মূল ছড়া – দ্য পিগ
এক যে ছিল বিজ্ঞ পাঁঠা, নিবাস কলিকাতা।
বুদ্ধিতে সে দারুণ ছিল, অসাধারণ মাথা।
রবীন্দ্রনাথ মুখস্থ তার, শেক্সপিয়ার-ও পড়া,
শখ ছিল তার জটিল যত অঙ্ক বসে করা।
সত্যিকারের বোকা যারা তাদের কাছে এসে
সব বোঝাত জলের মতো, মিষ্টি হাসি হেসে:
জাড্যাপহ মানেটা কী, প্রোটিন কাকে বলে
ডুবোজাহাজ, উড়োজাহাজ কেমন করে চলে।
বিজ্ঞ বলে কদর ছিল সুশীল সমাজেতে
পন্ডিতেরা চাইত তাকে বক্তারূপে পেতে।
বেশি পড়ার বিপদ হল: মাথার মাংসপেশী
ফুলবে যত, প্রশ্ন তত কুড়কুড়োবে বেশি।
এক বিকেলে বিজ্ঞ পাঁঠা তাকিয়ে আকাশপানে
ভাবলো বসে: সৃষ্টি কেন? কী জীবনের মানে?
পাঁঠা হওয়া ধন্য কীসে? সবাইকে কী দিতে?
কিসের জন্য পন্টকেরা আসলো পৃথিবীতে?
এমনিধারা চিন্তা যদি মাথায় ঘোরে কারো,
তোমরা বল, কেউ কখনো স্থির হতে কি পারো!
জবাবখানা নিজেনিজেই ভাবতে হবে ঠিক
কোনো বইয়েই থাকবে না তা, এটাই স্বাভাবিক।
বিজ্ঞ পাঁঠা ভেবেই চলে, বন্ধ নাওয়া-খাওয়া
সেদিন থেকে লক্ষ্য হলো জবাব খুঁজে পাওয়া।
এমনি করে জীবন কাটে — হঠাৎ কোনো রাতে
একমনেতে ভাবছে পাঁঠা একলা বসে ছাতে
চাঁদ ডুবেছে, অন্ধকারে আকাশ ঘন কালো
হঠাৎ যেন ঝিলিক দিয়ে সবই হল আলো!
বুঝিয়ে দিলো মিটমিটোনো তারার যত দল
এক নিমেষে পাঁঠার কাছে সব-ই হলো জল!
চারপায়েতে লাফিয়ে উঠে বলল সে, “ইউরেকা!
সব বুঝেছি! জন্ম কেন! ভাগ্যতে কী লেখা!
সারাজীবন নষ্ট শুধু, আর কী হবে খেটে!
এত পড়েও অন্ত তবু সব মানুষের পেটে।
মুন্ডু কেটে কশাই ব্যাটা ঝুলিয়ে দেবে ধড়
চামড়া খুলে মাংস যত কাটবে চড়াচড়।
কেউ বা খাবে বিরিয়ানি, কেউ বা শুধু ঝোল
আমায় খেয়ে সব ব্যাটাদের পেট-টা হবে ঢোল।
কী ভয়ানক বীভৎসতা, এর কি আছে সীমা
কাবাব খাবে, তাও আমাকে কুচিয়ে করে কিমা!
দু-পেয়ে সব মানুষ যত, এমনি বড়ো খাঁই
মগজটাকেও ছাড় দেবে না, করবে ভেজা ফ্রাই!
হালাল বল, বলি-ই বল, পাঁঠার এক-ই গতি
রামদাতে কিংবা ছুরিতে তার চরম পরিণতি।”
চিন্তা এমন মাথায় এলে — হোক সে নধরকান্তি
তোমরা বল, কোনো পাঁঠা আর কি পাবে শান্তি?
সমস্ত রাত ঘুম হল না, থাকল পাঁঠা বসে
শান্তি, আরাম, জোশ যা ছিল — সব গিয়েছে ধ্বসে!
সকাল হলে ভাবল পাঁঠা, “একটু আসি ঘুরে”
রাস্তাতে সে যেই নেমেছে অমনি দেখে দূরে
রোজ সকালে যেমনি ঘটে, নিত্যি বারোমাস
রামু চাষী আসছে নিয়ে সবুজ কচি ঘাস।
এক নিমেষে কী যে হলো, যেমনি মেলা ছুতো
দৌড়ে পাঁঠা মারলো তাকে একটি সিধে গুঁতো!
দড়াম করে ধাক্কা মেরে মাটির পরে ফেলে
চড়ল পাঁঠা তার উপরে, হেলায়, অবহেলে
এরপরে যা ঘটল সেটা শক্ত বলে যাওয়া
সংক্ষেপে এই: রামকে ধরে করলো শুরু খাওয়া!
বলতে হবে — শুনতে যতই লাগুক ভয়ংকর,
বাদ দিল না কিছুই পাঁঠা, মুন্ডু এবং ধড়!
ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে রক্ত চেটে চেটে
মাংস খেল, হাড় চিবোল, পুরল সব-ই পেটে
রামকে পুরো খাওয়ার পরে ফেলল মুখে সোজা
একটি খিলি পানের মত: পোশাক, জুতোমোজা।
সব ফুরোলে আরাম করে ঢেঁকুর তুলে শেষে,
দেখলো যারা তাদের দিকে বলল পাঁঠা হেসে,
“অনেক অনেক আগেই ছিল সন্দেহটা ক্ষীণ,
গেলাম বুঝি, আমার যেন ঘনিয়ে এলো দিন।
আজকে হলো কালিপুজো, পাড়ার অলিগলি
যেদিকে চাও ঘ্যাচাং করে শুধু-ই পাঁঠাবলি!
সন্দেহটা সেই কারণে হঠাৎ গেল বেড়ে
রামু চাষী আজকে আমায় খেতেও পারে মেরে
স্ট্র্যাটেজি তাই ঠিক-ই ছিল, যেমনি পাবো বাগে
ও খাবে কি আমায় ধরে, আমি-ই খাবো আগে!”
উপদেশ:
আসল কথা: কেউ যেন না এই-টা ভুলে যায়
“পাগোলে কী না বলে, আর ছাগলে কী না খায়!”
(এই ছড়াটি Roald Dahl এর The Pig অবলম্বনে লেখা । Dahl এর লেখার protagonist হল একটি pig, অর্থাৎ শুয়োর । ইংরেজি সাহিত্যে শুয়োরকে বুদ্ধিমান হিসেবে দেখানোর আরো উদাহরণ রয়েছে, যেমন George Orwell এর Animal Firm। বাংলা ভাষাতে শুয়োর শব্দের ব্যঞ্জনা কিন্তু অন্য ধরনের। এছাড়া, সাধারণ বাঙালি শুয়োরের মাংস খায় না। তাই, অনুবাদে শুয়োরকে শুয়োর রাখলে সেই লেখার সাথে আমাদের মানিয়ে নেয়া শক্ত । বাংলাতে পাঁঠা শব্দর ব্যঞ্জনা কিন্তু অনেকটা এই লেখার pig এর মত । যেহেতু বাংলাতে বোকাপাঁঠা একটি চালু শব্দ এবং গালাগালি , তাই পাঁঠাকে বুদ্ধিমান দেখানোর বৈপরিত্যটা আমাদের কাছে মজার হতে পারে । ছাগলের মাংস খাওয়ার উদাহরণও বাংলাসাহিত্যে বিরল নয় , যেমন পরশুরামের “লম্বকর্ণ “-র ভুটো ! এর সাথে যোগ করুন, “ছাগলে কী না খায় “। ছড়া শেষের উপদেশ এবং “ছাগলে কী না খায় “ অবশ্য মূল লেখাতে নেই , তা আমার সংযোজন ।)
ছবিঃ অংশুমান