গোবিন্দ রুবাই, মদন আর জলবাসীরা
নীলাঞ্জন শাণ্ডিল্য
জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এলে মাঝে মাঝে হিসেব করতে ইচ্ছে করে কী পেলাম আর কী পেলাম না। যা পেয়েছি তার মধ্যে বন্ধুদের স্থান উপরের থাকে থাকবে চিরকাল। আর সেসব বন্ধুদের সকলেই যে মানুষ ছিল তা নয়। তেমন হারিয়ে যাওয়া কয়েকজন না-মানুষের কথা লিখতে বসেছি আজ –
।১।
গোবিন্দম্ ইতি উচ্যতে
পতিতপাবন হরি নয়, বিড়ালের কথা বলছি। আমাদের বাড়িতে বিড়াল পোষার শখ অনেককালের। কত যে বিড়াল পোষা হয়েছিল –গোলমুখো বা ছুঁচলোমুখো,সরুলেজ আর চামরলেজ,ধলো-কালো-পাটকিলে, বাঘের মত ডোরা অথবা চিতাবাঘের মত ছোপ-ছোপ দেওয়া। নানা রকম স্বভাব তাদের। কেউ শান্ত,কেউ দুষ্টু, কেউ বা গম্ভীর। কেউ রাগী, কেউ স্নেহপ্রবণ। বাবা বলতেন দুজন মানুষের যেমন স্বভাব মেলে না, তেমনই মেলে না দুটি বিড়ালের; আর স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতেন এলিয়টের ম্যাকাভিটি দ্য মিস্ট্রি ক্যাট, ম্যাকাভিটি নামক রহস্যময় বিড়ালের গাথা। হরেক নাম ছিল আমাদের পোষা সে-সব বিড়ালদের – দিশি, বিলিতি, সংস্কৃত, আরবি আবার কখনো অর্থহীন। একটির নাম ছিল তড়িৎ, একটির তুপা আর একটির টুপি। টুপি তার নামটি পেয়েছিল কারণ সে তালপাতার একটা হ্যাটের ভেতরে নিজেকে অদৃশ্য করে বসে থাকতে ভালবাসত বলে। হঠাৎ করে কেউ এলে একটা রংচঙে তালপাতার টুপিকে মেঝেতে হেঁটে চলে বেড়াতে দেখলে আঁৎকে উঠত।
তাদেরই একজন ছিল গোবিন্দ। তখন আমরা ব্যান্ডেলে থাকি। একটা মেনি বিড়াল গুটিকয়েক ছানা পেড়েছিল আমাদের বাড়ির হাতায়। চোখ ফুটতে তারা একে একে সরে পড়তে লাগল। তারই একটি কী করে রয়ে গেল আমাদের বাড়িতে। ফোলা ফোলা গাল, পিঠের সাদার উপর ওপর মোটা তুলিতে টানা পাটকিলে রঙের লম্বা লম্বা পোঁচ। চোখ দুটি ডাগর। নাম দেওয়া হল গোবিন্দ, যদিও গোবিন্দের মায়ের গালই ফোলা হয় বলে চিরকাল শুনেছি।
শিগগিরই সে নিজে খেতে শিখল। দু-বেলা দুধভাত খায়। রান্নাঘরে পিরিচে করে তাকে খাবার দেওয়া হলে বন্ধ সদর দরজার বাইরে থেকে তার মা ডেকে উঠত। কী করে টের পেত কে জানে! গোবিন্দ খাওয়া ফেলে দরজার কাছে গিয়ে কাঁদত। দরজা খুলে দিলে মা ঘরে ঢুকে পড়ে সব বাৎসল্য ভুলে সেই দুধভাত গোগ্রাসে খেতে লাগত। গোবিন্দর সেদিকে দৃক্পাত ছিল না, সে মায়ের গায়ে গা ঘষত আর আদুরে গলায় ঘড় ঘড় করত। খাওয়া শেষ হলেই মা পগার পার। তখন গোবিন্দকে আর এক দফা খাবার দিতে হত। সেভাবেই চলছিল। কিন্তু, পথচারিণী মায়ের গা থেকে ডাঁশ পোকা চলে আসতে লাগল গোবিন্দের দেহে। ওষুধ দিয়ে স্নান করালে তবে ডাঁশমুক্তি। ভাগ্যবশত ক্রমশ গোবিন্দের মাতৃভক্তি কমতে থাকল, আর মাও ধীরে ধীরে অন্তর্হিতা হলেন। এবার তাকে মাছ খাওয়ানো শুরু হল। কিন্তু, একটা অদ্ভূত ব্যাপার দেখা গেল ওর মধ্যে। কোনো কোনো দিন কিছুতেই মাছভাত খেত না। সেদিন ওকে দিতে হত দুধভাত, আর মাছভাতটা যেত পাড়ার কাকেদের ভোগে। সেবারের কোজাগরী পূর্ণিমায়, যেদিন আমাদের দিনে উপোস ও রাত্রে নিরামিষের দিন,সেদিন ওর জন্য আলাদা করে মাছ রান্না করা হল; কিন্তু ও তা ছুঁয়েও দেখল না। ক্রমশ লক্ষ করে দেখা গেল যে পূর্ণিমা আর একাদশীর দিনগুলোতে ও মাছ খায় না। আমাদের ঠাকুমা একাদশী করতেন, তাই ব্যাপারটা সহজে ধরা পড়ল। কিন্তু এই সমাপতনের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। আমাদের বালক মনে একথা এল যে হয়তো নামের গুরুভার সইতে না পেরে তার এই আচরণ। কিন্তু কত দস্যি ছেলের নামই তো সেকালে গোবিন্দ রাখা হত, যেমন কানা ছেলের পদ্মলোচন। যাই হোক গোবিন্দ বেশিদিন বাঁচল না। অচিরেই আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তারপর আর বিড়াল পোষা হয়নি।
।২।
রুবাই
বিশেষ ধরণের ফারসি কবিতাকে বলে রুবাই। আমাদের মাদি কুকুরটাকেও দেওয়া হল সেই নাম। সে উচ্চবংশীয় ছিল না, আবার খাঁটি নেড়িও না। তার কানদুটো গোত্রকুলহীন নেড়িদের মত উটকো হয়ে থাকত না, বরং রুমালের মত ঝুলে পড়ত মাথার দুপাশে। রং ছিল কালো আর বাদামিতে মেশা। আমাদের ঘরের মধ্যে তার ঠাঁই হয়নি। ব্যান্ডেলের বাড়ির হাতা ছিল বড়োসড়ো। সামনের দিকটায় ফুলের কেয়ারি,পিছনে ফল-সবজির বাগান আর তারও পরে কলা বাগান। ডান পাশে একটা মস্ত কাঁঠাল গাছ আর বাঁ পাশে অনেককালের কাঠগোলাপের গাছ। এরকম বাড়িতে কুকুরের যা হয়, রুবাইয়েরও তাই হল। থাকত আউট হাউসের ডগ হাউসে। দিনের বেলা বাঁধা থাকত শেকলে। রাত হলে বাগানে ছেড়ে দেওয়া হত। তার সারারাতের পাহারাদারি নীরব ছিল না। সন্দেহজনক কিছু দেখলে জানান দিত আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে। মাঝে মাঝে দিনের বেলাও ছেড়ে দিলে, তার আমোদ দেখে কে। ভালবাসার চোটে প্রথমে গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত আর তারপর গা চেটে একশা করে দিত। এই আতিশয্যের ধাক্কায় আমাদের আশি পেরোনো,রোগাঠাকুমা দু-একবার পড়ে যাওয়ার পর, দিনের বেলা সে আর বিশেষ ছাড়া পেত না। দিনে মাংস ভাত আর রাতে ঝোলে ভেজানো ভুষি মেশানো আটার মোটা রুটি – এই ছিল তার খাদ্য। আমাদের পোষা বিড়ালের সঙ্গে প্রথম-প্রথম ঝগড়া হলেও পরে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। বিড়াল-বাবাজি ছাড়া পেলে মাঝে-মাঝেই বিকেলের ভ্রমণে চলে যেতেন আউট-হাউসে; রুবাইয়ের পাশে বসে থাকতেন। আমরা প্রায়ই সেখানে তাদের নীরব আলাপ দেখতে যেতাম। তারপর বাবা বদলি হলে ব্যান্ডেল থেকে কলকাতায় এসে উঠলাম গোপালনগরের দোতলার বাড়িতে। সেখানে আউট-হাউস নেই। তাই রুবাইকে আনা হল না। তাকে পরিচিত একজনের হাতে তুলে দেওয়া হল। তাতে রুবাইয়ের দিনের বেলার শিকল-বন্ধনের দশা থেকে মুক্তি ঘটলেও সে আর বেশিদিন বাঁচেনি।
।৩।
মদনমোহন
বিড়াল-কুকুরের সঙ্গে পাখিও পোষা হয়েছে অনেকবার। পোষা হয়েছে একেবারে ছোট্ট পাখি মুনিয়া থেকে কিছুটা বড়ো টিয়া পর্যন্ত। কলকাতার বাড়িতে এক বার একটা পাখির ছানা ছাতে পড়ে ছিল। কাকেদের সম্মিলিত চিৎকারে আমরা তা টের পেলাম। কোন জাতের পাখি তা দেখে বোঝা না গেলেও, মাতৃহীন অজ্ঞাত কুলশীল অসহায় সেটিকে পোষ্য নেওয়া হল। যত্ন করে তুলোয় ভেজানো পাতলা দুধ খাওয়ানো হত। সে বেঁচে গিয়ে ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠতে লাগল। এল লোহার তারের খাঁচা। আর একটু বড়ো হতে তার সাদায় ধুসরে মেশানো দেহে দেখা দিল বাদামি ছোপ ছোপ। জ্ঞানীরা বললেন, এ হল তিলে কোকিল, অর্থাৎ মেয়ে কোকিল। মেয়ে কোকিল ছেলে কোকিলের মত মনের সুর গলায় ঢেলে গাইতে পারে না। হৃদয়ে তার যতই ভালবাসা থাক না কেন, গলায় কেবল ক্যাঁ ক্যাঁ। কানে তালা ধরে। সে যাই হোক সে স্বাবলম্বী হওয়ার পর একদিন খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া হল; একটু দ্বিধা করবার পর উড়ে গিয়ে প্রথমে বসল ছাদের পাঁচিলে, তারপর আমগাছের ডালে, তারপর দূরের অশোক গাছের ডালে, তারপর হুস – একেবারে অদৃশ্য। পাখিটিকে বড়ো করে স্বাধীন করাই তো ছিল লক্ষ্য। তবু মন মানতে চায় না। সকলেই বিষণ্ণ। বড়ো হওয়া ইস্তক সে রোজ সকাল দশটায় লাঞ্চ সারত ভাতে-দুধে।
ছাড়া পাওয়ার পরের দিন ঠিক সকাল দশটাতেই ছাদের পাঁচিলে সেই চিরপরিচিত কানে তালা ধরানো ক্যাঁ ক্যাঁ ডাক। কী আশ্চর্য! সে ফিরে এসেছে! পাঁচিলে পায়চারি করছে আর চেঁচাচ্ছে। সাধে কী আর বলে অন্নচিন্তা চমৎকারা! মা তাড়াতাড়ি ভাত মেখে বাটিতে করে নিয়ে আসতেই তিন লাফে মায়ের কবজিতে। আগের মতই তৃপ্তি করে ভাত খেল, তারপর বাটি থেকে জল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মা। তারপর উড়ে চলে গেল। আমাদের মন ভাল করা সেই সময়টায় সে রোজ ফিরে আসত। আবার খাওয়া হলেই চলে যেত। এভাবেই চলল মাস তিনেক। তারপর একবার আমরা কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে গেলাম। ফিরে আসবার পর আর তার দেখা মেলেনি।
টিয়া জাতীয় পাখিও কিনে পোষা হয়েছে কয়েকবার। তখন পাখি পোষা নিষিদ্ধ ছিল না। পাখিওয়ালারা কাঁধে বাঁক নিয়ে ফেরি করে বেড়াত। খাঁচায় খাঁচায় ঝুলত হরেক পাখি। টিয়া, ময়না,ফুলটুসি, মুনিয়া, কাকাতুয়া – আরও কত। প্রথম পাখি কেনা হয়েছিল বিষ্ণুপুরে থাকতে। তারপর আরও কয়েকবার। কিছুদিন পরে খাঁচা খুলে ছেড়ে দেওয়া হত।
কিন্তু এবার ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। একদিন ঘরের জানলায় দেখা দিলেন গলায় লালচে রঙের বালার মত দাগ,কলাপাতা রঙের দেহ আর বাঁকানো ঠোঁট নিয়ে একটি পাখি। তিনি জানলার চৌকাঠে বসে শিস দিতে থাকলেন আর অস্ফুটে কী একটা বুলি বলতে থাকলেন। আমাদের মনে হল তিনি বলতে চাইছেন – মদনমোহন। মাঝে মাঝেই ঘরে ঢুকে একটি দ্বিধান্বিত পাক দিয়ে আবার জানলার চৌকাঠে গিয়ে বসছে সে। বোঝা গেল কারো পোষা পাখি, হয় পালিয়ে এসেছে বা ছাড়া পেয়ে। তখন কোকিলের ফেলে যাওয়া লোহার তারের খাঁচাটির দরজা খুলে দেওয়া হল; টিয়া মশায় গটগটিয়ে খাঁচার মধ্যে ঠুকলেন আর বেরোনোর কোনো লক্ষণ দেখালেন না। অস্ফুট বুলি অনুসারে তার নাম রাখা হল মদনমোহন। সে ভালবাসত ফল আর বাদাম খেতে। তার খাওয়ার ছোটো বাটিতে চিনে বাদাম, কিম্বা আঙুর বা কুলের মত ছোটো আকারের ফল দেওয়া হলে মানুষের মতই হাতের মুঠোয় সেটাকে ধরে নিয়ে আয়েস করে খেত। তার কাছে হাত বাড়িয়ে দিলে সে আলতো করে ঠোঁট দিয়ে আদর করত। তবু আমাদের মনে হত যেন কেউ হাতে চিমটি কাটছে। কিছুদিন পরে মদনমোহনের বৈকুন্ঠপ্রাপ্তি হলে আর কখনো পাখি পোষা হয়নি।
।৪।
জলে মাছ খেলা করে
বাবা একবার মাস খানেকের জন্য অফিসের কাজে ট্রেনিংয়ে গেলেন। আমরা তখন স্কুলে পড়ি। মার নিয়মিত বাজার করবার অভ্যেস ছিল না। যাতে খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে না হয় সে জন্য বাবা চাল-ডাল-আটা ইত্যাদি বাড়িতে এত মজুত করলেন যে সেই বিশ্বযুদ্ধকালীন মন্বন্তরের সময় হলে বাড়িতে রেইড হলেও আশ্চর্যের হত না। আরও সুবিধের জন্য এক সহকর্মীর পরামর্শে বাড়ি ছাদ-বারান্দায় (টেরেসে) চৌবাচ্চায় কই মাছ চাষের বন্দোবস্ত হল।মৎস মারিব, খাইব সুখে।
লেক মার্কেটের সেরা মাছওয়ালার হাঁড়ি থেকে আনা শিশু কইগুলো আমাদের আদরে-যত্নে এবং কালের নিয়মে ক্রমশ কৈশোর পার হয়ে যৌবন-প্রাপ্ত হল। তাদের ঘোর কৃষ্ণ দেহে হলুদ আর লালের আভা ফুটে উঠল। এত তেজ হল যে একটা মোটা তারের পাতের চারধারে চারটে ইট দিয়ে চৌবাচ্চার ঢাকা করতে হল, নইলে মাছগুলো প্রায়ই লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওজনেও এক-একটা আড়াইশো-তিনশো গ্রাম। খাওয়ার জন্য ধরতে হলে চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে জল বার করে দিয়ে তারপর জালের অভাবে গামছা দিয়ে প্রয়োজন মাফিক ধরা হত। সে মাছ কাটাও চারটিখানি কাণ্ড নয়। জলহীন কলতলাতে তারা ঠিক হা-রে-রে-রে না করলেও বেশ লম্ফ দিয়ে উঠত। তাদের কানে জবার ফুল না থাকলেও মাটিতে হাঁটবার সময় জবা ফুলেরই মত লাল কানকো বেরিয়ে পড়ত, আর হাতে লাঠি না থাকলেও পিঠের কাঁটার শক্তি ছিল যথেষ্ট। আমাদের মা অবশ্য ভয়ে এক কোণে বসে থাকতেন না। বঁটি এবং ছাই এই যুগপৎ অস্ত্রে তাদের প্রথমে আহত আর পরে নিহত করে, টুকরো করে কেটে ফেলতেন। আমাকেও আর কাহিনির মতো ঢাল-তলোয়ার ঝনঝনিয়ে যুদ্ধে নামতে হত না। পোষ্যকে নিহত করে খেয়ে ফেলবার রাক্ষুসে নিষ্ঠুরতা জিভের স্বাদগ্রহণ ক্ষমতা কমাতে পারত না। সে স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে।
একটু অহিংস ধরণে মাছ পোষার সখও ছিল। ছোটো পাথর, জলের গাছ,মধ্যযুগের দুর্গ, সমুদ্রের ঝিনুক আর কৃত্রিম আলো দিয়ে সাজানো কাচের চৌবাচ্চা হয়ে উঠত রূপকথার রাজপুরী। তাতে ছাড়া হত হরেক রঙের, হরেক আকারের, হরেক স্বভাবের আর হরেক নামের নানা মাছ। দেখে দেখে আশ মিটত না। ‘মাছ পোষার সখ’ নামে একটা খুব কাজের বই কেনা হয়েছিল। এই মাছেদের কেটেকুটে, রেঁধে-বেড়ে খাওয়ার কথা অবশ্য স্বপ্নেও মাথায় আসেনি।