গাংগোর
বিজয়কে সত্যি বলতে কি আমরা কেউই চিনতাম না। রামলাল নামে সাঁকরি গ্রামের একজন লোকের কথা জেনেছিলাম। তার কাছে গেলেই পথের প্রয়োজনীয় যোগাড়-যন্তর সে করে দেবে এমনটাই শুনেছিলাম। দেরাদুনের বাস যখন এসে পুরোলা পৌঁছোল, তখন সূর্যের আলো থাকলেও আর সাঁকরি যাবার গাড়ি-ঘোড়া নেই।
পুরোলাতে ডেরা ফেলতে না ফেলতেই রামলাল এসে হাজির। সেবারে হর কি দুন যাবার জন্য রামলালকেই সাথী করবার কথা ছিল আমাদের। ঠিক করা গেল পরদিনই আমরা সাঁকরি যাব। পুরোলার পশ্চিমে পাহাড় টপকালেই তমসা উপত্যকা। তমসার ইংরেজি নাম টনস। ইংরেজরা মনে হয় আমাদের দেশজ নামগুলো ভালো মতো বুঝতে আর উচ্চারণ করতে না পেরে নানান রকম বিকৃতি তৈরি করেছিল। সেসব কিছু কিছু আজও আমরা ব্যবহার করি, কোনকোনটা অবশ্য এখন পালটে দেওয়া হয়েছে। এই যেমন ধরো, বর্ধমান। এই সেদিনও স্টেশনের গায়ে লেখা থাকত বারডোয়ান (Burdwan)। টনসও তেমনি। তা যাক আমরা সাঁকরি পৌঁছনোর পথে দু চোখ ভরে তমসা নদীকে দেখলাম। নৈটোয়ারের কাছে জঙ্গল বিভাগের এক চেকপোস্ট। সেখানে নাম লেখাতে হয়। এখান থেকেই শুরু হয় গোবিন্দ পশুবিহার সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
সাঁকরি পৌঁছে জানতে পারা গেল রামলাল সাথে যাবে না। উপায়? তখনই মূর্তিমান উদয় হলেন। রামলাল বলল সে একে চেনে। এর নাম বিজয়। ওই পথেই বাড়ি। ও নিয়ে যাবেখন। পুরোলা থেকেই আমাদের সাথে প্রকাশ ছিল। সে আমাদের পূর্ব পরিচিত। ও বিজয়ের সাথে নিজেদের গ্রামের ভাষায় কথা বলে খানিক আশ্বস্ত হল, আর আমাদেরও বলল যে চিন্তার কিছু নেই। বিজয় মানুষ ভালো।
তমসার এদিকটাতে দুর্যোধন দেবতাজ্ঞানে পূজিত হন। ভালো মন্দ কারণ অকারণ বলতে পারিনা, তবে মানুষদের সাথে কথা বলে বোঝা যায় টেলিভিশন এবং জোরালো সমতলের সংস্কৃতির প্রভাবে দেবতার নামও বদল ঘটে যায়। তা যাইই হোক দুর্যোধনই যে এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান গ্রামদেবতা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সাঁকরিতে সে মন্দিরে বিজয়ই নিয়ে গেল আমাদের। কাঠের মন্দিরে তালা ঝুলছিল। দেবতা তো আসলে রাজা। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান, তাঁর রাজত্বের দেখভাল করেন। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ে যখন তিনি আসবেন তখনই মন্দিরের দরজা খোলা হবে।
সাঁকরি থেকে তালুকা হয়ে তবে হর কি দুন এর পথে হাঁটা শুরু হয়। চমৎকার রাস্তা। জঙ্গলের মনোরম পথ। পথে পড়ে ডাটমির গ্রাম। আলেকজান্ডারের সৈন্যরা নির্ঘাৎ এসেছিল এপথে। নইলে এমন নাম!
“তোমার গ্রামের নাম কী?”
“গাংগৌর, দাদা,” বিজয় উত্তর করে। ওর উচ্চারণে একটু ঔ কার থাকলেও আমি নামটা একটু সহজ করে গাংগোর বলি।
“তা, সে কতদূর?”
ঘন্টা চারেক চলার পর পা টনটন করে উঠলে দূরত্বের হিসেব জানতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আর বিজয়ও পোড় খাওয়া। সেও অমনি আশ্বস্ত করে বলে, “ব্যস আ গয়া দাদা।”
দেখা যাবে হয়তো আরো ঘন্টা দুই হাঁটতে হল। তবে আমাদের কপাল ভালো। আরো ঘন্টাদেড়েক পর রাস্তার পাশেই একটা বাড়িতে টকাস করে সে ঢুকে পড়ল। বললে, “এটাই আমার বাড়ি।”
“আর গ্রাম? ”
“সে নদীর ওপারে।”
বাহ। বেশ মজাদার হল তো! গ্রামেও থাকা হল আবার গ্রামের বাইরেও। বিজয়দের বাড়ির কাঠের দোতলার ওপরের তলায় থাকার বন্দোবস্ত। রাস্তা থেকে সরাসরি সেখানে ওঠা যায়। একটা ঢাউস পাথরের ওপর উঠে, বারান্দায় নেমে গেলেই হল। নীচের তলায় ঘাস বিচালি, জ্বালানি-কাঠ রাখার আর গরু, ছাগল, ভেড়ার পালের থাকার জায়গা। পাশের খানিকটা সমতল জমি লাঙল দিয়ে মাটি তুলে রাখা হয়েছে।
“কী হবে?” ওইদিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে বিজয় বললে, “ কুছ নেহি দাদা। ব্যস থোড়া আনাজ বোয়েঙ্গে।”
বিজয়ের মা চা বানিয়ে ডাক দিলেন বলে কথা এগোল না। তবে আনাজ বলতে স্কোয়াশ, বাঁধাকপি, আলু আর টমেটোর বাইরে খুব একটা কিছু হবে বলে তো মনে হয় না।
তমসার ওপরে একটা ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে বাঁহাতে গ্রাম; ব্রিজে ওঠার আগেই ডান হাতে উঠে গেলে বিজয়ের ঘর। বিজয়ের গ্রামেও একটা মন্দির। দুর্যোধনের। মন্দিরের চারপাশে অনেকটা জায়গা। একপাশে কাঠের চালা বানানো। সেখানে পালাপার্বণে গান বাজনা হয়। মন্দিরের গায়ে কাঠের নানারকম মূর্তি। বাঘ, ঘোড়া, শিকারি, বাজনদার এইসব। মন্দিরের ছাত দোচালা। তাতে ময়ূর, হাতি, ভেড়ার পুতুল সার দিয়ে রাখা রয়েছে।
“কেন?”
“জানি না। এমনিই, আছে তো এরকমই। আর এখন তো মন্দিরও বন্ধ। খুলবে সেই আষাঢ়ে যখন দেওমহারাজ আসবেন।”
মন্দিরের খোলা মাঠে কয়েকটা ছেলেমেয়ে খেলে বেড়াচ্ছিল। তাদের মলিন পোশাক কিন্তু মুখের হাসি সে মলিনতা ঢেকে দিচ্ছিল। কারণে অকারণে হেসে উঠছিল বাচ্চাগুলো। এর মধ্যে বিজয় গাঁওবুড়াকে ধরে আনল। গাঁওবুড়া আসলে পঞ্চায়েত প্রধান। গন্যিমান্যি লোক। খোঁজখবর হল। কে আমরা, কী কাজে এসেছি। বিজয় মাঝে মাঝেই জানান দিতে থাকল যে সে আমাদের সবিশেষ পরিচিত। তাতে করে গ্রামে তার খানিক গুরুত্ব বাড়ল কিনা তা বলতে পারব না। তবে মন্দির থেকে ওর বাড়িতে যখন আমরা ফিরে আসছি তখন তাকে আর দেখা গেল না। গাঁওবুড়ার সাথেই সে উধাও হল কোথায়।
আমরা ফিরে এসে, ঠান্ডা জমিয়ে পড়ার আগেই, বিজয়দের রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। রান্নাঘর বলতে আলাদা কিছু নয়। একটা বড়ো ঘরের একপাশে উনুন। তার চারপাশ ঘিরে শোওয়া বসা। বিজয়ের দুই ছেলে মেয়ে। বড়োটি, বছর তিনেকের মেয়ে, দিয়া। ছোটো ছেলেটি মাসচারেকের। তাকে ঘিরেই বাড়ির লোকের যত উৎকন্ঠা, কপালে চিন্তার ভাঁজ। গ্রামে ডাক্তারের ভারী অভাব। এদিকে ছেলেটির নিউমোনিয়া হয়ে গেছিল জন্মের পরপরই। দেরাদুন নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ওষুধও রয়েছে। অথচ ঘংঘঙে কাশিটা সারছে না কিছুতেই। ওইটুকু দুধের শিশু! কখনো মায়ের কোলে কখনো দিদিমার কোলে চেপে স্বস্তি খুঁজছে। আর কাঁদছে মিহি গলায়। প্রত্যন্ত গ্রামে ডাক্তার-বদ্যি নেই। চট করে শরীর খারাপ হলে কিচ্ছুটি করবার নেই। আমরা যারা বড়ো শহরে থাকি, কিংবা নিদেন মফস্বলেও থাকি, তারা ধারণাই করতে পারব না, প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে অধিকাংশ সময়েই শুধু জড়িবুটি, তুকতাক হাতুড়ের ওপর নির্ভর করে জীবন কাটানো ছাড়া আর উপায় নেই। মায়ের মুখ ক্লান্ত। পরপর কত রাত ঘুমোননি কে জানে! খুব কষ্ট হলেও আমাদের কিছুই করার ছিল না। বিজয়ের বাবা, বাচ্চাটার দাদু, চিন্তিত মুখে গুড়ুক গুড়ুক লম্বা গড়গড়ার হুঁকো টানছিলেন। উনি পাহাড়ে ছাগল ভেড়া চরাতে যান; এসময়টা বাড়িতে থাকার কথা নয়, বাচ্চাটার হাল দেখে রয়ে গেছেন।
বিজয় কখন বাড়ি ফিরেছিল জানিনা। হয়তো মাঝরাতে হবে। আমাদের সারারাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হল, বা বলা যায়, ভালো করে ঘুম হলই না। কী করে হবে। পাশের ঘরে বাচ্চার মা দিদিমা ঠায় জেগে আছেন। থেকে থেকে ওইটুকু শিশু কেশে চলেছে। আশঙ্কা আর মনখারাপে কি কারো ঘুম হয়? সকালের দিকে কাশি কমে এল। একটু ঘুমিয়েও পড়ল শিশুটি। ভোরের আলো সামান্য ফুটলে ওর মা ক্লান্ত চোখে হেসে বললেন এখন ভালো আছে। পাল্টা কিছু বলা তো দূর আমি হাসতেও পারলাম না। অপ্রস্তুত, অসহায় মানুষের মতো ওদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
গভীর রাতে বিজয়দের বাড়ির লাগোয়া উঠোন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল। কাঠের পাশাপাশি দুখানি বাড়ি মায়াবী রাজপ্রাসাদের মতো লাগছিল। প্রকৃতির অশেষ করুণায় আমরা এমন দৃশ্য মাঝে মাঝে দেখে ফেলি। যেমন দেখি সকালের আলোয় কিম্বা সূর্যাস্তের লাল আভায় অপার্থিব হয়ে যাওয়া সাদা পাহাড়ের চুড়োগুলোকে। তবু ভুল করে বার বার শৃঙ্গজয়ের কথা বলি, সমুদ্র দখলের কথা বলি, জঙ্গল অধিকারের কথা বলি। তোমরাই বলো জল মাটি হাওয়া পাথর পাহাড় নদী সমুদ্র জঙ্গল – এসব দখল করা যায়? জয় করা যায়? অধিকার করা যায়? কখোনো কি তা সম্ভব! কনকনে ঠান্ডার ওই রাতে বিজয়দের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে নদীর উল্টোদিকে পূর্ণিমার চাঁদের নীচে ভাসতে থাকা গাংগোর গ্রামকে দেখে নিজেকে যারপরনাই ভাগ্যবান মনে হল।
“দাদা ওঠো এবারে বেরোতে হবে।”
প্রকাশের কথায় চোখ খুলে দেখি, বিজয় চানটান সেরে টেরি কেটে আমাদের জন্য রুটি বানাচ্ছে। ওরা বলে চাপাটি। আলুর সবজি আর রুটি। সাথে ঘন দুধের চা এক গেলাস।
ছোট্ট দিয়া ভাইকে কোলে নিয়ে বসে আছে। সে এখন চুপ। গোল গোল চোখ মেলে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। দেখে আমাদেরও মন খানিক শান্ত হয়ে এলো। দু পা গেলেই গাংগোরের সীমানা পেরিয়ে যাব। আমরা সবাই মনে মনে প্রার্থনা করি, ফেরবার পথে যেন দেখি বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। রাস্তায় পা রেখে ঘাড় ঘোরাতেই মায়ের কোল থেকে ফিক করে হেসে দিল ছেলেটা।