টাইম মেশিন ঠগির আত্মকথা অলবিরুণী বসন্ত ২০১৬

আগের পর্বগুলো এইখানে

।২৬।

এরপর চারদিন ধরে আমরা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম হয়ে এগিয়ে চললাম। পঞ্চম দিন সকালে অবশেষে সাগরে রেখে আসা গুপ্তচরদের মধ্যে একজন এসে আমাদের সঙ্গ ধরল। বলে, “পীর খান সাহেব সালাম দিয়েছেন, আর বলেছেন আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। বুনিজ (শিকার) খপ্পরে এসে গেছে। শহর ছাড়বে সামনেই।”

“লোকটার কোন পরিচয় জানো?”

“না মীর সাহেব। আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ জেমাদারসাহেবের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই অনেক কথাবার্তা বলতে দেখেছি। উনি জানতে পারেন।”

“ঠিক আছে। এখন একটু হাত পা খেলিয়ে নাও, তারপর রওনা দেয়া যাবে। সাগর এখান থেকে ঠিক কতদূর হবে বলো তো?”

“আজ্ঞে চোদ্দ ক্রোশ। তবে আমি একটা রাস্তা দেখেছি যেটা দিয়ে তার অর্ধেক রাস্তা হাঁটলেই সাগরে গিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে।”

“তার মানে সেখান দিয়ে গেলে আজ সন্ধের মধ্যে শহরে পৌঁছে যাবো, তাই তো?”

“সন্ধেও লাগবে না। দুপুরের মধ্যেই নিয়ে গিয়ে ফেলবো দেখবেন।”

লোকটা আমাকে এমন একটা জঙ্গুলে রাস্তা ধরে নিয়ে গেল যে সে না থাকলে আমি সে রাস্তাটা হাজার চেষ্টা করলেও চিনতে পারতাম না। সাগর পৌঁছে আমি তাড়াতাড়ি পীর খানের সেই ভুতিয়ারার দোকানে গিয়ে উঠলাম। পীর খান  সেখানে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠে এসে বলল, “যাক। পৌঁছে গেছেন। আমার ভয় হচ্ছিল খবরটা বুঝি আর ঠিক সময় পৌঁছোলই না।”

পাশে দাঁড়ানো দোকানদারের দিকে দেখিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ইনিই খবরটা দিয়েছেন, তাইতো?”

দোকানদার তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এসে বলল, “আজ্ঞে। সেবকের নাম পেরু।”

“কী মনে হয়, ভালো বুনিজ হবে নাকি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার হিসেবমত সাত-আট হাজার টাকা তো পাবেনই।”

লোকটা নিজের কাজটা ভালো বোঝে বলে মনে হচ্ছিল। প্রশ্ন করলাম, “কাজ তো ভালোই বোঝ। তা দলে ভিড়ে যাওনা কেন?”

সে হেসে মাথা নেড়ে বলল, “সে চেষ্টা করে দেখেছি। গণেশ জেমাদারের দলে ছিলাম কিছুদিন। চেনেন নাকি গনেশ জেমাদারকে?”

“তা চিনি বইকি। নাম আছে লোকটার।”

“সে নামটাম যা-ই থাক না কেন, লোক কিন্তু সুবিধের নয়। লোকজনের সঙ্গে যা ব্যবহার করত!সাক্ষাত শ্মশানের কুকুর একটা। বারদুয়েক ওর সঙ্গে বেরিয়ে শেষমেস আর ভালো লাগলো না বলে ধান্দা ছেড়ে এখন দোকান দিয়ে বসেছি একটা। মাঝেমধ্যে আপনাদের মত দুএকজন সজ্জন এ পথে এলে দেখাসাক্ষাত হয়। সকলেই কিছু কিছু দিয়ে যান। তাতেই যৎসামান্য রোজগার হয় ওই যা।”

আমি তাকে ফের একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললাম, “রোজগার তো তোমার খারাপ হয় না বলেই মনে হচ্ছে। ঠগির পয়সার বখরা নিয়ে বেশ ভালোই আছ! ভয়েভক্তিতে কিছু না কিছু দিয়েই যায় সবাই, তাইতো?”

সে সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে বলে, “ছি ছি কী যে বলেন? অধম আপনাদের দীন সেবক–”

তার চালাকি ভরা চোখদুটোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললাম, “কাল তাহলে ভোর ভোর রওনা হচ্ছি, তাইতো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। সাহুকার যাবে জব্বলপুর। আপনারা আগে আগে বেরিয়ে একটু এগিয়ে থাকুন, যাতে পথে বেরিয়েই আপনাদের না দেখে ফেলে। তাহলে ঘাবড়ে গিয়ে ফিরেও আসতে পারে। এ রাস্তায় কিছুদিনের মধ্যে বেশ ক’জন নামিদামি লোক গায়েব হয়ে গেছে বলে খবর আছে।”

“তাই হবে,” এই বলে পীর খানের দিকে ঘুরে বললাম, “চলো হে পীর খান। এখানে আমাদের কাজ শেষ।”

ঘাঁটিতে ফিরে পীর খান বলে, “অল্প সময়ের মধ্যে লোকটার চরিত্রটা ভালো বুঝে ফেলেছেন মীর সাহেব। কাজে দক্ষ হলেও লোকটা সুবিধের নয়। সব ঠগিরাই ওকে একটু সমঝে চলে। কখন কার কথা কোথায় ফাঁস করে দেয়! সাগর দিয়ে যে ঠগির দলই যাক না কেন, এই পেরুকে ভুতেরা খানিক সেলামি দিয়ে যেতেই হয় তাদের। ওই করে পয়সাও করেছে মন্দ না।”

শুনে আমি বললাম, “তাহলে তো একে ছেড়ে দেয়া যায় না পীর খান। একটা লোক কোন কাজ না করে, কেবল ঘরে বসে বসে ঠগির খাটুনির পয়সায় মোটা হচ্ছে, এ চলতে দেয়া যায় না। একে নিকেশ করে দেয়া যাক,কী বলো?”

পীর খান মাথা নেড়ে বলল, “কথাটা ঠিক, তবে লোকটা বেজায় ধূর্ত। দিনের আলোয় ছাড়া বাইরে বের হয় না। বড়ো দল দেখলে কাছে যায় না। একে বের করে আনবে কী করে?”

“সে তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। লোকটা টাকা ভালোবাসে তো?”

“প্রাণের চেয়েও বেশি।”

“তাহলে আর কোন সমস্যা নেই। দেখে যাও শুধু ব্যাটাকে কেমন একটা টোপ দিই,” এই বলে আমার এক বিশ্বস্ত  ছোকরাকে ডেকে বললাম, “জংলি, তুই পেরু ভুত্তেরাকে চিনিস?”

সে মাথা নাড়ল, “খানিক আগে আপনি যার সঙ্গে কথা বলছিলেন সেই লোকটা তো? আমি আটা কিনতে বাজারে গেছিলাম। তখন দেখলাম। ওকে তো ভালো করেই চিনি মীরসাহেব। ওর বাড়িও জানি।”

“ঠিক আছে। তাহলে এক দৌড়ে ওর কাছে যা। গিয়ে বল, একবার এসে আমার সঙ্গে যেন দেখা করে এক্ষুণি। বলবি, ভালো খবর দিয়েছে। কাজ হবেই। কিন্তু আমরা আর এ রাস্তা দিয়ে শিগগির ফিরছি না। কাজেই ওর টাকাটা আগেই মিটিয়ে দিয়ে যেতে চাই একেবারে। নইলে কবে টাকা পাবে ঠিক নেই। কী রে, সব গুছিয়ে বলতে পারবি তো?”

“পারবো না মানে? শুনে নিন একবার–” এই বলে সে আমি যা যা বলেছিলাম সব গড়গড় করে বলে গেল।

বললাম, “বেশ। আমার এই শিলমোহরের আংটিটা সঙ্গে করে নিয়ে যা। নইলে তোকে বিশ্বাস করবে না। হারাস না যেন। আর শোন, যা বলবি রামাসিতে বলবি। ও রামাসি বলতে পারে।”

জংলি আংটিটা হাতে নিয়ে এক দৌড়ে চলে গেল। তারপর বেশ অনেকটা সময় কেটে যাবার পরেও যখন সে ফিরছে না দেখে আমি একটু উতলা হয়ে পড়েছি তখন সে দেখি দৌড়োতে দৌড়োতে আসছে।

বললাম, “কী রে? দেরি কেন?”

সে বলে, “বলছি। কাজ হয়ে গেছে। আগে একটু জল খাই। এতটা রাস্তা দৌড়ে এসেছি-”

জলটল খেয়ে একটু ঠান্ডা হয়ে সে বলল, “আমি আসলে গেছি বেশ আস্তে আস্তে হেঁটে। বেশি তাড়াহুড়ো করে হাঁফাতে হাঁফাতে গেলে লোকটা যদি সন্দেহ করে! গিয়ে দেখি পেরু দোকানে বসে খদ্দেরদের জন্য কাবাব ভাজছে। আমি কাছে গিয়ে আংটিটা দেখাতে সে আমায় পেছনের ঘরে গিয়ে বসতে বলল। খানিক বাদে হাতের কাজ সেরে সে এলে আমি তাকে যা যা শিখিয়ে দিয়েছিলেন সব বললাম। লোকটা দেখি বেজায় উত্তেজিত হয়ে ভুরুটুরু কুঁচকে ঘরের মধ্যে ক্রমাগত পায়চারি করছে আর বিড়বিড় করে কীসব বলছে। খানিক অপেক্ষা করে আমি শেষে বললাম, ‘যা ঠিক করবেন তাড়াতাড়ি করেন। আমায় ফিরতে হবে।’

“শুনে সে পায়চারি করা থামিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মালিক যখন তোকে পাঠাল তখন তার সঙ্গে কে কে ছিল?’

“আমি বুদ্ধি করে বললাম, ‘কেউ না। মালিক শুয়ে পড়েছিলেন। আমি মালিকের দরজার কাছে শুই। আমাকে ডেকে নিয়ে আপনাকে খবরটা দিতে বললেন।’

“সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাঁবুতে আর কে কে ছিলো?’

“আমি বললাম, ‘আর কেউ না। মালিক রাতে একাই থাকেন। একটা বড়োসড়ো চামড়ার থলে থেকে টাকা বের করে করে গুনছিলেন।’

“‘থলেটায় কত টাকা ছিল দেখেছিস?’

“বললাম, ‘উঁহু। আড়াইশো টাকা অবধি গুণে বাইরে সাজিয়ে রেখে বললেন, এতেই হয়ে যাবে এর। থলেতে তখনো আরো অনেক টাকা ছিল।’”

“তারপর?”

“তারপর বেটা আবার খানিক পায়চারি করে হঠাৎ আমার কাছে এসে বসে আমার একটা হাত ধরে বলে, ‘তুই তো খুব চালাক ছেলে রে জংলি? তোকে আমার খুব ভালো লেগেছে, বুঝলি?’

“আমি তাড়াতাড়ি আমার অন্য হাতটা জামার তলায় রাখা ছুরিটার ওপরে রাখলাম। লোকটাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে লোকটা আবার মিষ্টি গলায় বলল, ‘শোন জংলি, তোকে এরা আদরযত্ন বিশেষ করে না নারে?’

“আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘উঁহু।’ শুনে সে বলে, ‘তোকে আমার এত ভালো লেগে গেছে যে কী বলব। তুই আমার কাছে এসে থেকে যা। আমার বউ-বাচ্চা কিছু নেই। তোকে আমি নিজের ছেলের মতো রাখব। তারপর বড়ো হয়ে তুই আমার মত ভুত্তেরা হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে খাবি। এই ঠগির দলের সঙ্গে মিশে মানুষ মারার কাজ আর করতে হবে না। কী রে? থাকবি আমার কাছে?’

“আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখন সে বলে, ‘তাহলে শোন। আমি এখন তোর মালিকের কাছে যাব না। তুই তো তোর মালিকের দরজায় শুয়ে থাকিস রাত্রে। তাঁবুতে তোর মালিক ছাড়া আর কেউ থাকে না। মালিকের নুন খেলি এতদিন, তাই তোকে কিচ্ছু করতে বলবো না। রাত দুই প্রহর পার হলেই  আমি তোদের আড্ডায় গিয়ে তোর মালিকের তাঁবুতে ঢুকব। তুই তখন শুধু আফিমখোরর মত ঘুমিয়ে থাকবি। জাগবি না। আর কিচ্ছু করতে হবে না তোকে। আমি তোকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকে—বুঝলি তো?’

“বললাম, ‘হ্যাঁ, বুঝেছি। গোটা থলেটাই আপনার হয়ে যাবে।’

“ ‘এই তো, ঠিক বুঝেছিস। আমি চলে আসবার পর সুযোগ বুঝে দল ছেড়ে পালিয়ে আমার কাছে চলে আসবি, ব্যস।’

“ বললাম, ‘কিন্তু ঘাঁটির বাইরে যে পাহারা থাকে?’

“ ‘দূর বোকা। আমি জামাকাপড় খুলে একটা কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে যাবো। কেউ আমায় দেখতেই পাব না।‘

“আমি বললাম, ‘আমি রাজি। পাজি লোকগুলোর হাত থেকে ছাড়ান পেলে আমি বেঁচে যাই।

“ ‘বেশ বেশ। এখন গিয়ে তোর জেমাদারকে বল, আমি বলেছি, আমি ওসব কথায় ভুলে মোটেই তার ডেরায় যাচ্ছি না। শিকারী যখন আদর করে ভেড়া মেরে ফাঁদ সাজিয়ে রাখে, নেকড়ে তখন মোটেই সেদিকে পা বাড়ায় না।  তাহলেই হবে। আর রাতের বেলা—মনে থাকবে তো?’ ”

তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে আমি বললাম, “দারুণ কাজ করেছিস রে জংলি। কী হে পীর খান? শুনে কী মনে হল? ”

পীর খান হেসে বলল, “রাতে খেল জমবে।”

“সে তো জমবেই। এখন দুটো নজরদারকে ডাকো।“

দুজন নজরদার আসতে আমি পেরুর ষড়যন্ত্রের কথা তাদের খুলে বলে বললাম, “তোরা লুকিয়ে নজর রাখবি লোকটা কখন আসে। আমার তাঁবুতে যখন ঢুকবে, কোন বাধা দিবি না। দুজন দরজার দুধারে অপেক্ষা করবি। লোকটা থলে নিয়ে বের হতে যাবে যখন তখন চেপে ধরে ফেলবি। আমি উঠে না আসা অবধি মারপিট কিচ্ছু করবি না। আর জংলি, তুই, ঠিক যেমন বলেছে পেরু সেইভাবে যদি চুপচাপ মটকা মেরে না থাকিস তাহলে তোকেও কিন্তু ওর সাথে এক কবরে পাঠিয়ে দেব এই বলে দিলাম। পীর খান তাঁবুর পেছনেই বাইরে লুকিয়ে থাকবে। লোকটা তাঁবুতে ঢুকলে চুপিচুপি উঠে তাকে খবরটা দিয়ে দিবি শুধু।”

জংলি মাথা নেড়ে বলল, “কিচ্ছু ভাববেন না মীরসাহেব। এতদিন আপনার নুন খেলাম! যেমন বলবেন অক্ষরে অক্ষরে শুনব।”

*******

সে রাতটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। ঘাঁটির পাশে ঝিলের জলের ছলছল শব্দ শুধু শোনা যায়। রাত দু প্রহরের মুখমুখ সব দেখেশুনে ঠিকঠাক করে রেখে আমি গিয়ে আমার ঘরে শুয়ে পড়লাম।  একটা কম্বল মাথায় মুড়ি দিয়ে তার নিচে তলোয়ারটাকে খুলে হাতের কাছে রেখে আমি কম্বলের ফাঁক দিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিশ্চিন্ত ছিলাম, এমন অন্ধকার রাতের সুযোগ চোরটা ছাড়বে না। টাকার থলে চুরি করতে আসবেই।

দুপ্রহরের খানিক বাদে সে এল। দরজার কাছে একটা গাঢ় অন্ধকারের টুকরোর মত একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে  তারপর নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে এসে প্রথমে আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করে নিল আমি সত্যি ঘুমিয়ে আছি কি না। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল তলোয়ারটা সোজা ওর বুকে বিঁধিয়ে দিই। লোভটা অনেক কষ্টে আটকে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলাম চুপচাপ। খানিক বাদে আমার বালিশের নিচে সে হাতটা ঢুকিয়ে দিল। এত আস্তে ঢুকিয়েছিল সে হাতটা যে সত্যিই যদি ঘুমিয়ে থাকতাম আমি তাহলে টেরও পেতাম না। থলেটা কিন্তু ছিল বালিশে অন্যধারে। তার ওপরে মাথা রেখে আমি শুয়েছিলাম। লোকটা একটুক্ষণ অপেক্ষা করে একটুকরো ঘাস বের করে আমার কানে আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো।

timemachonethogi (Medium)

আমি, যেন ঘুমের মধ্যেই, ভারি বিরক্তির একটা শব্দ করে মাথাটা এদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। এইবার টের পেলাম সে থলেটার নাগাল পেয়েছে। আ-স্তে, ভীষণ আস্তে–একটু একটু করে থলেটা আমার বালিশের নিচ থেকে টেনে নিয়ে কাঁধে ফেলল সে। অন্ধকারে তার ভেতরে ভর্তি টাকার ঠুনঠুন শব্দ হল একটু। তারপর আমায় ছেড়ে উঠে দরজার দিকে চোখ পড়তেই সে খেয়াল করল, জংলি সেখানে আর নেই। একটু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর তাঁবুর দরজার দিকে যেতে যেতে নিজের মনেই বিড়বিড় করে সে বলল, “ব্যাটার তর সয় না। এখুনি ঘাঁটি ছেড়ে ভাগবার কী দরকার ছিল? দিনকয় পরেও তো-”

 বলতে বলতেই তাঁবুর দরজার মুখে পৌঁছে গিয়েছিল সে। দরজার বাইরে যে পা বাড়িয়েছে অমনি মুখের কথাটা শেষ না হতেই  থেকে পীর খান, মোতি্রাম আর বাকিরা মিলে তাকে চেপে ধরে ফেলেছে।

“দারুণ কাজ হয়েছে,” বলে হাঁক দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, “একটা বাতি জ্বালাও কেউ। ঠগির ঘরে চুরি করবার মত বুকের পাটা কোন রুস্তমের তার মুখটা একবার দেখা যাক!”

সঙ্গে সঙ্গে একটা আলো জ্বালিয়ে নিয়ে আসা হলে দেখা গেল, পেরু, কাঁধে আমার টাকার থলেটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে।

বললাম, “কী রে? নেকড়ে নাকি শিকারির টোপ খায় না? সেই তো শেষে টোপ গিললি! যা করেছিস তাতে তোকে বাঁচতে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু আমার প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব যদি দিস তাহলে আমি একবার ভেবে দেখতে পারি।”

বেচারা বেজায় ঘাবড়ানো গলায় বলল, “যা জানতে চাইবেন সব বলব। শুধু আমায় প্রাণে মারবেন না। মারুন ধরুন, সঙ্গে করে নিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে দিন, যা ইচ্ছে করুন। কথা দিচ্ছি এই সাগর শহরে আমি আর কখনো পা রাখব না।”

“ঠিক আছে। প্রথমে বল, যে বুনিজের খবরটা দিয়েছিস সেটা সত্যি খবর না মিথ্যে?”

“একেবারে সত্যি মীর সাহেব। আপনার নজরদাররা নিজেচোখে ওদের তৈরি হতে দেখে এসেছে আজ রাতে। কাল সকালে ওরা রওনা হবে।”

“ছাড়া পেতে হলে তোকে দু হাজার টাকা এনে দিতে হবে আমাদের। এক্ষুণি। দিবি?”

সে হাত কচলাতে কচলাতে বলে “অত টাকা আমি পাব কোথায় মীরসাহেব? আমার কাছে একটা ফুটো পয়সা পর্যন্ত নেই।”

“মিছে কথা বলবি না একদম,” পীর খান আর মোতিরাম চিৎকার করে উঠল, “বছরের পর বছর এ তল্লাটে যত ঠগির দল এসেছে তাদের থেকে তোলা তুলে তুলে কত হাজার টাকা তুই জমিয়েছিস তার হিসেব আছে?”

আমি আমার রুমালটা তাকে দখিয়ে বললাম, “এটা দেখছিস তো? এটা কীভাবে কাজ করে তা-ও তোর জানা। টাকাটা দিবি কিনা বল।”

অমনি সে কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “দেবো , দেবো। আমার সঙ্গে চলুন, আমি এক্ষুণি টাকা বের করে দেবো আপনাদের।”

আমি হেসে বললাম, “আচ্ছা দ্যাখ, তোকে যে পাকড়াও করতে পেরেছে তার বুদ্ধি তোর থেকে বেশি সেটা মানবি তো? তাহলে এমন বোকার মত কাজ আমি করব আর তোর সাথে গিয়ে নিজেদের ধরিয়ে দেব সে কথা তুই ভাবলি কী করে বল তো? টাকা চেয়ে আমি মজা করছিলাম সেটাও বুঝলি না? এবার আসল প্রশ্নটার জবাব দে। তোর জমা টাকাপয়সা সব কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তার ঠিকানাটা দে।”

শুনে গম্ভীর হয়ে সে বলে, “মেরে ফেললেও সে কথা আমি আপনাদের বলব না মীর সাহেব।”

“ভালো, ভালো। দম যখন বন্ধ হয়ে আসবে তখনও দেখি জেদটা থাকে কি না। এই,ধর দেখি এটাকে।”

জনাদুয়েক লোক মিলে তাকে চেপে ধরতে আমি রুমালটা তার গলায় দিয়ে খানিক পাক দিয়ে প্রাণে না মেরেই ফাঁস আলগা করে দিলাম। সে দেখি দমবন্ধ হয়ে গিয়ে ধুঁকছে। খানিক জল দিতে ঢকঢক করে সেটা খেয়ে নিয়ে সে আবার আমার পায়ের ওপর পড়ল এসে। একটা লাথি মেরে পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “টাকাপয়সা কোথায় রেখেছিস সেটা এখনো বলে দে, নইলে আরেকবার রুমাল পরাব কিন্তু।”

“আগে কথা দিন, টাকাপয়সা পেলে আমায় ছেড়ে দেবেন?”

“সে দেখা যাবে। আগে জায়গাটা কোথায় বলে দে। আমার লোকজন গিয়ে সব টাকাপয়সা উঠিয়ে নিয়ে আসবে। এখান থেকে তুই কোথাও নড়বি না। তোর মত একটা চোরকে নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করতে চাইনা আমি।”

খানিক ভেবেচিন্তে মাথা তুলে সে বলল, “মোতি্রাম, শেষবার যখন গণেশের দলের কাজ ছেড়ে আমি ফিরলাম, তখন তুমিও তো ছিলে আমার সঙ্গে। মনে আছে, একটা আমগাছের কোটরে আমি আমার হিস্যার টাকাপয়সা লুকিয়ে রেখেছিলাম? জায়গাটা তো তুমি চেনো?”

মোতিরাম মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

“ওই আমগাছের কোটরটার ভেতরে আরো হাতখানেক খুঁড়লেই আমার সব জমা সোনাদানা, টাকাপয়সা পেয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ রে বদমাশ, এবারে কোথায় যাবি?” আমি হাসতে হাসতে বললাম, “ভবানীর সেবক ঠগিদের অনেক রক্ত  শুষেছিস তুই। ভবানী তাই তোকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন নিজে। তাঁর আদেশে আজ তোর শাস্তি হবে আমার হাতে। আমি আমার কথা রাখব। এখান থেকে কোথাও নড়বি না তুই আর। ওই দ্যাখ, তোর কবর খোঁড়া হয়ে র‍য়েছে আজ সন্ধে থেকে–” বলতে বলতে আমি তার মুখে থুতু ফেললাম। দেখাদেখি তাকে ঘিরে রাখা দলের বাকিরাও তার মুখে থুতু ফেলতে শুরু করল। একটু বাদে আমি বললাম, “এটাকে আর একবার চেপে ধর, আর তামাক নিয়ে আয়।”

এই ঝিরনি দেবার ব্যাপারটা পেরুর অজানা ছিল না। নিজেকে ছাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু অতজনের সঙ্গে একা সে পারবে কেন? কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার মৃতদেহটা মাটিতে আছড়ে পড়ল।

আমি মোতিরামের দিকে ফিরে বললাম, “জনাদশেক লোক নিয়ে গিয়ে তুমি গাছটা খুঁজে দেখ। বদমাশটা মরার আগে সত্যি কথা বলে থাকলে বেশ কিছু নগদ হাতে আসবে আমাদের।”

মোতিরাম বেরিয়ে গেলে লোকজন পেরুর শরীরটাকে নিয়ে পুঁতে দিয়ে তার ওপরের মাটি সমান করে দিল।

শেষরাতের দিকে মোতিরাম একগাদা সোনাদানা, গয়না আর টাকাপয়সা নিয়ে ফিরে এল। সব মিলিয়ে প্রায় হাজারতিনেক টাকার জিনিস। জিনিসগুলোর সবই নানা সময়ে ঠগিদের কাছ থেকে আদায় করা। মোতিরাম,পীর খান আর দলের আরো অনেকে তার মধ্যে অনেক জিনিস চিনতেও পারছিল।  সোনাদানার গয়নাগুলো গলিয়ে ফেলে আমরা দলের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিলাম। সে যাত্রা বাড়ি ফেরা অবধি সে টাকায় আমাদের সবার পথখরচা ভালোভাবে চলে গিয়েছিল।

পরদিন সকালে আড্ডা ছেড়ে পথে বের হয়ে খানিক দূর গিয়ে যখন প্রথামাফিক শিকারের পরে সবাই মিলে গুড়প্রসাদ খাচ্ছি তখন আমাদের এক নজরদার সাগর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিল, সাহুকার আর তার দল সেখান থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছে। আরো জানা গেল, ‘ভিখারি’ নামে আমাদের আর এক নজরদার সাহুকারের দলে রাতপাহারার দারোয়ানের চাকরি জুটিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। দলে আছে তিনটে টাট্টু। তার একটায় সাহুকার চড়েছে, আর দুটোয় তার মালপত্র চাপানো হয়েছে। সাহুকার আর ভিখারি ছাড়া দলে আছে আরো চারজন লোক।

সব শুনেটুনে আমি হুকুম দিলাম, জায়গাটা ছেড়ে এগিয়ে চলতে হবে। সাহুকার যেন লোকালয়ের এত কাছে আমাদের খবর না পায়।

দিনতিনেক সাহুকারের দলটার থেকে খনিকটা দূরত্ব রেখে তাদের আগে আগে চলবার পর অবশেষে আমরা ঠিক করলাম এবার সময় হয়েছে। চার দিনের দিন আমরা এমনভাবে পথ চলতে লাগলাম যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহুকারের দলটা এসে আমাদের ধরে ফেলল। তার দলের মধ্যে ভিখারিকে দেখে আমার বেশ মজাই লাগছিল। তারা কাছাকাছি এগিয়ে এলে পরে এটা ওটা দু-একটা কথা হবার পর সাহুকার জিজ্ঞাসা করল আমরা যাচ্ছি কোথায়। তাকে ফের আমাদের সেই ছুটি কাটিয়ে নাগপুরের সেনাছাউনিতে ফিরে চলা হিন্দুস্তানী সেনাদলের পুরনো গল্পটা একবার শুনিয়ে দিলাম। এরপর তারাও আমাদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে লাগলো। সাহুকার লোকটা বেজায় মোটা, হাসিখুশি আর বুদ্ধিমান। মজার মজার চুটকিলা বলে বলে আমাদের হাসিয়ে চলছিল সারাক্ষণ। এমনিকরে চলতে চলতে দিনের শেষে একটা গ্রামে গিয়ে পৌঁছোলাম যখন ততক্ষণে সাহুকারের সঙ্গে আমার দিব্যি বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তারা রয়ে গেল গ্রামের ভেতর। আর তাদের বিদায় জানিয়ে আমরা চললাম গ্রামের বাইরে আমাদের তাঁবু খাটাবার জন্য।

সন্ধেবেলা আমাদের দলবলকে একত্র করে আমি বললাম, “কালকের দিনটা ভালো। শুক্রবার পড়েছে। কাজকর্ম কালই মিটিয়ে ফেলতে হবে।”

অতএব বেলহা আর লুগাইয়ের একটা দল মাঝরাতের মধ্যেই এগিয়ে গেলো ঠিক জায়গা খুঁজে রাখতে আর কবরগুলো তৈরি রাখতে।

পরদিন সকালে সাহুকার তার কর্মচারী (আদতে আমাদের দলের ভিখারি)কে দিয়ে খবর পাঠাল, আমরা যেন একটু তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিই। গ্রামের অন্যধারে তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের সঙ্গেই নাকি বাকি রাস্তাটা যেতে চায় সে।

“সাগর ছাড়বার পর থেকেই সাহুকার বেশ ভয়ে ভয়ে ছিল মীরসাহেব,” ভিখারি জানালো, “আসলে এদিকে পরপর কয়েকটা লোক নিখোঁজ হয়েছে তো! তার ওপর আমিও সাগর ছেড়ে ইস্তক বেটাকে কদিন ধরেই ভয় দেখিয়ে চলেছি। তারপর কাল আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে সারাদিন একসাথে চলবার পর সন্ধেবেলা যখন দেখি আপনার খুব প্রশংসা করছে তখন আমি কথাটা পাড়লাম, যে মীর সাহেবের দলের সঙ্গে একসঙ্গে গেলে কেমন হয়। তাতে বিপদের ভয়টয়ও থাকবে না। ওতেই সাহুকার রাজি হয়ে গেছে।”

“ভালো কাজ হয়েছে ভিখারি,” আমি তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, “কিন্তু আর দেরি নয়। এইবারে চলো সব–”

“জয় ভবানী, জয় মীর সাহেব” বলে হাঁকার দিয়ে আমাদের দলটা এইবারে গ্রামের উল্টোপাশের দিকে পা বাড়াল।

ক্রমশ