ভ্রমণ

bhromon07 (Small)

রাখী নাথ কর্মকার

জেটল্যাগের জন্য তারপরের ক’টা দিন কেমন যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই কেটে গেল ঠুমরির। তার মাঝেই ঠুমরি  খালি চারিদিকে চেয়ে দেখে আর  অবাক হয়– এখানে সব কিছুই কেমন যেন ইন্ডিয়ার থেকে  উলটো—লাইটের সুইচ উলটো, গাড়ির ড্রাইভিং বাঁদিকে,রাস্তায় হাঁটা ডাইনে !…মা বলেছে,ভারতবর্ষে ব্রিটিশ কানুন মেনে চলা হয়,আমেরিকায় তার ঠিক উলটো সবকিছু ! ঠুমরির আরো মজা লাগে যখন দেখে, ভারতে গরমে ঘেমেনেয়ে ঘরে ঢুকলে ঠান্ডিমেশিন রয়েছে শরীর ঠান্ডা করার জন্য, আর এখানে বাইরে বরফ ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য ঘরে রয়েছে হিটিং সিস্টেম !

ওদের নিউ জার্সির অ্যাপার্টমেন্টের সামনেটায় ফাঁকা জমিতে ছোট্ট একটুকরো রঙিন পার্ক,বসন্তের আগমনে পিছনে একটা গোলাপি চেরিগাছ উপচে পড়েছে ফুলে,একটা আকাশরঙা ব্লু জে পাখি ‘জে জে’ করে অনেকটা টিয়াপাখির মত তীক্ষ্ণস্বরে পাড়া মাতাতে থাকে সারাটা দিন।

একগুচ্ছ ভ্যাকসিনের পাট চুকিয়ে এখানকার প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছে ঠুমরি। সারাটাদিন স্কুলেই কেটে যায় ওর,কিন্তু স্কুলে যেতে ওর মোট্টে ভালো লাগেনা।

‘বন্ধু’ শব্দটা নেহাতই যেন বাহুল্য এখানে। ‘বুলিং’ কাকে বলে ও আগে জানত না। এখন জেনে গেছে। ওর মানে হল উপদ্রব করা। কেউই ওর পাশে বসতে চায় না,লাঞ্চটাইমে পাশে বসে খেতে চায় না,ওর সঙ্গে খেলতে চায় না। ঠুমরি এখন একা, একা আর একা।

মা বুঝিয়েছে, “তুমি সকলের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করবে। দেখবে,ঠিক বন্ধু পাবে।”

কিন্তু কই তা তো হয়নি এখনো! ও সকলকেই সাহায্য করার চেষ্টা করে,কিন্তু ও একদিন স্কুলে যেতে পারে নি,কেউ ওকে আগের দিনের ওয়ার্ড নোটগুলো দিল না। শেষে মিস রড্রিগাজের কাছ থেকেই ওকে চাইতে হল। সেদিন লাঞ্চটাইমে খেতে খেতে হাতে একটু ডিমের টুকরো লেগে গিয়েছিল। অমনি পাশের বেঞ্চে বসে কার্লোস, টাইলর, মার্থা সব্বাই ‘এও! এও!’ করে চিৎকার করতে শুরু করে দিল!

তড়িঘড়ি লাঞ্চবক্স বন্ধ করে রেস্টরুমে হাত ধুতে  ছুটেছিল ঠুমরি।  সেদিন গ্রুপ প্রজেক্টের সময়  মেগান ডেস্কটা নাড়াচ্ছিল,অথচ নির্লিপ্তভাবে দোষটা চাপাল ঠুমরির ঘাড়ে,আর মিস রড্রিগাজ মেগানের কথাই বিশ্বাস করে ওর রিসেসটা অফ করে দিলেন!   

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে টানা প্রায় সাতদিন ছুটি পড়ে গেল স্কুলে। স্প্রিং ব্রেক। স্কুল যাওয়ার বিচ্ছিরি জীবন থেকে মুক্তি। কিন্তু বাড়িতে বসেই বা কীভাবে সময় কাটাবে ভেবে ভেবে আকাশপাতাল এক করে দিয়েছে ঠু্মরি। একে তো কাছের লোকেদের কাছে না পাওয়ার কষ্ট, তার ওপর এই একলা একলা থাকা-ঠুমরির কিছুই যেন ভাল লাগে না!

সেদিন সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে হঠাৎ রজতকাকু এসে হাজির, “আরে ঠুমরি! এতবড়ো ছুটিটা কী করে কাটাবি রে? বাড়ি না বসে থেকে চল,আমরা কোথাও ঘুরে আসি। ওয়েদারটাও এ’বছর বেশ ভালোই ঠেকছে। টেম্পারেচার পনেরো-ষোল ডিগ্রির কাছাকাছিই থাকবে। আর চুপিচুপি জানিয়ে দি–আমার আগাম টিকিটও কাটা হয়ে গেছে! হুঁ হুঁ !  তাহলে এই শনিবারই আমরা ঘুরে আসব..দ্য মাজেস্টিক  স্ট্যাচু অফ লিবার্টিইইইইইই …

ঠুমরি যেন হাতে চাঁদ পেল! মা বাবাও প্রায় এক কথায় রাজি। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ওপর গত সপ্তাহেই স্যোশাল স্টাডিজে পড়েছে ঠুমরি। স্কুলের ফার্স্ট মার্কিং পিরিয়ডে এই স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ওপর প্রজেক্টও করতে হবে।

আর তর সইছিল না ঠুমরির। প্রচন্ড উৎসাহের সঙ্গে শনিবার কী পরে যাবে তা স্যুটকেসটা থেকে আজ বার করতে গিয়েই হঠাৎ স্যুটকেসের কোণায় ভাঁজ করে রাখা কালো জিনসটার পকেট থেকে টুক করে কী যেন একটা গড়িয়ে পড়ল মেঝের কার্পেটে ! আরে! এতো সেই ম্যাজিক ‘আওয়ার গ্লাস’টা ! এই কদিনে এটার কথা তো ও পুরোপুরি ভুলেই গিয়েছিল!

******

শনিবারের ঝকঝকে সকালের  তকতকে রোদ্দুর গায়ে মেখে,ফুরফুরে শিরশিরে হাওয়ায় উড়তে উড়তে রজতকাকুর গাড়িতে করে যখন স্টেটেন আইল্যন্ডে এসে নামল ওরা সব্বাই, তখন নীল আকাশে খুশির পলকা মেঘে হাসি হাসি ‘স্মাইলি ফেসের’ছড়াছড়ি! ঠিক যেন কলকাতার শীতের সকালের পিকনিক হচ্ছে। মা সক্কালবেলা থেকেই যত্ন করে তৈরি করেছেন নানা ধরনের খাবার। আলুর পরোটা,ডিমের তরকারি,ভেজিটেবল চপ। সব পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছেন সঙ্গে। এছাড়াও সঙ্গে আছে ঘরের তৈরি কেক,কলা,আপেল আর মিষ্টি। তা দিয়েই গাড়িতে বসে সারা হয়ে গেল সকালের ব্রেকফাস্ট।

রজতকাকু মানুষটিকে ঠুমরির ভারি ভাল লাগে। ছোটমামার মত মজারু,আর ছোটপিসির মত যত্নশীল। কত্ত গল্প যে তার স্টকে আছে তার ইয়ত্তা নেই। কলকাতাতেও বাবার সাথে একই প্রজেক্টে কাজ করতেন।বিয়ে থা করেন নি। কাকুর বাবা মারা গেছেন ছোটোবেলায়। মাও মারা গেছেন কয়েকবছর আগে। কোন পিছুটান নেই। বাবার অনেকটা আগে থেকে এ দেশে আছেন। ছুটিছাটা থাকলে তাঁকে বাড়িতে পাওয়াই যাবে না,তাই ‘উড়নচন্ডী’ শব্দটার সঙ্গে মিলিয়ে মা রজতকাকুর এক মজারু নাম দিয়েছেন ‘ঘুরনচন্ডী’। ঘুরনচন্ডী মানুষটা এখানকার অনেক জায়গা ঘুরে নিয়েছেন এর মধ্যেই। আজ তাই কাকুই ওদের গাইড।

গাড়ি থেকে নেমে নরম রোদ্দুরে হাত পা সেঁকে নিয়ে,ফেরি করে ওরা চারজনে এবার এসে পৌঁছল ব্যাটারি পার্কে। এই ব্যাটারি পার্ক থেকেই ওদের লিবার্টি আইল্যান্ডের যাওয়ার টিকিট অনুমোদন করাতে হবে।পার্ক থেকেই দূরে দেখা যাচ্ছিল আপার নিউ ইয়র্ক বে আর হাডসন রিভারের সংযোগস্থলে -নীল অস্থির ঢেউএর  বুকে জেগে থাকা ছোট্ট লিবার্টি আইল্যান্ডটিকে, আর সেই আইল্যান্ডের ওপর মাথা উঁচু করে নির্নিমেষে চেয়ে থাকা দেবী লিবার্টির সবুজ মূর্তিখানি।

bhromonotitbhromon01 (Small)কাকু বলতে শুরু করলেন, “জানিস ঠুমরি,১৬২৪ সালে স্থাপিত হওয়ার পর ১৭৮৫-৯৫ সাল পর্যন্ত এই নিউ ইয়র্ক শহরটি ছিল আমেরিকার রাজধানী । বিশ্বের মানচিত্রে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক,কূটনৈতিক -প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই এই শহরের শ্রেষ্ঠতা সন্দেহের ঊর্দ্ধে। নিউইয়র্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো শহর। রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতরও অবস্থিত এখানেই। আর এই সর্বজনীন শহরটির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ওই যে দূরে লিবার্টি আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সবুজ স্বাধীনতার দেবী স্ট্যাচু অফ লিবার্টি।”

কথা বলতে বলতেই কখন যেন স্ট্যাচু ক্রুজের ফেরি এসে গিয়েছিল। সেই খেয়ায় চেপে হাডসনের গম্ভীর ঢেউএর মাথায় নাচতে নাচতে ওদের ফেরি চলল আইল্যান্ডের দিকে। ডেক থেকেই ভিড় করে থাকা পর্যটকদের রোগা,মোটা চেহারার জটলার ফাঁক দিয়ে ঠুমরির চোখে পড়ছিল স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মূর্তিটি । চারপাশে সকলে পটাপট,খটাখট ক্যামেরায়,মোবাইলে ছবি তুলে যাচ্ছে,দেবীসাক্ষাতের মুহূর্তটুকুকে বন্দি করে রাখতে চায় সবাই চিরদিনের মত! ঠুমরির চারপাশে ওরই বয়সের কয়েকটি মেয়ে,মাথায় লিবার্টির স্পাইকঅলা সবুজ মুকুট পরে মহানন্দে লাফালাফি করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঠিক যেমন কলকাতায় ওদের স্কুলের গো অ্যাজ ইউ লাইক কম্পিটিশনে কেউ রানি,কেউ পরী সেজে মাথায় মুকুট পরে ঘুরে বেড়াত সেইরকম। মাথার ওপর গাংচিলগুলো কী নিশ্চিন্তে ডেকের ওপর পাক দিয়ে বেড়াচ্ছে!

আইল্যান্ডে নেমেও দেখে বেশ মজা হল। লোকেদের পায়ের কাছেই তিড়িং বিড়িং গঙ্গাফড়িংএর মত  নেচে বেড়াচ্ছে পাখিগুলো। হাতে করে কেউ কিছু খাবার দিলে অকুতোভয়ে দৌড়ে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা বললেন, “এখানে অকারণে কেউ এদের মারে না বা ক্ষতি করে না, তাই এরাও মানুষকে ভয় পায় না।  দুষ্টুলোকের পাল্লায় পড়লে কবেই এরা প্লেটে রোস্ট হয়ে চলে আসত!”

ইশশশশশ! শুনে এত খারাপ লাগল ঠুমরির যে ও ঠিকই করে নিল,ও একেবারে পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাবে! যদিও হ্যাঁ–স্বীকার করতেই হবে মায়ের হাতের মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন চপ ওর দারুণ প্রিয় ! খাবারগুলোর কথা মনে পড়লেই ওর জিভে জল চলে আসে…কিন্তু …নাহ, এবার লোভ সামলাতেই হবে,হবেই হবে!

“দেখ ঠুমরি,তুই এখন একশ আঠাশ বছরের পুরোন,পৃথিবীবিখ্যাত ধাতুর মূর্তি ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র পেডিস্ট্যলে।”

 পাথুরে পেডিস্ট্যলের খোলা চৌহদ্দিতে রজতকাকুর কথাগুলো সমুদ্রের ঝোড়ো নোনা হাওয়ার তাড়ায় ছেঁড়া কাগজের টুকরোর মতই ফুরফুরিয়ে উড়ে গিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছিল, “জানিস ঠুমরি, মুক্তি আর স্বাধীনতার প্রতীক স্ট্যাচু অফ লিবার্টি আসলে ফ্রান্সের দেওয়া এক অনুপম উপহার যা ১৮৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার শতবর্ষ উপলক্ষে তার ঠিক দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৮৮৬ সালে ফ্রান্স তুলে দিয়েছিল আমেরিকার হাতে। ১৯২৪ সালে যা আমেরিকার জাতীয় সৌধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। রোমান স্বাধীনতার দেবী লিবার্টাসের আদলে তৈরি এই দেবীর পরনে ভারী,ঢোলা পোশাক।  পেডিস্ট্যল থেকে ১৫১ফুট উঁচু লিবার্টির পায়ের তলায় পড়ে রয়েছে ভাঙা শিকল যা আসলে অন্যায়ের বাঁধন ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রতীক। শক্ত লোহার খাঁচার ওপর ছোট ছোট তামার পাতের টুকরোয় মোড়া মূর্তির বাঁ হাতে আইনের ফলক যাতে রোমান হরফে খোদাই করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাদিবস-৪ জুলাই,১৭৭৬। আর ডান হাতে স্বাধীনতার সোনালি জ্বলন্ত মশাল। সমুদ্রের নোনাজলের অত্যাচারে তামার সেই রং এতদিনে বদলে গিয়ে কেমন অদ্ভুত সবুজ রঙ ধরেছে!  দেবীমূর্তির মাথার মুকুটের সাতটি ছটা আসলে সাতটি মহাসাগর ও মহাদেশের প্রতীক। জনশ্রুতি এই যে,ফরাসী ভাস্কর ফ্রেডেরিক অগস্ত বারথোল্ডি,যিনি স্ট্যাচুটি তৈরি করেছিলেন,তাঁর মায়ের মুখের আদলেই নাকি তৈরি হয়েছিল দেবী লিবার্টির সুন্দর মুখখানি।”

ঠুমরির কানে ছাড়াছাড়া এসে পৌঁছচ্ছিল কথাগুলো। এগুলো  অবশ্য মোটামুটি সবই ওর জানা। এখানে স্কুলের স্যোশাল স্টাডিজে এগুলো পড়েছে ও।

পেডিস্ট্যল থেকে আলোআবছায়ায় ১৫৪টি পাকানো সিঁড়ি বেয়ে ওরা চারজনে যখন স্ট্যাচুর ক্রাউনে এসে পৌঁছল, এই হিমেল হাওয়াতেও দরদরিয়ে ঘামছে ওরা সবাই। ক্রাউনের ২৫টা চৌখুপ্পি জানালা থেকে কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল দূরের নিউ ইয়র্ক শহরটাকে ! নীচে তখন লিবার্টি আইল্যান্ডে এসে থামা স্ট্যাচু ক্রুজের আর একটি ফেরি থেকে পিঁপড়ের মত ছোটো ছোটো মানুষগুলো নেমে আসছিল পিলপিল করে।    

ক্রাউন থেকে আবার ওরকমই পাকানো অন্য একটি সরু সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে লিবার্টির কিছু অজানা গল্প বলতে শুরু করেছিলেন রজতকাকু, “লিবার্টির আইডিয়াটা প্রথমে কার মাথায় এসেছিল বল তো ঠুমরি? ফরাসি অধ্যাপক এডোয়ার্ড দ্য লেবুল্যের। ১৮৬৫ সালে এক কান্ট্রি হাউসে তাঁরই ডাকা একটি ভোজসভায় তিনি প্রথম প্রস্তাব রাখলেন, আগামী ১৮৭৬ সালে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমেরিকার স্বাধীনতার শতবর্ষপূর্তি  উপলক্ষে  ফ্রান্সের তরফ থেকে আমেরিকাকে কোন উপহার দেওয়া যায় কিনা।

“আইডিয়াটা মনে ধরেছিল তরুণ ফরাসি শিল্পী ফ্রেডেরিক অগস্ত বারথোল্ডির। ১৮৩৪ সালে ফ্রান্সে তাঁর জন্ম।ছেলেবেলায় বাবা মারা যান। শিল্পকলার প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ দেখে মা তাঁকে প্যারিসে শিল্পকলা নিয়ে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। গ্রিস,রোমের নিওক্ল্যাসিক্যাল শিল্পরীতিতে তৈরি বীরোচিত,সমীহজাগানো অমর কীর্তিস্তম্ভের মহান আদর্শ তাঁকে মোহিত করত।

“১৮৫৬ সালে প্রথমবার যখন ইজিপ্টের ম্যাজিক দুনিয়ায় তিনি পা রাখলেন, প্রাচীন সুউচ্চ পিরামিডের অভিজাত রূপ আর বিপুলাকায় স্ফিংক্সের রহস্যময়তা অজান্তেই সম্মোহিত করে তুলেছিল বারথোল্ডিকে। স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল এমনই কিছু তৈরি করার,যা সমস্ত পৃথিবীকে হতবাক করে দেবে।    

“ইতিমধ্যে ১৮৭০ সালে জার্মানি ফ্রান্স আক্রমণ করে,শুরু হয় ফ্রান্স প্রাশিয়ার যুদ্ধ ।এক অস্থির,টালমাটাল সময় চলছিল তখন,অবশেষে ১৮৭১ সালে তৃতীয় নেপোলিয়নের পতন ও যুদ্ধ শেষে ফ্রেঞ্চ রিপাবলিক গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।

১৮৭১ সালের জুন মাসে নিউ ইয়র্ক এসে হাজির হলেন বারথোল্ডি। আপার নিউ ইয়র্ক হার্বরের কাছে ছোট্ট বেডলো’স আইল্যান্ডটি দেখেই তাঁর মনে হল এটাই সেই জায়গা, যেখানে মাথা তুলে দাঁড়াবে তাঁর লিবার্টি! লেবুল্যের ছিল প্রচুর চেনাশোনা।সেই সূত্র ধরেই  ইউ এস প্রেসিডেন্ট ইউলিসেস এস গ্রান্ট  ছাড়াও আরো অনেকের সঙ্গেই ইতিমধ্যে বারথোল্ডির দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে।

ফ্রান্সে ফিরে প্রায় চার বছর ধরে এরপর পোড়ামাটির মডেলের পর মডেল তৈরি করে চললেন তিনি। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখ,পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি, কলোসাস অফ রোডস’তৈরি হয়েছিল  খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। গ্রিক সূর্যের দেবতা হিলিওসের আদলে তৈরি ব্রোঞ্জের সেই মূর্তিটি ২২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভূমিকম্পে  ধ্বংস হয়ে যায়। শোনা যায়,সেই মূর্তিটিরও ডান হাতটি ছিল উত্তোলিত ভঙ্গিমায়,মাথার মুকুটেও ছিল স্পাইক। লোকে তাঁর লিবার্টির মূর্তিটি সেই প্রাচীন মহিমান্বিত  স্থাপত্যটির সঙ্গে  তুলনা করবে তা জানতেন  বারথোল্ডি। তিনি চেয়েওছিলেন, তাঁর লিবার্টি হবে ‘এ যুগের কলোসাস’।

“১৮৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর পাঁচ ফুটের কাছাকাছি লিবার্টির প্রাথমিক মডেলটির প্রদর্শন করা হয় ফ্র্যাঙ্কো-আমেরিকান ইউনিয়নের ব্যবস্থাপনায় প্যারিসের এক বিখ্যাত হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে,যার মূল উদ্দেশ্য ছিল,প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করা। সেই প্রাথমিক মডেলটি এখন প্যারিসের লাক্সামবার্গ গার্ডেন পার্কে সংরক্ষিত আছে। ১৮৭৬ সালে মশালসমেত লিবার্টির ডানহাতটি ফিলাডেলফিয়ায় এবং ১৮৭৮ সালে লিবার্টির মাথাটি  প্রদর্শিত হয়েছিল প্যারিসে।

“যাই হোক,ছুতোর মিস্ত্রী, মেটাল ওয়ার্কার, প্লাস্টারার –বারথোল্ডির তত্ত্বাবধানে বাছা বাছা দক্ষ ফরাসি শিল্পী ও কারুবিদদের প্রায় নয় বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে তৈরি হয়েছিল সেই মূর্তি।

“এইখানে আরো একজন বিখ্যাত মানুষের কথা না বললে লিবার্টির ইতিহাস প্রায় না-বলাই রয়ে যাবে। তিনি হলেন আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেল,যিনি প্যারিসের সুবিখ্যাত আইফেল টাওয়ার তৈরি করেছিলেন। ছোট ছোট পাতলা তামার পাত জুড়ে জুড়ে  সম্পূর্ণ মূর্তিটি তৈরি করতে গিয়ে বারথোল্ডি দেখেছিলেন,শুধুমাত্র তামার পাতগুলিরই সবসুদ্ধ মোট ওজন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল প্রায় একত্রিশ টনেরও বেশি। এত ভারী  মূর্তিটি কোন কঠিন,শক্তপোক্ত অবলম্বন না হলে কোনমতেই টিঁকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। বারথোল্ডি তখন লিবার্টির মেরুদন্ড অর্থাৎ লোহার খাঁচাটির নকশা করবার কঠিন দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছিলেন ‘লোহার জাদুকর’ আইফেলের হাতে। স্ট্যাচুর ঠিক মাঝখানটিতে ওঠানামার জন্য আইফেল তৈরি করেছিলেন একজোড়া পাকদন্ডী সিঁড়ি। মূর্তির কাঠামোর জন্যও তিনি কারটেন ওয়াল নামে এক নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন।      

“১৮৮৪ সালের মধ্যেই বারথোল্ডির ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ পুরোপুরি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু,এদিকে কী  হয়েছিল,বিপুলায়তন লিবার্টির মূর্তিটি স্থাপন করার জন্য ঠিক তেমনই একখানি প্রকাণ্ড,শক্তপোক্ত  ভিতের প্রয়োজন ছিল,যা তৈরি করার ভার দেওয়া হয়েছিল আমেরিকান স্থপতি রিচার্ড মরিস হান্টকে। কিন্তু টাকার অভাবে আমেরিকায় সেই কাজ ততদিনে বন্ধ হয়ে গেছে।

বারথোল্ডি পড়লেন অথই জলে। তবে কি তাঁর স্বপ্ন সফল হবে না? এতকিছুর পরে লিবার্টি কি নিউ ইয়র্ক হার্বারে তার নিজস্ব ঠাঁইটি পাবে না? ঠিক এমন সময়,সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’সংবাদপত্রের মালিক জোসেফ পুলিতজার! ওঁর নামেই সাংবাদিকতা,সাহিত্য ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এখন ‘পুলিতজার  প্রাইজ’ দেওয়া হয়।  কোটিপতিদের কঠিন সমালোচনা করে তিনি কাছে ডেকে নিলেন সাধারণ মানুষকে। কথা দিলেন,পেনি থেকে ডলার -যে যাই দান করুক, প্রত্যেকের নাম প্রকাশ করবেন তাঁর কাগজে। শ্রমিক, মজুর, বুড়ো,জোয়ান, অভিবাসী, স্কুলের ছোট পড়ুয়া–সব্বাই সাধ্যমতন চাঁদা দিলেন। মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই প্রায় এক লক্ষ ডলারেরও বেশি জমা পড়ে গেল। জোরকদমে শুরু হয়ে গেল কাজ।

“১৮৮৫ সালের জুন মাসে,২১৪ টি ক্রেটে  প্যাক করা অবস্থায় মূর্তির  টুকরোগুলি ফ্রেঞ্চ যুদ্ধজাহাজে করে এসে পৌঁছল নিউ ইয়র্ক হার্বারে। ১৮৮৬ সালের ২৮শে অক্টোবর ‘ডেডিকেশন ডে’তে লিবার্টির মুখে ফ্রান্সের পতাকার আবরণ সরিয়ে,নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মূর্তিকে সম্বর্ধনা জানাল সকলে।

bhromonotit02 (Small)“স্ট্যাচু অব লিবার্টি’, বা ‘লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য  ওয়ার্ল্ড’ ছিল মুক্তি, স্বাধীনতা আর আশার প্রতীক। এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা যা  না বললেই নয়,লিবার্টির এই কঠিন,শীতল ধাতব অস্তিত্বের মাঝেও উষ্ণ হৃদয়,মুক্ত প্রাণের কন্ঠস্বরের উদ্দীপনা পুরে দিয়েছিল এক তরুণী। ১৮৮৩ সালে চাঁদা তোলার সময় আমেরিকান কমিটি নিউ ইয়র্কে সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে একটি নিলামের আয়োজন করেছিল। বহু বিখ্যাত লেখকের পান্ডুলিপি তাতে ছিল। তাদের মধ্যেই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল এক তরুণী কবি এমা ল্যাজারাসের কাজটি। রাশিয়া থেকে অত্যাচারিত উদ্বাস্তুদের আমেরিকায় পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়ার সমসাময়িক ঘটনাদ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘দ্য নিউ কলোসাস’।

“এই কবিতাটিতে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ বা ‘মাদার অফ এক্সাইলস’ এর মূল অর্থ তুলে ধরা হয়েছিল ‘আমেরিকা,দ্য হোম অফ ফ্রি’ হিসেবে। ১৯০৩ সালে এই কবিতার ছত্র খোদাই করে  দেওয়া হয়েছিল লিবার্টির পেডিস্ট্যলে।  মুক্তির প্রতীক ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’  ১কোটি ২০লক্ষেরও বেশি সেইসব বহিরাগতদের  স্বাগত জানিয়েছিল যারা বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৮৯২ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে উন্নত ভবিষ্যৎ ও জীবনের আশায় কাছেই এলিস আইল্যান্ডের দরজা দিয়ে আমেরিকায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল ।”   

রজতকাকুর গল্প শুনতে শুনতে  নিচের লিবার্টি মিউজিয়ামটাও ওদের ঘোরা হয়ে গেল । মিউজিয়ামের আনাচেকানাচে ছড়ানোছিটানো বিভিন্ন ছবি, স্ট্যাচুর নানা সাইজের প্রতিমূর্তি রজতকাকুর গল্পেরই প্রতিধ্বনি করে চলছিল। অতীতের ঘটনাবহুল গল্পের আকর্ষণীয় দুনিয়াটায় কখন পুরোপুরি যেন হারিয়েই গিয়েছিল ঠুমরি। হঠাৎ নাকটা সুড়সুড় করে উঠতে জিনসের পকেট থেকে রুমালটা বার করতে গিয়ে কী একটা যেন হাতে ঠেকল ওর…সেই আওয়ার গ্লাসটা ! এখানে আসার সময় সকালবেলায় চুপিচুপি পকেটে পুরে নিয়ে এসেছিল এটাকে ঠুমরি। এটার কার্যকারিতাটা বুঝি পরখ করে দেখতে হবে না? প্লেনের মিস্টার এহসান সুলেমান শাহ যে সত্যি কথাই বলেছিলেন,তার প্রমাণ কী? এর আগে যে দুএকবার এটাকে পরখ করে দেখার কথা ভাবেনি ও তা নয়, কিন্তু বছরে মাত্র তিনবারের ত্রিসীমানাতেই ওটার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ বলে সুযোগটা নষ্ট করতে চায় নি ও। ঠিক করেছিল কোন  গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছে তবেই ওটার সদ্ব্যবহার করবে। আজই সেই সুবর্ণসুযোগটা হাতে এসেছে। আজই ঠুমরি যাচাই করে  নিতে চায়,এই লিকপিকে আওয়ার গ্লাসটার দৌড় কদ্দূর। মিস্টার এহসান সুলেমান শাহের টাইমট্রাভেলের কথাটা ঠিক কতটা সত্যি আর কতটা গাঁজাখুরি গপ্পো সেইটা সে যাচাই করে নেবে আজ।     

এইবারে ওর পক্ষে সবচেয়ে মুশকিল কাজ হল যে,কোন সালে ও ফিরে যাবে সেটা ঠিক করা। আচ্ছা ১৮৭৫ সালে ফিরে গেলে কেমন হয়? যখন লিবার্টির প্রাথমিক মডেলটা তৈরি করেছিলেন বারথোল্ডি?

নাকি ১৮৮৪ সালে, যখন স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র মূর্তিটা বানানো পুরোপুরি সম্পূর্ণ হয়ে গেছিল? যখন ‘গ্যাজেট,গঁতিয়ে এন্ড কোম্পানি’র উঠুনের এক অনুষ্ঠানে বারথোল্ডি পরিপূর্ণ স্ট্যাচুটি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত,লিভাই মর্টানের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেজেন্ট করেছিলেন  আমেরিকানদের প্রতি তখন গিয়ে হাজির হলে কেমন হয়? ধুত্তোরি! মাথা-টাথা সব ঘেঁটে যাচ্ছে ঠুমরির। নাহ–আগে রেস্টরুমে যেতে হবে,নিরিবিলি একান্ত জায়গা বলতে এছাড়া আর কোন জায়গার কথা মনে পড়ল না ঠুমরির ।

মাকে বলে ও কাছের রেস্টরুমে এসে ঢুকল। খুব সাবধানে জিনসের পকেট থেকে পেনসিলটর্চের মত ছোট্ট,সরু ‘আওয়ার গ্লাস’টা বার করল ঠুমরি। তার একটা প্রকোষ্ঠ অর্থাৎ চেম্বার পুরো বালিতে ভর্তি, আর অন্যটা পুরোপুরি খালি।

আওয়ার গ্লাসের মাঝের প্যাসেজটা অর্থাৎ ‘নেক’টা যেন কোন জাদুবলে ‘লক’ করা আছে,-একটা ‘চেম্বার’ থেকে অন্য চেম্বারে বালি ঝরে পড়ার জায়গা আছে তো? হাতে নিয়ে একবার ওটাকে ওপরনীচ করল  ঠুমরি। কিছুই হল না। তাহলে কি পুরোটাই  মিস্টার এহসান সুলেমান শাহের মনভোলানো গল্প? কী যেন বলেছিলেন ভদ্রলোক? আওয়ার গ্লাসটি হাতে নিয়ে ঠিক যে সময়ের কথা ও চিন্তা করবে,পৌঁছে যাবে সেখানেই—

কিন্তু কোন সময়টা সেটাই তো ও এখনো ঠিক করে উঠতে পারছে না! আচ্ছা, ‘ডেডিকেশন ডে’টা ট্রাই করলে কেমন হয়? নাকি…?  

একটা ‘খুট’ করে আওয়াজে চমকে উঠে ঠুমরি  দেখল, ওপরের চেম্বারটা থেকে হঠাৎই আস্তে আস্তে, তিরতির করে বালি ঝরে পড়তে শুরু করেছে নীচের চেম্বারে! মাথাটা হঠাৎ কেমন ভারি ভারি ঠেকল ওর,কেমন যেন একটা ঝিমঝিম ভাব-

-টলতে টলতে রেস্টরুমের একটা কোণায় ঠেস দিয়ে বসে পড়ে এবার ওর মনে হল চোখের সামনে সব যেন কেমন দুলতে শুরু করেছে। ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। চোখদুটো একবার ভাল করে রগড়ে নিয়ে ঠুমরি চোখ বড়ো বড়ো করার চেষ্টা করল।  ও নিজেকে দেখতে পাচ্ছে,ঠিক যেমন আয়নায় সবাই নিজেকে দেখতে পায় !  কিন্তু এই ছোট্ট কেবিনটায়,বন্ধ দরজার এপারে কোন আয়না নেই। তাহলে ও নিজেকে দেখতে পাচ্ছে কী করে? শরীরটা যেন ভীষণ হাল্কা হয়ে গেছে ঠুমরির। হাওয়ার মত হাল্কা ! কেবিনের বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে দিব্যি গলে বেরিয়ে এল ঠুমরি,অথচ পিছন ফিরে উঁকি মেরে দেখল ও কিন্তু ঠিক সেভাবেই কোণায় ঠেস দিয়ে বসে আছে। হাতের ফাঁকে জীবন্ত হয়ে ওঠা আওয়ার গ্লাসটা।

কীসের একটা আওয়াজ কানে আসছিল ঠুমরির,আর ভেবে সময় নষ্ট না করে আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে সেটা খুঁজতে এদিকওদিক উঁকি মারল ও। পুরো জায়গাটাই যেন ভোজবাজির মত বদলে গেছে। রেস্টরুমের বাইরে যে প্যাসেজটা দিয়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির পেডিস্ট্যলের মিউজিয়ামে পৌঁছোন যায় সেখানটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু দূরে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাচ্ছে ও। সেখান দিয়েই প্রচুর  মানুষের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে । 

ক্রমশ

জয়ঢাকের সমস্ত ভ্রমণকথা একত্রে এই লিংকে