গল্প -যমধারার জঙ্গলে দীপক দাস শীত ২০১৬

golpojamdhara01।।এক।।

অয়নদা এসেছে! খবর ছড়াতেই আমাদের বাড়ি জমজমাট।

ইন্দ্র, কৃষ্ণ, বাবলা, শুভ, দীপু জমিয়ে বসেছে আমাদের পড়ার ঘরে। আমাদের তিনভাইয়ের বন্ধু। ছুটির দিনগুলো আমাদের বাড়িটা এমনিতেই টিভি চ্যানেলের ওয়ান ব্রেক সিনেমার মতো হয়ে যায়। অয়নদা আমাদের পিসির ছেলে। নামী সংস্থায় কাজ করে। ও শখের পক্ষীবিশারদও। শীতকালে প্রতি সপ্তাহেই ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। ফিরে আমাদের গল্প বলে। একবার ছত্তীসগড়ের জঙ্গলে একটা বুনো মোষ লুকিয়ে পিছু নিয়েছিল ওর। শুনে ময়ূখ চৌধুরীর কমিকসের ‘কেপ বাফেলো’ দলের দলপতি মবোগোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

এসব গল্প শোনার লোভেই বন্ধুরা এসে জড়ো হয়। কিন্তু দাদাটির দু’টো খারাপ ব্যাপার আছে। ও ভূতে বিশ্বাস করে, তবে ভয় পায় না। অয়নদা বলে, জঙ্গলে রাত কাটানোর জন্যই বুঝতে পেরেছে, ভূত বলে কিছু আছে। আমরা প্রতিবাদ করলেও পাত্তা দেয় না। দ্বিতীয় খারাপ ব্যাপারটা হল, ও কিছুতেই কোনও পাখির চেনা নাম বলে না। একটা খটোমটো বৈজ্ঞানিক নাম বলে মুখটা গম্ভীর করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। নয়তো মিটিমিটি হাসে। তা নিয়ে আমাদের রাগ, ফেসবুকে ভ্যাংচানো স্টিকার আদানপ্রদান চলে।

কিন্তু এবারে যেন মজার অয়নদাকে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। চুপচাপ। কিছু ভাবছে সবসময়। বিকেলে নবারুণ মাঠে খেলতে গিয়েছিলাম সবাই। ও এবার মাঠেই নামল না। রোলারটার উপরে চুপ করে বসে রইল। অথচ খেলাধুলোয় অয়নদা বরাবরই ভাল। ক্যারাটেও জানে।

আজ রাতে অয়নদার সম্মানে আমাদের বাড়ি ফিস্ট। খাওয়াদাওয়ার পরে আমরা চেপে ধরলাম, কী হয়েছে বলতেই হবে। অনেকক্ষণ গম্ভীর থেকে মুখ খুলল ও। বলল, “এবার আমি বাঁকুড়ায় গিয়েছিলুম, যমধারার জঙ্গলে পাখি দেখতে। জঙ্গলটা একটা পাহাড় ঘিরে। পাহাড়ের পাশেই একটা গ্রাম। সঙ্গীরা মিলে রাতে ওই গ্রামে গেলুম। কী একটা পরব ছিল সেদিন। আগুন জ্বালিয়ে নাচগান হচ্ছিল। সঙ্গীরা উৎসব দেখতে ব্যস্ত। আমি ঘুরতে বেরোলুম। অমাবস্যার রাত। তার ওপর গ্রামটা প্রায় জঙ্গলে ঘেরা। ফলে অন্ধকারটা বেশ ঘন। জঙ্গলে একটা পেঁচা হুঁ-হুঁ-হুঁ করে একটানা ডাকছে। গা ছমছমে পরিবেশ। মোবাইলের আলো জ্বেলে যাচ্ছিলুম। গ্রামের শেষ দিকে পৌঁছেছি। হঠাৎ ঝোপের মাঝে দপ করে আলো জ্বলেই নিভে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল, কোনও বুনোজন্তুর চোখ। মোবাইলের আলো চোখে পড়েছে। তাহলে তো দু’টো চোখই জ্বলে উঠত! মনের ভুল ভেবে এগোতে যাচ্ছি তখনই খসখস শব্দ। দাঁড়িয়ে পড়লুম। মনে হল, একটা গুনগুন সুর শুনতে পাচ্ছি। না, গান নয়, মন্ত্র পড়ার মতো সুর! ঝোপে আবার মন্ত্র পড়ছে কে? পা টিপে টিপে এগোলুম। অন্ধকারে ঝোপের ভিতরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কী ঘটছে সেটা দেখার আগ্রহে মোবাইলের আলোটাও জ্বালতে পারছি না। কিছুক্ষণ পরে মনে হল সুরটা থামল। জঙ্গলে রাতে নানারকম শব্দ শোনা যায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে ফিরে আসব ভাবছি, তখনই দপ করে আলো জ্বলে উঠল। খুব অল্প সময়ের জন্য দেখতে পেলুম, একটা মুণ্ডু শূন্যে ঝুলছে। পাশে একটা হাত।”

একটু থামে অয়নদা। তারপর বলে, “ভূতে বিশ্বাস করলেও ভয় পাই না। কিন্তু সেদিন বেশ ভয় লাগছিল। এমন হয় নাকি! ততক্ষণে মন্ত্রের গুনগুনটা ফিরে এসেছে। মানুষের স্বর বলেই মনে হল। ফলে ভয়টা কেটে গেল। কিছুক্ষণ পরে আবার জ্বলল আলোটা। এবারেও সেই হাত আর মুণ্ডু। তবে ওই আলোতে আরও একটু দেখতে পেলুম। ঝোপের মাঝখানটা সাফ করা। আর একটা খুব মৃদু আলো জ্বলছে। অন্ধকারে একগোছা ধূপকাঠি জ্বললে যেমন দেখায় সেরকম। মুণ্ডুটার আড়ালে ছিল বলে আলোটা এতক্ষণে দেখতে পাইনি। তবে সেই আলোয় স্পষ্ট কিছু দেখা সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ পরে দপ করে আবার আলো জ্বলল। এবার দেখলুম, দু’হাতে ভর দিয়ে পাদু’টো উপর দিকে তুলে খাড়া রয়েছে একটা লোক। সম্ভবত ওই অবস্থাতেই আগুনের উপরে কিছু ছুঁড়ছে। যার জন্য দপ করে আলো জ্বলে উঠছে। আরও কিছুক্ষণ এরকম চলল। তারপর আগুনটা আবার জ্বলে উঠল। জ্বলতেই থাকল। দেখলুম, লোকটা দু’হাতে ভর দিয়েই জঙ্গলে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণের পরে একইভাবে ফিরে এল। একটা পাখির ডানা ঝাপটানো আর কোঁক কোঁক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। সম্ভবত বনমোরগ। আলোর কাছে আসতে দেখতে পেলুম, ওর মুখে একটা পাখি ধরা। লোকটা আবার মন্ত্র পড়া শুরু করল। তারপর একহাত আর মুখ দিয়ে পাখিটার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে নিয়ে দেহটা আলোর উপরে ঘোরাতে লাগল। আলোর জোর কমে আসছিল। লোকটা পাখির রক্ত দিয়ে আগুনটা নেভাচ্ছে! কিছুক্ষণের মধ্যে আলোটা পুরোপুরি নিভে গেল। ধূপগুলো তখনও জ্বলছে। লোকটা ততক্ষণে হাত ছেড়ে পায়ে ভর করে দাঁড়িয়েছে। সব ঘটনাটা ঘটতে অন্তত কুড়ি-পঁচিশমিনিট সময় তো লেগেছে। এতক্ষণ মাথা নীচু করে থাকাটা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সব রক্ত নাকমুখ দিয়ে বেরতে শুরু করবে। আমি এসব কথা ভাবছি, লোকটা ততক্ষণে ঝোপ থেকে বেরিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে। পিছু নিয়ে ওর ঘরটা দেখে নিলুম।”

অয়নদা থামতেই কৌতূহলের হুল বিঁধতে লাগল ওর কানে। শুভ জিজ্ঞাসা করল, “একজন হাতে ভর দিয়ে ব্যায়াম করছে, তাতে তোমার চুপ থাকার কী হল!”

বাবলা ধরতাই দিল, “কত লোকেই তো ওরকম পারে।”

ইন্দ্র একটু রেগেই গেল, “তোমার এই এক দোষ! পাখির নাম জিজ্ঞাসা করলে বৈজ্ঞানিক নাম ছাড়া বল না। তুমিই আবার যত্তসব কুসংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাও! কত লোকের কতরকম বিশ্বাস থাকে।”

বাক্যবাণে ভীষ্মের শরশয্যায় পাওয়া অয়নদা বলার চেষ্টা করল, “তোরা দেখিসনি তাই বিশ্বাস করছিস না। ইলেকট্রিকের আলোয় বসে সবকিছু উড়িয়ে দেওয়া যায়।”

ধেপু হঠাৎ বলে বসল, “আমাদের দেখাতে পারবে? তাহলে আমরা বিশ্বাস করব।”

ধেপু আমার মেজভাই। ও খুব বেশি নড়াচড়া করতে ভালবাসে না। খেলতেও যায় না মাঠে। জোর করে ধরে নিয়ে গেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে কারও সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে চোট পেয়ে বসে পড়ে। ও কিনা জঙ্গলে যেতে চাইছে! আশ্চর্য! অয়নদা কিন্তু ধেপুর চ্যালেঞ্জ নিল। বলল, “পরশু তো অমাবস্যা। চল তাহলে?”

।।দুই।।

পরদিন সকালে বাঁকুড়া স্টেশনে। বিডিআরের ইঞ্জিনটার সামনে সবাই মিলে ছবিটবি তুলে বাসস্ট্যান্ডে চলে এলুম। খাওয়াদাওয়া সেরে ট্রেকারে সোজা কবি বড়ু চণ্ডীদাসের বাশুলী মন্দিরে। কে যেন বলল, “অন্যবার এসে দেখব।”

কিন্তু বাবলা একটা হিন্দি সিনেমার সংলাপ একটু ঘুরিয়ে বলল, “আয়া হুঁ তো দেখ কর যাউঙ্গা।”

যমধারায় পৌঁছতে দুপুর। উঠলুম আরণ্যক গেস্টহাউসে। ডর্মিটরি দখল করে জিরিয়ে নিচ্ছি, ম্যানেজার তাপসদা বললেন, “সামনের পাহাড়ে একটা ঝোরা আছে। সবাই চান করে।”

আমরাও চান করলুম। শুধু ধেপু ছাড়া। এত গরমে ওর চান না করার কারণ বোঝা গেল না। বাবলা টানাটানি করায় পুরোহিতের শান্তিজল ছেটানোর মতো করে মাথায় কিছুটা জল ছিটিয়ে উঠে পড়ল।

বিকেল পর্যন্ত টানা ঘুম। সন্ধেবেলায় বেরোলুম আশপাশ দেখতে। বাজারে একজন অয়নদাকে ডাকল। ও এগিয়ে গিয়ে কথা বলল। ওর এখানে অনেক চেনাজানা লোক আছে। ঘুরে-টুরে ফিরলুম দশটা নাগাদ। খাওয়াদাওয়া সেরে খাট জড়ো করে জমিয়ে আড্ডা। আড্ডাতেই পরেরদিনের সফরসূচি ঠিক হল। অয়নদা রাত বারোটার আগে কিছু দেখাতে পারবে না বলে দিয়েছে। তাই দিনেরবেলাটা নষ্ট না করে আমরা বিহারীনাথে চলে যাব। ফিরে এসে যমধারার জঙ্গলটা রেকি করে নেব। রাতে অভিযান শুরু হবে। কথার মাঝে দীপু হঠাৎ, “আমরা কতজন আছি?” বলে নিজেই গুনতে শুরু করল, “এক, দুই…নয়। যাহ্, ন’জন হয়ে গেল যে।”

golpojamdhara02সবাই হাঁ। শুভ জানতে চাইল, “ন’জনে সমস্যাটা কী?”

দীপু বলল, “আরে অভিযানের একটা নাম দিতে হবে না? টেনিদাদের চারমূর্তি বা ফেমাস ফাইভের মতো।”

আমি বললুম, “ওরা ন’জন তো বেশ নাম।”

দীপুর মনে ধরল। ও বলল, “তাহলে ওরা ন’জন এবার শুয়ে পড়ুক? কাল ভোরে তো ওরা ন’জনকে উঠতে হবে।”

শুনে গেস্ট হাউস কাঁপিয়ে হেসে উঠলুম আমরা।

এত হইচইয়ের মধ্যেও অয়নদা কিন্তু চুপচাপ। জিজ্ঞাসা করলুম, “কী গো অয়নদা, চ্যালেঞ্জ নিয়ে চাপে আছ? চাপ নিও না। কাল কিছু দেখাতে না পারলেও এত সুন্দর একটা জায়গায় আনার জন্য ধন্যবাদই দেব।”

অয়নদা গম্ভীর গলায় বলল, “বাইরে তাকা। কেমন অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিস? এতে কিছু দেখলে ঠিক থাকতে পারবি তো?”

সবাই চেঁচিয়ে উঠলুম, “আগে দেখাও তো!”

সারাদিনের ঘোরাফেরায় রাতে ঘুমটা গাঢ় হয়েছিল। হঠাৎ ‘আঁ আঁ’ করে প্রচণ্ড চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের লাইটটা কেউ জ্বেলে দিয়েছে। দেখি, রাজা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “জানলায় দু’টো পা। চেটোগুলো উপরে। যেন কেউ হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”

আমার ছোটোভাইটি একটু ভীতু টাইপের। ওকে জোর করে ধরে এনেছি। আমি বললুম, “লোকে মুণ্ডু না দেখিয়ে, চোখ না পাকিয়ে পা দেখাচ্ছে কেন বল তো?”

কৃষ্ণ বলল, “বোধহয় ফুটবল খেলতে ডাকছে।”

হট্টগোলেও দীপু কিন্তু চোখ বুজে শুয়েই আছে। চোখ বুজেই বলল, “জানলায় দু’টো পা। ওরা ন’জনের আঠারোটা। এঁটে উঠতে পারবে না। শুয়ে পড়, শুয়ে পড়।”

ঘরের লাইট নিভে গেল। কিছুক্ষণ পরে অয়নদার হিসহিসে গলা, “এখনও বল, ফিরে যাবি?”

বাবলা ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “আয়া হুঁ তো…”

বিহারীনাথে যাওয়া হল বটে, কিন্তু ‘ওরা ন’জন’-এর পাহাড়ে ওঠা হল না। অটোচালক গল্প করেছিলেন, ওই পাহাড়ে বুনোশুয়োর আছে। দেড়শো-দু’শো কিলো ওজন। শুনে বাবলা কিছুতেই পাহাড়ে উঠতে চাইল না। ফিরে এলুম গেস্টহাউসে। বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে যমধারার জঙ্গলে গেলুম। পাকা রাস্তা ছাড়িয়ে অনেকটা রাস্তা। আশেপাশে কোনও বাড়ি নেই। বেশ ঘন জঙ্গল। মাঝে একচিলতে পথের রেখা। লোকজন আসে। তবে খুব বেশি নয়। কিছুটা এগোলে একটা ঝর্ণা। ওটাই যমধারা। কেন এমন নাম, কে জানে! ধারার পাশ দিয়ে একটা পাথুরে পথ। ওর শেষপ্রান্তে রাজা চন্দ্রশর্মার শিলালিপি আছে। ঝোপেঝাড়ে কত পাখি! আমরা উঠতে শুরু করলুম। ভীষণ খাড়াই। একটু উঠছি আর হাঁফিয়ে যাচ্ছি। কিছুটা ওঠার পরেই ইন্দ্র একটা পাথরের উপরে বসে পড়ল। চোখ গোল্লা গোল্লা, কুলকুল করে ঘামছে। বললুম, “কী হল রে?”

ও বলল, “তোমরা ওঠ, আমি বসছি।”

ওপর থেকে শুভ চিৎকার করছে, “জ্যাকি চ্যানের কী হল?”

ইন্দ্র নিজেকে ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্টধারী বলে দাবি করে। যতবার দাবি করে ততবারই শুভ জানতে চায়, “বেল্টটা কীসের? চামড়ার না রাবারের?” জ্যাকি চ্যান নামটা ওরই দেওয়া।

ইন্দ্র ফিসফিস করে বলল, “নীচের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরে গিয়েছে।”

আমি ফিক করে হেসে উঠতে শুরু করলুম। ধেপু, বাবলা তখন শিলালিপির কাছে। লিপির পাথরটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ। ধেপু লিপিটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। বাবলা জিজ্ঞাসা করতে গম্ভীর মুখে বলল, “গুপ্তধনের সংকেত হতে পারে।”

অয়নদা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। ধেপুর কথা শুনে বলল, “এমন ফাঁকা জায়গায় গোটা গোটা বাক্যে সংকেত! তুই আর কষ্ট করিস না। এত লোক এতদিন ধরে আসছে। তারা লিপির পাঠোদ্ধার করে গুপ্তধন বের করে বেচেও দিয়েছে।”

গেস্টহাউসে ফিরতে সন্ধে। অয়নদা ফিরল না। পরিচিত একজনের খোঁজ গিয়েছে। পরে ফিরবে। খাওয়াদাওয়ার পরে রাতে অভিযানের প্রস্তুতি প্রায় সারা। এবার চুপি চুপি বেরিয়ে যাব, রাজা জানাল, ও যাবে না। ওর নাকি খুব ঘুম পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শুভর কটাক্ষ, “অনিচ্ছুক ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধে না যাওয়াই ভাল। ধরা পড়ার চান্স থাকে।”

।।তিন।।

রাতে জঙ্গলটা একেবারেই অন্যরকম। এত ঘন কালো আগে কখনও দেখিনি। হাতটা চোখের কাছে তুলেও জামার রং দেখতে পাচ্ছি না। ছুঁচোরা যেমন পরস্পরের লেজ কামড়ে রাস্তা পার হয় সেরকমভাবে আমরাও একে অপরের জামা ধরে লাইন দিয়ে হাঁটছিলুম। সবার আগে অয়নদা। শেষে কে থাকবে তাই নিয়ে একদফা মনকষাকষি। ধেপু পরিষ্কার বলে দিল, ওর ঠান্ডার ধাত। শেষে থাকলে শীত পাবে। এই গরমে ঠান্ডা! কিন্তু ও কোনও যুক্তিতেই সম্মত নয়। কৃষ্ণ বলল, “আমি ক্রিকেটে ওপেন করি। এগারো নম্বরে নামব?”

বাবলার দাবি, ফুটবলে ও ফরোয়ার্ড। তাই পিছনে থাকবে না। একই যুক্তিতে দীপু মাঝমাঠের খেলোয়াড়। অয়নদা গর্জনের সুরে বলল, “ওপেনার আর ফরোয়ার্ড সামনে চলে যা। আমি পিছনে থাকছি।”

সঙ্গে সঙ্গে দু’জনে সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। শেষে ঠিক হল, শুভ গোলকিপার। সব খেলোয়াড়ই ওর সামনে থাকে। তাই ওরই পিছনে থাকা উচিত। সমবেত যুক্তির চাপে শুভ রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে পিছনে গেল।

অয়নদার নির্দেশে কেউ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিনি। শুধু ওর মোবাইলের আলোটা জ্বলছে। কিছুক্ষণ পরে যমধারার জল পড়ার একটানা শব্দ কানে এল। অয়নদা একটা জায়গায় বেছে আমাদের বসিয়ে দিল। জঙ্গলে প্রচুর মশা। কামড় আটকানোর জন্য সবাই ক্রিম মেখেছি। সেই রাগেই বোধহয় মশাগুলো কানের কাছে পনপন করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। বারোটা অনেকক্ষণ বেজেছে। ধেপু একবার ফিসফিস করে বলল, “আজকে আর কিছু দেখা যাবে না।”

সঙ্গে সঙ্গে শুভর কাঁপা কাঁপা গলা, “ওটা কী?”

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি, দু’টো জ্বলজ্বলে চোখ। তখনই কে একটা ‘আঁক’ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ধেপুর গলা, “বাবলা, আমি রে, আমি।”

ভয়ের চোটে ও বাবলাকে খামচে-টামচে নিয়েছে বোধহয়। অয়নদা হিসহিসে গলায় জানাল, “ওটা খরগোশ মনে হচ্ছে।”

আবার কিছুক্ষণ অপেক্ষা। নিঝুম জঙ্গলে সব শব্দই জোরে শোনাচ্ছে। যমধারার একটানা আওয়াজটাও গভীর রাতে রহস্যময়। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। হঠাৎ কে যেন পিঠে কামড়ে নিল। তারপরেই ধপ করে আওয়াজ। ‘ওরে বাবা রে’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলুম। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ বলে উঠল, “আমি গো বড়দা, আমি।”

কৃষ্ণের ওপরের পাটির দাঁত কোদালের মতো। ঘুমে ঢুলে পড়তেই সেই দাঁত আমার পিঠে গেঁথে যায়। ও পিঠ থেকে গড়িয়ে নীচে। অয়নদা রেগে গেল, “তোরা তো জ্বালিয়ে খেলি!”

ওর কথা শেষ হয়েছে কী হয়নি, চন্দ্রশর্মার লিপির কাছে ফস করে আগুন জ্বলে উঠল। তারপরেই ‘আঁ আঁ আঁ…’ করে ভীষণ আওয়াজ। সে আওয়াজে অনেক সাহসী লোকেরও পিলে চমকে উঠবে। আমরা ভয়ে সবাইকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু আমাদের আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে অয়নদাও ‘আঁ আঁ আঁ…’ করে চিৎকার করে উঠল। কে একজন আলো জ্বালাল। ছোটো টর্চের আলো। কেউ হয়তো লুকিয়ে পকেটে এনেছিল। সেই আলোতে দেখলুম, অয়নদা দু’হাতে ভর দিয়ে এগোচ্ছে শিলালিপির দিকে। দিনের বেলায় পায়ে হেঁটে উঠতে কষ্ট হয়। ও কিন্তু দ্রুত গতিতে উঠছে। টর্চের আলোয় ওর চোখ দু’টো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। মুখে সেই প্রাণকাঁপানো আওয়াজ। শিলালিপির কাছে আবার আলো জ্বলল। ‘আঁ আঁ আঁ…’ করে চিৎকারটাও শোনা গেল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলুম।

জ্ঞান ফিরল গেস্টহাউসের বিছানায়। রাজা উদ্বিগ্ন মুখে চেয়ে আছে। রাতে আমরা না ফেরাতে ও ভোরবেলায় তাপসদাকে তুলে সব কথা বলে। উনি লোকজন নিয়ে গিয়ে আমাদের সকলকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেন। কিন্তু অয়নদাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ শুধু শিলালিপির কাছে দু’জায়গায় পোড়া দাগ পেয়েছে। রাতে সেই আগুন জ্বলার দাগ।

আবার বাঁকুড়া স্টেশন। খবর পেয়ে আমাদের বাড়ির লোকেরা এসেছে। শুধু নেই অয়নদা। পুলিশ এবং একটা ‘রক ক্লাইম্বিং’ দলের লোকেরা তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি।

কোনও চিহ্ন না রেখে অয়নদা যেন উবে গেল!

ছবিঃ অংশুমান

 জয়ঢাকের গল্প ঘর