ওসলা
“কাল সকালে তোমাকে ঘরে পাতা দই খাওয়াব।”
প্রকাশ কথাটা পাড়তেই আমার বন্ধু অর্ণব চোখ কপালে তুলে বলল, “এই ঠান্ডায় দই?”
আসলে আমাদের কলকাতায় দই বলতেই ফ্রিজ থেকে বার করা ঠান্ডা জমাট বস্তুটাই মনে পড়ে আগে, ফলে পাহাড়ি গ্রামে হাড়কাঁপা ঠান্ডায় সক্কালবেলা দই খাবার কথা ভেবে সে বেচারা এক পা পিছিয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু শেষকালে সকালে গরম গরম রুটি তরকারির পর সাদা ঘন যে বস্তুটি দই বলে দেওয়া হল তার তুল্য অমৃত আমরা খুব কমই খেয়েছি। মাখন না তোলা ঘন দুধ থেকে পাতা দই যে অমন সুস্বাদু হতে পারে না খেলে আমরা জানতেই পারতাম না। যারা যারা ভুরু কুঁচকে ছিল দেখা গেল তারাই দু দু বাটি চেয়ে খেল।
গাংগোর পেরিয়ে বেশ খানিক যাবার পর ওসলা গ্রাম। নদী থেকে অনেক উঁচুতে বসতি। নদীর কাছাকাছি চাষের জমি। প্রকাশদের বাড়ি আবার গ্রামের একেবারে টং-এ। কাঠের দোতলা। প্রকাশের বোন মণীষা ঘাসের বোঝা নিয়ে ফিরছিল, আমাদের দেখেই বোঝা রেখে ছুট্টে গিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে গেলাসে করে জল নিয়ে এল। বয়স এগার কি বারো। ক্লাস সিক্সের ছাত্রী। পড়াশোনা বাদেও, ঘরে-বাইরে এর মধ্যেই অসম্ভব পরিশ্রমী হয়ে উঠেছে সে। পাহাড়ি মেয়েরা অমনিই হয়। প্রকাশের ঠাকুমা বাইরে চাতালে রোদ পোয়াতে পোয়াতে আমাদের দিকে সস্নেহে তাকিয়েছিলেন। আমরা ওনার দিকে তাকিয়ে নমস্তে করতেই মুখময় হাসি ছড়িয়ে হাত তুলে আশির্বাদ করলেন।
লক্ষ করছিলাম গ্রামের মানুষদের কাটা কাটা চোখমুখ। অদক্ষ চোখে, মধ্য এশিয়ার মানুষদের সাথে খানিক মিল আছে ভাবি। মনে মনে সেইসব যুদ্ধবাজ মানুষদের কথা ভাবি, যারা খানিকটা ভাগ্যের তাড়নাতেও বতে, এসে পড়েছিল সুদূর মধ্য-পশ্চিম এশিয়া থেকে হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে এদ্দুর। তারপর যুদ্ধটুদ্ধ ভুলে এদের মানুষের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। তাও কতদিন আগে। এখানকার ভারতীয় মানুষদের মুখে চোখে চেহারায় সেই পুরানো ছাপ বুঝি আজও টের পাওয়া যায়। গ্রামের মাঝামাঝি একটা বেশ বড়ো চাতাল। ওপরের ঝরনার জল সেইখানে বয়ে এসে বারোয়ারি কলতলা বানিয়েছে। গ্রামের মানুষদের সেইখানে জমায়েত, স্নান করা বাসনধোয়া কাপড়কাচার ফাঁকে ফাঁকে হাসিমশকরার দেদার হুল্লোড়।
প্রকাশের বাবার নাম বাহাত্তর সিং। আমরা যেদিন ওনার বাড়ি যাই উনি সেদিনই বাড়িতে ছিলেন না। হাসিখুশি মানুষটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল হয়েছিল পরে। তমসার পাড়ে এক বিকেলে। উঁচু থেকে নদীখাতের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বাহাত্তর সিং একটা গল্প বলেছিলেন। মহাভারতের অজানা গল্প। পুরাণকথাও বলা যেতে পারে।
সেটা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঠিক আগের সময়। পাহাড় ঘেরা এই অঞ্চলের সর্বময় কর্তা, রাজা দুর্যোধন। তিনিই এখানকার রক্ষাকর্তা। দস্যুদের হাত থেকে গ্রামের সাধারণ নিরীহ মানুষদের রক্ষা করতেন তিনি আর তার প্রিয় বন্ধু কর্ণ মহারাজ। ফলে তাদের দাপট আর জনপ্রিয়তার কোনো অভাব ছিল না এ উপত্যকায়। তারা ছিলেন প্রকারান্তরে দেবতা। দেওমহারাজ। কথিত আছে পাতালের রাজা ছিলেন বভ্রুবাহন (অর্জুনের ছেলে নয় কিন্তু!!), এই এলাকার অন্যতম গ্রামদেবতা। তার অন্য নাম হল পোখু দেবতা। তো এই দেবতা ছিলেন অমিত শক্তিধর দানবের মতো। এমনকী পূজারিরাও তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে পূজা দিতে ভয় পান। এমনই ভয় আর বিশ্বাস যে সরাসরি যিনিই তাকাবেন তার মৃত্যু অবধারিত। তো এহেন দেবতাটি আবার রাজা দুর্যোধনের দারুণ ভক্ত। আজ বাদে কাল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। তার খুউব ইচ্ছা কৌরবের পক্ষ হয়ে লড়াই করেন। পোখুদেবতা আবার ছিলেন অসামান্য ধনুর্ধর। ফলে সোনায় সোহাগা। কৌরবের পক্ষে যোগ দিলে পান্ডবদের হার তো নিশ্চিত। কী করা যাবে এবারে! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রমাদ গুনলেন। তিনি তো অন্তর্যামী এবং অসামান্য কূটনীতিকও বটে। কৌশল করে তিনি পোখু দেবতার থেকে কথা আদায় করে নিলেন যাতে যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ না করেন। কথা আদায় করেও শ্রীকৃষ্ণের মনে শান্তি নেই। যদি শেষমুহূর্তে কথার খেলাপ করে বসেন পোখু ওরফে বভ্রুবাহন! শেষ মুহূর্তে যদি দুর্যোধনেরা হারছে দেখে ভেবে বসেন, “নিকুচি করেছে কথা দেওয়া, দ্যাখ আমি কেমন তীর ধনুক চালাই!” তবে তো একাই নিকেশ করে দেবেন পান্ডবদের সৈন্যদল। তাহলে? তাহলে আর কী, ছলে বলে ধুরন্ধর শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগেই দিলেন পোখু দেবতার মুন্ডু ঘ্যাচাং ফুঁ করে। হায় রে! কিন্তু এ তো ঘোর অনৈতিক কাজ। হলেনই বা শ্রীকৃষ্ণ! অনুতাপ হল তাঁর। অনুশোচনায় কৃষ্ণঠাকুর এইবার ভাবলেন প্রায়শ্চিত্ত করবেন। ভেবে ভেবে ভগবান তাকে অমরত্বের বর দিলেন। তবে যুদ্ধের পর। বভ্রু প্রার্থনা করলেন, অন্তত যুদ্ধটা তিনি যেন দেখতে পারেন। কিন্তু তা কী করে হবে? তাঁর যে মাথা কাটা গেছে! তখন তার কাটা মুন্ডুটাই যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে একটা বড়ো গাছের ডগায় ঝুলিয়ে দেয়া হল। যাতে পুরো যুদ্ধই তিনি দেখতে পান।
তারপর যা হল যুদ্ধে তা তো সকলেই জানে। কুরুক্ষত্রে কৌরবদের হার দেখে দুঃখে পোখুদেবতার চোখ ফেটে জল গড়াতে থাকল। সেই জলেই সৃষ্টি হল তমসা নদী। গ্রামের ক্ষেত্রপাল দেবতা হিসেবে বভ্রু আজও পূজিত হন কিন্তু তমসার জলে কোনো পবিত্র কাজ করা বারণ, কেননা ও তো দুঃখের কান্না!
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল কোথায় কুরুক্ষেত্র আর কোথায় গাড়োয়াল! মহাভারতের গল্প কেমন দুটি অঞ্চলকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দিয়েছে তার পুরাণকথায়। আর তমসার সৃষ্টি নিয়ে কি অপূর্ব গল্প একখানা!
“তার মানে দুর্যোধনের মন্দির ওসলাতেও…”
“ আলবৎ !!” আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠেন বাহাত্তর সিংজি।
“দুর্যোধন ঘোরেন যখন, তখন আপনাদের গ্রামেও আসেন নিশ্চই?”
“আসেন বইকি, শুধু আসেন না, শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাস অবধি থাকেন এখানে। সারা গ্রাম জুড়ে ধুমধাম পুজোআচ্চা, নাটক যাত্রা, নাচ-গান, কী নেই ওই সময়! আমার বাড়ি থেকে পূর্বে গেলে যে মন্দির, ওটাই দেও মহারাজের মন্দির।
আর কর্ণ মহারাজ?
“নৈটোয়ারের কাছে তার মন্দির আছে।”
প্রকাশ আজকাল পুরোলাতেই থাকে। সেখানেই কলেজ। ভাইও পড়ে সেখানকার স্কুলে। বাহাত্তর সিংজি মাঝে মাঝে আসেন সেখানে ছেলেদের কাছে থাকেন। ওর এই অদ্ভুত নামকরণের কথা জিজ্ঞেস করছি করব করে একেবারে আসবার আগের মুহূর্তে কথাটা পাড়ায় একগাল হেসে বলেছিলেন বাহাত্তর সালে জন্ম কিনা! পুরোলাতে এলে নিয়ম করে যোগাযোগ করেন তিনি। কুশল জিজ্ঞাসা করেন আপন লোকের মতো। কলকাতার কোন খবর শহরে এসে টিভিতে দেখলেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করবেন সব ঠিক আছে তো, ভাল আছে তো সব? আমি আশ্বস্ত করি। আর ভাবি, কোথায় গাড়োয়ালের পুরোলা আর কোথায় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা। দুটো জায়গাকে নিমেষে এক করে দিচ্ছে আরেক ভারত, অন্য মহাভারত। বেড়াতে বেড়াতে এই কথাটিই আমি কেবল টের পেয়ে চলেছি।
এইখানেই শেষ হল ইন্দ্রনাথের পাহাড়ি গ্রামের গল্প। এ লেখার সবকটা এপিসোড একত্রে এইখানে পাবে–পাহাড়ি গ্রামের গপ্পো
পরের সংখ্যা থেকে শুরু হবে গা ছমছম নতুন—উঁহু থাক। এখন বলছি না।