সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতা২০২২- সেরা প্রবন্ধ-(যুগ্ম)দ্বিতীয় স্থান-ভ্রাম্যমান বেচুবাবুর সংকট- জ্যোতির্ময় দালাল-শীত ২০২২

probondhobechutitle

অতিমারী গত দু’বছরে আমাদের নাগরিক জীবনে যা যা ব্যবহারিক পরিবর্তন এনেছে, তার অন্যতম প্রধান হল অনলাইন কেনাকাটার পরিমাণে এক বিপুল বৃদ্ধি। সারা বিশ্ব জুড়েই মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ নন এমন অসংখ্য বয়স্ক মানুষজন, যাঁরা অতীতে নানান অনীহা থেকে প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পরিষেবা থেকে দুই কেন, দুশো-গজের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেন, তাঁরাও আজ বাধ্য হয়েছেন এই নতুন বাণিজ্য মাধ্যমের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে। সত্যিই তো, আজ এ টু জেড অর্থাৎ আমাজন টু জোমাটো পর্যন্ত সবার মায়াবিপনিতেই স্রেফ একটা মুঠোফোনের পর্দায় অঙ্গুলিচালনে মিলছে আমাদের অনায়াস প্রবেশাধিকার। 

মনে একটা প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। ঘরে বসে বসে আমাদের মনপসন্দ জিনিসটি কেমন হাতের গোড়ায় এসে যাচ্ছে। এটাও সবাই দেখছি যে দুয়ারে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেবার দরুন অতিরিক্ত পরিবহন মাসুল সেভাবে চাপছে না ক্রেতার ওপরে।, উল্টে অনেক ক্ষেত্রেই সেটি আবার মিলছে সাধারণ দোকানের তুলনায় সুলভ মূল্যে, লোভনীয় ডিসকাউন্ট এ। আবার দোকানে সশরীরে হাজির হতে হচ্ছে না বলে পয়সা, সময়, পরিশ্রম সবই কী দারুণভাবে বেঁচে যাচ্ছে! যেখানে লাভের অঙ্ক বাড়ানোই যে কোনো বাণিজ্যিক সংস্থার মূল লক্ষ্য, সেখানে অতিমারী-প্রসূত এই আপাত: নতুন ধারার বেচাকেনার অভ্যাসের অতিরিক্ত খরচের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে ভার্চুয়াল বিকিকিনির হাটবাজার আর কত দিন খোলা থাকতে পারবে? অজ্ঞাত গৌরী সেনের বদান্যতায় এমন “দুয়ারে পার্সেল” প্রজেক্ট আর কদ্দিন চলতে পারবে? 

এই ধাঁধার উত্তর অনেকাংশে লুকিয়ে আছে গণিতের এক বিশেষ শাখায়, যার নাম Operations Research! নামটা বিশেষ পরিচিত নয় আমজনতার কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতিস্বরূপ অনেক অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মানবসভ্যতা প্রত্যক্ষ করেছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখার এক উল্কাগতির উত্থান। তবে শুধু বিশ্বযুদ্ধের অ্যাটম বোমা নয়, বিংশ শতাব্দীর মধ্য চল্লিশের দশকে বিশ্বের সেরার সেরা গণিতজ্ঞরা জন্ম দিয়েছিলেন Operations Research-এর, ফলিত গণিতের এক নতুন শাখার!আজ বিশ্বের প্রায় সব প্রথম সারির বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেবার কাজে সাহায্য নেয় কোনো না কোনো গাণিতিক মডেলের। সহজবোধ্য ভাষায়, একটি সংস্থা তার কাজ-কারবার চালানোর সময় যে নানাধরনের বাস্তব সমস্যা, শর্তাবলী ও নিয়ম-কানুনের সম্মুখীন হয়, তাদেরকে অঙ্কের ভাষায় প্রকাশ করে একটি গাণিতিক সমস্যায় রূপান্তরিত করে ম্যথ-মডেল! তার সমাধানের জন্য লেখা হয় অত্যুন্নত কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যারা নিমেষে সে সব জটিল অঙ্কের সমাধান ক’রে বাতলে দেয় সাফল্যের পথ। স্ট্যাটিস্টিক্স, ম্যাথ-মডেলিং, সিম্যুলেশন – ফলিত গণিতের নানান ধারার সঙ্গে কম্পিউটার সায়েন্সের সমন্বয় আজ একবিংশ শতাব্দীতে Operations Research -কে দিয়েছে আরেকটি গালভরা তকমা যার নাম অ্যানালিটিক্স! হ্যাঁ, এই শব্দটি আজ অনেকেরই কাছেই খুব পরিচিত, পপুলার মিডিয়ার কল্যাণে! 

গাণিতিক সমস্যার কম্পিউটারে পাওয়া সমাধান ম্যাজিকের মত আমাদের বাতলে দেবে ব্যবহারিক জীবনে চলার পথ… শুনতে একটু আজব লাগছে কি? কিন্তু যখন এ দুনিয়ায় কম্পিউটারের নামগন্ধও ছিল না, আমাদের হযবরল-র গেছোদাদা তো জানতেন এ বিদ্যে! জাস্ট কাক্কেশ্বরের কুচকুচে কালো স্লেটের বুকে বা মাটির ওপর কাঠির আঁচড়েই তিনি অতি জটিল সব অঙ্কের সমাধান করে দিতেন নিমেষেই! কিন্তু গেছোদাদাকে এখন আর পাচ্ছি কোথায়? উলুবেড়ে মতিহারি রামকিষ্টপুর চক্কর কাটার হ্যাপা কি আর পোষায়! তার চেয়ে আমরাই না হয় একটু চেষ্টা-চরিত্র করে দেখি – এই অঙ্কের ম্যাজিকের জগতের কিছু ছোটোখাটো নুড়ি-টুড়ি কুড়িয়ে পকেটে ভরা যায় যদি! 

ফিরে আসি আবার “দুয়ারে পার্সেল” প্রজেক্টে! এটা তো সবাই জানি যে ভদ্রলোকটি তোমার বাড়ির বেল টিপে পার্সেলটি দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি কেবল তোমার কাছেই আসছেন না। তাঁর ডেলিভারি ট্রাক বা বাইকের পেছনে বাঁধা ”সান্তাক্লজিয়” ঝোলাটিতে আছে আরও গোটা-পঞ্চাশেক জিনিস! এবার যদি ভাবো,সারা শহরে বা সারা দেশ জুড়ে একই সময়ে এরকম কত শ’ বা হাজার ট্রাক বা বাইক বাড়ি বাড়ি পার্সেল পৌঁছে দিচ্ছে, তাহলে মাথাটা একটু কেমন কেমন করাটা তেমন দোষের না! 

তবে এক্ষুনি অত জটিলতায় আমরা ঢুকছি না। আজ আমাদের টার্গেট কেবল সেই ভদ্রলোক, যিনি আমাদের পার্সেলটা বয়ে আনছেন। আর, এটা আমরা জানি যে ওনার ঝোলায় আরও তিরিশ- চল্লিশটা প্যাকেট আছে যা আজকের মধ্যেই উনি বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবেন বলে বেরিয়েছেন।

এখন, সাধারণ বুদ্ধিতে এটাই বলে যে ওঁর সবকটা গন্তব্যস্থল শহরের একই এলাকায় হলে সুবিধে। সাতসকালে কোম্পানির গোডাউন বা ঐরকম কোনও জায়গা থেকে যখন ওনার ডেলিভারির ব্যাগটি ভরা হয়, তখনই এটা মাথায় রাখা হয়। ফলে ভদ্রলোকের বাহনটি সারাদিনের মধ্যে শহরের একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই ট্রিপ মেরে সবকটা প্যাকেটকে তাদের গন্তব্যে আরামসে পৌঁছে দিতে পারে। এতে সময় আর জ্বালানি দুয়েরই সাশ্রয়। নইলে ভাবো যদি একটা পার্সেল দিতে হয় শ্যামবাজারে, নেক্সটটা বেহালায়, আর তার পরেরটা কোন্নগরে,–তাহলে দিনভর কী দৌড়- ঝাঁপটাই না করতে হবে! আর তেল খরচটার কথা তো বলাই বাহুল্য! 

কিন্তু, ভৌগোলিক অঞ্চল ধরে ধরে ডেলিভারি আইটেমগুলোকে এভাবে ভাগ করার চল তো সেই কোন যুগ থেকে চলে আসছে ডাকবিভাগেই। এতে নতুনত্ব কি?

প্রাথমিক উত্তরটি হল, মানুষের সময়ের অভাব। ধৈর্যের অভাব। তাৎক্ষণিক তৃপ্তির অভ্যাস! অতি কর্মঠ এবং নিষ্ঠাবান ডাককর্মী থাকলেও একটা চিঠি শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছাতে লেগে যেত দুই থেকে তিন দিন। আজ আমরা কোনো ই-কমার্স স্টোরে ঢুকে মোবাইলের পর্দায় আঙুলের খোঁচা অথবা কম্পিউটার স্ক্রিনে মাউসের ক্লিকে পেমেন্ট করার আগে দেখতে ভুলি না যে জিনিসটা অন্য কোনো সাইট বা অ্যাপ থেকে আরো কম দামে, আরো কম সময়ে সম্ভব হলে আজকের মধ্যেই হাতে এসে যেতে পারে কী না! অনলাইন ক্রেতার চাহিদার এই তীব্র গতির সঙ্গে তাল মেলানো গতানুগতিক ডাকব্যবস্থার পক্ষে অসম্ভব। তাই বিশ্বের প্রায় সব বড় বড় ই-কমার্স সংস্থার এই জোগান পদ্ধতিটির রাশ আছে তাদের নিজেদের হাতে। সাপ্লাই চেন লজিস্টিক্স (জোগান শৃঙ্খল পরিকাঠামো) হল এই নতুন বিপণন-ব্যবস্থার মেরুদণ্ডস্বরূপ। বলা হয়, যেকোনো দুটি যুযুধান বাণিজ্যিক-সংস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতাটি আদতে তাদের নিজের নিজের সাপ্লাই চেন-এর দক্ষতার মধ্যে লড়াই। আর এই লড়াইতে Operations Research -এর ভূমিকা বিরাট। এই শাখাটির জন্মলগ্নে যখন কম্পিউটার প্রযুক্তিও ছিল সদ্যোজাত, সেই সময় গণিতজ্ঞদের দল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হাতে- কলমে দস্তুরমত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুরূহ সব গাণিতিক মডেলের সমাধান করতেন। বিগত ৫০-৬০ বছরে Operations Research শাখাটির ক্রমবিকাশের পাশাপাশি কম্পিউটার প্রযুক্তির অভাবনীয় গতিতে বিকাশের ফলে আজ অনেক জটিল গাণিতিক সমস্যাও সমাধান হয়ে যায় নিমেষে। কম্পিউটার প্রযুক্তির এই উন্নতি যে ঠিক কী মাপের, সেটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এটা উল্লেখ করাই মনে হয় যথেষ্ট হবে — অতীতে যে অঙ্ক কষতে দানবীয় চেহারার সব কম্পিউটার দরকার হতো, আজ অতি সাধারণ ল্যাপটপেও তার চেয়ে ঢের বড় আর জটিল অঙ্ক সেকেন্ডের মধ্যে সমাধান করা যায়। 

সাপ্লাই চেন লজিস্টিক্স সংক্রান্ত বহুবিধ অতি দুরূহ গাণিতিক সমস্যার মধ্যে একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় সমস্যা আজ আমরা বোঝার চেষ্টা করব। উদাহরণ হিসেবে নেব – আজকের ই-কমার্স ব্যবস্থায় সময় ও অর্থ সাশ্রয়কারী, অথচ সুদক্ষ ডিসট্রিবিউশন সিস্টেম যার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে অঙ্কের এক মজাদার সমস্যা! 

এখন দেখ, “দুয়ারে পার্সেল” প্রজেক্টে আমরা না হয় ক্রেতার অবস্থানের এলাকা ধরে ধরে পার্সেলগুলোকে গোডাউনেই ভাগ-টাগ করে গাড়িতে লোড করে নিলাম। ধরো, আমাদের কাছে আছে ৩০ টার মত পার্সেল। এবার এতগুলো বাড়ির মধ্যে কোনটায় আগে যাব? আর খোলসা করে বললে কোন ক্রমানুসারে (সিকোয়েন্স-এ) আমাদের এই ৩০ টা গন্তব্যে যাওয়া উচিত, যাতে দিনের শেষে আমাদের ন্যূনতম দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়? মনে রাখতে হবে, একজন ডাকপিয়নের সমস্যাও একই ধাঁচের। কেবল তাঁকে একটা অপেক্ষাকৃত ছোটো পরিসরে হেঁটে বা সাইকেল চেপে কাজটা সারতে হয়। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে হয়ত গোটা শহরটাই টহল দিতে হবে এক দিনে! তাই ক্রমানুসার অনুযায়ী রুট নির্ধারনের এই কাজটি নির্ভুলভাবে করা অত্যন্ত জরুরি। ন্যূনতম দূরত্বের বদলে যদি অনুমান-নির্ভর আর কোনও ক্রমানুসার মেনে রুটটি তৈরি হয় যা হয়ত মাত্র ২-৪ কিলোমিটার বেশি, তার সুদূরপ্রসারী ফল ক্ষতিকর হতে পারে। যেহেতু ডিসট্রিবিউশনের এই কাজ প্রায় বছরভর চলতে থাকে, তাই একটা গাড়ি রোজ ২-৪ কিলোমিটার অতিরিক্ত চললে বছরের শেষে কত টাকার বাড়তি তেল পুড়ছে সেটা ভাবো! তাহলে সারাদিনে দেশ জুড়ে একটা বড় সংস্থার এরকম কয়েকশ’ গাড়ি হাজার হাজার লিটার তেল অপচয় করতে থাকলে ক্ষতির বহরটা নিজেই বুঝে নাও! 

এইবেলা আমাদের সমস্যাটিকে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে পেশ করা যাক। 

আমাদের কাছে ‘ক’ সংখ্যক গন্তব্য আছে, আর যে কোনও দুটি গন্তব্যের মধ্যে দূরত্বও জানা আছে। তাহলে, কোন বিশেষ ক্রমানুসারে ঐ ‘ক’ সংখ্যক গন্তব্যে একে একে যাওয়া উচিত যাতে আমরা সবকটি জায়গায় ঠিক একবার করে যেতে পারি, আর আমাদের সামগ্রিকভাবে অতিক্রান্ত দূরত্বটিও ন্যূনতম মানের হয়। আর হ্যাঁ, আমাদের কিন্তু ফিরেও আসতে হবে যাত্রা শুরুর স্থানটিতে। একটা সোজা উদাহরণ দিয়ে বললে আমাদের যেতে হবে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, আর ‘ঘ’ এলাকায়। ধরা যাক আমরা এদের মধ্যেই একটা এলাকায় এখন বসে আছি। তাহলে বাকি তিনটে এলাকা কোন ক্রমানুসারে ঠিক একবার করে ঢুঁ মেরে সবচেয়ে কম দূরত্ব অতিক্রম করে আমরা নিজের এলাকায় ফিরে আসতে পারব – সেটাই ঠিকঠাক বের করতে হবে। 

এই গাণিতিক সমস্যার পোশাকী নাম ট্র্যাভেলিং সেলসম্যান প্রবলেম অর্থাৎ “ভ্রাম্যমান বেচারামের সমস্যা।” এটা Operations Research-এর অতি বিখ্যাত ও সর্বাধিক-চর্চিত সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম। মজার ব্যাপার হল, এই সমস্যাটি বুঝতে পারা খুবই সহজ, তবু একে ঠিকঠাকভাবে সমাধান করার উপায় বেরোয়নি এত বছরেও!

একটা ছোট্ট উদাহরণ নিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করি এর জটিলতা-টা ঠিক কোনখানে! 

নিচের টেবিলে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, আর ‘ঘ’ এলাকার ক্ষেত্রে প্রতিটি এলাকা থেকে অন্যগুলোর দূরত্ব কিলোমিটার-এ দেওয়া হল। যেমন ধরো ক থেকে গ এর দূরত্ব = ৫ কিলোমিটার, আবার গ থেকে ঘ এর দূরত্ব= ৩ কিলোমিটার, ইত্যাদি। লক্ষ্য করো,, কোনাকুনি ঘরগুলোতে অর্থাৎ ক থেকে ক, খ থেকে খ ইত্যাদিতে “X”চিহ্ন দেওয়া, কারণ আমরা তো আর কোনো একটা এলাকা থেকে আবার সেই এলাকাতেই যাচ্ছি না! 

probondhobechu01

এই টেবিলের তথ্যগুলোকে ছবির আকারেও সাজিয়ে দিলাম – যাকে বলে নেটওয়ার্ক ডায়াগ্রাম। প্রতিটি বাহুর মাপ তার পাশে লেখা আছে । এটা কিন্তু ‘টু-দি-স্কেল’ ছবি নয়, অর্থাৎ বাহুগুলিকে তাদের দৈর্ঘ্য-অনুপাতে আঁকা হয়নি। 

probondhobechu02

আমরা এই সমস্যা সমাধানের একটা যুক্তিনির্ভর উপায় কি বের করতে পারি? 

যেহেতু আমাদের লক্ষ্য হল সামগ্রিক রুটের দূরত্ব কমানো, অতএব  প্রথম থেকেই আমরা সেটা মাথায় রেখে এগোই! এমনকি কোন এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করব সেটাও দূরত্বের মানগুলোকে দেখেই স্থির করি। টেবিলে সবচেয়ে ছোট সংখ্যা যেহেতু ‘১, তাই আমরা প্রথম ট্রিপটা করি “ক – খ”। তারপর, যেহেতু ‘খ’ থেকে ন্যূনতম দূরত্বে অবস্থিত এবং এখনো পর্যন্ত অদেখা এলাকাটি হল ‘গ’, তাই পরবর্তী ট্রিপ হবে “খ – গ”। সুতরাং, এ পর্যন্ত আমাদের রুটটি হল “ক – খ – গ।” একই ভাবে আমরা ‘গ’ থেকে এখনো অব্দি অদেখা আর ন্যূনতম দূরত্বে অবস্থিত এলাকা (আর একটাই তো পড়ে আছে!) হিসেবে পাই ‘ঘ’। মনে রাখতে হবে, আমাদের ফিরতেই হবে শুরুর জায়গায়, কাজেই সম্পুর্ণ রুটটি হল “ক – খ – গ – ঘ – ক”। সত্যি বলতে কি, এই ছোট্ট গাণিতিক সমস্যাটির সঠিক সমাধান কিন্তু এই ক্রমানুসার-টাই! 

তাহলে জটিলতাটা কোথায় রে বাবা! এ তো দিব্যি মুখে মুখেই সলভ হয়ে গেল। 

ঠিক আছে, এবার উপরের সংখ্যাগুলোকে একটু পাল্টে দি। নিচের নতুন টেবিল দেখে আবার ওপরের টেকনিকটা লাগাও তো? 

probondhobechu03

আগের চিন্তাধারা অনুসরণ করলে আবার পাবে “ক – খ – গ – ঘ – ক”, যার দৈর্ঘ্য = ৫৪। 

কিন্তু দেখ, “ক–গ –খ – ঘ – ক” রুটটি এর চেয়ে ছোটো, যার দৈর্ঘ্য = ৪৮। কাজেই, আগের চালাকিটা এবারে আর খাটল না ! শুনতে আজব লাগলেও বিফলতার কারণটা লুকিয়ে আছে আমাদের বেছে নেওয়া পদ্ধতিতে – যা আমাদের প্রথম ধাপ থেকেই দূরত্ব কমানোর দিকে নজর দিতে বলেছে । কিন্তু আমাদের আসল উদ্দেশ্য তো প্রথম ধাপ বা কয়েকটি ধাপের দূরত্ব কমানো নয়, বরং এমন সমাধান বার করা যা প্রথম থেকে শেষ ধাপ অবধি সামগ্রিক দূরত্বটাকে কমাবে – তার জন্য দরকার হলে মাঝের কোনও ধাপে বেশি দূরত্বও অতিক্রম করা চলতে পারে। মোদদা কথাটা হল, আমরা গোটা সমস্যাটার সমাধান চাই – কোনোএকটা ছোট অংশের নয়। এই কন্সেপ্টটাকেই গণিতের ভাষায় বলে অপটিমাইজেশান, যা অপারেশনাল রিসার্চ-এর মূল ভিত্তি। ম্যানেজমেন্ট পেশাদাররা এই চিন্তাধারাটির গালভরা নাম দিয়েছেন – সিসটেমস থিংকিং! উপরে বর্ণিত আমাদের পদ্ধতিটাও কিন্তু নেহাত ফেলনা নয়। বাস্তব গাণিতিক সমস্যাটি যদি অতি কঠিন হয় যেখানে কোনো সুষ্ঠু সমধানসূত্র মিলছে না, তখন খানিকটা সমঝোতা করে কিঞ্চিত ‘অদূরদর্শী’ পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে। আমাদের উপরোক্ত প্রাথমিক সমাধান পদ্ধতিটিকে গাণিতিক পরিভাষায় সত্যিই বলা হয় ‘Myopic heuristic’।

কিন্তু এত হ্যাপা করার আছেটা কী! খামোখা মগজের ঘিলু না ভেস্তিয়ে সোজা খাতা-পেন্সিল নিয়ে বসে যাও, আর সবকটা সম্ভাব্য ক্রম লিখে ফেল। এর পর স্রেফ প্রতিটা রুটের দৈর্ঘ্য যোগ করে করে বের করা, আর শেষকালে সবচেয়ে ছোট রুট-টাকে বেছে নেওয়া – এই তো কাজ! কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর সাহায্য নিলে এ তো জলভাত! ধর, দ্বিতীয় টেবিল থেকে আমরা “খ – ঘ – ক – গ- খ ” রুটটার দৈর্ঘ্য পাই = ১১ + ১৫ + ১২ + ১০ = ৪৮। তা, এরকম মোট কটা রুটের দৈর্ঘ্য চাই আমাদের উদাহরণে? উত্তর হল = ২৪। তার কারণ – আমরা প্রথম জায়গাটা ৪ ভাবে বেছে নিতে পারি। তারপর, প্রথম জায়গাটা ঠিক করা হলে দ্বিতীয়টি বাছতে পারি ৩ ভাবে, তারপর তৃতীয়টি ২ ভাবে, আর শেষটি মাত্র ১ ভাবে। তাহলে দাঁড়ায় ৪টি জায়গা বেড়ানোর জন্য মোট (৪×৩×২× ১) = ২৪ টা ক্রম। অঙ্কের পরিভাষায় একে বলে factorial, আর লেখা হয় ‘৪!’ এইভাবে।

আচ্ছা, যদি ৪টের যায়গায় ১০ টা জায়গা হয়? তাহলে মোট ক্রম সংখ্যা হয় = ১০! =৩,৬২৮,৮০০। এটা এমন কিছু বড়ো সংখ্যা নয় কম্পিউটার-এর কাছে। 

যাইহোক, আমাদের সেই ডেলিভারি ট্রাকে কিন্তু সকাল সকাল ৩০ টা পার্সেল ভরা হয়েছে। এবার আমাদের কম্পিউটারকে কিছু সহজ যোগের অঙ্ক করতে হবে। 

তারপর ওই যোগফলগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্রতম মানটি আমাদের চাই! 

ব্যাস! তার পরেই আমরা গাড়িতে স্টার্ট দেব। 

তবে এর জন্য আমাদের কম্পিউটারকে বের করতে হবে ৩০! = ২.৬৫×১০^৩২ (  10^32 মানে ১ এর পিঠে ৩২টা শূন্য) মাত্ৰ এই কটা যোগফল! অর্থাৎ, ২৬৫-এর পরে ৩০ খানা শূন্য! (কোনও দিন যদি বাই চান্স ৫০ টা পার্সেল হয়, সেদিনের কাজ হবে ৩-এর পরে ৬৪-টা শূন্য-ওয়ালা যোগ করা! ) 

ইয়ে, আমরা সময়মত বেরোতে পারব তো? 

 

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s