গল্প পানি-পথ বৈশাখী ঠাকুর শরৎ ২০১৭

বৈশাখী ঠাকুরের আগের গল্প–  ব্যাংবাহিনীর স্কুলভ্রমণ   ,  বিবর্তন

আজ সকাল থেকেই শরীরটা ভালো নেই টোডির। কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। জ্বর আসছে মনে হয়। গায়ে হালকা টেম্পারেচারও আছে। তাই মা বলেছেন, ডিটোর সাথে বেশি মাখামাখি না করতে। ওরই যমজভাই। হুবহু একইরকম দেখতে। তাই টোডি আর ডিটো। ডিটো মানেও হুবহু। আবার টোডি উল্টে দিলেও ডিটো। নাওয়া-খাওয়া-খেলা-ধুলো-ওঠা-বসা সবই একসাথে। ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শেষে ডিটোরও না জ্বর চলে আসে! তাই আজ দুই ভাইয়ে কিঞ্চিৎ ছাড়াছাড়ি করে থাকতে হচ্ছে। এ ভাই এ ঘরে পড়ছে তো অন্য ভাই পাশের ঘরে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে। টেবিলের দুইপ্রান্তে বসে দু’জনে খাচ্ছে। খেলাধুলাও একসঙ্গে হচ্ছে না। অতএব ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটিতেও বেশ ফাঁক পরে যাচ্ছে। ঠিক জমছে না ব্যাপারটা।

দুই ভাই অমরেন্দ্র বিদ্যাপীঠে ক্লাস সিক্সে পড়ে। দু’জনকে একইরকম দেখতে বলে ইস্কুলে তাদের নিয়ে বেশ হুল্লোড় হয়। টোডি আর ডিটো ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগ করে। বিকেলে আবার দুই ভাইয়ের সাঁতারের ক্লাস থাকে। আজ টোডি দর্শকের ভূমিকায়। ডিটো জলে নামবে। দু’সারি অজস্র বেঞ্চ পাতা থাকে সুইমিং পুলের একদিকে। সার দিয়ে বাবা-মায়েরা বসে থাকেন। এইখানে বসে মায়েদের ঐ গুলতানি শোনার কোনও ইচ্ছে নেই টোডির। তাই সে পুলের উল্টো প্রান্তে গিয়ে একটা সিমেন্টের বেঞ্চ আছে, সেখানে গিয়ে বসল। স্বচ্ছ নীল জলে সূর্যের ঐ ঝিকিমিকি যে কী অসাধারণ এক রূপ-মাধুর্যের সৃষ্টি করেছে তা যে টোডি এতকাল খেয়াল করেনি কেন সেটা ভেবেই সে অবাক হল। তারা সেকেন্ড ব্যাচটায় সাঁতার কাটে। তাই অস্তগামী সূর্যের ঐ দুর্দান্ত রংবাজিও দেখার সৌভাগ্যও হল আজ। এতদিন কেবল মন দিয়ে সাঁতার কেটে গেছে, কিন্ত আর কিছু খেয়াল করেনি। আজ ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় বসে দেখল, কীভাবে থেকে থেকে ঐ লালচে আকাশ যার সাথে মিশেছে, কমলা কুসুমের মতো কিছু আভা যাকে মুহূর্তের মধ্যে ছাপিয়ে এক সোনালি আলো বিশ্বচরাচরে ছেয়ে গেল। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য দেখে সত্যিই মোহিত হয়ে গেল টোডি।

ইতিমধ্যে  কিছু ব্যায়াম কসরত করে গা গরম করে নিয়েছে সাঁতারুর দল। ঝপাং ঝপাং করে সব জলে নামছে। আহা! এই গরমে ঠান্ডা জলে নেমে যে কী সুখ! যে জানে সে জানে। ডিটো সাঁতার কেটে ঐ প্রান্তেই যাবে যেদিকে টোডি বসে আছে। ডিটো সাঁতার কাটতে কাটতে তার কাছে এসে একগাদা জল ছড়িয়ে ফিরে যাচ্ছিল। দুষ্টুমির একটা সুযোগও ডিটো ছাড়ে না। খানিক দূরে  সাঁতরে যাওয়ার পর টোডি আর ডিটোকে দেখতে পেল না। টোডি জানে, ডিটো ডুবসাঁতারটাও খুব ভালো দিতে পারে।

ডিটো সুন্দর করে ব্যাক স্ট্রোক করে ফিরছিল যখন, আচমকা ওর পায়ে যেন কীসের একটা সুড়সুড়ি অনুভব করল। কোনও জল-ঢোঁড়া সাপ হবে হয়তো। প্রথম প্রথম ডিটোও ভীষণ ভয় পেত। কিন্তু এখন বুঝেছে, এদের থেকে কোনও ক্ষতি হবার চান্স নেই। বেচারারা নিজেরাই এত ভয় পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যায় যে খেই হারিয়ে ফেলে। যাই হোক, সে পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছিল যখন সুড়সুড়িটা আরও তীব্র মনে হল। সে তৎক্ষণাৎ ডুবসাঁতার দিয়ে দেখতে গেল ব্যাপারখানা কী। দেখে তো সে কেমন তাজ্জব বনে গেল। এক ছোটোখাটো অদ্ভুত গোছের মানুষেরই মতন একটা কে যেন! এক লহমায় সে এত ঘাবড়ে গেছিল যে সে খেয়ালই করেনি ঐ অদ্ভুত প্রাণীটা ইশারায় তার পিছু পিছু যেতে বলছে। যখন সম্বিত ফিরল, সে কেমন সম্মোহিতের মতো ডুবসাঁতার দিয়ে ঐ লিলিপুটটার পেছন পেছন চলল। অনেকটা দূর গিয়ে কেমন ভয় ভয় করতে লাগল ডিটোর। অমনি সে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় শুনতে পেল, “ভয় কীসের? তোমায় আবার সময়মতো এখানে ফিরিয়ে এনে দেব।”

কেমন চমকে উঠল ডিটো ঐ স্পষ্ট বাংলায় বাক্যিগুলো শুনে। সেটা বুঝতে পেরেই বুঝি খুদে মানুষটা তাকে আশ্বস্ত করল। “আমরা মনের ভাব পড়ে ভাষা অনুবাদ করে বলতে পারি।”

আশ্চর্য হল বটে ডিটো। তবে ভাবনাচিন্তার তেমন অবকাশ পেল না।

এবার খানিক দূর এগিয়ে যেতেই ডিটো দেখতে পেল একটা সুড়ঙ্গমতো পথ। দীর্ঘ সেই টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে তার ভয়ের সাথে রোমাঞ্চও কম হচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ দেখল, তার জন্য পথ অবরুদ্ধ। ছোট্ট মানুষটা অনায়াসে ঢুকে গেল, কিন্তু তারই হল বিপদ। ডিটো বুঝতে পারছিল, এটা সেই দরজা যার ওপারেই এই খুদে মানুষদের রাজ্য। তাদের আকারগুলো বেশ খর্বকায় হবার দরুন এই ঢোকার রাস্তা তেমন প্রশস্ত নয়। শুধু ঐ ছোটো মানুষদের উপযোগী করেই বানানো। একটু একটু রাগ হচ্ছিল ডিটোর। তাকে ডেকে এনে এভাবে হেনস্থা!

টোডি যদিও জানে তার ভাই খুব ভালো ডুবসাঁতার কাটে, কিন্তু এতক্ষণ তাই বলে মাথা তুলবে না এমন তো হয় না। আর তাদের এই ক্লাবের সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অল্প পয়সায় শেখায় বলে প্রতি গ্রীষ্মে এত ভিড় হয় যে বলার নয়। তার মধ্যে ট্রেনারের সংখ্যা অত্যন্ত কম। ফলস্বরূপ, ডিটো যে নেক্সট ল্যাপ্সটায় সাঁতার কাটছেই না তা কেউ খেয়ালই করবে না। মনটা কেমন আনচান করে উঠল টোডির। মাকে বললেই মা এখন অযথা দুশ্চিন্তা করতে বসবে। তাছাড়া এই স্বল্প জলে ডোবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ডিটোর। তার এবার থার্ড সিজনে সাঁতার শেখা। শেখা আর বলা উচিত না। অনুশীলন, প্র্যাকটিস – যা বলবে। এ বছর ডিটোরা স্টেট লেভেলে অংশগ্রহণ করতে চলেছে। গতবছর ডিস্ট্রিক্ট লেভেল মাতিয়ে এসেছে। বাড়িতে মেডেলে ভর্তি। যার সাথে জলের এত সখ্যতা সে ডুবতে পারে না, টোডি জানে। কিছুতেই ডুবতে পারে না। কিন্তু কথা হল, ডিটো তাহলে  গেল কোথায়? আর দশ মিনিট অপেক্ষা করে টোডি তাদের ট্রেনারকে বলে দেখবে বলে মনে মনে ঠিক করল।

হঠাৎ মাথার ওপর একটা আওয়াজ শুনতে পেল ডিটো। ওপরে সুড়ঙ্গের কিছু পাথর সরে গেল। ফাঁকটা বড়ো হওয়ায় এবার সে খুব সহজেই ঢুকে যেতে পারল। তাহলে ব্যবস্থা সবরকমই আছে। ডিটো এবার অত্যাশ্চর্য হয়ে দেখল, মাটির তলায় এক আস্ত রাজ্যপাট। বাড়িঘর, ইমারত, ইস্কুল সব। তবে রুক্ষ-শুষ্ক। মরুভূমির মতো ধু ধু করছে। অবাক হবার সাথে সাথে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল টোডির। খুদে মানুষটা কিন্তু তার মনের ভাবটা বুঝতে পারল। সেই ছোট্ট বন্ধুটাই তাকে জানাল যে তাদের এটাই এখন মস্ত সমস্যা। জলের নিদারুণ অভাব। ঠিক এই কারণে লোকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। অকাল মৃত্যু হচ্ছে। তাদের রাজ্যে জলের জন্যও হাহাকার পড়ে গেছে। ঐ পুকুর-কাম-সুইমিংপুল সংলগ্ন যতটুকু বাসভূমি আছে তারাই কেবল বেঁচেবর্তে কোনওরকমে টিকে আছে।

ভারি আশ্চর্য হল ডিটো। প্রথমত, পাতালদেশে এমন রাজ্য! বাস্তবে যে এমন কিছু থাকতে পারে এ ধরায় তাই ভেবে সে প্রচন্ড অবাক হল। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, আচমকা এমন জলের অভাব কেন? এর আগে কী করে চলত তবে! কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে সে সোজাসুজি প্রশ্নটা করেই বসল।

“আসলে তুমি দেখে থাকবে আমাদের এ তল্লাটের ঠিক ওপরেই তোমাদের এক শিবমন্দির ছিল। চলতি কথায় তোমরা যাকে বুড়োশিবতলা বলে থাক।”

“কিন্তু সেটা তো আমাদের এই পুল থেকে বেশ খানিকটা দূরে।”

“ঠিকই। ওপরে এমনটাই হবার কথা। যেমন এরিয়াল ডিস্টেন্স অনেক কম হয় তেমন মাটির তলার দূরত্বও সংকীর্ণ হয়ে আসে।”

“তা অবশ্য হতে পারে। কারণ, বাসে বা গাড়িতে যেতে যা সময় লাগে তার চেয়ে কম সময়ে আমরা একই জায়গায় পৌঁছে যাই পাতালরেলের সাহায্যে।”

“একদম ঠিক ধরেছ।”

“হ্যাঁ, তুমি বেশ কী বলছিলে সেই মন্দিরটার কথা?”

“আসলে একসময় এই মন্দিরে বিরাট সমারোহ করে নিয়মিত পুজো হত। মন্দির জাগ্রত বলে নামডাক কিছু কম ছিল না। ফলে অগণিত ভক্তের সমাগম হত রোজ। দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ আসত মহাদেবের মাথায় জল ঢালতে। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে দুধ, জল ঢালা হত। শিবলিঙ্গ থেকে ড্রেনেজ সিস্টেমটাই এমনভাবে বানানো হয়েছিল যে সমগ্র জলটাই আমাদের রাজ্যের সংরক্ষণাগারে এসে পড়ত। খেয়াল করলে দেখতে পাবে, মন্দিরের মেঝেতে অনেক ক্ষুদ্র ছিদ্র করা আছে যার থেকে জল চুইয়ে পড়ার অবকাশ ছিল। ফলে আমাদের জলের অভাব হত না। কিন্তু পরবর্তী কালে একবার শিবরাত্রির দিনে মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে বেশ কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। কোনও কারণে ফুড পয়জনিং হয়ে গেছিল। ব্যস! মানুষের মনে ভক্তি ছেড়ে ভয় ঢুকে গেল। সমীক্ষা তদন্ত করে মন্দির প্রায় উঠে যাবার জোগাড়। আয় কমে যাবার দরুন আর কোনও পুরোহিতও এগিয়ে আসে না। দু-চারজন যাও বা এগিয়ে এল কিন্তু ততদিনে মন্দিরের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে লোক সমাগম কমে এল। অতঃপর মন্দির পরিত্যক্ত হয়ে গেল আর আমাদের শুরু হল জল নিয়ে তুমুল সংগ্রাম। তবুও বিশেষ তিথিতে, শিবরাত্রির দিনে বিস্তর জল পেতাম আমরা। তাই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলাম, কিন্তু সে আর কদ্দিন! তারপর আরও একটা বাজে কাজ তো তোমাদের মর্ত্যলোকে দিন দিন বেড়ে চলেছে।”

“কী বল তো?”

“দুনিয়ার সব পুকুর বুজিয়ে গগনচুম্বী ফ্ল্যাট-বিল্ডিং তুলছ।”

“হুম। এটা তুমি খুব সত্যি কথা বলেছ। আমাদের পুলটার দক্ষিণদিকে আরও একটা পুকুর ছিল। সেটা বুজিয়েও তো ফ্ল্যাট উঠে গেল। তাতে তোমরা নিশ্চয়ই আরও অসুবিধেতে পড়ে গেছ।”

“সে আর বলতে! আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা।”

“কিন্তু আমি তোমাদের এই সমস্যার সমাধান করব কী করে?”

“তুমি বুদ্ধি খাটিয়ে কোনও অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা করবে ঐ মন্দিরকে ঘিরে। তাহলে আবার মন্দিরকে নিয়ে মানুষের মনে আলোড়ন শুরু হবে। সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে সাহায্যও করতে পারি। মন্দির আবার চালু হয়ে গেলে আমাদের আর অতটা  দুঃখ থাকবে না।”

টোডি চিন্তিত মুখে উঠে বলতেই যাচ্ছিল। যখন দেখতে পেল অতি দ্রুত লাস্ট ল্যাপটা কাভার করে ডিটো অন্যদের সাথে মিশে গেল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন টোডি। কিন্তু ডিটোর চোখমুখ উত্তেজনায় এত লাল কেন!

সেদিন রাত্রে খাটে শুয়ে শুয়ে টোডি সেই আশ্চর্য উপাখ্যান শুনল ডিটোর কাছে। উত্তেজিত ডিটো তাকে বলেছিল, “জানিস তো, অবিকল ছবিতে দেখা, বইয়ে পড়া এল্ভস বা গবলীনদের মতো দেখতে। কানদুটো পেল্লায় সাইজের এবং খুব কার্যকরীও। দারুণ সজাগ। আমি খেয়াল করেছি। কোনও ক্ষীণ শব্দও ওদের ঠিক কানে চলে যায়। তবে মানুষগুলো বেঁটে বেঁটে ছোটখাটো। আর চোখের মণিগুলো অন্য ধরনের।”

“হয়তো ওরা আলো সহ্য করতে পারে না বলে এমন ব্যবস্থা। মাটির তলায় বাস তো! আর শ্রবণেন্দ্রিয় অত্যন্ত সজাগ বলেই হয়তো কানগুলো  এমনভাবে সৃষ্টি।”

“হতেও পারে। আচ্ছা টোডি, তোর মনে আছে, আমরা একবার টিভিতে হিস্ট্রি চ্যানেলে একটা প্রোগ্রাম দেখেছিলাম যেখানে অজন্তা ইলোরা গুহার নিচেও এমন এক রাজ্যের কথা অনুমান করা হয়? বহু ক্ষুদ্র নিখুঁত ড্রিলিং পাওয়া গেছে গুহার মেঝেতে।”

“আর সরু সরু বেশ কিছু প্যাসেজ। খানিক দূর গিয়ে সেগুলো এত ছোট হয়ে গেছে যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তা দিয়ে ঢুকতে পারবে না। এখন সরকার থেকে সেসব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওখানের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা স্বীকার করে নিয়েছে যে বহুদূর পর্যন্ত বেশ কিছু সুড়ঙ্গপথ আছে। সেসব টানেল নাকি মাইলের পর মাইল চলে গেছে ভেতরে।”

“এমনকি, গুগল ম্যাপে সার্চ করলেও দেখায় যে পৃথিবীর আরও অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড বেসের মতো ভারতবর্ষের ঠিক ঐ জায়গাটাতেও আন্ডারগ্রাউন্ড বেস আছে।”

“শুধু তাই নয়, ইলোরা গুহার কৈলাস মন্দিরের নির্মাণ তো আজও আমাদেরকে বিস্মিত করে। যে যুগে এর পত্তন হয়েছিল তখন এমন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। তা সত্ত্বেও একটা পাহাড়কে কেটে কেটে কী করে এটি তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল কে জানে! হিসাব বলে, যে পরিমাণ পাথর কাটতে হয়েছিল তা একশো বছর ধরে কোনও বিরতি বা ছুটি না নিয়ে  কাজ করলেও মানবজাতির পক্ষে সম্ভব হত না। অথচ কথিত আছে, আঠারো বছরে এই মন্দির গড়ে উঠেছিল।”

“অত্যন্ত উন্নতমানের টেকনোলজি ছাড়া এ অসম্ভব। আমার যা মনে হচ্ছে তোরও কি তাই মনে হয়?”

“হতেও পারে। ভিনগ্রহের না হলেও আমাদের চেয়ে ভিন্ন তো বটেই।”

“আমাদের অত ভেবে কাজ নেই। আমরা যা সাহায্য করতে পারি তাই না হয় করি।”

দুই ভাইয়ে মিলে এবার মন দিয়ে পরামর্শ করল কীভাবে ঐ মন্দিরের হৃত গৌরব ফেরানো যায়। পূর্বের মতো ফের মহিমান্বিত হতে পারে।

প্যারাসিটামল খেয়ে টোডি আজ অনেকটাই ফিট। অনেক করে মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আজ দুই ভাই জলে নামবে বলে ঠিক করেছে। অন্য সময় যেসব কথা কানে নেয় না আজ সে কথাই মাকে মনে করিয়ে দিয়েছে।

“মনে নেই মা,  ট্রেনারকাকু মানে স্যার কী বলেছেন? অল্প জ্বর সর্দিকাশিতেও নামতে।”

“তা এতকাল যখন বলতাম তখন তো গা করতিস না!” একটু অবাক হয়েই মা কথাটা বলে।

“না না, মা, আজ আমাদের যেতেই হবে। স্যার নতুন কীসব টেকনিক শেখাবেন বলেছেন।” ডিটো ভাইকে সাপোর্ট করে।

অঢেল উত্তেজনা আর উৎসাহ নিয়ে দুই ভাই বেরোল। যথাসময়ে দুই ভাই নেমেছে এবং গতকালের মতো জলে তার খুদে বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে ডিটোর। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। ডিটো তাদের প্ল্যানটা বলাতে সেই খুদে মানুষটার মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

“আমার নাম যেমন ডিটো তেমন তোমার নাম কী?”

“মারজুয়ানা।”

“বাহ্‌, ভারি সুন্দর নাম তো!”

“আমাদের এখানে সবার নামের শেষে আনা শব্দটা পাবে। যেমন আমার বাবার নাম ছিল অরিয়ানা। মা ছিলেন রিয়ানা। আমার বউ, তিকিয়ানা। ছেলে, টাকিয়ানা।”

“সে কী! তুমি এইটুকুনি, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?”

“আমাকে দেখতে ছোটো। কিন্তু বয়সে ছোটো নই।”

সেটা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল ডিটো। বেশ মজা লাগল তার।

“চল, তোমায় একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাই কোন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে তুমি মন্দিরের উপরে উঠতে পারবে। খুব দ্রুত কিন্তু কাজটা সারতে হবে। ঘণ্টা বাজিয়েই তোমায় ফিরে যেতে হবে নিজের জায়গায়। বাকি কাজটা টোডির।”

“ভয় কী, আন্ডারগ্রাউন্ড ডিসটেন্সে কম তো!” হেসে ফেলল মারজুয়ানা।

ঘুরতে ঘুরতে তারা মন্দিরের সেই গুপ্ত মুখটায় এল যা বড়সড় একটা পাথর দিয়ে অবরুদ্ধ।

“তোমরা ঐ পথটা ব্যবহার কর বুঝি?”

“খুব কম। এমারজেন্সি এক্সিট বলতে পার। তবে আজ প্রয়োজনে নিশ্চয়ই করব। তুমি যাও, ওপরে গিয়ে জোরে জোরে ঘণ্টাটা বাজিয়ে এস। সময়ের কথাটা মাথায় রাখবে কিন্তু। টাইমিংয়ের গন্ডগোল হলেই কিন্তু মুশকিল।”

টোডি খুব সন্তর্পণে সাঁতার কাটছিল। ওর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

সব গার্জেনরা প্রতিদিনের মতো দর্শকের ভূমিকায় বসে বাচ্চাদের সাঁতারের তদারকি করছিল। আচমকাই একটা শোরগোল শোনা গেল। হঠাৎ দেখা গেল, সুইমিং পুলের একদম অন্য প্রান্তে একটা বাচ্চা প্রায় হাবুডুবু খেতে খেতে চেঁচাচ্ছে, “বাঁচাও! বাঁচাও!”

সবাই বুঝতে পারল টোডি আত্মরক্ষার জন্য চেঁচাচ্ছে। তৎপর হয়ে যেতে না যেতেই অবিশ্বাস্যভাবে টোডি উধাও। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন হঠাতই সেই পরিত্যক্ত মান্দির থেকে ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল। সজোরে বেশ কয়েকবার ঘন ঘন সেই ঘন্টাধ্বনি আকাশ-বাতাসকে মুখরিত করে তুলল। দিশেহারা টোডির মা, শ্রাবণী তখন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এই ডামাডোলে ডিটো ফিরে এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই বিনা ভূমিকায় ঘণ্টাধ্বনিতে সবাই যারপরনাই বিস্মিত। একদল ছুটে সেদিকে চলে গেল। কেউ কেউ জলে ছেলেটার খোঁজ মেলে কিনা তা দেখার জন্য রয়ে গেল। শ্রাবণীকে যথাসম্ভব সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে ডিটো।

“তুমি চিন্তা করো না, মা। টোডির কোনও ক্ষতি হবে না। তুমি দেখো, আবার টোডি আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।”

মায়ের মন কি তা মানে! হাপুস নয়নে শ্রাবণী কেঁদে চলেছে। ধরা ধরা গলায় বলল, “গায়ে জ্বর নিয়ে নামতে বারণ করেছিলাম। কিছুতেই কথা শুনল না।”

অত্যুৎসাহী দর্শক যারা ঘন্টাধ্বনি শুনেই ছুটে গেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, টোডি মন্দির প্রাঙ্গণে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। শুনে সবাই তাজ্জব বনে গেল। এও কি সম্ভব! সবাই হুড়মুড় করে অকুস্থলে গিয়ে দেখে সত্যিই তাই!

বলাই বাহুল্য, এমন এক আশ্চর্য ঘটনা মন্দিরকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করল। সবই বাবার দয়া। জয় শিবশঙ্কর! জয় শিবশম্ভু! অচিরেই বাবার কৃপার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল।

স্থানীয় বাসিন্দারা মিলে মন্দির পরিষ্কার করে এক পুরোহিতকে নিয়োজিত করল যাতে ঠিক করে নিয়মিত পুজা-অর্চনা হয় মহাদেবের। ভক্তের সমাগমের সাথে সাথে শিবমন্দিরে ফুল-বেলপাতার সহযোগে অকৃপণভাবে জল–দুধের এখন অফুরন্ত ভাণ্ডার। লোকের মুখে মুখে এই কাহিনি ছড়িয়ে পড়াতে আবার দূরদূরান্ত থেকে ভক্তদের ভিড়ের ঠ্যালায় একেবারে অস্থির কান্ড!

মন্দিরের এখন রমরমা অবস্থা। দুই ভাইও মাঝে মাঝে গিয়ে জল ঢেলে আসে মহাদেবের মাথায়। তারপর দু’জনে কল্পলোকে চিন্তা করে নেয় কতটা সুজলা সুফলা হল তাদের ঐ মারজুয়ানার রাজ্যপাট।

ছবি তিতিল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস একত্রে 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s