চাদের। কোথা থেকে যদুপুরের এই অঞ্চলে এসেছিলেন কেউ জানে না। এসে চেষ্টা করেছিলেন সব ধর্মের মানুষকে এক করার। তাঁকে সকলে ভালোবাসত। সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর ভক্ত। এখনো প্রতি বৈশাখে ঘাসিবাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে মাজার ঘিরে মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন। সব ধর্মের মানুষ। গমগম করে কৌশিকী নদীর এই পুরোনো চর। শমীক ঘাসিবাবার গল্প পড়ুয়াদের বোঝান, “তোমরাও ভালোবাসবে সকলকে।”

ঘাসিবাবাকে শ্রদ্ধা জানানোর পরে নদীর চর ধরে হাঁটতে শুরু করেন সকলে মিলে। যেতে যেতে কখনো হাতের ছোটো আঁকশি দিয়ে নদী থেকে কচুরিপানা, শেওলা, ঝাঁঝি তোলেন। ছেলেমেয়েরা সেগুলো মাটিতে গর্ত করে খুঁড়ে পুঁতে ফেলে। কৌশিকীর ক্ষীণস্রোতকে যতটা সম্ভব বন্ধন মুক্ত করার চেষ্টা। কখনো নদীর বাঁধের গায়ে ইঁদুরের গর্তগুলো ইটের টুকরো দিয়ে বুজিয়ে দেন। পড়ুয়ারা সাহায্য করে। তারপর ফিরে এসে ছাতিমগাছের নীচে বসে ছোটোখাটো ফিস্ট। বাড়ি থেকে যে যা আনে সব খবরের কাগজের ওপর ঢেলে একসঙ্গে মেখে খাওয়া। খেতে খেতে কবিতা, গল্প, গান।

শমীক শিবাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের অতি প্রিয় স্যার। প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃতির শিক্ষাতেও বিশ্বাসী। তাই পড়ুয়াদের নিয়ে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতি দর্শনের সঙ্গে চলে প্রকৃতি শুদ্ধির কাজ। একবার সারা শিবাডাঙায় প্লাস্টিক মুক্তি অভিযান চালিয়েছিলেন একমাস ধরে। শিবাডাঙা ফিডার রোডের ধারে যত গাছ রয়েছে, সব শমীক আর তাঁর পড়ুয়াদের লাগানো। শমীককে শ্রদ্ধা করেন এলাকার সচেতন মানুষেরা। অবশ্য টিপ্পনি না কাটলে যাদের ভাত হজম হয় না তারা বলে, ‘দ্যাবাদেবীর ক্ষ্যাপা দল’। দ্যাবা শমীক আর দেবী শমীকের স্ত্রী স্মিতা। দুজনে একই স্কুলে কাজ করেন। আর দুজনেরই জীবনাচার একই পথে চলে।

আজ স্মিতা আসেননি। সবুজ ছাড়া অন্য বাচ্চারাও আজ আসেনি। স্কুলে একটা লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। শমীকদের স্কুলে মাস তিনেক হল মিড ডে মিল চালু হয়েছে। কোনো সমস্যা ছিল না। আজ হঠাৎ তৃতীয় আর চতুর্থ শ্রেণির একদল ছেলেমেয়ে খাবার খেতে চায়নি। বিপুল-টুবলরা সেই দলে ছিল। তাদের দাবি, রজতের মাকে রান্নার কাজ থেকে সরাতে হবে। ওরা মেথর সম্প্রদায়ের। রজতের মায়ের বাবা এবং রজতের ঠাকুরদা, দুজনেই হাসপাতালে মুদ্দাফরাসের কাজ করতেন। শমীক অবাক হয়ে গিয়েছিলেন বাচ্চাদের কথা শুনে। রজতের দুই দাদু যখন ওই কাজ করতেন তখন এদের কারো জন্ম হয়নি। কী বলছে এরা? কাদের শেখানো কথা! শমীক বিপুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মুদ্দাফরাস মানে কী রে?” বিপুল চুপ করে ছিল।

শমীককে অবশ্য উত্তরের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল লোক স্কুলে হাজির হয়। ওদেরও দাবি, বাচ্চারা ঘেন্না করছে। ঘেন্না করে খাবার খেলে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই রজতের মাকে ছাড়িয়ে দিতে হবে। শমীক বুঝতে পারেন, এটা পরিকল্পিত। এর জল অনেক দূর গড়াবে।

“স্যার, টুবলুরা খেল না কেন?” আবার জানতে চায় সবুজ।

“ওদের খিদে নষ্ট হয়ে গেছে রে। বুঝলে সবুজ, ঘাসিবাবার গল্প শুনে ওদের কিছু লাভ হয়নি। ওরা কিচ্ছু শেখেনি। আচ্ছা সবুজ, রজত যদি পড়া ছেড়ে দেয় তোমার কেমন লাগবে?”

“খুব খারাপ লাগবে স্যার। ও আমার খুব ভালো বন্ধু। পড়া ছেড়ে দেবে কেন স্যার?”

“যদি রজতের মাকে গ্রামের লোকেরা আর রান্না করতে না দেয় ওরা খুব মুশকিলে পড়বে। আচ্ছা, রজতের মায়ের রান্না তোমার খারাপ লাগে?”

“না তো স্যার। মায়ের মতোই রান্না করে কাকিমা।”

“তাহলে চলো, রজতের বাড়ি যাই।”

দুই

স্মিতা তখনো রজতদের বাড়িতে বসে ছিলেন। রজতের মা অপমানে লজ্জায় কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে বসে আছেন। রজতের বিহ্বল দশা এখনো কাটেনি। অত লোকের চেঁচামেচি, সবার মুখে ওর মাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথায় রজত ভয় পেয়ে গিয়েছিল। রজতের মা মাথা নীচু করে কাঁদছিলেন। বড়ো দুঃখী মহিলা। লেখাপড়া জানেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছেছেন। রজতের বাবা কারখানায় কাজ করতেন। কিন্তু সুপারভাইজারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে কোমরে আর যকৃতে চোট পান। আর ভালো হননি। কারখানা থেকে পাওয়া টাকা তাঁর চিকিৎসাতেই খরচ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। রজত ভালো ছেলে। খেলাধুলোতেও ভালো। ছেলেটাকে বড়ো করতে গেলে কাজটা রজতের মায়ের খুব দরকার।

স্মিতা বললেন, “পাড়ার কিছু লোক শাসিয়ে গিয়েছে, সোমবার আরো ঝামেলা হবে। যারা রজতের মাকে রক্ষা করতে চায় তারা যেন ওকে বাড়িতে রাঁধুনি রাখে।”

শমীক বুঝতে পারেন, এক্ষুনি একবার সবুজের বাবার সঙ্গে দেখা করা দরকার। সবুজকে ডেকে নিয়ে বেরোনোর সময় শমীক স্মিতাকে বলে যান, রাতে যেন রজত আর ওর মাকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে যান।

সবুজের বাবা পার্টির বড়ো নেতা। এলাকায় দারুণ প্রভাব। শমীক কিছু বলার চেষ্টা করতেই স্বদেশবাবু জানালেন, তিনি সব জানেন। এও জানালেন, তাঁর পার্টির সিদ্ধান্ত এটা। শমীক বুঝতে পারেন, গ্রামের কিছু ছুঁৎমার্গী উচ্চবর্ণের মানুষজনকে উস্কে দিয়ে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপক্ষকে চাপে ফেলার কৌশল। কারণ শিবাডাঙা পঞ্চায়েত স্বদেশবাবুদের পার্টির দখলে নেই। যদিও ব্লক, বিধানসভা তাঁদের দলেরই। উনি কিছু করবেন না।

শমীক উঠে আসার আগে বললেন, “আমি হাল ছাড়ব না। অন্যায় দাবি মানব না। স্কুলের বাচ্চাদের দিয়েই আপনার পার্টিকে প্রতিরোধ করব।”

“শমীকবাবু, আপনাকে এবং আপনার স্ত্রীকে আমরা আন্তরিক শ্রদ্ধা করি। সে জন্য নির্দ্বিধায় সবুজকে আপনার কাছে সঁপে দিয়েছি। কিন্তু মাফ করবেন, সোমবার হয়তো সবুজও আমাদের পার্টির হয়ে যাবে।”

“দেখা যাক।” বলে বেরিয়ে গেলেন শমীক।

রবিবার পড়ুয়াদের বাড়ি বাড়ি গেলেন শমীক আর স্মিতা। কিন্তু শ’দেড়েক পড়ুয়ার অভিভাবকদের মধ্যে জনা কুড়িকে পাশে পেলেন। সবুজকে রাজি করিয়েছেন। ও যদি খেতে বসে তাহলে আন্দোলনের আর মূল্য থাকবে না। ওর বাবার বিরোধীরা বলতে সুযোগ পাবে, নিজের ছেলেকেই আটকাতে পারে না…

তিন

কিন্তু সোমবারে দেখা গেল উলটো ছবি। সেই জনা কুড়ি অভিভাবকদের ছেলেমেয়েদের অনেকেই স্কুলে আসেনি। যারা এসেছে তাদের কেউ কেউ খেতে রাজি নয়। স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারেন, ওরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কষ্টের বিষয়টা হল, সবুজও একপাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। বাকি দুজন শিক্ষক ঝামেলার ভয়ে শমীকদের উপরেই বিরক্ত হচ্ছেন। সব থেকে বিড়ম্বনা রজতের। খেতে বসার জন্য পাতা চটে একা বসে আছে ছেলেটা। কী করুণ দৃষ্টিতে একবার স্মিতার দিকে, আরেকবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। আর থাকতে পারলেন না স্মিতা। ছুটে গিয়ে রজতকে কোলে তুলে নিয়ে কেঁদে ফেললেন। কিন্তু বাধাদানকারীরা অন্ধের মতো নিশ্চল।

রাগে, হতাশায় হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছিল শমীকের। ভাবছিলেন আজই চাকরি ছেড়ে দেবেন। এ গ্রামেই থাকবেন না আর। স্টাফ রুমের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন শমীক। পদত্যাগপত্রটা তৈরি করে ফেলবেন। তখনই সবুজ ছুটে স্মিতার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময়েই স্কুলে ঢুকলেন স্বদেশবাবু। বাবাকে দেখে ভয়ে আবার জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল সবুজ।

স্বদেশবাবু তাঁর পরিচিত ভরাট গলায় বললেন, “বসে পড় সবুজ। আর আমাকে মাফ করে দিস। তোকে ভয় দেখিয়ে তোর মনের সবুজকে মেরে ফেলেছিলাম। তোর মায়ের কাছেও ক্ষমা চেয়েছি। আর এমন ভুল হবে না।” তারপর রজতের মায়ের দিকে ফিরে বললেন, “বৌদি, বড়ো অমানবিক কাজ করে ফেলছিলাম। আপনি রজত আর সবুজতে খেতে দিন।”

ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল। স্বদেশবাবু সেদিকে না তাকিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দিকে ফিরে বললেন, “এই, তোরা যারা খেতে চাস বসে যা। নয়তো অভিভাবকদের স্কুলের বাইরে নিয়ে গিয়ে হল্লা কর।”

কে একজন বলে উঠল, “আমরা কিন্তু নেতৃত্বকে নালিশ করব, আপনি দলের নির্দেশ মানেননি।”

স্বদেশবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন, “পারলে কোরো। এখন বাচ্চাদের খেতে দাও। তিনটে বাজতে চলল। সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

আর আশা নেই দেখে বিরোধীরা একে একে সরে গেল। ভয়ের বাধা সরে যেতে বাচ্চারাও ছুটে গিয়ে খেতে বসে গেল। বিপুল-টুবলুরাও।

শমীক স্বদেশবাবুর হাতদুটো চেপে ধরলেন। উনি জড়িয়ে ধরলেন শমীককে। তারপর দুজনেই তাকিয়ে রইলেন সেইদিকে যেদিকে একদল শিশু উজ্জ্বল মুখে খাবার খাচ্ছে। রজতের মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে খাবার পরিবেশন করছেন। ছবির সুন্দর দৃশ্য। তাকিয়ে থাকেন স্মিতা, শমীক আর স্বদেশবাবু।

অলঙ্করণ:মৌসুমী রায়

জয়ঢাকের গল্পঘর

4 thoughts on “গল্প-তুমি অন্নপূর্ণা- দীপক দাস শীত ২০২০

    1. ধন্যবাদ আপনাকে। মতামত পেয়ে আমারও ভাল লাগল।

      Like

  1. সমাজের একটা অনভিপ্রেত দিককে সুন্দরভাবে গল্পে তুলে ধরেছেন আপনি। শমীক-স্মিতাদের মত কিছু মানুষের সামান্য স্বার্থহীনতাই বোধহয় সমাজটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখনও। খুব ভাল লাগল গল্পটি।

    Like

    1. ঠিকই বলেছিস। সকলের সব জায়গায় খবরদারিটা যে দরকার নেই এটাই ওরা বুঝতে চায় না। তবে সমাজে এখনও অনেক শমীক-স্মিতা আছেন। তাঁরা নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। এটাই ভরসার।

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s