ওহ আচ্ছা আচ্ছা…
শুভজিৎ বরকন্দাজ
ছোট্ট মেয়ে টুসকি। যেন ছোট্ট্ পুতুলটি। সক্কলের খুব আদরের। রোববারের সারাটা সকাল ধরে একমনে সে একটা ভারি সুন্দর ছবি আঁকল। ফুটফুটে জোছনারাতের ছবি। নীল রঙের আকাশ আর হলদে সাদা জোছনা যেন গড়িয়ে পড়ছে আঁকার পাতায়। এবার কী চাই! কী চাই…!
হুঁ হুঁ… একটা সুন্দর ফুটফুটে ডানামেলা পরি চাই।
চাই বললে চলবে কেন! চাই-ই… চাই। তাই খুব মন দিয়ে একটা পরি আঁকল টুসকি। টানা টানা চোখ। ধবধবে নীল-সাদা ফিনফিনে তার পোশাক। মা যেমনটি বলে, ঠিক সেই গল্পের পরিটার মতোই। কী মিষ্টি তার হাসি!
পরি আঁকা হতেই চোখ পিটিয়ে পরিটা হেসে উঠল মিষ্টি করে। টুসকিকে বলল, “টুসকি সোনা, তোমার যেমন মা আছে, আমারও তেমন খুব ছো্ট্ট্ ছোট্ট্ ফুটফুটে কত মেঘ-পরি ছানা আছে। তাদেরকে আমার কাছে এনে দিলে না যে!”
“ওমা! তোমার ছানা?”
“হ্যাঁ গো, হ্যাঁ… জোছনাপরি আদর করে টুসকির রেশম-চুলে হাত বুলিয়ে দিল।”
“আহা! তাদের কথা কি তোমার খুব মনে পড়ছে? তাহলে তো আনতেই হয়। নইলে যে খুব কষ্ট্ হবে তোমার গো!”
টুসকির কথায় জোছনাপরি খুব মিষ্টি করে হেসে টুসকির গাল টিপে আদর করে দিল, “হুঁ সোনা, চাই-ই চাই। আমার ছোট্ট্ মেঘপরিদের এনে দাও দিকি!”
টুসকি তখন দু’চোখ বুজে মেঘছানাদের খুঁজতে থাকল, “কই গো কই! মেঘছানারা কই! কোথায় যেন, কেমন যেন!”
“ওহ, আচ্ছা! আচ্ছা!” বলতে বলতেই দল বেঁধে মিষ্টি হেসে গান গাইতে গাইতে এসে হাজির হল পুচকু পুচকু মেঘপরিদের দল।
তাদের দেখে জোছনাপরি খুব খুশি। টুসকিও খুশি। খুব মন দিয়ে সে সাজিয়ে দিল মেঘপরিদের। টানা টানা কাজল-চোখ দিল। চুলে লাল-নীল ফিতে দিল। গায়ে ফিনফিনে জরির ডানা দিল। সক্কলে মিলে দল বেঁধে সে কী হুটোপুটি তাদের! মা-পরির তাই দেখে মুখে হাসি আর ধরে না। ছানাপরিরাও খুশি। টুসকিও হাসল খিলখিলিয়ে।
কিন্তু এ ছবি তো বাবাকে গিয়ে দেখানো চাই! যেমন ভাবা তেমনি কাজ! টুসকি গেল দৌড়ে তার বাবার ঘরে, “বাবা বাবা… দ্যাখো দ্যাখো…আমার জোছনাপরি আর মেঘপরিদের দ্যাখো।”
বাবার কি আর দেখার সময় আছে! বাবা বসে মুখ গুজেঁ তার কম্পিউটারে। টুসকির ছবি ভালো করে না দেখেই মাথা নেড়ে বলল, “ছবি একেঁছো! ওহ, আচ্ছা! আচ্ছা!”
ইসস্…বাবাটা ভারি দুষ্টু! ছবিটা না দেখেই বলল, আচ্ছা আচ্ছা! টুসকি গেল এক দৌড়ে রান্নাঘরে। মাকেও তো দেখানো চাই!
মারও কি দেখার সময়! মা তখন সকালের জলখাবার বানাতেই হিমসিম। ঘেমে নেয়ে একসা। পরোটা তো ভাজা হয়েছে। এবার মাংসটাও রাঁধতে হবে কষে! মশলা কই! মশলা কই! বলতে না বলতেই টুসকি হাজির তার জোছনাপরি আর মেঘপরিদের দল জুটিয়ে।
মাও তার হাতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে কোনরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলক দেখেই হেসে বলল, “ছবি এঁকেছ? ওহ, আচ্ছা! আচ্ছা!”
ইসস্… মা’টাও কেমন! ভারি বাজে! ছবি না দেখেই বলল, আচ্ছা আচ্ছা! ভারি রাগ হল টুসকির। আলাপই করল না তার বন্ধুদের সাথে! দু’গাল বেয়ে জল নামল ফোঁটায় ফোঁটায়। যাও তো যাও…. সবার সাথেই আড়ি। আড়ি আড়ি আড়ি।
মনখারাপ করে টুসকি এল পড়ার ঘরে। সেখানে আছে তার মুন্নি পুতুল, মিঞাঁও মশাই আর গজক সাহেব। মুন্নি পুতুল টুসকির নতুন সাথীদের দেখে ভারি খুশি। চোখ পিটিয়ে ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকালো। তারপর ঝিকিয়ে উঠে বলল, “এস এস। বোস বোস! কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য!”
মিঞাঁও মশাই ভীষণ ভারিক্কি হয়ে গলা ঝাড়ল। তারপর বলল, “এসেছ তোমরা?বেশ!বেশ!”
গজকসাহেব তো একটা মোটুরাম হাতি। হেলতে দুলতে তার চব্বিশটি ঘন্টা পার। জোছনাপরি আর মেঘপরিদের দেখে শুঁড় তুলে নমস্কার করে বলল, “খবর ভালো তো?”
তো সব্বার সাথেই ভাব। কী মজা! কী আনন্দ্!
এতক্ষণ জোছনাপরির মুখে কথাই ছিল না। কেবলি মিটমিটিয়ে হাসছিল। এবার একে একে তার মেঘপরিদের সাথে সবার আলাপ করিয়ে দিল। তারপর বলল, “চল তাহলে, তোমাদের সব্বাইকে একবার মেঘের রাজ্যখানা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
কী মজা! কী মজা! আহা! আহা! চলো চলো! সব্বাই চলো!
কিন্তু টুসকি পড়ল মহা ভাবনায়, “আমি তো উড়তে জানি না। মুন্নিপুতুল, মিঞাঁও মশাই, গজকসাহেব— কেউই তো উড়তে জানে না। আমরা যাই কী করে!” টুসকির মুখে মেঘ নামল।
জোছনাপরি মিষ্টি হেসে টুসকির ছোট্ট্ চিবুক ছুঁয়ে বলল, “আহা! এমন মিষ্টি মেয়ে তুমি! মনখারাপ করলে কি চলে! আমি তো আছিই! চলো চলো…! তোমাদের সব্বাইকে নিয়ে যাব মেঘের দেশে। সেখানে এখন জোছনারাত…চলো চলো…চলো শিগগির!”
বলতে বলতে থোকা থোকা সাদা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ভেলা এসে হাজির। কাশফুলের দাঁড় বেয়ে সেই ভেলা ঠেলে নিয়ে এল এত্তটুকুনটুকুন খুদে চেহারার মেঘবালকের দল।
আহা! দেখেই চোখ জুড়োলো। খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল টুসকি। মিঞাঁও মশাই খুশিতে বলে উঠল, মিয়াঁওওও…! গজকওসাহেব খুশিতে শুঁড় দোলালো, ওঁয়াওওওও…!
দেখতে দেখতে চোখের পলক পড়তে না পড়তে সক্কলে এসে হাজির হল মেঘপরিদের দেশে। যত উপরে উঠছে ভেলা, টুসকির গায়ে জোছনা ঝরে পড়ছে গুঁড়ো গুঁড়ো। গায়ের রং কী সুন্দর চাঁপা ফুলের মতো হয়ে যাচ্ছে ওর। ইসসস্… কি সুন্দর! টুসকির মুখে আর হাসি ধরে না।
জোছনাপরি মেঘরাজ্যের সকলকে ডেকে ডেকে বললে, “শোন শোন, এই আমাদের টুসকি সোনা। আর এরা ওর বন্ধুরা। সক্কলে খুব আদর করবে ওদের। যত্ন করবে কিন্তু! সবাই মাথা নেড়ে বললে, “সে কী কথা! করব না কেন? নিশ্চয়! নিশ্চয়!”
এবারে খাওয়াদাওয়ার পালা। কত্ত সুন্দর সুন্দর খাবার এল টুসকিদের জন্যে। মেঘের থালায় এল মিহি সোনপাপড়ির মতো জোছনার গুঁড়ো। একটু মুখে তুলতেই কী অমৃত স্বাদ! মনটা ভরে যায়। মুখ ধোওয়ার জন্যে পদ্মপাতায় এল মিঠি জল। সে কী ভারি ঠান্ডা জল! আর সেসব পরিবেশন করছে ফুটফুটে সব মেঘ-মেয়েদের দল। চুলের খোঁপায় তাদের কাশফুলের পালক গোঁজা।
টুসকি জোছনাপরির কোলে বসে তার চিবুক ছুঁয়ে বলল, “তোমাদেরও কি ফ্রিজ আছে গো? ভারি ঠান্ডা তোমাদের জল।”
জোছনাপরি হাসতে হাসতে বলল, “না গো মেয়ে না! আমরা এখানে মেঘ জমিয়ে জমিয়ে বরফ বানাই আর তা দিয়ে জল ঠান্ডা রাখি।”
মিঞাঁওমশাই উসখুস করছিল আর চারিদিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। তা দেখে মেঘপরিরা বলল, “কী গো মিঞাঁও মশাই, তোমার কী পেট ভরল না?”
মিঞাঁওমশাই ইয়াব্বড়ো ঢেঁকুর তুলে মুখের সামনে তিনটে তুড়ি মেরে বলল, “নাহ! আসলে আমি তো খুব মাছ, মাংস খাই; তা এখানে বুঝি মাছ মাংস মেলে না?”
তা শুনে জোছনাপরি মনখারাপ করে বলল, “উঁহু, আমরা তো কাউকে কষ্ট দিই না। আর কাউকে হত্যাও করি না। আমরা সবাই এখানে বরফজল আর জোছনাগুঁড়ো খেয়েই থাকি।”
জোছনাপরির কথায় টুসকি ভারি খুশি হল। তাইতো তোমরা এত্ত সুন্দর! তোমরা এত্ত মিষ্টি। আমিও আর কাউকে মারব না। কক্ষণও কষ্ট দেব না। মাছ মাংসও খাব না…কক্ষণও না…!”
বলতে না বলতেই মেঘের ওদিক থেকে কে যেন ডেকে উঠল টুসকির নাম ধরে। ভারি চমকে উঠে টুসকি চাইল চোখ বড়ো করে।
ওম্মা! এ যে মা!
হাতে গরম পরোটা আর মাংসের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা। আর হেসে বলছে, “ঘুমিয়ে পড়েছিলি সোনা মা? কার সাথে বলছিলি, মাছ খাবি না, মাংস খাবি না? কীরে? ওরে পাগলি, তোর জন্যেই তো বানিয়েছি পরোটা আর মাংস। তুই-ই তো খেতে ভালোবাসিস মা!”
টুসকির বুকের মধ্যে ছোট্ট দু’হাতে তখনও আঁকড়ে ধরা ছিল আঁকার খাতাটা। সেখানে এখন শুধু মেঘ আর মেঘ। মিঞাঁওমশাই আর গজকসাহেব উপুড় হয়ে পড়ে আছে বিছানার ওপর। মুন্নিপুতুল বালিশে আধশোয়া।
মা তখনও বলছে, “খেয়ে নে সোনা! খেয়ে নে লক্ষ্মীটি!” টুসকি ছবির দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখল মেঘপরিরা সকলেই মিলিয়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে। জোছনাপরিও মিলিয়ে যেতে যেতে বলছে, “ওহ, আচ্ছা! আচ্ছা!”
ছবিঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের গল্পঘর