ভ্রমণ

bhrom01 (Small)

bhrmontitle (1) (Small)

দেবগ্রাম

পশ্চিমবঙ্গের দু দুটো দেবগ্রামের সংগে তো আমিই ছোটোবেলা থেকে পরিচিত। একটা বোলপুরের কাছে বীরভূমের দেবগ্রাম আরেকটা বেথুয়াডহরির কাছে নদীয়ার দেবগ্রাম। তোমরাও কেউ কেউ নিশ্চয় জানো। এখন যে দেবগ্রামের কথা লিখছি সেটা কিন্তু উত্তরাখণ্ডের এক পাহাড়ি গ্রাম। কল্পেশ্বর মহাদেব এর মন্দিরে যেতে পথে পড়ে এই গ্রাম।

বদ্রীনাথের রাস্তায় যোশিমঠের খানিক আগে পড়ে হেলাং। সেখান থেকে বাঁহাতি রাস্তায় বেশ খানিক গেলে উরগাঁও। উরগাঁও থেকে আরও পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গেলেই দেবগ্রাম।

পঞ্চকেদারের এক কেদার হলেন কল্পেশ্বর মহারাজ। পুরাণমতে এখানে মহাদেবের জটা অধিষ্ঠান করেন। গল্পটা সবারই জানা। মহাভারতের যুদ্ধের পর পাণ্ডবরা মনের গ্লানি মোছার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মহাদেব-এর তপস্যা করছেন, তাঁকে খোঁজ করছেন হিমালয়ের এদিকে সেদিকে, কিন্তু পাচ্ছেন না। পাবেন কী করে? মহাদেব যে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন যাতে তাঁকে ধরা না যায়।

এমন এক সময়ে মহাদেব মস্তো এক মহিষের ছদ্মবেশে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। মধ্যম পান্ডব ভীম তা বুঝতে পেরে পেছন থেকে জাপটে ধরলেন তাঁকে। সামনের অংশ তো হাতের নাগালের বাইরে তবু পেছনের অংশ জাপটে ধরে রইলেন। শিবঠাকুরেরও আর পালিয়ে যাওয়া হল না। মাটি ফুঁড়ে লুকিয়ে পড়ার জন্য যে ঝাঁপ দিয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব, ভীমসেনের শক্তির কাছে হার মেনে অমনিই রইলেন। হিমালয়ের পাঁচ জায়গায় প্রকাশ রইল তার। জটা কল্পেশ্বরে, রুদ্রনাথে মুখমন্ডল, মধ্যভাগ মধ্যমহেশ্বরে, তুঙ্গনাথে বাহু ও কেদারনাথে পৃষ্ঠভাগ এসে পড়ল।

bhromon54 (Small)এও কথিত যে এই মন্দিরগুলির প্রতিষ্ঠাতাও পান্ডবরা। দেবগ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে কল্পগঙ্গা পেরোলেই কল্পেশ্বরের মন্দির। বলতে গেলে গ্রামের পরেই। উরগাঁও পেরিয়ে দেবগ্রামে ঢোকার আগেই আরও এক মন্দিরের দেখা পাওয়া যায়। এর নাম ধ্যান বদ্রী। গাড়োয়ালে মোট সাতখানা বদ্রীনারায়ণের মন্দির, যাকে একত্রে সপ্তবদ্রী বলা হয়ে থাকে, তার একটি এইখানে। প্রাচীন এই মন্দিরটির চাতালে পাঁচখানা পাথরের তৈরি জলের উৎসমুখ। যেন কোনো প্রাণীর মুখ। সেখান থেকে জল পড়ে। পাহাড়ি ঝরনার জল।

মন্দির চত্বর নির্জন, জনমনিষ্যি নেই। হাঁকডাক, ফুল বেলপাতার ডাঁই, কোলাহল, হট্টগোল একেবারেই নেই। আমাদের সত্যিই খুব ভালো লেগে গেল বলে আমরা এখানেই অনেকক্ষণ বসে রইলাম। উপলব্ধি করলাম ধ্যানবদ্রী নামটি প্রকৃতই এই মন্দিরের সঙ্গে মানানসই। ওদিকে বৃষ্টি এসে যেতে পারে বলে আমাদের এক বন্ধুর তাড়ায় উঠতেই হল। দেবগ্রাম সীমানাতে এসে ভিজে একসা হলে কেমন কথা। ফলে আমরা বিষ্ণুর শরণ ছেড়ে মহাদেবের দিকে চললাম। দুপুর দুপুর গিয়ে পৌঁছলাম দেবগ্রামে। এখন গ্রামের ঘরদোর সবই প্রায় পাকা হয়েছে। বিদ্যুতের আলো এসেছে। পায়ে চলা রাস্তা কংক্রিটের হয়েছে। আমরা যখন গ্রামে ঢুকে পড়েছি আমাদের সাথে সাথেই আটজন লোক বাঁশের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা ছোটো ট্রান্সফরমার নিয়ে এলো। আগেরটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই। দেখতে ওইটুকু হলে কী হবে। বেজায় ভারী। আটটা শক্তিশালী লোক পালা করে করে একটু একটু পথ হেঁটেছে খানিক বিশ্রাম আবার হাঁটা ; আমাদেরই মতো। মানে পাঁচ কিলোমিটার। ঘেমে নেয়ে হাঁপিয়ে একসা। অকুস্থলে পৌঁছিয়ে ঘাম মুছে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল। এবারে আলো জ্বলার কোনো সমস্যা রইল না। এবারে জায়গামত আটকে দেওয়া। তা ধীরে সুস্থে করা যাবে খন।

এত প্রত্যন্ত গ্রামে রাজিন্দর নেগি-র বাড়িতেই হোটেলের মতো থাকার ব্যবস্থা, বলতে গেলে এলাহি ও রাজকীয়। কাঠের রেলিংঘেরা বারান্দায় বসে সামনের উপত্যকার দিকে চেয়ে থাকলেই মন ভালো হয়ে যাবে।

দেবগ্রামে চাষের জমি বিস্তর। চাষও হয় চমৎকার। গম, রাজমা, রামদানা, আলু, বাঁধাকপি আর হ্যাঁ স্কোয়াশ। গরম গরম আটার রুটি আর স্কোয়াশের তরকারি খেয়ে আমরা যেন বাগানে বেড়াতে বেড়িয়েছি, এমন চালেই চললাম কল্পেশ্বর মন্দিরের দিকে। গ্রামের বাঁধানো পথ, চাষের জমির মাঝখান দিয়ে বাড়িঘরদোরের পাশ দিয়ে পড়ল গিয়ে হালকা জঙ্গলের পথে।

হাঁটতে হাঁটতে জলের শব্দ শুনলাম। তারপর সে নদী দেখতেও পেলাম। কল্পগঙ্গা। তার ওপরে একটা ঝোলা পুল পেরিয়ে ওপারে কল্পেশ্বর মহাদেবের মন্দির। নিরিবিলি। আমরা ভিন্ন আর দর্শনার্থী নেই। একটা গুহামতন জায়গাকে মন্দিরের রূপ দেওয়া হয়েছে। মন্দির চত্বরে পাথরের অনেক মূর্তি, এবং সবগুলিই যথেষ্ট প্রাচীন। শিব—পার্বতী, গণেশ, নন্দী মহারাজ, নটরাজ, এইমতো।

মূর্তিগুলির প্রাচীনতা এবং শিল্প বিচার করলে এক একটি দেশের মূল্যবান সম্পদ। অবলীলায় অযত্নে পড়ে আছে একপাশে। মন্দির দেখে, শিবঠাকুরের কাছে ধূপ জ্বেলে, জল ঢেলে আমরা ফিরে এসে এক সাধুবাবার ডেরায় এসে বসলাম। সাধুবাবা খুব অমায়িক। স্বাভাবিক গপ্পগাছা চলতে চলতে উনি আবার আমাদের জন্যে চা-ও বানিয়ে ফেললেন।

আমরা বললাম, “আপনার ছবি তুলব?”

হেসে বললেন, “তা বেশ তো নাও না।” তারপর কলকাতার কথা জিজ্ঞেস করলেন। এখন আর কোথায় কোথায় যাব সে কথাও জিজ্ঞেস করলেন আমাদের।

অনেকক্ষণ গপ্প করে আমাদের আবার খিদে খিদে লাগছিল। আমরা সাধুবাবার কাছ থেকে বিদায় চেয়ে ঝোলাপুল পেরিয়ে এপারে এসে পায়ে পায়ে  একেবারে নদীর জলের কাছে পাথরের ওপরে গিয়ে বসলাম। খাবার দাবার সঙ্গেই ছিল। অমনি শুরু হয়ে গেলো আমাদের পিকনিক। ঠান্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে পাথরের ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে আমাদের ভোজনপর্ব যা জমে উঠেছিল যে কী বলব! আমরা ক’জন, বয়ে যাওয়া নদী, তার পারের অসংখ্য ছোটো বড়ো বোল্ডার, অজস্র নুড়িপাথর এইই। নদীর উৎসের দিকে জঙ্গল ক্রমশ ঘন হয়ে গেছে। ওইদিকে খানিক এগোতে একটা চমৎকার ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড।

বিকেলের মধ্যে রাজিন্দরজির বাড়িতে ফিরে ঠিক হল রাতে রান্নাটা আমরাই করব। ওনাকে বলতেই মিসেস নেগি আমাদের একটা স্টোভ ধার দিলেন। আর আমার এক বন্ধু তক্ষুণি সেটা নিয়ে তেল ভরে প্রবল বিক্রমে পাম্প দিতে শুরু করল। তা দেখে শ্রীমতী নেগি তো হেসে খুন। অনেক কসরতের পর স্টোভটা না ধরাতে উনি জিজ্ঞেস করলেন যে সত্যিই আমরা খাবার বানাতে পারব কিনা! আমরা প্রবলভাবে হ্যাঁ হ্যাঁ বলাতে এবং নিশ্চয় স্টোভটাতে কোনো গোলমাল আছে এই সন্দেহ প্রকাশ করাতে, উনি কথা না বাড়িয়ে আলগোছে স্টোভটা বারান্দার এক কোণায় নিয়ে বাতাস আড়াল করে তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। শুধু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নিজেদের ঘরে নেমে যাবার সময় মুচকি হেসে বলে গেলেন,  “অসুবিধে হলে বোলো আমার রান্নাঘর কিন্তু খোলা আছে।”

অসুবিধে অবশ্য হয়নি। খিচুড়ি রান্না ঠিকঠাকই হয়ে গিয়েছিল। রাতের বেলা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ঠান্ডা উপেক্ষা করেও আমরা কাঠের রেলিং দেওয়া বারান্দায় অনেকক্ষণ বসেছিলাম। সামনের পাহাড় অপূর্ব আলোয় ভেসে যাচ্ছিল।

সকালে রোদ ওঠার পর লেপের তলা থেকে বেরিয়ে বাইরে রোদে পিঠ করে বসে আছি। নেগিজি এসে চা দিয়ে বলে গেলেন ভাবিজি বলেছে নাস্তা উনিই বানাচ্ছেন, আমরা যেন রাতের মত আবার নিজেরাই না বানাতে বসি।

ছোটখাট উচ্চতার একজন মানুষ, বয়েস মেরেকেটে ত্রিশ বত্রিশ, হাসি হাসি মুখে নীচের রাস্তা ধরে এই বাড়ির দিকেই এগিয়ে এলেন।

“নমস্কার। জি। নমস্কার-”

পালটা আমরাও নমস্কার করলাম।

“মেরা নাম কুঁয়ার সিং নেগি। রাজিন্দরজি মেরা ভাইয়া। সাগা নেহী লেকিন ভাইয়া।” অর্থাৎ নিজের নয় তবে রাজিন্দরজি কুঁয়ার সাবের ভাইই বটে।

“আপ?”

এবারে আমাদের পালা। আমার এক বন্ধু দেবু সবিস্তারে আমাদের পরিচয় দিয়ে আমাদের আসবার উদ্দেশ্য জানাল। আমরা এবারে রুদ্রনাথ যাব শুনে সে তো খুবই উল্লসিত। গড়গড় করে পথের বিবরণ এবং সে ক’বার ওপথে গেছে তার বিশদ জানাতে থাকল। লোকটি নেহাৎই ভালোমানুষ, কিন্তু তাকে থামাতেই হল। বলা গেল যে আমাদের সঙ্গে আমাদের দুই বন্ধু আছেন তাঁরা এলাকারই বাসিন্দা, অর্থাৎ কী না গাড়োয়ালি। তাঁরা এসব পথঘাট বিলক্ষণ চেনেন। মালপত্র বয়ে দিয়ে তাঁরাই সাহায্য করছেন।

লোকটি এক মুহূর্ত হতাশ হল, কিন্তু পরমুহূর্তেই চাঙ্গা হয়ে বলল, তাতে কী, তোমরা তো আবার আসবে, তখন নিশ্চয় লোকের দরকার হবে, বা নিদেন তোমাদের বন্ধুরা তো আসবে কেউ না কেউ, তাদের দরকার হতে পারে; তো আমার নাম লিখে রাখো, আর হ্যাঁ আমার মোবাইল নম্বর।

বলাকওয়া চা পান শেষ করে লোকটি পাশের রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে দেখল গতকালের আনা ট্রান্সফর্মারখানা বসানো হচ্ছে। সেও ওদের সঙ্গে হেইয়ো জোয়ান বলে জুটে গেল দিব্যি।

রুটি খেতে খেতে নেগিজির উঠোনের ফুলগাছের আশপাশে দেখি একটা কালচে ধূসর রঙের পাখি লেজ নাচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাচানোর সময় বসে আছে তারপর লাফিয়ে এদিক সেদিক যাচ্ছে। পোকা খুঁজছে সম্ভবত। আকারে সাধারণ চড়াইয়ের মতো। লালচে বাদামি লেজ। পেটের কাছটাও লালচে। আর ছোট্ট তেকোনা ঠোঁট। নেগিজিকে ইশারায় ওর নাম জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন, “চিরবিরা।”

ভাবিজি আর রাজিন্দর নেগি-র থেকে বিদায় চেয়ে আমরা গ্রামের উত্তর পশ্চিম দিকে পাহাড় ভাঙতে আরম্ভ করলাম। ওদিকেই রুদ্রনাথের পথ। দেবগ্রাম বেশ ছড়ানোছিটানো। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে। সমৃদ্ধ গ্রামই বলা চলে। আমাদের আসার খবরও দেখছি অনেকেই জানে। বাইরের লোক বলতে এই আমরা ক’জন। আর আমাদের চিনে ফেলাটাও সোজা। বেশভূষা কথাবার্তা চালচলন সবই যে এখানকার লোকের থেকে আলাদা। তবে আমাদের গাড়োয়ালি বন্ধুরা সহজেই এদের সাথে মিশে যাচ্ছে। যে দেখছে আমাদের, সকলেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। রুদ্র মহাদেবের কাছে যাচ্ছি বলে কথা। এখনও কত পথ! গ্রামের ওপরের দিকে প্রায় গ্রামের শেষ সীমানাতে গ্রাম-দেবতার পাকা গাঁথুনির মন্দির। সেখানে জল খাবার পর ফিরে দাঁড়িয়ে দেবগ্রামকে বিদায় জানালাম।  

জয়ঢাকের সমস্ত ভ্রমণকথা একত্রে এই লিংকে