ভ্রমণ

পূর্বপ্রকাশিতের পর

পেডিস্ট্যল থেকে বেরিয়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ফোর্টউড লেভেলের একটা কোণায় এসে ঠুমরি ঠেসে দাঁড়াল –ওর চারিদিকের সমস্ত কিছুই এক নিমেষে কেমন যেন বদলে গেছে। চেনা পরিবেশটা কোন জাদুবলে হঠাৎ ভ্যানিশ! সকালের রোদ ঝলমলে দিনটাও কেমন এক মুহূর্তে বদলে গিয়ে বিচ্ছিরি একটা গোমড়ামুখো,স্যাঁতস্যাঁতে দিনের চেহারা নিয়েছে।

ঝাপসা কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশে কোন কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না! তার মধ্যে বিচ্ছিরি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির তান্ডব! বুকের মাঝে কেমন যেন  ধুকপুক করতে শুরু করল ওর-মা, বাবা, রজতকাকু–কেউ কোত্থাও নেই–চারিদিকে এত লোকের ভিড়ে কাউকে চেনে না ও! তবে ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না,কেমন যেন হাওয়ার মত ভেসে আছে ও,শরীরে কোন ভার নেই,ভর নেই–!

বেডলোজ্‌ আইল্যান্ডে যারা রয়েছে তাঁরা ফরাসি  বা আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ব্যক্তি বলেই মনে হল ঠুমরির।  বেডলোজ্‌ আইল্যান্ডের চারপাশে বহু ছোট বড় নানা সাইজের নৌকা। “প্লেজার বোট” ভর্তি লোকজন হামলে পড়েছে এই মহান উৎসবের সাক্ষী হতে। এদিকওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ঠুমরি,ওর কাছেই জমাট বেঁধে থাকা স্টিমশিপ আর টাগবোটগুলোর ( বন্দর এলাকায় বড় বড় জাহাজ টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তিশালী ছোটো বোট) মধ্যে থেকে ভিড়টা হঠাৎ প্রবল উৎসাহে চিৎকার করে উঠতে সেদিকে তাকিয়ে দেখল,এক গুরুগম্ভীর ভদ্রলোক আরো অনেকের সাথে একটা ইয়টে করে এসে নামলেন এই বেডলোজ্‌ আইল্যান্ডে।

সকলের উচ্ছ্বসিত চিৎকার শুনে ঠুমরি বুঝল,ইনিই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড! আইল্যান্ডের একপাশে নোঙর করা লাল রঙের একটা বার্জ,যার গায়ে বড়োবড়ো করে লেখা -“ইট, ড্রিঙ্ক এন্ড বি মেরি”।

bhromonotit02 (Medium)সেই বার্জ উপচে পড়া লোকেদের কথাবার্তায় কান পাতল ঠুমরি—

“আরে আজকের দিনটায় পুরো আমেরিকাই ভেঙে পড়েছে এই নিউ ইয়র্ক শহরে,ভর্তি ভর্তি ট্রেন উপচে লোক এসে হাজির হয়েছে এখানে! শহরের একটা হোটেলও খালি নেই…”

“হ্যাঁ।  কত লোক কাল রাতে এসে কোন হোটেলে জায়গা না পেয়ে এখানে ওখানে রাত কাটিয়েছে!

“তবে যাই বলুন, আজ এই বিচ্ছিরি আবহাওয়ার মাঝে,এই কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে,এমন পিটপিটে বৃষ্টি আর প্রবল ঠাণ্ডা হাওয়ার ভ্রূকুটি তুচ্ছ করে আমাদের আর এই বেডলোজ্‌ আইল্যান্ডের কাছে এসে এই মহিমান্বিত অনুষ্ঠানটা দেখার সুযোগই হত না যদি না এই বার্জ-এ আগে থেকে আমাদের  সিট বুক করা না থাকত!

“সে আর বলতে! আজ সকাল থেকেই নিউ ইয়র্ক শহরে প্যারেড শুরু হয়ে গেছে -ম্যানহাটান, ব্যাটারি পার্ক, ম্যাডিসন স্ক্যোয়ার, ফিফথ অ্যাভেন্যু উপচে পড়েছে ভিড়ে ঐ প্যারেড দেখবে বলে।”

চারপদিকে উৎসবের মেজাজ তখন। প্রতিটি বাড়ির জানালায় ফরাসী তিনরঙা পতাকার পাশাপাশি উড়ছিল আমেরিকার পতাকা! প্রায় চোদ্দশ পুলিশ নিযুক্ত হয়েছে প্যারেড আর এই উৎসর্গ উৎসবের  দর্শনার্থীর ভিড় সামলানোর জন্যে ।

লোকজনেরকথাবার্তা শুনতে শুনতেই ঠুমরি দেখল,প্রার্থনা সঙ্গীত শেষ হওয়ার পর প্রথমে বক্তব্য রাখতে শুরু করেছেন ফরাসী প্রতিনিধিদের প্রধান এবং বিখ্যাত ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার,কাউন্ট ফার্দিনান্ড দ্য লেসেপ্স । তারপর নিউ ইয়র্ক কমিটির চেয়ার‍্যান মিস্টার এভার্ট (পুরো নামটা দূর থেকে শুনে ভালো বুঝতে পারল না ঠুমরি) এই মহান উপহার সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য পেশ করতে শুরু করলেন ।

ঠিক সেইসময় একটা গন্ডগোল ঘটে যেতে দেখল ঠুমরি, মিস্টার এভার্টের বক্তব্য চলাকালীনই লিবার্টির মশালের টঙে দাঁড়িয়ে থাকা বারথোল্ডির কাছে বোধহয় কোন ভুলভাল সংকেত চলে গেছিল,স্ট্যাচুর মশালের সুউচ্চ চূড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে দড়ির এক হ্যাঁচকা টানে ফ্রান্সের তিনরঙা  পতাকায় মোড়া দেবী লিবার্টির মুখের আচ্ছাদন উন্মোচন করে দিলেন বারথোল্ডি,ঠিক যেমন বোধনের দিন কোলকাতায় ওদের পাড়ার দুর্গাপ্রতিমার মুখের আবরণ উদঘাটন করা হয়। আর সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে মানুষজনের কানফাটানো উল্লসিত চিৎকার, শিঙ্গার তীক্ষ্ণ আওয়াজ,অসংখ্য কামান থেকে তোপ দাগার ভয়ঙ্কর আওয়াজে চাপা পড়ে গেল মিস্টার এভার্টের গলার স্বর,লোকজন বুঝতেই পারল না মিস্টার এভার্টের  বক্তব্য তখনও শেষ হয় নি,তারা ছন্নছাড়া হয়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল পরবর্তী ইভেন্টের। কেউ কেউ আবার অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গিয়েছে ভেবে  ফিরে যাবার জন্য বোটে হল্লাও জুড়ে দিল।

এই চূড়ান্ত বিশৃংখলার মাঝে মিস্টার এভার্ট হতভম্ব হয়ে গিয়ে স্বস্থানে বসে থাকা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের দিকে ঘুরে তাকালেন,তারপর হতাশ হয়ে নিজের অতি যত্ন করে প্রস্তুত করে রাখা দীর্ঘ ভাষণ অসমাপ্ত রেখেই ধপ করে বসে পড়লেন!

ঠুমরির ভয়ানক হাসি পেল। গতবছর,ওদের স্কুলে অ্যানুয়াল প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন উপলক্ষে ক্লাস এইটের মেয়েরা মিলে লক্ষণের শক্তিশেল নাটকটা মঞ্চস্থ করেছিল। তখনও ঠিক এমনই একটা গোলমেলে কান্ড ঘটেছিল। একটা সিন শেষ হয়েছে,পরবর্তী সিনের জন্য রামের কোলে শুয়ে পড়ে থাকা লক্ষণের মৃতদেহ হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে,অথচ পর্দা ফেলার ভার যার ছিল সেই রঘুদা নাকে এক টিপ নস্যি নিয়ে স্টেজের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘড়ঘড়িয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। সে কী কান্ড ! উফফফ—শেষে গেমটিচার দীপিকা ম্যাম দৌড়ে গিয়ে পর্দাটা ফেলেন। ততক্ষণে যা লোক হাসানোর তা হয়ে গেছে !

bhromonotit01 (Medium)গমগমে গলার আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখল ঠুমরি,ইতিমধ্যে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড তাঁর ভাষণ দিতে শুরু করেছেন, “We will not forget that Liberty has here made her home; nor shall her chosen altar be neglected” …। নিউ ইয়র্ক হার্বারে একটানা তোপধ্বনির আওয়াজ শেষ হলে শুরু হয়ে গেল সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা ! আমেরিকান প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড স্ট্যাচুর উপহার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আবার শুরু হল-ন্যাশনাল স্যাল্যুট-বন্দরের বহু কামানের সামরিক অভিবাদনের অঙ্গস্বরূপ একসাথে গোলাবর্ষণ!

এর মাঝেই একটা বোট থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল…আশে পাশে ভিড় করে থাকা লোকজনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল ঠুমরি,ঐ বোটটা প্রতিবাদী মহিলাদের –‘সাফ্রেজিস্ট’নামের একটি গ্রুপের একটি বোট আইল্যান্ডের কাছাকাছি এসে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

কীসের প্রতিবাদ? অবাক হয়ে ঠুমরি জানতে পারল, আজকের এই মহান দিনে,এক  উজ্জ্বল দীপ্তিশীল দেবীমূর্তির উৎসর্গ অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র বারথোল্ডির স্ত্রী এবং লেসপসের নাতনি ছাড়া আর  কোন মহিলাকে আমন্ত্রণ করা হয়নি! সেই চরম অবহেলার প্রতিবাদ করে ‘সাফ্রেজিস্ট’দের দল তাঁদের বোটটি ভিউইং স্ট্যান্ডের কাছে  নোঙর ফেলে প্রচার করছে। তুলে ধরার চেষ্টা করছে এক অদ্ভুত বিদ্রূপকে -এক গৌরবান্বিত নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠানে নারীরাই বাদ!

ভোটাধিকারের দাবিও করছে তারা, খেয়াল করল ঠুমরি,তারিখটা মনে করার চেষ্টা করল ও। হ্যাঁ,ঠিকই তো,ওদের এলিমেন্টারি স্কুলের স্যোশাল স্টাডিজের টিচার,মিস ইবার্ট বলেছিলেন-১৯২০ সালে আমেরিকায় মেয়েরা ভোটাধিকার পেয়েছিল!

প্রচন্ড ভিড়ে উপচে পড়া দুএকটি বোট ইতিমধ্যেই ব্যাটারি পার্কের দিকে ফিরে যেতে শুরু করেছে।আজ এই দূর্যোগপূর্ণ দিনে লিবার্টির মশাল আলোকিত করার প্ল্যান বাতিল করা হয়েছে। একটা রাজকীয় আতসবাজির প্রদর্শনও হওয়ার কথা ছিল আজ,কিন্তু এই জঘন্য আবহাওয়ার জন্য সেটা পিছিয়ে পয়লা নভেম্বর হবে বলে ঠিক করা হয়েছে বলে শুনতে পেল ঠুমরি। ইশ্‌শ্‌!! আতসবাজির খেলাটা মিস হয়ে গেল ওর!  ও শুনেছিল, এইসব বড়ো বড়ো উৎসবে আতসবাজির খেলা হয় দেখার মত। চোখ ঝলসে দেয় আলোর ফুলকি! ওটা দেখতে পেলে আজ ওর ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যেত!

এবার কী করবে ঠুমরি ভাবতে গিয়েই ওর খেয়াল হল – আরে…আধঘন্টা বোধহয় হয়ে যাবে আর খানিকক্ষণের মধ্যেই!

ভাবতে না ভাবতেই ঠুমরির চোখের ওপর ভেসে উঠল আওয়ার গ্লাসটা। সেটার ওপরের চেম্বারটা প্রায় খালি হয়ে এসেছে। এবার ফিরতে হবে তাহলে। কিন্তু,কিন্তু –

ঠিক তক্ষুণি একটা দৃশ্য দেখে থমকে গেল ঠুমরি- সামনেই একটা বড়োমাপের পালতোলা বোট ঘুরে ফিরে যাচ্ছিল,কোনভাবে একটি বাচ্চা ছেলে,ঠুমরির থেকেও অনেক ছোটো হবে -হাডসন নদীর জলে পড়ে গেছে । উঁহু-হঠাৎ পড়ে যায়নি তো! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওর থেকে বড়ো একটি ছেলে ধাক্কা মেরে বাচ্চা ছেলেটাকে জলে ফেলে দিল!

চাপাচাপি ভিড়ের মধ্যে কেউই খেয়াল করেনি ব্যাপারটা! বড়ো ছেলেটা ভাজা মাছটি উলতে খেতে জানেনা এমন ভাব করে বোটের ভিড়ের ভিতরে ঠেসেঠুসে ঢুকে একটু দূরে এক ভদ্রলোকের গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল। ভদ্রলোকটি ছেলেটিকে কিছু একটা প্রশ্ন করলেন। ছেলেটি ঠোঁট উলটে দুদিকে জোরেজোরে মাথা নাড়াল। বোধহয় বোঝাতে চাইল ও কিছু জানে না। ভদ্রলোক উদ্বিগ্নভাবে ভিড়ের মধ্যে এদিকওদিক তাকিয়ে বাচ্চা ছেলেটির নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছেন–“জোনাথন–জোনাথন—”

কোথায় জোনাথন? বোটটা ততক্ষণে ঘুরে গিয়েছে কিছুটা। আর জোনাথন জলে খাবি খেয়ে চলেছে–কুয়াশা আর বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন চারিদিক, কারোরই চোখে পড়েনি ঘটনাটা।

অক্টোবরের হাড় কনকনে ঠান্ডায় ছোট ছেলেটা জলের মধ্যে নাকানিচোবানি খেতে খেতে প্রাণপণে চিৎকার করে চলেছে অথচ ব্যাটারি পার্কের তোপের আওয়াজ শিঙার আওয়াজ, চারিদিকে অজস্র বোটের তীক্ষ্ণ,খ্যানখ্যানে আওয়াজে সে চিৎকার ফিকে হয়ে গেছে, তার ওপর চারিদিকে এমন ভয়ানক কুয়াশা যে একহাত দূরের কোন জিনিসও ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না !  

প্রমাদ গুনল ঠুমরি। কী করবে ও বুঝে উঠতে পারল না,ওর কিছুই করার ক্ষমতা নেই সেটা ও বিলক্ষণ  জানে। ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কেউ ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। কাউকে ও ছুঁতে পারছে না। পুরোপুরি হাওয়ায় মত ভেসে রয়েছে ও – ঠিক যেন ভূতের গল্পে পড়া বাতাসে ভেসে থাকা আত্মাদের মত!

কিন্তু এইভাবে চোখের সামনে একটি অসহায় বাচ্চা ছেলেকে ডুবে যেতে দেখবে-সেটাও তো মন মেনে নিতে চাইছে না। ঠুমরির মনে পড়ে গেল,মিস্টার এহসান সুলেমান শাহের কথাগুলো, “তোমার কিন্তু তেমন কিচ্ছু করার থাকবে না,শুধু নীরব দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া !”

হঠাৎ এলিমেন্টারি স্কুলে শোনা বাইবেলের অ্যাক্ট অফ কাইন্ডনেসের ওপরে লেখা লাইনগুলো ওর মাথার মধ্যে গিজগিজ করে উঠল-  “But the fruit of the Spirit is love, joy, peace, patience, kindness, goodness, faithfulness, gentleness, self-control; against such things there is no law.” অর্থাৎ ‘fruit of the Spirit’ হল এই নয়টি বৈশিষ্ট্যমূলক গুণ যা একান্ত ভালো মানুষের মধ্যে থাকে, এই নয়টি গুণের বিরুদ্ধে কোন আইনই বা নিয়মই খাটে না ! শুধু তাই নয়, দিদুনের কাছে থেকে মহাভারতের গল্পচ্ছলে শোনা গীতার কয়েকটি কথাও ওর মনে পড়ে গেল —“যে কোন ভালো কাজ করে তার কখনো খারাপ পরিণতি হয় না।”  নিজেকে শুধু একটা প্রশ্নই করল ঠুমরি,হয়তো ও কিছুই করে উঠতে পারবে না,কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কোথায়?    

যা করার খুব তাড়াতাড়ি,এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই করে ফেলতে হবে ঠুমরিকে,ও এটুকু বুঝতে পারছে। বাতাসের ক্ষমতাই এখন ওর ক্ষমতা। বাতাসের শক্তিটাকেই ওকে কাজে লাগাতে হবে! যা থাকে কপালে ভেবে পালতোলা বোটটার ফোরক্যাসল হেড ডেকে এসে উপস্থিত হল ঠুমরি। একটা জিনিস ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। যে সময়ের যে জায়গায় এসে ও পৌঁছবে, সে জায়গায় ওর অবাধ গতি। নৌকার তিনকোণা ফোরক্যাসল হেড ডেকে নৌকার কর্মীরা সমস্বরে ‘দম লাগাকে -হেঁইয়ো’ বলে চাকার মত ভারি ক্যাপ্সটানটাকে ঘুরিয়ে যাচ্ছে সবকটা পাল তুলে দেওয়ার জন্য। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে মেন ডেক-এর দিকে আর একটু এগিয়ে দেখল ঠুমরি ওখানে শিক্ষানবিশদের কেবিনে উপচে পড়েছে  গিজগিজে লোকের কালো কালো মাথা। ঠিক সেখানেই কেবিনের সামনেই ঝুলে থাকা একটা ফুটবলের মত সাইজের মত ঘন্টা চোখে পড়ল ওর। ভাবার আর সময় নেই। ঘন্টাটার খুব কাছে গিয়ে প্রচন্ডবেগে পাক খেতে  থাকল ঠুমরি। আরে এইতো! হাওয়ার বেগে ঘন্টাটা দুলতে শুরু করেছে! ঠুমরি আরো জোরে পাক খেতে লাগল। ঘন্টাটা দুলছে-দুলছে-দুলছে -এই তো বাজতে শুরু করেছে—ঢং ঢং ঢং!

যে কর্মীরা জোর লাগাকে পালগুলোকে তোলার জন্য ক্যাপ্সটানের চাকা ঘুরিয়ে চলছিল তারা থমকে থেমে গেল। নৌকোর ভিড়ের বকবকানি,গজগজানি এক দমকেই  নেমে গেল। সবার মনে একটাই প্রশ্ন। কী করে,কোনও তীব্র ঝোড়ো হাওয়া ছাড়াই ঘন্টাটা বাজতে শুরু করেছে নিজে নিজে? সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে শুরু করে দিয়েছে, এর মাঝেই কানে ভেসে আসতে শুরু করেছে হারিয়ে যাওয়া একটি ছেলেকে খুঁজে পেতে মরিয়া এক ভদ্রলোকের আর্ত চিৎকার- “জোনাথন,জোনাথন! হ্যোয়ার আর ইউ?”

নৌকোর ভিড়ে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে- সবাই এদিকওদিক ঝুঁকে পড়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে, কী ঘটেছে। 

কাজ হয়েছে-কাজ হয়েছে ! ঠুমরি এত পাক খেয়েও কেন হাঁপিয়ে পড়ল না বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পেল কয়েকজন ঝুঁকে পড়েছে ডেক থেকে। ওই তো, ওই তো-জোনাথনের কালো মাথাটা -আছাড়িবিছাড়ি খেতে থাকা দুটো হাত- দেখতে পেয়েছে একজন ! দূরবীন চোখে লাগিয়ে কালো মতন,বেঁটে মতন একটা লোক দেখতে পেয়েছে জোনাথনকে– গায়ের মোটা রেনকোটটা খুলে রেখে লোকটা নিমেষের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছে ঠান্ডা হাডসনের জলে—কাকে যেন বলতে শুনল ঠুমরি-“জোনাথনের কাকা  নিশ্চয়ই ছেলেটার অত খেয়াল রাখে নি,বাপমা মরা ছেলেটার কপালে এই ছিল-“

ঠুমরির হাতে আর সময় নেই–একি ! মাথাটা এরকম ঝিমঝিম করছে কেন? এটা কি ওকে মনে করিয়ে দেবার সংকেত যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে–এর মধ্যে ফিরে যেতে না পারলে—না। তাহ্লে কী হবে তা ঠুমরির জানা নেই। সে আওয়ার গ্লাসটাকে মনে করার চেষ্টা করল একবার। রেস্ট রুমে পড়ে থাকা একবিংশ শতাব্দীর ঠুমরির চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করল। চারপাশে সব আবছা হয়ে আসছে কেন? দিনের আলোমাখা ঝলমলে জামাটা সমেত সুয্যিমামা টুপ করে নীলসায়রে ডুব দিলে সব যেমন চারিদিক ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে আসে ঠিক তেমনই-

–“ঠুমরি ! ঠুমরি–“

রেস্টরুমের দরজায় দুমদাম ধাক্কা ! মায়ের উদ্বিগ্ন গলার স্বর ভেসে আসছে দরজার  ওপার থেকে।  ঠুমরি ঘোলাটে চোখে তাকাল হাতের আওয়ার গ্লাসটার দিকে। ওপরের চেম্বারটা পুরোপুরি খালি হয়ে গেছে। আওয়ার গ্লাসের মাঝের প্যাসেজটাও কে যেন আবার লক করে দিয়েছে। ঘুম ঘুম চোখে সেটাকে জিনসের পকেটটায় চালান করে নিজেকে ঝাঁকুনি দিয়ে টেনে তুলে রেস্টরুমের দরজাটা খুলল ঠুমরি। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন-“একী রে ! প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেছে-তোর কোন পাত্তা নেই-শরীর ঠিক আছে তো?”

হঠাৎ যেন নিজেকে কী ভীষণ ফ্রেশ লাগছে! ঠুমরি ঝিলমিলিয়ে হেসে উঠল, “হ্যাঁ মা, এই একটু পেটটা ব্যথা করছিল। কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না,আমি এখন একদম ঠিক আছি।” মায়ের চিন্তাগ্রস্ত,অবাক চোখের চাউনি ছাপিয়ে ঠুমরির দুচোখের পাতায় সেইমুহূর্তে ভেসে উঠেছে হাডসনের ঠান্ডা জলে ভেসে ওঠা  উনিশ শতকের একটি ছোট্ট ছেলে জোনাথনের হাসিমুখখানি ! উনিশbhromonotit03 (Medium) শতকের এক মেঘে ঢাকা,কুয়াশার কুহেলিকায় আচ্ছন্ন,একঘেঁয়ে অথচ জমজমাট, স্মরণীয়,উত্তেজনাপূর্ণ বিকেলকে পিছনে ফেলে রেখে ঠুমরির সামনে এখন হাতছানি দিচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর রোদ ঝলমলে এক উজ্জ্বল বিকেল!

আজ এই দিনটা ঠুমরির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন! সবচেয়ে আনন্দের দিন! এক অদ্ভুত বিশ্বাস,অবলম্বনের আশ্বাস,নিরাপত্তার অনুভূতি এইমুহূর্তে শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় অনুভব করতে পারছে ও – কারোর জন্য কিছু করতে পারলে যে  এমন এক অসাধারণ ভালো লাগায় ভরে যায় মনপ্রাণ,নিজেকে এমন  পরিপূর্ণ লাগে –ওর দশ বছরের ছোট্টো জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারল ঠুমরি ! এই প্রথম  উপলব্ধি করল কারোর উপকারে লাগতে পারার শিহরণ বা  রোমাঞ্চ যে উদ্যমের প্লাবন আনে -তার সাথে কোন আনন্দেরই তুলনা হয় না,হতে পারে না !