পার্থ ঘোষ
মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠল তমাল। মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল মেয়ের দিকে। দেখল, মেয়ের চোখে দুঃখের ছায়া। দৃষ্টিতে কেমন হতাশা। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। মেয়ের মুখ-নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ সুতীক্ষ্ণ তিরের মত আঘাত করেছে তমালের বুকে। চামড়া ফুঁড়ে সোজা ঢুকে গেছে হৃদয়ের নরম অংশে।
বুকের ভেতরটা যেন হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল। সত্যি, মেয়েটার সঙ্গে সময় কাটানোটা অনেকটাই কমে গেছে। মেয়েকে এখন আর নাগালে পায় না সে। যেদিন প্রথম কোলে কোলে সকালের স্কুলে নিয়ে গিয়ে ভর্ত্তি করেছিল, সেদিনের দৃশ্যটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।
ছোট্ট মেয়েটার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল ঝর্ঝর্ করে। অঝোর ধারায় কাঁদছিল তার মেয়ে স্নিগ্ধা। তমাল সান্ত্বনা দিচ্ছিল। মেয়ের তবু এক গোঁ, ইস্কুলে যাবে না। নতুন জায়গা, নতুন কিছু মানুষ, অচেনার ভয়, অজানার ভয়।
দু’তিন দিন পর পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল অনেকটাই। মেয়ে তখন স্কুল থেকে বাড়ি এসে গড়গড় করে গল্প করত। তার নতুন বন্ধুদের কথা বলত, দিদিমনিদের কথা বলত। নিজে ছাড়া অন্যে কী কী দুষ্টুমি করেছে তার কথাও বলত। চোখে মুখে তার খুশি উপছে পড়ত। ইস্কুল না যেতে পারলে মেয়ের মন খারাপ হয়ে যেত। চোখে জল চলে আসত। একেবারে প্রথম দিনের বিপরীত দৃশ্য।
ক্লাস টপকে টপকে মেয়ে বড় হতে শুরু করল। বাড়ল পড়ার চাপ। সংখ্যায় বাড়ল দিদিমনি। বাবার সঙ্গে খেলার, গল্প করার সময় কমতে থাকল। সেই সঙ্গে নাচ, গান, আঁকার প্রশিক্ষণও শুরু হয়ে গেল। স্বভাবতই কিছু সময় চুরি হয়ে যেতে লাগল তার দৈনন্দিন জীবন থেকে।
মেয়ে যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ত তমাল তখন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলেই দেখত মেয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আগে বাবাকে জড়িয়ে ধরবে তবে শান্তি। কতদিন মেয়েকে বকেছে তমাল। বলেছে, “আগে গা-হাত-পা ধুয়ে পরিষ্কার হই, তারপর আদর হবে। রাস্তার ধুলো, গায়ের ঘাম সব তো তোমার গায়ে লেগে যাবে।”
মেয়ে শুনত তখনকার মত, আবার পরদিন সেই একই কাজ করত। ওকে বকার পর মনটা খারাপ হয়ে যেত তমালের। কষ্ট লাগত, মনে হত কত আশা করে থাকে মেয়েটা সারাদিন, কখন বাবা বাড়ী ফিরবে; একটু নয় জড়িয়ে ধরে, তাতে কি আর হবে? কাল থেকে আর বকবে না ওকে। কিন্তু অপরিষ্কার জামা-প্যান্টের কথা মনে হলেই ফের বকে ফেলত মেয়েকে।
এখন আর মেয়েকে পায় না অফিস থেকে ফেরার সময়। ওই সময় ওর টিউশনির পড়া থাকে অথবা নাচের ক্লাস। অভ্যেস বদলে গেছে। ফলে কিছুটা দুরত্বও বেড়েছে।
মোট কথা মেয়ে এখন খুব ব্যস্ত। তমালও যে ব্যস্ত নয় তা নয়। তমালের নেশা তমালকে মেয়ের থেকে অনেকটাই দূরে নিয়ে গেছে। স্পর্শ দূরভাষ যন্ত্রটা কেনার পর থেকে যন্ত্রটা রাক্ষসের মত বেশ অনেকটা সময়ে খেয়ে নিচ্ছে তমালের। একবার ওর পর্দায় আঙুল ঠেকলে সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা যে কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না তমাল। মোবাইলটা যে তমালকে ক্রমশ গ্রাস করছে সেটা বুঝতে পারছে সে। কিন্তু তবুও তার নেশা কাটিয়ে উঠতে পারছে না তমাল। কিসের একটা হাতছানি তাকে মোবাইল স্পর্শ করার নেশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে।
অফিস থেকে ফিরেও ওই মোবাইলের পর্দায় চোখ সেঁটে যায় তমালের অভ্যাসবশত। আর তাতেই মেয়ের থেকে দূরত্বটা তৈরি হয়ে যাচ্ছে তার। বাবা ব্যস্ত দেখে মেয়ে নিজেই একা একা খেলায় মেতে উঠছে। কখনও বা নিজের আঁকা, পড়া, গান বা নাচ ইত্যাদিতে মগ্ন হয়ে যাচ্ছে নিজে নিজেই।
প্রথম কিছুদিন বাবার কাছে এসে সে চেষ্টা করেছে বাবার মনটাকে তার দিকে ফেরাতে, কিন্তু তমাল বুঝতে পারেনি। সে তখন স্যোশাল সাইটে চ্যাটিং-এ ব্যস্ত। স্নিগ্ধা বাবাকে ডেকেছে বারবার। খেলার কথা বলেছে, গল্প করার কথা বলেছে কিন্তু তমাল স্বপ্নের দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরে আসতে পারেনি, বা চায়নি। মেয়েকে বলেছে, “তুমি ওঘরে গিয়ে খেলা করো, একটু পর আমি আসছি।”
মেয়ের মন খারাপ হত তখন বাবার কথা শুনে। মনে অভিমান জমত। দুঃখ লাগত। বাবাকে বড়ই অচেনা মনে হত। রাগ হত মোবাইলটার ওপর। ওটার জন্যেই ওর বাবা আর ওর সঙ্গে মেশে না, খেলে না, কথা বলে না। সে ছুটে যেত মায়ের কাছে। কিন্তু সেখান থেকেও তাকে ফিরে আসতে হত। মা টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে বলত, “কালকের হোম-ওয়ার্কটা শেষ করে নাও । আমি একটু পরে যাচ্ছি।”
স্নিগ্ধার চোখে জল চলে আসত। সে ছুট্টে চলে যেত তার খেলার রাজ্যে। বিছানার ওপর শুয়ে থাকা পুতুলদের সঙ্গে কথা বলত সে। বাবা, মা-র কথা বলত তাদের। তারা তো কোন উত্তর দিতে পারে না, শুধুই শোনে বলে রাগ হত স্নিগ্ধার। সে তাদের মারত, ছুঁড়ে ফেলে দিত বিছানা থেকে। আছাড় মারত মেঝেয়। স্নিগ্ধার দু’চোখ দিয়ে নামত জলের ধারা । সে কান্না দেখার মত কেউ থাকত না তার পাশে।
আজ অনেকদিন পর বাবা অফিস থেকে এসে মোবাইল নিয়ে বসতেই স্নিগ্ধা বাবার কাছে এসে দাঁড়াল। আজ বাবার সঙ্গে খুব খেলতে ইচ্ছে করছে ওর। স্কুলের বন্ধু তৃপ্তি আজ তাকে গল্প বলেছে। ওরা বাবা মেয়েতে কাল লুডো খেলেছে। তিনবারের খেলায় প্রতিবারই তৃপ্তি জিতেছে। সেজন্য তৃপ্তির বাবা তাকে বড় সাইজের একটা ক্যাডবেরি উপহার দিয়েছেন। ক্যাডবেরি পেয়ে তৃপ্তির খুব আনন্দ হয়েছে। সে-কথা সে বলেছে স্নিগ্ধাকে।
তৃপ্তির গল্প স্নিগ্ধার মনে বাবার ভালোবাসার কথা মনে করিয়েছে। সেই গল্প শোনার পর থেকেই বাবার জন্য তার খুব মন খারাপ করছিল। মনে হচ্ছিল ছুট্টে বাবার কাছে চলে যায়। বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছোটোবেলার মতন।
সেই জন্যই আজ গুটি গুটি পায়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে। তাকে দেখে তমাল বলে উঠল, “কিছু বলবে?”
স্নিগ্ধার মনটা কেমন করে উঠল। অভিমানে ফুলে উঠল ঠোঁট। সে গড়গড়িয়ে বাবাকে বলে ফেলল, “বাবা এখন আর আমায় আগের মতন ভালোবাস না। আমার সঙ্গে খেলা কর না, কথাও বল না বেশি। আগে কত খেলা করতে, গল্প করতে…. তুমি খুব বাজে, আমায় ভালোইবাস না।”
তমাল চমকে উঠল মেয়ের অভিমানী কণ্ঠে। অবাক বিশ্ময়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, ছোট্টো মেয়েটা হঠাৎই অনেকটা বড় হয়ে গেছে। সে নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। তার মনে হল, খুব অন্যায় করেছে সে মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু আর নয়, কোন কিছুর জন্যই মেয়ের ভালোবাসাকে, মেয়েকে দূরে ঠেলে দিতে পারবে না সে।
হাতের মোবাইলটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে সে কাছে টেনে নিল তার মেয়েকে। স্নেহের চুমু এঁকে দিল তার কপালে। বাবার আদরে মেয়ের চোখে জল চলে এলো। বাবার চোখও ভিজে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তমাল ভেজা গলায় মেয়েকে বলল, “তোর বাবা আর তোর সঙ্গে খেলা না করে মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকবে না, দেখিস। তোর কাছে বসে সময় কাটাবে আগের মতনই। এবারের মতো তোর বুড়ো বাবাকে ক্ষমা করে দে।”
বাবার আদরে আদরিনী মেয়ে চোখের জল মুছে ফেলল হাতের তালুতে। মুখে তার হাসি ফুটল। কান্না ভেজা গলায় বলল, “বুড়ো, আবার মোবাইল নিলেই কিন্তু কান ধরে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে দেব।”
বাবা আর মেয়ের অট্টহাস্যে ঘরের দেওয়ালের টিকটিকিটা চমকে উঠল। পিতৃস্নেহের জোয়ারে ভাসল মেয়ে, মেয়ের আদরে ভাসল বাবা।
সত্যি। বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে
LikeLike