ভ্রমণ

 

bhrmontitle (2)

bhrmontitle (1)

ডুমক

bhromonhimaloy (1) (Medium)ইন্দর সিং ভান্ডারির বাড়ির ছাতটা ভারি মনোরম। উত্তর পূবে পাহাড়ের ঢাল আর দক্ষিণ পশ্চিমে রুদ্রগঙ্গা। মাঝে অনেকটা ছড়ানো উপত্যকার ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গ্রাম। গ্রামের ধারে রাস্তার পাশেই লম্বা টানা ঘরের ওপরে এই ছাত। বিকেলের আলোয় ফুরফুরে শীত শীত হাওয়ায় চাদর গায়ে বসে চা খেতে খেতে এমন গ্রাম দেখার কী যে সুখ তা কী আর বলব! ইন্দরজি অবশ্য ছাতে উঠতে পারেননি তখন, যখন আমরা ওখানে বসে চা খাচ্ছিলাম। ওঁর পা ভেঙে গিয়েছিল। নীচে ঘরের সামনে একটা নীচু খাটিয়ায় পা মেলে বসেছিলেন ভদ্রলোক। দিন দু চার আগে রাস্তা ধরে আসার সময় বাধানো রাস্তার ধারে বেকায়দায় পা হড়কে এই বিপত্তি। কোনো মানে হয়!

ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে যাওয়ায় তাদের সঙ্গে তক্ষুণি তক্ষুণি আলাপ হল না। ছাতে বসে থাকতে আমাদের এত মজা লাগছিল যে শীত করলেও কেউই নেমে ঘরে চলে যাবার কথা মুখেও আনছিল না। বরং গায়ের চাদরটাকেই বেশ করে জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে বসে বলাবলি করছিল যদি আরেক পেয়ালা করে চা পাওয়া যেত! যাহা বলা, এরই মধ্যে ইন্দরজির ছোটো ভাইপো কেটলি হাতে সিঁড়ি বেয়ে হাজির, “আপকে চায়ে।”

bhromonhimaloy (2) (Medium)

সকাল সকাল কল্পেশ্বর লাগোয়া গ্রাম দেবগ্রাম থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের পথ বেয়ে উরগাও উপত্যকার শেষ গ্রাম বাসা ছাড়িয়ে পিতরা ধার পার হয়ে, কালগোটে গ্রাম পেড়িয়ে দুপুর দুপুর নাগাদ ডুমক গ্রামে পৌঁছে আমাদের ভারী ভালো লেগেছিল। এখানে অবশ্য অন্যপথে গোপেশ্বর থেকে পায়ে হেঁটেও সরাসরি চলে আসা যায়। গ্রামের লোকেরা সে পথ চেনে, যায়ও। গোপেশ্বর চামোলি জেলার সদরঘাঁটি।

একঝলক দেখেই বোঝা গেল বেশ পরিচ্ছন্ন গ্রাম। বাঁধানো রাস্তা। দু’দুটো স্কুল। একটা স্কুল তো একেবারে ইন্দরজির বাড়িতে ঢোকার মুখেই, রাস্তার উল্টোদিকে। থাকা হবে কোথায় এটা জানার জন্য সে বাড়িতে ঢুকে জিজ্ঞেস করতেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন ভদ্রলোক, “আরে আমার বাড়িতেই তো ট্রেকারদের জন্য বন্দোবস্ত মজুদ। কোথাও যাবার দরকারটা কী?”

অনায়াসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা জুটে তো গেলই, একটা গোটা রান্নাঘরও মিলে গেল রান্না করার জন্য। গল্পও করতে করতে এইবারে সন্ধ্যা নেমে এল। একটা দুটো তারা ফুটে উঠল আকাশে। আমার বন্ধু রাজা তারা চিনতে পারে ভালো। তাকে বললাম, “এবারে আমাকে কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ চিনিয়ে দিবি ঠিক। কলকাতায় গিয়ে শীতের দিনে সাতটা সাড়ে সাতটার সময় মাথার ওপর পাশাপাশি ভীড় করে থাকা ওই তারাদের ঠিক চিনে নিতে পারব তাহলে।”

“আর কালপুরুষ ?”, বন্ধু জিজ্ঞেস করে।

“ওটা চিনে নিতে পারব। লুব্ধক আছে না !”

“সপ্তর্ষি মণ্ডল অবশ্য ওই শীতের সময় একটু গভীর রাতে দেখা যায়। রাতে কি উঠেছ কখোনো? দেখতে?”

“না ভাই।”

“এবারে একবার উঠে দেখো। আর অগস্ত্য?”

“সে কোথায়?”

“উত্তর আকাশে যেমন ধ্রুবতারা, ঠিক তার বিপরীতে দক্ষিণ আকাশে অগস্ত্য। একবার আমাদের প্রকৃতিপাঠ শিবিরে যেও, আরো ভালো করে এইসব চিনে নিতে পারবে।”

রাতে ইন্দরজির স্ত্রীই আমাদের রুটি বানিয়ে দিলেন। বেশ ফুলকো ফুলকো গরম রুটি উনুন থেকে সরাসরি আমাদের পাতে। খেতে খেতেই স্কুলের গল্প করলেন ইন্দর সিং। দুটো স্কুলের একখানা সরকারি। প্রাথমিক বিদ্যালয়। অন্যটা গ্রামের লোকেদের মিলে বানানো। সেবারেই কেন্দ্রীয় স্কুল বোর্ডের মান্যতাও পেয়েছে পাঁচ বছর চালানোর পর। আর্থিক অনুদানও। ফলে চিন্তা দূর হয়েছে অনেকটা। এই স্কুল দশ ক্লাস অবধি। ইন্দর বল্লেন এটাই বেশি ভালো। গ্রামের লোকেরা একযোগে অনেক কষ্ট করে এই স্কুল বানিয়েছেন। এটা তাঁদের সন্তানের মতো। আরও একটা দারুণ খবর জানা গেল। পুরোনো ছাত্ররা যারা এই স্কুল থেকে পাশ করে শহরে কলেজে পড়তে যায়, ফিরে এসে অন্তত একবছর তাদের এখানে শিক্ষকতা করতে হয়। চাকরি পেয়ে বা অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা ও রোজগার শুরু হলে আর্থিক সাহায্যও করে সকলে। তবে গ্রামে ফিরে এসে পড়ানোটা বাধ্যতামূলক। আর ছেলেমেয়েরা সানন্দে তা করেও।

সকালে দেখা হল ইন্দরজির ছেলে মেয়েদের সঙ্গে। সকাল সকাল সবার পরণে স্কুলের পোশাক। বাড়িতে আরও বাচ্চারা আছে। ইন্দরজির ভাই দাদা অন্য আত্মীয়স্বজন। কোলের বাচ্চা আর একেবারে এক দু বছরের গোটা তিনেক শিশু বাদ দিয়ে সকলেই তৈরি, স্নান করে স্কুল পোশাকে, ব্যাগ নিয়ে। এই বাড়ি থেকেই স্কুলে যায় নয় নয় করে সাতটি বিভিন্ন বয়েসের ছেলেমেয়েরা। সকলেই নমস্তে করে চলে যাবার সময় বাড়ির সদর দরজা পার হয়ে পিছু পিছু বাইরের রাস্তায় এসে দেখি গোটা গ্রাম থেকে গাঢ় নীল প্যান্ট আর আকাশি নীল জামায় ছেলেমেয়েরা চলেছে ছোট্ট স্কুলের দিকে। পুবদিক থেকে রোদ এসে পড়েছে স্কুলবাড়ির বারান্দায়। গোটা গ্রাম যেন হাসছে সেই আলোয়। অপূর্ব সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে। ডুমক গ্রামে থাকার সময়কাল খুবই কম হলেও তাকে মনে রাখবার মূল কারণ এই স্কুল। পাহাড়ের এই অসাধারণ সুন্দর গ্রামটিতে বাড়তি সৌন্দর্য যেন যোগ করেছে এই অসামান্য বিদ্যালয়।

গ্রাম থেকে বেড়িয়ে কালাপানি নদী পেরোলেই আবার জঙ্গল। জঙ্গলের রাস্তায় বিস্তর পাখি। হিমালয়ের নানান প্রজাতির পাখি। পথে আমাদের সঙ্গে দেখা হল বাসা গ্রামের কুঁয়ার সিং নেগীর সঙ্গে। সে পায়ে হেঁটে গোপেশ্বর যাচ্ছিল। খানিকটা পথ আমাদের সঙ্গে যাওয়া যাবে বলে একসাথে চলল।  খুব হাসিখুশি ছোট্টোখাট্টো মানুষ সে। আমরা ইতিউতি পাখি দেখছি বলে সে-ও বিপুল উৎসাহে আমাদের দেখাতে শুরু করল। একটা কালো ল্যাজ কালো মাথা সবুজ রঙের পাখি দেখিয়ে বলল ওটার নাম কী জানো? নেউলি। হলদে ঠোঁটের চড়াইয়ের মতো পাখিটা তখন পোকা খেতে ব্যস্ত। আবার কাকের মতো একখানা কুচকুচে গা হলদে ঠোঁটের পাখি দেখিয়ে বলল এটার নাম কালচিনি। আরও আরও অনেকগুলো পাখির নাম সে বলেছিল বটে কিন্তু আমি ভুলে গেছি। তবে একখানা পাখির মজার নাম ভুলিনি। চিরিবিরি। শুনেই আমায় ছড়ায় পেল। জঙ্গলের ছায়ায় বসে আমার বন্ধুরা যখন কাঠকুটো জোগাড় করে চা করতে ব্যস্ত তখন আমি টপ করে ছড়াটা লিখে ফেল্লাম। এই যে সেটা।

চিরিবিরি পাখিটা

মিশকালো ঠোঁটে

জঙ্গলে সারাদিন

শুধু পোকা খোঁটে।

বাদামি ও লালে মেশা

ল্যাজ খালি নাড়ে

আরো গাঢ় লাল রঙ

পেটের দুধারে।

ডুমক গিয়েছিলাম, বহু বছর কেটে গেছে তারপর। কদিন আগে আমার এক বন্ধু ওপথে যাবে শুনে একখানা ছবি দিয়ে বললাম এই ছবিখানা ইন্দরজির বাড়িতে দিয়ে দিও। এটা ওর ছেলেমেয়েদের ছবি। সে ফিরে এসে আমায় বললে, ইন্দরজির সাথে তার দেখা হয়েছিল। তিনি একইরকম আছেন। শুধু ছবির ছেলেমেদের পাওয়া যায়নি।

আমি আঁতকে ওঠায় সে তাড়াতাড়ি আমায় আশ্বস্ত করে বললে, “আররে তারা কি আর সেই ছোটোটি আছে?  সব যে বড়ো হয়ে গেছে! কত বছর হল সে খেয়াল আছে? তবে তারা দিব্যি মনে করতে পারল ছবি তোলার কথা। কতোদিন বাদে আবার ছেলেবেলা ফেরত এল যে তাদের কাছে!