জুলি, মিঠু, বিশুয়া
সুমন মিশ্র
আজ হয়ত আমার বাড়িতে কোন না- মানুষ সদস্য নেই, তবে এককালে তারা ছিল। আমার ছোটবেলার বেশিরভাগ সময়টা জুড়েই তারা ছিল। তাদের নিয়ে ঘটনা ও নেহাত কম নয়। তাই আমার কথাগুলো কোথা থেকে শুরু করব, আর কতটুকুই বা বলব, বুঝে উঠতে পারছি না। স্মৃতির পাত্র সামান্য কাত করলেই অনেক গল্প এসে মনের মাঝে জড়ো হচ্ছে।
যদিও এতকাল বন্ধুদের কাছে সুযোগ পেলেই ফলাও করে গল্প করে এসেছি ছোটবেলায় আমার কত পুষ্যি ছিল, তারা কী কী কান্ডকার খানা করত। তবে মুখে বলা আর লেখায় প্রকাশ করাতো এক ব্যাপার নয়। মুখে বলাটা কিঞ্চিৎ সহজ কাজ। স্মৃতির পটে যেটুকু এখনও ধরা আছে গড়গড় করে বলে যাও। আমার বন্ধুরাও বরাবর সেগুলো বেশ গোলগোল চোখ করেই শুনে এসেছে। আমার বন্ধু মহলে পুষ্যির ব্যাপারে কেউই মার্জারের উপরে উঠতে পারেনি, সেখানে আমার রেকর্ড তো বেশলোভনীয়। বিড়াল,মাছ,পাখিতো ছিলই, সঙ্গে কিছুদিনের জন্য একটি খরগোশও আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছিল। সঙ্গে ছিল বিশুয়া,তার কথাও যথাস্থানে।
বলছি বটে যে তারা আমার পুষ্যি ছিল, কিন্তু পুষ্যির দেখভালের দায়িত্বটা আমার বাবা মাকেই নিতে হত। আমার কাজ ছিল তাদের সঙ্গ টুকু পুরোদমে উপভোগ করা।
তখন আমি বেশ ছোট। বয়েসে এবং আয়তনেও। স্মৃতিটুকুও তাই বেশ আবছা। কিন্তু কিছু কিছু কথা বেশ মনে আছে। এক সন্ধ্যায় বাড়িতে বেশ হুলুস্থুল শুরু হল। বাড়ির উল্টো দিকে অ্যাকুয়ারিয়ামের দোকানের কাকু এসে হাজির। টিভি যে ঘরে রাখা থাকত সেই ঘরে একটা উঁচু তাক ছিল। আমার উচ্চতা তখন এতটাই কম ছিল যে খাটের উপর দাঁড়িয়েও তার নাগাল পেতাম না। সেই কারণে হয়ত আমার হাত থেকে বাঁচিয়ে ওই জায়গাটাই নতুন অ্যাকুয়ারিয়ামের জন্য ঠিক করা হয়েছিল। মাপজোখ শেষ করে সে ঘন্টাখানেকের মধ্যে অ্যাকুয়ারিয়াম দিয়ে গেল। তার ভিতরে আলো জ্বলছে, টলটল করছে জল, তাতে কৃত্রিমভাবে বুদবুদ সৃষ্টি হচ্ছে, নীচে রঙবেরঙের পাথর কিন্তু মাছ কই! মা বললেন, বাবা ওই অ্যাকুয়ারিয়ামের দোকানেই গিয়েছেন পছন্দসই মাছ কিনে আনতে। নানান রঙিন মাছ সেদিন নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের সব নামও জানি না। শুধু মনে আছে তাদের মাঝে দুটো গোল্ড ফিশও ছিল। মাছেদের খাবার দেওয়ার দায়িত্ব ছিল বাবার। কয়েক সপ্তাহ অন্তর বাবা সব মাছগুলোকে বাইরে বের করে একটা বড় জল ভর্তি বালতিতে রাখতেন। তারপর চলত অ্যাকুয়ারিয়াম পরিষ্কারের কাজ। সব দায়িত্ব বাবার। তো আমার দায়িত্ব কী ছিল? আমার আবার দায়িত্ব কী? ওই বয়েসের পুঁচকে ছেলেকে কেউ দায়িত্ব দেয় নাকি? আমি খালি মাছগুলো কেমন জলে খেলে বেড়ায় তাই দেখতাম।
একদিন দুপুরে দেখি একটা গোল্ডফিশ জলের মধ্যেই কেমন খাবি খাচ্ছে। কিছুক্ষণ সে খাবি খেল, তারপর ধীরে ধীরে অ্যাকুয়ারিয়ামের নীচে কেমন নেতিয়ে পড়ল। বাবা কলকাতায় কাজে গিয়েছিলেন। বাড়িতে আমি, মা,ঠাকুমা। তাঁরা কিছু বুঝতে পারলেন না। চোখের সামনেই সে মারা গেল। এর কয়েক সপ্তাহ বাদে এক দুপুরে আবার দেখি অবশিষ্ট গোল্ডফিশটাও আগেরটার মতই খাবি খাচ্ছে। ভালো করে দেখতেই ব্যাপারটা বুঝলাম। আসলে তার মুখের হাঁ-এর সমান মাপের একটা পাথর তার মুখে আটকে গেছে। পাথরটা কৃষ্ণবর্ণ বলে হঠাৎ দেখলে বোঝা যাচ্ছে না। ছুটে গেলাম বাবার কাছে। বাবা ছুটে এলেন। তিনিও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তাঁর শখের মাছটিকে বাঁচাবেনই। তারপর একটা ছোট্ট শলাকা দিয়ে কিভাবে যে পাথরটা তিনি বের করেছিলেন তা আর মনে নেই। তবে সে যাত্রায় মাছটিকে বাঁচানো গিয়েছিল। এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল, প্রাণ বাঁচাতে পারার সুখানুভূতি।
সেবার হঠাৎ আমার বাড়িতে এক বেড়ালের আনাগোনা শুরু হল। আমার তাকে ভালো লেগে গেল এবং তাকে মনেপ্রাণে পোষ্য হিসাবে গ্রহণ করলাম। তবে খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিল বাবা মায়ের উপরেই।
পোষ্য হিসাবে যখন গ্রহণ করেছি তখন একটা নাম তো রাখতেই হয়। তখন দুপুর বেলায় জননী সিরিয়ালটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আমার ঠাকুমার পাশে বসে আমিও দেখতাম। সেখানেই সম্ভবত একটা চরিত্রের নাম ছিল জুলি। অতএব আমার নতুন পোষ্যেরও নাম রাখলাম জুলি।
কিন্তু সে দু’দিন পরেই আমার আশ্রয় ত্যাগ করল। আমি সকাল থেকে অপেক্ষা করে শেষে বিকালে পাড়ায় তাকে খুঁজতে গেলাম। জুলি জুলি করে পাড়াময় ডেকে বেড়ালাম। তখন টিভি দেখে আমার ধারণা হয়েছিল কেউ হারিয়ে গেলে এভাবেই রাস্তায় নেমে তার নাম ধরে ডাকলেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর যেহেতু আমার দৌড় তখনও পাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাই জুলিও পাড়ার বাইরে কিছুতেই যেতে পারে না।
জুলিকে খুঁজে পেলাম না, কিন্তু পাড়ার এক বাড়ির বারান্দা থেকে ডাক এল, “কিরে বেড়াল হারিয়েছে?”
আমি বললাম, “জুলিকে পাচ্ছি না।”
“উপরে আয়।”
আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম। আমার হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ ধরিয়ে দেওয়া হল। উঁকি মেরে দেখলাম ব্যাগের ভিতর সাদা বলের মত গুটিসুটি মেরে আছে একটা বেড়ালছানা। তৎক্ষণাৎ তার নতুন নামকরণ করলাম জুলি।
ব্যাগ দোলাতে দোলাতে সন্ধ্যের পর খুশি মনে ফিরে এলাম বাড়ি। কিন্তু মুশকিল হল ঝোলা থেকে নামাতেই সে এক দৌড়ে ঢুকে গেল আলনার নীচে। এক দিকে লোডশেডিং, মোমবাতির টিমটিমে আলো জ্বলছে, তার মধ্যে সে ভয় পেয়ে লুকিয়েছে একদম অন্ধকার কোনায়। তার উপস্থিতিটুকু বোঝার একমাত্র উপায় ছিল জ্বলজ্বলে ক্ষুদে দুটো চোখ, আর মিউ মিউ স্বর। বেশ কিছুক্ষণ জুলি আয়, জুলি আয় করেও কাজ না হওয়ায় রান্নাঘর থেকে এক মুঠো মুড়ি এনে আলনার সামনে দিয়ে বলেছিলাম – জুলি এটা খা। তারপর নিজের কাজে চলে গিয়েছিলাম। তখন আমার কত কাজ থাকত, পড়াশোনা করে এক প্রস্থ খেলতে হবে জুলির পিছনে পড়ে থাকলে চলবে না।
পরের দিন সকালে দেখলাম তার সাহস কিছুটা বেড়েছে। গুটিগুটি পায়ে ছাদে চলে গেছে। ভয়ে ভয়ে ইতিউতি দেখছে। সেদিন আমার সঙ্গে তার সখ্য হতে বেশি সময় লাগেনি।
এইবার কিন্তু জুলি আর আমায় ছেড়ে গেল না। আমৃত্যু আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমার সঙ্গে খেলত, কোলে বসে আদর খেত, বাড়িময় ছুটে বেড়াত, পায়ে পায়ে ঘুরত,বাগানে লাফালাফি করত, প্রজাপতির পিছনে ছুটে বেড়াত। শীতকালে গভীর রাতে খাটের ধার ঘেঁষে ঘুরে বেড়াত আর করুণ স্বরে মিউ মিউ করত। মশারিটা একটু ওঠালেই ভিতরে ঢুকে আসত তারপর হয় লেপের নীচে নয়ত লেপের উপরেই গুটিসুটি মেরে আরাম করে ঘুমত।
সে একবারই অসুস্থ হয়েছিল। তখন তার এক অদ্ভুত নেশায় ধরেছে। ছাদের পাঁচিলের গা ঘেঁষে চুপ করে বসে চড়াই শিকার করত। সারা বাড়ি ছড়িয়ে রাখত নিরীহ শিকারের পালক। বাড়ির সকলে তাকে শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখলেই তাড়া লাগাত। নিরীহ পাখিগুলোর জন্য বড্ড মায়া লাগত। তারপর একদিন হঠাৎ তার গলায় কিছু একটা হল, খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। যতক্ষণে পশু চিকিৎসকের খোঁজ পাওয়া গেল ততক্ষণে সব শেষ। বাগানেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। আমি কি কেঁদেছিলাম? হয়ত কেঁদেছিলাম। আজ আর মনে পড়ে না।
একবার আমার পাখি পোষার শখ হল। তখন আমি ক্লাস ফোর। মেধাভিত্তিক পরীক্ষা চলছে। বাবা কথা দিয়েছিলেন পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে সেদিন টিয়াপাখি নিয়ে আসবেন। আমিও সেই আনন্দেই আছি। ওদিকে ঘটল এক দুর্ঘটনা। বিরতির সময় তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে পড়লাম সিঁড়ি থেকে। নীচের কংক্রিটের চাতালে মুখ থুবড়ে। সামান্য হুঁশ যখন এল তখন দেখলাম আমায় দিদিমণিরা রিকশায় করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে খবর গেল। বাবা যখন পৌঁছলেন স্কুলে আমি তখন টিচার্স রুমে বেঞ্চে শুয়ে আছি। বাবাকে দেখে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল – টিয়া পাখি এনেছ?
বাড়ি ফিরে দেখলাম খাঁচা সমেত একটা টিয়াপাখি রাখা আমাদের বেডরুমে। মাথার কাছে তার লালচে ছোপ। দোকান থেকে নাকি বলেছে এই প্রজাতিটাকে গুলমোহর বলে। বাবা বলেছিলেন – ওসব ফালতু কথা। মাথার কাছে রঙ করে দিয়েছে দাম বাড়াবে বলে। জানে পাখিকে তো আর সাবান দিয়ে স্নান করাব না। সাবান দিলে একদিনেই ওই রঙ উঠে যেত। সত্যি সত্যিই কয়েকদিন পর সেই রঙ ফিকেও হয়ে গিয়েছিল।
পাখির খাঁচাটা বাবার পছন্দ হয়নি। তাই নতুন খাঁচা এল, বড়সড় ,শক্তপোক্ত। সঙ্গে আনা হল আর একজন সঙ্গীকে। একটা চন্দনা। দুটো এক খাঁচাতেই থাকত। প্রথম কয়েকদিন মনমালিন্যের পর দুটিতে বেশ ভাব হয়েছিল। পরের সাতটা বছর তারা দিব্যি আমার বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছিল। নামকরণের ব্যাপারটা আমার বরাবরের পছন্দ। প্রথম টিয়াটির নাম দিলাম মিঠু, চন্দনার কী নাম দিয়েছিলাম তা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না।
প্রথমেই বলেছি পোষ্যের দেখভালের দায়িত্ব ছিল বাবার উপর। তাদের ছোলা, জল দেওয়া। মাঝে মাঝে খাঁচার উপর জল ছিটিয়ে তাদের স্নান করানো সব বাবাই করতেন। তারাও সম্ভবত বাবাকে বেশ পছন্দ করত। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল উল্টো। আমার ধারণা ছিল সব টিয়াই কথা বলতে শিখে যায়। তাই আমিও তাদের প্রথম প্রথম কথা শেখাতে চেয়েছিলাম। কথা তো তারা শেখেইনি উপরন্তু সদা আমার উপর একটা বিরূপভাব ছিল। আমার সেই প্রাথমিক অপচেষ্টার শাস্তি স্বরূপ তারা আমায় দেখলেই ট্যাঁ ট্যাঁ করে গঞ্জনা দিত।
মেঘ ডাকলে, বৃষ্টি এলে তাদের খাঁচাটি ছাদের উপর নামিয়ে রাখা হত। বৃষ্টি শুরু হলে তাদের আনন্দ আর দেখে কে। ট্যাঁ ট্যাঁ করে আনন্দে তারা চিৎকার করত। খাঁচার উপরের দিকটা পায়ে আঁকড়ে উল্টো হয়ে দুজনেই পাখা ছড়িয়ে দিত। সারা শরীরে মেখে নিত প্রকৃতির স্নেহাশিস।
পাখির ব্যাপারে বাবার উৎসাহ ছিল দেখার মত। টিয়ার পিছু পিছু বাড়িতে এল এগারোটি বদরী পাখি। চ্যাপটা চঞ্চুর রঙিন পাখিগুলোকে প্রথম দিনই খুব ভালো লেগে গেল। চুপচাপ বসে থাকে। সন্তর্পণে খাঁচার ফাঁক দিয়ে আঙুল গলিয়ে তাদের আদরও করা যায়। চঞ্চুর সামনে আঙুল নিলে কুট কুট করে কামড়ায়।
দোকান থেকে একটা জালিদার খাঁচা দিয়েছিল কিন্তু সেইটাও বাবার না-পসন্দ। কাঠের মিস্ত্রিকে দিয়ে তৈরি হল চাকা লাগানো বিশাল এক খাঁচা। উচ্চতা প্রায় আমার বুক সমান। চওড়াও দেখার মত। চার কোনায় মাটির ছোট হাঁড়ির গায়ে গর্ত করে বাসা বানানো হল। নীচে বড় পাত্রে কাগনি দানা বা ঘাসের বীজ ভর্তি করে রাখা হত। কোনাকুনি দুটি কাঠের দাঁড় বসানো ছিল তাদের রকের আড্ডার জন্য। ছোট ছোট পাখিগুলোর জন্য খাঁচাটা বেশ বড় ছিল। তারা মনের আনন্দে ওড়াউড়ি করতে পারত। নিজেরা থাকতাম দোতলা ইট বের করা বাড়িতে কিন্তু পোষ্যের জন্য প্রাসাদটুকু বাবা তৈরি করিয়েছিলেন।
এরপর একদিন স্কুল থেকে ফিরে ঠাকুমার ঘরে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলাম। দরজার পাশে ছোট্ট খাঁচায় একটা ধবধবে সাদা, তুলতুলে খরগোশ। বসে পড়লাম খাঁচার সামনে। সেও তার ক্ষুদে লাল চোখ দিয়ে আমায় পর্যবেক্ষণ করে চলল। এত কাছ থেকে খরগোশ এই প্রথম দেখলাম। মাকে জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল সামনের মাছ, পাখির দোকানে জায়গার কমতি হওয়ায় আপাতত আমাদের বাড়িতে তার স্থান হয়েছে। ফলত আব্দার জুড়লাম বাবা যেন খরগোশটা কিনে নেয়, আমি পুষব।
এবার মা আপত্তি জুড়লেন। খরগোশ দৌড়ে বেড়াতে ভালবাসে, এইটুকু খাঁচায় তাকে আটকে রাখা উচিৎ নয়। একবার ছেড়ে দিলে সে কোথায় পালাবে ঠিক নেই। কে ছুটবে তার পিছনে? আমি যদি পুষি তাহলে সে দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।
ব্যাপারটা গোলমেলে। খরগোশের পিছনে দৌড়নো আমার কম্ম নয়। তাই খরগোশ পোষার ইচ্ছাতেও আমায় ইতি টানতে হয়েছিল সে যাত্রায়। খরগোশটা আমাদের বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিল। খাঁচার ফাঁক দিয়ে সাধ্যমত তাকে আদর করতাম, খাওয়াতাম। সেও তার সীমিত ক্ষমতা নিয়ে ঠাকুমার ঘর সাধ্যমত নোংরা করে আবার ফিরে গিয়েছিল।
আমাদের বাড়ির এক তলায় থাকত মিস্ত্রিদাদু। সবাই ডাকত সুমিত মিস্ত্রি বলে। পেশায় রাজমিস্ত্রি। তার আসল বয়েস যে কত ছিল কে জানে। আমি ছোটবেলা থেকেই তাকে একই রকম দেখে এসেছি। তার ঘরটা ছিল বেশ লম্বা কিন্তু অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে। সন্ধের পর একটা টিমটিম করে হলদে আলোর বাল্ব্ জ্বলত। ঘরে ঢুকলেই নাকে আসত একটা তেলচিটে গন্ধ।
তা সেই মিস্ত্রিদাদুর পোষ্য ছিল বিশুয়া। বেজি যে কারও পোষ মানতে পারে তা আগে জানতাম না। একদিন কোথা থেকে যেন তাকে ধরে এনেছিল। সে তখন ছোট। তার গলায় বাঁধার জন্য লম্বা একটা চেনও জোগাড় হয়েছিল। প্রথম প্রথম বেঁধে রাখতে হত, পরে সে সবের বালাই ছিল না। পুরো বাড়িতেই ছিল তার অবাধ যাতায়াত। আমারও বিশুয়া নামটা বেশ পছন্দ হয়েছিল। বিশেষত – এই বিশুয়া, আরে এ বিশুয়া বলে ডাকতে দারুণ লাগত।
মাঝে মাঝে বিশুয়াকে শীতের দুপুরে আমাদের ছাদে বেঁধে রাখা হত। সেও বেশ আয়েশ করে গায়ের লোম ফুলিয়ে কালচে খয়েরি বলের মত বসে থাকত। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেরালেও সন্ধের পর সে ঠিক মিস্ত্রিদাদুর ঘরে ফিরে আসত। আমিও মাঝে মাঝে সাঁঝবেলায় যেতাম তাদের ঘরে। ছোট খাটিয়ায় বসে পা দোলাতে দোলাতে বিশুয়াকে ডাক দিতাম। সেও আমার কোলে উঠে শুয়ে পড়ত। তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। সে চুপটি করে পশমের মাফলারের মত আমার কোলে শুয়ে থাকত। একবার আঁকার স্কুলে শুনলাম তুলির ব্রাশ বেজির লোম দিয়ে তৈরি হয়, তাই বেজি শিকারও হয় ভীষণভাবে। সঙ্গে সঙ্গে সেই তুলি নিয়ে হাজির হলাম বিশুয়ার কাছে। সত্যিই তো বিশুয়ার লোমের সঙ্গে তুলির ব্রাশের কী আশ্চর্য মিল।
একদিন সকালে শুনলাম বিশুয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, না কোথাও নেই। মিস্ত্রিদাদুকে বলতেই সে বলল – ও বনের জীব বনে ফিরে গেছে। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন হঠাৎ করে কারও বনের কথা মনে পড়ে নাকি! নিশ্চয়ই বাড়িতেই কোথাও আটকে পড়েছে। যেখানে যেখানে সে আটকে থাকতে পারে সব খুঁজে দেখলাম। না কোথাও নেই। তিনদিন কেটে গেল এইভাবে। বাড়ির একতলায় এক নাটকের দল ভাড়া ছিল। তাদের স্টোররুমটাও ছিল অদ্ভুত ধরনের। চওড়ায় সরু, কিন্তু লম্বায় অনেকটা। আর উচ্চতাও ছিল বাকি ঘরের দেড়গুণ। তার ভিতরে নাটকের সরঞ্জাম জমতে জমতে প্রায় ছাঁদ ছুয়েছে। ঘরের একদম উপরে একটা তারজালি লাগানো ছোট জানলা, যার মুখটা আমাদের দোতলার ল্যান্ডিং-এর ঊচ্চতায় ছিল। সকালে পড়তে যাব বলে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, হঠাৎ একঝলক মনে হল কিছু একটা উঁকি দিচ্ছে জানলা দিয়ে। বিশুয়া না? জানলার কাছে যেতেই সে ভয়ে পালিয়ে গেল। বিশুয়ার নাম নিয়ে বেশ কয়েকবার ডাকার পর সে আবার উঁকি দিল জানলা দিয়ে। আমার আর তর সইছে না, ছুটে নামলাম সিঁড়ি বেয়ে। একতলায় স্টোর রুমের দরজায় তালা। চাবি তো নাটকের গ্রুপের কাছে। তাদের আসতে আসতে বিকেল। অতক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। বেচারা হয়ত তিনদিন খাবার পায়নি। কিছু ভেবে না পেয়ে দরজায় চাপ দিলাম। তালাবন্ধ দরজা আর কতটা ফাঁক হবে। তবে সামান্য ওই ফাঁক গলেই বিশুয়া বেরিয়ে এসেছিল, তারপর ভয়ের চোটে সেই যে দৌড় দিল আবার তার দেখা পাওয়া গেল সন্ধের পর।
আজ ভাবলে অবাক লাগে কোথায় সেই বিশুয়া, কোথায় মিঠু, কোথায় আমার চন্দনা, বদরীর ঝাঁক। সব এক এক করে হারিয়ে গেছে। যে বাড়ি ঘিরে এত স্মৃতি, যার পোষ্য ছিলাম আমরা, সেই বাড়িটাই যে আজ হারিয়ে গেছে। সঙ্গে হারিয়ে গেছে আমার আপনভোলা শৈশবের দিনগুলো। এইজন্মে আর তারা ফিরবে না। শুধু রয়ে গেছে চাপ চাপ স্মৃতির পদচিহ্ন। আর আছে মায়া। এ মায়া বড় সাংঘাতিক। সেই মায়ার টানেই আমি আমার পোষ্যদের নিয়ে একদিন হেসেছি, তাদের মৃত্যুতে কেঁদেছি। আর আজ তাদের কথা লিখতে গিয়ে বারবার স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছি।