স্বার্থপর দৈত্য
(The Selfish Giant: Oscar Wilde) বঙ্গানুবাদ ও নাট্যরূপ – অনুপম চক্রবর্তী
(স্টেজে পাঁচ–ছয়জন বাচ্চাদের খেলতে দেখা যাবে। বাগান, ফুলগাছ আর এক কোণে দু: একটি বড়ো গাছ দেখা যাচ্ছে। আর একদিকে উঁচু পাঁচিল দেখা যাচ্ছে। পর্দার পেছন থেকে শোনা যাবে)
“অনেক দিন আগের কথা…এক জায়গায় থাকতো এক দুরন্ত বাচ্চার দল। তারা সব্বাই স্কুল :এ যেত, পড়াশোনা করত আর স্কুল থেকে ফিরে বিকেলবেলায় ভিড় করতো ওদের সব্বার প্রিয় খেলার জায়গায় ।”
১মঃ আমাদের এই খেলার জায়গাটা হ’ল একটা মস্ত উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা বড়ো বাগান।
২য়ঃ সেই পাঁচিলের একটা কোণে আছে একটা অনেক বড় ফাটল। রোজ বিকেলবেলায় আমরা সব্বাই মিলে সেই ফাটল দিয়ে গলে এই বাগানে ঢুকে পরি…আর তারপর ?
৩য়ঃ আর তারপর শুরু হয় আমাদের অনেক রকম খেলা… চোরপুলিশ, আব্বুলিশ, কানামাছি ভোঁ:ভোঁ, কিৎ :কিৎ …আরও কতরকম খেলা। সেই সব খেলতে খেলতে কোথা দিয়ে যে বিকেল গড়িয়ে যায় আমরা বুঝতেই পারি না !!
১মঃ এই বাগানটা মস্ত বড়ো। নরম ঘাস দিয়ে ঢাকা। আর এই ঘাসের মধ্যেই ফুটে আছে কত রংবেরঙের ফুল ! ঠিক যেন আকাশে ফুটে থাকা তারার মত!!
৩য়ঃ আর ঐ কোণে দেখ – বারোটা বড় বড় আমগাছ !! ওখানে বসন্তকাল থেকেই কত মুকুল ধরে থাকে……
৪র্থঃ আর গরমকালে? ঐ গাছগুলোতে পাকা পাকা মিষ্টি আম হয়, আর আমরা পেড়ে পেড়ে খাই !!
১মঃ আর গাছগুলোতে থাকে অনেক রকম পাখি। তারা এমন মিষ্টি গান করে…যেই শোনে মুগ্ধ হয়ে যায়।
২য়ঃ যা বলেছিস। আমরাও তো কতবার খেলতে খেলতে থমকে দাঁড়িয়ে পাখিদের গান শুনেছি…।
(সবাই মিলে:) “আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে ”……
কিন্তু ওদের এই আনন্দ বেশিদিন রইলো না। এই যে এত সুন্দর বাগান, সেটা আসলে ছিল একটা দৈত্যের বাগানবাড়ি। সেই দৈত্য ৭ বছর আগে তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করবে বলে, লম্বা লম্বা পা ফেলে কোথায় যেন গিয়েছিলো। এতদিন বাদে তার সাধ হোল ফিরে আসতে। তখন সেই দৈত্য তার ঝোলাঝুলি নিয়ে আবার তার লম্বা লম্বা পা ফেলে সেই অনেকদুরের দেশ থেকে ফিরে এলো তার নিজের বাগানবাড়িতে !!
(দৈত্যর প্রবেশ )
১মঃ হ্যাঁরে, ওটা কী রে? এদিকে আসছে?
৪র্থঃ উরিবাবা !! এতো রাক্ষস টাক্ষস মনে হচ্ছে রে ?
২য়ঃ বাবারে !! চল পালাই ?
৩য়ঃ মা !! আমাকে বাঁচাও !!
দৈত্যঃ অ্যাই, তোরা কে রে? আমার বাগানে তোরা কী করছিস? দেখিস নি আমার বাগানের পাঁচিলের গায়ে কি লেখা আছে? লেখা আছে –“বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ !!”
৩য়ঃ আমি বাড়ি যাবো।
৪র্থঃ আমাদের যেতে দাও ।
দৈত্যঃ ঠিক আছে। আজ তোদের ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এর পর যদি কোনও দিন ঢুকিস, আমি তোদের গায়ের চামড়া খুলে নুন মাখিয়ে শুকোতে দিয়ে দেবো।
ছেলেমেয়েরাঃ পালা পালা পালা……
দৈত্যঃ হা হা হা, জেনে রাখিস, এই বাগান আমার। শুধুই আমার। আমি ছাড়া আর কারুর এই বাগানে ঢোকার অধিকার নেই। এই দেখ, আমার বাগানের পাঁচিল:এ কি লেখা আছে…।লেখা আছে “অনধিকার প্রবেশ নিষেধ”
(স্টেজের আলো নিভে যাবে, তারপর হলুদ আলো জ্বলবে,…পরের দিন……)
৫মঃ আমরা কোথায় খেলবো রে?
৪র্থঃ হ্যাঁরে… আমাদের তো কোথাও খেলার জায়গা নেই…।
২য়ঃ এবার আমাদের রাস্তার ওপরেই খেলতে হবে…।
৩য়ঃ ওখানে খালি নুড়ি পাথর…
১মঃ আর গাড়ি চলে, ধোঁয়া আর ধুলোয় ভর্তি
২য়ঃ আমার একদম ভালো লাগছে না !!
৫মঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বাগানে খেলতে কী মজাটাই না হত রে !!!
১মঃ ঐ দৈত্য টা খুব স্বার্থপর, খুব দুষ্টু !!
(সব্বাই মিলেঃ) দুষ্টু , দুষ্টু , পচা, স্বার্থপর !!
(বসন্তর প্রবেশ)
বসন্তঃ আমি বসন্ত, আমি সারা পৃথিবীতে নিয়ে আসি নতুন প্রাণের ছোঁয়া। আমার আসার খবর পেয়েই পুরনো শুকনো পাতারা সব ঝরে যায়, আর ফুটে ওঠে নতুন সবুজ পাতা।
কিন্তু, এ কী !! এই বাগানের পাঁচিলে লেখা দেখছি.. “অনধিকার প্রবেশ নিষেধ” !!!
নিশ্চয়ই এ সেই স্বার্থপর দৈত্যর বাগান…তাই বুঝি পাঁচিল গুলো এত্ত উঁচু !! আমি তবে কেমন করে যাব ভেতরে ? থাক তবে, ফিরেই যাই !!
(শীতের প্রবেশ)
শীতঃ হা হা হাঃ !! ভাগ্যিস, আমি আগেই ঢুকে পড়েছিলাম এই বাগানে !…আজ বসন্ত ফিরে গেল…। তার মানে এখন আমিই থাকব এই বাগানে…হাড় কাঁপানি শীতের হাওয়া দেবো… গাছেরা সব শুকিয়ে যাবে। পাখিদের বাসায় হিম পড়বে… সক্কাল বেলা থেকে পাখিদের ঐ কিচির –মিচির …সব সব বন্ধ হয়ে যাবে !!
দৈত্যঃ সব দিক জুড়ে আজ বসন্ত। শুধু আমার বাগানেই আজও বসন্ত:র দেখা নেই? আজও শীতের হাড় কাঁপানো হাওয়া আর বরফ পড়ে চলেছে …
আমার বাগানে বসন্ত আসতে এতো দেরি কেন? পাখিদের গান শুনতে পাইনা কেন? গাছে গাছে ফুল ফোটা গেছে থেমে…বলি ব্যাপারটা কী?
শীতঃ কেন দৈত্য ? তুমিই তো বলতে…শীত হল তোমার প্রিয় ঋতু ? হাওয়ার এই শিরশিরানি , ঐ যে গাছের নিচে, বাড়ির মাথায় বরফ জমেছে …এই তো তোমার প্রিয়?
দৈত্যঃ প্রিয়, প্রিয়,…কিন্তু বরফ পড়ে পড়ে যে আমার বাড়ির ছাত ভেঙে যায় , বরফ জমে জমে আমার বাগানের ঘাস মরে যায় !!…আমার বাগান ভরা ফুল…তারা সব শীতের শুকনো হাওয়ায় শুকিয়ে মরে গেছে…… আমার বাগানে আর পাখি ডাকে না…! একী ভয়ানক নির্জনতা !! আমার বাগানে কি আর কখনও বসন্ত আসবে না?
বুঝেছি, বুঝেছি …এসব আমার:ই পাপের ফল। আমিই একদিন আমার বাগানে হাসিখুশি বাচ্চাদের ঢুকতে বারণ করেছিলাম। আজ তাই এ বাগানের সব খুশি আর আনন্দ বন্ধ হয়ে গেছে।………আমি কী বোকা !! আমি কী স্বার্থপর !!
শীতঃ আমি তো আছি…
দৈত্যঃ চলে যাও …চলে যাও, শীত । আসতে দাও বসন্তকে, ……… ঝরে যাক শুকনো পাতা। সরে যাক বরফের ঢাকা ……আবার সূর্যের আলো পড়ুক আমার বাগানে।
স্টেজের আলো নিভে যায় ।
আবার আলো জ্বলে । দৈত্য শুয়ে আছে……বাইরে বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ……… দৈত্যর ঘুম ভাঙে…..)
দৈত্যঃ ওই তো, ওই তো বাচ্চারা এসেছে।
(দৈত্য দুচোখ কচলে বাগানে আসে। বাগানে বাচ্চারা খেলা করছে )
১মঃ আজ অনেকদিন পড়ে এই বাগানে ঢুকলাম
৪থঃ ভাগ্যিস, পাঁচিলের গায়ে ফাটলটা ছিল…
২য়ঃ কিন্তু, সেই দৈত্যটা আবার আসবে নাতো রে?
৫মঃ নারে নাঃ, দেখছিস না? এতো বরফ জমে আছে ? ঐ বাড়িটার মাথায় তো বরফের পাহাড় হয়ে গেছে …দৈত্যটা নিশ্চয়ই ঠাণ্ডায় জমে মরেই গেছে।
(দৈত্য:র প্রবেশ…………বাচ্চাদের আর্তনাদ )
দৈত্যঃ ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না। আজ থেকে তোমরা সবাই এই বাগানে যতখুশি খেলতে পারবে। আমি কিচ্ছু বলব না !!
২য়ঃ তুমি আমাদের মারবে না ?
দৈত্যঃ না না, একদম না।
৩য়ঃ আমাদের চামড়া ছিঁড়ে নেবে না?
দৈত্যঃ ছি ছি, কক্ষনো না ।
১মঃ তুমি আমাদের ধরে রাখবে না?
দৈত্যঃ একদম না। তোমরা খেল। আমি তোমাদের খেলা দেখব।
৩য়ঃ কী মজা !!
সব্বাইঃ কী মজা! হুররে !!!
(সব বাচ্চারা হাত ধরে গোল করে ঘুরতে থাকে, দৈত্য বসে থাকে। এক কোণে একটি বাচ্চা একটা গাছে উঠতে চেষ্টা করছে…কিন্তু পারছে না …)
দৈত্য: আরে খোকা , তুমি গাছে চড়বে ?
৫মঃ হ্যাঁ , আমি গাছে উঠতে চাই।
দৈত্য: নিশ্চয়, দেখেছ, গাছটাও তোমাকে কোলে নেবে বলে ওর ডাল নিচে ঝুঁকিয়ে রেখেছে! এসো, আমি তোমাকে গাছে চড়িয়ে দিই।
৫মঃ আমি পড়ে যাব না?
দৈত্য: কিচ্ছু ভয় নেই। এই তো আমি ধরে আছি।
(বাচ্চাটাকে দৈত্য গাছে উঠিয়ে দেয়। বাচ্চাটি খিল খিল করে হাসতে থাকে )
দৈত্য: সত্যি, আমি কী বোকা ছিলাম !…আমি কি স্বার্থপর……আমার বাগানে পাঁচিল তুলে, বাচ্চাদের আসতে বারণ করে কী পাপটাই না করেছি !! আজ আমি আমার এই পাঁচিল ভেঙে দেব।
(দৈত্য দৌড়ে গিয়ে একটা কুড়ুল নিয়ে এসে পাঁচিল ভাঙতে শুরু করে )
দৈত্য: আজ থেকে এই বাগান তোমাদের…তোমরা রোজ এখানে এসে খেলা করবে……… কেউ তোমাদের বকবে না ।
(বাচ্চারা খুশিতে হাততালি দেয়)
৪র্থঃ কী মজা, কী মজা
২য়ঃ আমাদের খেলার বাগান ফিরে পেলাম
৩য়ঃ আমাদের আর রাস্তায় খেলতে হবে না ।
১মঃ হ্যাঁ, রাস্তায় ভীষণ ধুলো। আমাদের একটুও ভালো লাগত না ।
দৈত্য: আজ সন্ধে হতে চলল। তোমরা সবাই বাড়ি যাও। কাল সবাই মিলে আবার খেলতে এস।
(সবাই দৈত্যকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে যায়। শুধু ৫ম বালককে দেখতে পাওয়া যায় না )
দৈত্য: ও কই, যাকে আমি গাছে তুলে দিয়েছিলাম?
৩য়ঃ ও তো কখন গাছ থেকে নেমে বাড়ি চলে গেছে।
দৈত্য: ঠিক আছে। ওকেও বোলো কিন্তু, কাল যেন আবার আসে।
(স্টেজের আলো নিভে আবার জ্বলে। দেখা যায় বাচ্চারা খেলা করছে। দৈত্য বসে বসে ওদের খেলা দেখছে, মাঝে মাঝে খেলায় যোগও দিচ্ছে । বাগানে আর বরফ নেই। অনেক ফুল ফুটেছে আবার। পাখিদের গান শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ ।)
এরপর থেকে রোজই বিকেলবেলায় বাচ্চারা বাগানে ভিড় জমাত আর দৈত্য ওদের সাথে খেলায় মেতে উঠত। এইভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর পার হয়ে গেলো। দৈত্য এখন বুড়ো হয়েছে। একদিন দৈত্য শুয়ে শুয়ে পাখিদের গান শুনছে, এমন সময়—
(স্টেজের আলো কমে যাবে। বাচ্চারা নেই…কিন্তু পাখিদের আওয়াজ আছে…দৈত্য মাটিতে শুয়ে… দেবশিশু রূপে ৫ম বালকের প্রবেশ……পরনে নীল –সাদা কাপড়, মাথায় মুকুট, হাতে বাঁশি ।)
দৈত্য: কে তুমি?
দেবশিশুঃ চিনতে পারছোনা আমাকে? একদিন আমাকে আদর করে কোলে তুলে তুমি গাছে চড়িয়ে দিয়েছিলে ?
দৈত্য: হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আমি রোজ খুঁজতাম তোমাকে, সব বাচ্চারা আসতো …কই তুমি তো আর এলে না ?
দেবশিশুঃ এই তো আমি এসেছি । তোমাকে নিয়ে যেতে…
দৈত্য: কোথায় ? কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে ?
দেবশিশুঃ তোমাকে নিয়ে যাবো স্বর্গের বাগানে । তুমি বাচ্চাদের নিজের বাগানে খেলতে দিয়েছ। আমাকে আদর করে গাছে উঠতে সাহায্য করেছ।.আজ তাই আমি তোমাকে আমার বাগানে নিয়ে যাব।
দৈত্য: কেমন সে বাগান ? সেখানে এতো হাসি আর খুশি আছে ?
দেবশিশুঃ আছেই তো। সেখানে আছে অপার শান্তি। সেখানে কোনও কষ্ট নেই, কোনও হিংসে নেই, কোনও ঘেন্না নেই, ভয় নেই। কেউ কাউকে মারে না। বকে না। সবাই সবাইকে ভালবাসে।
দৈত্য: তবে চলো , আমাকে নিয়ে চলো সেইখানে……
(দৈত্য উঠে দেবশিশুর হাত ধরে। তারপর দুজনে ধীরে ধীরে স্টেজ থেকে বেরিয়ে যায়।
আলো নিভে যায়, ও আবার জ্বলে ওঠে। বাচ্চাদের প্রবেশ )
২য়ঃ আজ দৈত্যকে দেখতে পাচ্ছিনা ?
৩য়ঃ দৈত্য, দৈত্য, তুমি কোথায় ?
৪র্থঃ ওই দেখ। ওখানে কত সাদা ফুল পড়ে আছে ?
১মঃ নিশ্চয়ই দৈত্য চলে গেছে। আর আমাদের জন্যে ফুল জমিয়ে রেখে গেছে ।
২য়ঃ ঠিক, ঠিক।
১মঃ দৈত্য, তুমি খুব ভালো। যেখানেই থেকো, খুব ভালো থেকো।
সব বাচ্চারাঃ খুব ভালো, খুব ভালো, খুব ভালো।
যবনিকা নেমে আসে