ঠগির আত্মকথা আগের পর্বগুলো
।৩৮।
চারদিনের দিন নাসিকে এসে পৌঁছোবারর পর পীর খান এসে বলে “সুকর খুদা। শুভান খান যা বলেছিল, অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। দেখে যাও, রোকরিয়ারা আসছে।”
“ঠিক দেখেছ তো খান?”
“ঠিক মানে? যেমনটা বলেছিল তার সঙ্গে দলটার চেহারা হুবহু মিলে গেছে। বিশ্বাস না হলে নিজে এসে দেখে যাও একবার! দলটার সঙ্গে দুখানা উট। আর লোকগুলো যতই ছদ্মবেশ ধরুক, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। এরা রোকরিয়া না হয়ে যায় না।”
“ঠিক আছে। বুরহানপুরে যেমন করেছিলাম, এখানেও সেই রাস্তা ধরব। এরা জানে না আমরা এখানে আছি। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শহরের বাইরে চলে যাও সব। তারপর ফের একবার সবাই মিলে উলটোদিকের দরজা দিয়ে ঢুকে বাজার এলাকায় গিয়ে এদের কাছাকাছি বাসা নেব।”
সেই মতো কাজ হল। খানিকক্ষণ বাদেই আমরা ফের একবার শহরে ঢুকে এসে রোকরিয়ার দলটা যেখানে ডেরা বেঁধেছে তার পাশের দোকানটাতে আস্তানা নিলাম। আলাপ জমতেও দেরি হল না বিশেষ। খানিকক্ষণের মধ্যেই রোকরিয়াদের জেমাদারের সঙ্গে কথাবার্তা চালু হয়ে গেল আমার।
লোকটার নাম নারায়ণদাস। লম্বা চওড়া চেহারা। মাথায় পাগড়ি। কুতকুতে দুটো চোখ। বিরাট গোঁফ। ঝোপের মত দাড়ি। হাবেভাবে বেজায় চালাকচতুর। একে কাবু করা খুব সহজ হবে না। তার দিকে দেখতে দেখতে আমি মনে মনে বলছিলাম, তোমায় আমি নিকেশ করবই। দু’লাখ টাকার জন্য তুমি তো ছাড় স্বয়ং রুস্তমের সঙ্গেও এক হাত লড়ে যেতে আমি রাজি।
সকালের খাওয়াদাওয়া সেরে গল্প হচ্ছিল নারায়ণ রাওয়ের সঙ্গে। দেখা গেল বাজি রাওয়ের ওপরে সে বেজায় চটা। পুণার খবর জিজ্ঞাসা করতে বলে “এই বাজিরাওটা একটা কাপুরুষ। কার্কির লড়াইয়ের সময় যদি সামনে এসে লড়ত তাহলে ফিরিঙ্গিদের এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারত।”
“সেরকমটা হলে ভালোই হত বলছেন?”
“হত না মানে! কোথাকার সব বেজাতের লোকজন! যদ্দিন বম্বের কেল্লায় ঘাঁটি গেড়ে থেকেছে সে নাহয় একরকম ছিল। একটা সময় ওই কেল্লার বাইরে এক হাত জমিও ছিল না ব্যাটাদের। আর এখন দেখুন, কেমন একটু একটু করে এগোতে এগোতে গোটা মারাঠা দেশটাকেই গিলে ফেলতে বসেছে।”
আমি মাথা নাড়লাম, “আর না না, বাজিরাওয়ের শক্তিও কম নয়। সঙ্গে নামকরা সব লড়িয়েরা আছে। দেখবেন ঠিক কিছু একটা করবে।”
“কিছুই করবে না মীরসাহেব। ও শুধু পালিয়েই বেড়াবে দেখবেন। ব্যাটা কাপুরুষ!”
“করুক গে যাক, আমার আর তাতে কী?” আমি মাথা নাড়লাম, “আগে ভাড়াটে সৈনিক ছিলাম, যুদ্ধটুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। এখন তো আমি আদার ব্যাপারি, বেনারসের সাহুকারের গদিতে কাজ করে খাই, তার হুকুমে তার টাকাপয়সা জিনিসপত্রের আনা-নেওয়া করি, এই যেমন এখন চলেছি। ওসব রাজা-উজিরে কে কোথায় কী করল তাতে আমার কী আর আসে যায়।”
শুনে নারায়ণদাস বলে, “আরে আপনিও তার মানে আমার পেশাতেই আছেন। ভালো ভালো। তবে ব্যাপার কী জানেন, আপনার সঙ্গে অনেক লোকজন আছে। এ পেশাতে সেটা একটা সুবিধের ব্যাপার। লোক কম হলে বিপদের ভয় বাড়ে। আমার ভাইটাও এই কাজ করত। বছরকয়েক আগে এই রাস্তাতেই ইন্দোর যাবার পথে সে বেচারা ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিল। বুরহানপুরের পর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
আমি অবাক মুখ করে বললাম, “বলেন কী? এ রাস্তায় এতকাল ধরে এত টাকাপয়সা নিয়ে যাওয়া আসা করছি, চোরডাকাতের উৎপাত কখনো দেখিনি তো!তবে এখন আর আমার সে-সব ভয় নেই। ফিরিঙ্গিদের আশ্রয়ে আছি। চোরডাকাত থাকলেও আমার আর কিছু যায় আসে না।”
“ফিরিঙ্গিদের আশ্রয়ে আছেন মানে? আপনি তো বলছিলেন কোন সাহুকারের কাছে কাজ করেন।”
“হ্যাঁ, তা করি বটে, কিন্তু এবার বম্বে থেকে রওনা দেবার সময় আমার বন্ধু শুভান খান ফিরিঙ্গি সরকারের একটা চিঠি আমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। এই যে—” বলতে বলতে আমি মোম কাগজে মুড়ে রাখা সেই চিঠিখানা বের করে এনে নারায়ণদাসকে দেখালাম।
দেখে নারায়ণদাস একেবারে গলে পড়ে বলে, “আপনি ভাগ্যবান লোক মীরসাহেব। শুভান খানের মত বড়মানুষ আপনার বন্ধু হন। এমন মানুষ আর দুটি দেখিনি। আমায় বিলক্ষণ স্নেহ করেন তিনি। এই কাজটাও তো নিজে আমার হয়ে অনেক টাকার জামিন দাঁড়িয়ে আমায় জুটিয়ে দিয়েছেন। তা এমন বন্ধু যখন পেয়েছেন তখন যুদ্ধবিগ্রহের কাজ ছেড়ে দিয়ে ভালোই করেছেন। কী হবে শুধুশুধু সামান্য মাইনেয় প্রাণ হাতে করে এর ওর দলে যুদ্ধ করে! তা কার দলে ছিলেন?”
আমি তার কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, “কাউকে বলবেন না যেন জেমাদারসাহেব, জানাজানি হয়ে গেলে আমি বিপদে পড়ব। আমি চিতু পিন্ডারির দলে তিন হাজারি সেনাপতি ছিলাম।”
শুনে দেখি নারায়ণদাসের চোখ কপালে উঠে গেছে। বলে, “চিতু পিন্ডারি? আপনি মজা করছেন নাকি মীরসাহেব?”
“ছি, ছি, আপনার মত লোকের সঙ্গে মজা করতে যাব কেন? আমি সত্যিকথাই বলছি। তবে একটু খেয়াল রাখবেন, লোক জানাজানি যেন না হয়ে যায়।”
“আরে রাম কহো, আমি হলাম গিয়ে পেশাদার রোকরিয়া। রোকরিয়ার মুখ থেকে কথা বের হয় শুনেছেন কখনো মীর সাহেব? তা আপনার তো অনেক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছে মশাই? শুনেছি চিতু নাকি একেবারে মাদ্রাজের কাছাকাছি অবধি গিয়ে এমনকি ফিরিঙ্গিদের রাজপাটও ছারখার করে দিয়ে এসেছিল?”
“হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন মোটামুটি। একসময় সে-সব গল্প বলবো’খন। তবে নিজের কথা নিজের মুখেবলতে একটু সংকোচ হয় কিনা!”
“আরে সংকোচ কীসের মীর সাহেব? এমন বীরের সঙ্গে কাজ করেছেন। নেমাওয়ারের সেই দলটাকে তো আমি দেখেছি!”
“আপনি ওখানে ছিলেন নাকি?”
“আরে হ্যাঁ, ছিলাম তো। উজ্জ্বয়িনী আর ইন্দোর থেকে কিছু মালপত্র নিয়ে আমি তখন নেমাওয়ারে এসেছি। চিতুর রওনা হবার দৃশ্যটা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। ভালো একটা ঘোড়া পেলে আমিও তার দলে ভিড়ে যেতে পারতাম তখন। কিন্তু কপাল খারাপ, সে-সব হল না। শুনেছি নাকি চিতুর দলের প্রত্যেকটা পিন্ডারি হীরে-জহরতের স্তূপ নিয়ে ফিরেছিল সেবার।”
“এক্কেবারে ঠিক শুনেছেন। সেই প্রথম অভিযানে ভালো লাভ করেছিলাম আমরা। তবে সে সময় আমি সবে চিতুর দলে ঢুকেছি। আমাসয় কেউ চিনত না। পরের অভিযানে যখন বের হলাম আমরা তখন নেমাওয়ারে এলে আপনি আমার নাম জানতে পারতেন। ততদিনে আমি চিতুর দলে বেশ নামজাদা লোক হয়ে গেছি।”
“আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার নাম আমি তাহলে শুনেছি। আপনিই তাহলে সেই সৈয়দ আমীর আলি, তাই না? চিতুর দলে গফুর খানের ঠিক পরেই আপনার নাম করা হত।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এই অধমই সেই আমীর আলি। এখন আমার অবস্থা খারাপ চলছে। তবে সে তো সবারই এক দশা। চিতু মারা গেল। গফুর খান নিখোঁজ হয়ে গেল। শুনেছি নাকি পালিয়ে গিয়ে হায়দরাবাদে উঠেছে। সৈয়দ ভিকু যে কোথায় আছে কে জানে। সৈয়দ দুলা তো শুনেছি বুরহানপুর আর এলিচপুরের মাঝামাঝি এলাকায় জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ফিরিঙ্গিরা তার মাথার ওপর পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে। আমায় কেউ ততটা চিনত না বলে বেঁচে গিয়েছি। এখন যদি চুপচাপ থাকতে পারি তাহলে আমার কোন ভয় নেই। দু’নম্বর অভিযানের পরে হাওয়া বুঝে আমি পিন্ডারিদের দল ছেড়ে ঝালোনে আমার গ্রামে ফিরে চলে গিয়েছিলাম। অন্যরা যদি সে বুদ্ধিটা করত তাহলে এমন দুর্দশা তাদের হত না।”
“তা ঠিক বলেছেন,” নারায়ণদাস মাথা নাড়ছিল, “চিতুর এমন পরিণতি হবে কেউ ভাবতে পারেনি। লোকটা মরদ ছিল বটে। তা মীর সাহেব, শুনেছি ফিরিঙ্গিরা নাকি চিতুকে একটা জায়গির দিতে চেয়েছিল, সত্যি নাকি?”
“আমিও তাই তো শুনেছি। চিতু যদি ফিরিঙ্গিদের কথাটা মানত তাহলে বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু তার জীবনের উদ্দেশ্যটাই তো ছিল ফিরিঙ্গিদের মেরে এ দেশ থেকে তাড়ানো। ভেবেছিল মারাঠারা ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে জিততে শুরু করলেই পনেরো হাজার ঘোড়সয়ার নিয়ে সে তাদের দলে গিয়ে ভিড়বে। আমারও ইচ্ছে ছিল সেরকম হলে চিতুর সঙ্গে ফিরিঙ্গি তাড়াতে যাব। কিন্তু মারাঠারাও আর জিতল না, আমারও আর যুদ্ধে যাওয়া হল না। এখন তো এই দেখছেন, বনেজঙ্গলে ঘুরে সাহুকারের চাকরবৃত্তি করছি।”
“আমাদের কপাল,” নারায়ণদাস একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “পেশোয়া আর নাগপুরের রাজা যদি চিতুর মত হতে পারত তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত দেখতেন। কিন্তু সে সব ভেবে আর এখন লাভ কী? এখন ফিরিঙ্গিরা দেশের নতুন মালিক হয়েছে। তাদের মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা তো দেখি না। সে যা হোক মীর সাহেব, বাকি রাস্তাটা কিন্তু আমরা আপনার সঙ্গ ছাড়ছি না। আমি ইন্দোরে যাচ্ছি কিছু মালপত্র আনতে। আপনাদের রাস্তাও তো সেইদিকেই পড়ছে। সত্যি কথা বলি, সিন্দোয়া ঘাটের জঙ্গলটা আমি আপনাদের মত একটা বড় দলের সঙ্গে পেরোতে পারলে নিশ্চিন্ত বোধ করব। জায়গাটা ভালো নয়। অরাজক দেশ। জঙ্গলের ভিলের দল তার সুযোগ নিচ্ছে। বাহিনী ছেড়ে পালানো মারাঠা সৈন্যের বেশ কয়েকটা দলও শুনছি ঘোরাফেরা করছে ও এলাকাটায়। এদের কারোই তো ধর্মজ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। একসঙ্গেই যাওয়া যাক, কী বলেন?”
“আর কোন আপত্তি নেই,” আমি জবাব দিলাম, “আমার অবশ্য সঙ্গে হাজার দু’তিন টাকার বেশি আর কিছুই নেই। কেউ নিতে এলে টাকার বদলে মার খাবে বেশি।”
নারায়ণদাস মাথা নেড়ে বলে, “আমার কাছে সেটুকু টাকাও নেই। তবে টাকা না থাকলেও প্রাণের ভয়টা তো আছে? আমার আবার তলোয়ারবাজিটাজি অত আসে না।”
“তা অবশ্য ঠিক বলেছেন,” আমি জবাব দিলাম। লোকটার সঙ্গের মালপত্র বোঝাই উটদুটো দেখলেই অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল, নারায়ণদাস তার টাকাপয়সার ব্যাপারে ডাহা মিথ্যে কথা বলছে।
পরে পীর খানকে সব কথা বলতে সে খুব একচোট হাসল। তারপর বলে, “কিন্তু মীরসাহেব, লোকটার যা দশাশই চেহারা! আমার কিন্তু আপনার জন্য ভয় হচ্ছে। একা একা কোন ঝুঁকি নেবেন না।”
আমি হেসে জবাব দিলাম, “আরে ওর থেকে কত দশাসই লোক আমার হাতে নিকেশ হয়েছে সে কি ভুলে গেলে? তার ওপর ওর ভাইকেও তো বুরহানপুরের ওদিকে আমিই মেরেছি এর আগে। ও আমারই শিকার। এ সুযোগ আমি হাজার টাকা পেলেও ছাড়ব না।”
“ঠিক আছে। তবে একে শিকার করা হবে ইন্দোরের একেবারে কাছাকাছি এসে। সেখান থেকে ঝালোন বেশি দূরে নয়। চটপট পালানো যাবে। এদের মারা নিয়ে গন্ডগোল একটা যে হবেই সেটা তো বলাই বাহুল্য। কাজেই কাজ শেষ করেই ঘরে ফেরার রাস্তা দেখতে হবে।”
“উঁহু, আমি ভাবছিলাম, বুরহানপুরের কাছাকাছি কাজটা করে সটান জঙ্গলে ঢুকে যাব। কেউ আর খুঁজে পাবে না আমাদের।”
“কেউ পাবে না বলছেন? জঙ্গলে কিন্তু শেখ দুলার দলটা এখনো রয়ে গেছে। আগেরবার ঘাউস খানদের কী দশা করেছিল পিন্ডারিরা মনে আছে তো মীরসাহেব?”
আমি শিউরে উঠে বললাম, “আস্তাফ্ফুর আল্লা, না না, বুরহানপুরের কাছে আর কাজ করবার দরকার নেই। ওই ইন্দোরের কাছে গিয়েই যা করার করলে হবে।”
এর পরের ক’দিনের কথা আর বিশেষ কিছু বলবার নেই। সেই একই একঘেঁয়ে রাস্তা চলা। রোকরিয়ারা আবার রাতের বেলা পথ চলে না। কাজেই দিনের বেলা তীব্র গরমে, ধুলোয় নাজেহাল হয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ হাঁটতে হত। সন্ধেবেলা বিশ্রামের জায়গায় পৌঁছে না মিলত ভালো থাকবার জায়গা, না মিলত ভালো খাবার। তবে সেই সবের মধ্যেও আমাদের গোটা দলটা নিখুঁতভাবে তাদের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল। বেনারসী হিন্দি আর ভোজপুরী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কথা বলত না তারা। তাদের তখন দেখে কে বুঝবে তারা বেনারসের লোক নয়! দিনের শেষে আমরা আমাদের নিয়ম অনুযায়ী তাঁবু খাটাতাম কোন গ্রামের চৌহদ্দির বাইরে আর রোকরিয়ারা গিয়ে ঢুকে পড়ত গ্রামের ভেতর।
বেশ কয়েকদিন এইভাবে চলবার পর একটা লাভ হল। রোকরিয়াদের সঙ্গে প্রায় দিন কুড়ি চলবার পর অবশেষে আমরা গ্রামের বাইরে আমাদের সঙ্গে রাত কাটাতে রাজি করে ফেললাম। ততদিনে তাদের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাবসাব হয়ে গেছে। এইবারে চব্বিশ ঘন্টাই তারা আমাদের নজরদারির আওতায় চলে এল। সন্ধের পর থেকে ঘুমোতে যাওয়া অবধি সময়টাও আমরা তাদের সঙ্গে একসাথে গানবাজনা, গল্পগুজব করে কাটাতাম, আর তাদের প্রত্যেকটা চলাফেরা, কথাবার্তা নজর করতাম। লোকগুলোকে বেশ খুশিতে রাখছিলাম আমরা, ওতে মনে সন্দেহ আসে না।
নারায়ণদাসকে আমি আর পীর খান আমাদের পিন্ডারি অভিযানের সত্যিমিথ্যে নানান গল্প দিয়ে একেবারে বশ করে ফেলেছিলাম। সে আর তার দলবল হাঁ করে আমাদের গল্প শুনত। লোকগুলো যতই সন্দেহবাতিক রোকরিয়া হোক, আসলে কিন্তু বেশ সরলই ছিল।
এমনিভাবে চলতে চলতে ইন্দোর যখনার পাঁচদিনের পথ, তখন শুনি রোকরিয়ারা ঠিক করেছে, তাড়াতাড়ি জঙ্গল থেকে বের হয়ে যাবার জন্য তারা এবার থেকে দিনরাত পথ চলে দিনে ত্রিশ ক্রোশ করে রাস্তা পার করবে। আমার লোকজনের পক্ষে সেই গতিতে চলা অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই ঠিক হল, পরদিন থেকে তারা আমাদের দল ছেড়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলে যাবে। আমরা পেছন পেছন আসব। অতএব আমরা ঠিক করে নিলাম, যা হয় হোক, সেই রাতেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে আমাদের।
সে রাতটাও বাইরে থেকে দেখলে একেবারে আর পাঁচটা রাতের মতই ছিল। একটা গ্রামের বাইরে বড় বড় তেঁতুল গাছের নিচে আমাদের আস্তানা করা হয়েছে। সেখানে আগুন ঘিরে বসে গান গল্প, খাওয়াদাওয়া চলছে। রোকরিয়ারাও তখন বেশ খোশমেজাজে আছে। ইন্দোর আর বেশি দূরে নয়। তাদের বিপদের ভয়ও কমে গিয়েছে একেবারে।
সন্ধের মুখমুখ চাঁদ উঠলো। সেদিকে দেখিয়ে নারায়ণদাস বলে, “চাঁদ উঠে গেছে। ওটা ওই গাছের মাথা পর্যন্ত উঠে এলেই আমরা রওনা হয়ে যাব মীর সাহেব। খুব ভালো সময় কাটলো আপনাদের সঙ্গে। এবারে আপনারা ভালো করে ঘুমোন। সকালে যখন জেগে উঠবেন ততক্ষণে আমরা আরো বিশ ক্রোশ পথ পড় হয়ে যাব।”
ততক্ষণে আমার দলের লোকজন তাদের যার যার জায়গা নিয়ে নিয়েছে। প্রত্যেক রোকরিয়ার জন্য চারজন করে ঠগি দেয়া হয়েছে। নিঃশব্দে কাজ চলছে আমাদের। রোকরিয়ারা বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। থালার মতো চাঁদটা ভাসতে ভাসতে দূরের জঙ্গলের গাছগুলোর মাথা ছুঁতেই রোকরিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে তাদের কাছাকাছি লোকজনদের জোড়হাতে নমস্কার করে বিদায় জানাতে শুরু করল। নারায়ণদাস আমার দিকে ঘুরতেই আমি বললাম, “না জেমাদারজি, শুধু নমস্কার নয়,আসুন, যাবার আগে একবার কোলাকুলি করে নিই। বড়ো ভালো সময় কাটল আপনাদের সঙ্গে আমাদের।”
এই বলে আমি তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেই হাঁক দিয়ে উঠলাম, “পান লাও।”
জেমাদারের প্রাণহীণ শরীরটা ততক্ষণে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে। চারপাশে তাকিয়ে একঝলক দেখে নিলাম দলের বাকিদেরও একই দশা হয়েছে ততক্ষণে। হাতের রুমালটা গুটিয়ে নিতে নিতে আমি বললাম, “তাড়াতাড়ি করো হে সব। আকাশে এতবড় চাঁদ। চারপাশে সব দেখা যাচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই।”
একঘন্টার মধ্যে লুগাইদের কাজ শেষ হয়ে গেল। শরীরগুলোকে কবর দিয়ে তাদের মালপত্র সহ উটদুটোকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আর একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে রওনা হয়ে গেলাম। পরের গ্রামটার কাছে এসে টুপুনির গুড় কেনার জন্য সামান্যক্ষণ থেমেছিলাম আমরা। সকাল হচ্ছে যখন ততক্ষণে আমরা খুনের জায়গা থেকে অন্তত বিশ ক্রোশ দূরে চলে এসেছি।
সেখা থেকে রাতে রাতে পথ চলে ইন্দোর আর উজ্জ্বয়িনী শহরদুটোর থেকে বেশ খানিক দূর দিয়ে গাঁগঞ্জের মধ্যে দিয়ে পথ চলে কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা ঝালোনে গিয়ে পৌঁছে গেলাম। পথে শুধু একবার হোলকারদের এলাকায় ঢোকবার সময় খাজনা নেবার লোকজন আমাদের সন্দেহ করে মালপত্র দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু সুভান খানের দেয়া ফিরিঙ্গি পরিচয়পত্রের জোরে সেখানেও আমাদের বিশেষ সমস্যা হয়নি।
এই যাত্রায় যা লাভ হল আমাদের তেমন লাভ কোন ঠগি স্বপ্নেও কল্পনা করবে না। বাবার তো আনন্দে পাগল হবার জোগাড়। জনে জনে ডেকে আমার কীর্তির কথা বলে বেড়াচ্ছে। সবাই খুশি, শুহু গণেশ জেমাদারের মুখচোখ দেখে আমার ভালো লাগছিল না। বোঝা যাচ্ছিল, আমার এতবড় সৌভাগ্যে সে মনে মনে হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। টাকা পয়সা ছাড়াও আমাকে তখন সর্বকালের সেরা ঠগি ঝোরা নায়েক আর কুদুক বনোয়ারির সঙ্গেও যে তুলনা করা হচ্ছে সেটাও তার গাত্রদাহের আরেকটা কারণ ছিল। এই দুই ঠগিসম্রাটকে ভবানীর বরপুত্র বলা হত, কারণ জীবনে কখনো তাঁরা কোন অভিযানে ব্যর্থ হননি। আমাকেও এখন সেইভাবে ঠগিসমাজে ভবানীর আর এক বরপুত্র হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।
ঝালোনে পৌঁছোবার কয়েকদিন আগে বাহাদুরপুর নামে একটা জায়গায় একটা ঘটনা ঘহটেছিল সেটার কথা এইখানে বলে নিই। এখানে পৌঁছে আমরা সন্ধেবেলায় রান্নাবান্না করছি এমন সময় একদল লোক এল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে।
পীর খানকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এরা আবার কারা? দেখে তো ঠগিই মনে হচ্ছে, কিন্তু এখানে আর কোন দল কাছাকাছি আছে বলে তো জানি না। দেখো তো একবার।”
পীর খান বের হয়ে গিয়ে তাদের দলের পান্ডাটাকে নিয়ে আমার তাঁবুতে ফিরে এল।
সেলাম টেলাম আদানপ্রদান হবার পর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “মশায়ের পরিচয়?”
“আমার নাম এই এলাকায় সকলেই জানেন, এবং ভয়ভক্তিও করে থাকেন। আমি লাল খান।”
“লা…ল খান?” আমি মাথা নাড়লাম, “কই, আমি কখনো আপনার নাম শুনি নি তো? আপনি কী করেন?”
“আমরা ব্যাবসা করে খাই। মানে, গায়ের জোরে যখন যা চাই জুটিয়ে নিই আর কি।”
“ও। তা আপনারা কি পিন্ডারি?”
“না পিন্ডারি নয় । আমরা ডাকু।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “কী সাংঘাতিক। তা আপনারা দিল্লি থেকে আসছেন নাকি?”
“হ্যাঁ। তা আপনারা আমাদের না জানলেও আমরা কিন্তু আপনাদের পরিচয়টা আপনাদের ঘাঁটি গাড়বার কায়দা দেখেই বুঝতে পেরে গেছি। আপনারা ঠগি, তাই তো? আমরা তো তাহলে ভাই ভাই হলাম।”
“হ্যাঁ তা বটে। তা কী চাই সেটা তো বললেন না?”
“রাতটা আপনাদের ঘাঁটিতে কাটাতে চাইছিলাম। তারপর সকালে উঠে যদি আপনারাও আমাদের রাস্তাতেই যান তাহলে একসঙ্গেই যাওয়া যাবে।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “থাকবার খাবার কোন অসুবিধে হবে না, কিন্তু সারা রাত নয়। চাঁদ উঠলে আমরা রওনা দেব এখান থেকে। উত্তরের দিকে যাব।”
“ঠিক আছে। আপনারা চলে গেলে আমরা এখানটাতেই রাতটা কাটিয়ে দেব।”
“তা আপনারা চললেন কোনদিকে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“হায়দরাবাদের দিকে যাব ভাবছি। এ সময়টা সাধারণত ডাকুরা পথে বের হয় না। কাজেই লোকজনও সন্দেহ করবে না, আর আমরাও গোটা রাস্তাটা একলা কাজ করতে পারব। বর্ষা কাটিয়ে একেবারে দশেরার সময় ফিরবো ভাবছি। যাচ্ছি ভোপাল আর বুরহানপুর হয়ে। ফিরবো নাগপুর হয়ে।”
“বুনিজিটুনিজ কেমন পাচ্ছেন?”
“ওই মোটামুটি। কাজ হয়েছে গোটাকয়, কিন্তু সে এমন কিছু বড় কাজ নয়।”
আমি বললাম, “রাস্তাটা আপনি ভালোই নিয়েছেন। সিকন্দর জার রাজত্বের মধ্যে দিয়ে যাবেন। ওখানে চোরডাকাতের ওপরে অত্যাচার বিশেষ হয় না বললেই চলে। ভালো আয় করবেন দেখবেন। তাহলে এখন আমায় মাপ করতে হবে। আমার লোকজন আপনাদের দেখভালের বন্দোবস্ত করে দেবে। আমার আবার একটু দাঁতের ব্যথা হয়েছে। মুখটাও ফুলে গিয়েছে। তার বন্দোবস্ত করব এখন–”
সে উঠতে উঠতে বলে, “সালাম। তা আপনারা তো ঘরে ফিরছেন। তা যদি না হত তাহলে বলতাম একসঙ্গে যাব। আমরা ডাকুরা কাজকর্ম খারাপ করি না কিন্তু।”
গোটা সময়টা আমি আমার আসল গলা লুকিয়ে অন্যরকম গলায় লাল খানের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলাম। তার ওপর দাঁতের ব্যথায় মুখটাও ফুলে ছিল। কাজেই আমি নিশ্চিত ছিলাম পরে কখনো মুখোমুখি হলে সে আমাকে কোনমতেই চিনতে পারবে না।
বাড়ি ফিরে ব্যাপারটা বাবাকে বলে আমি প্রস্তাব দিলাম, “লোকটাকে দেখে কাজের মনে হল। এ অনেক লুটের মাল নিয়েই দশেরার পর এ রাস্তায় আবার ফিরবে। সে সময় একে ধরে সব কেড়েকুড়ে নিলে কেমন হয়?”
শুনে বাবা মাথা নেড়ে বলে, “যেতে পারো, তবে সাবধান। এরা দেখতে যতটা বোকা লাগে আসলে ততটা নয়। আমি এর আগে কয়েকবার ডাকু শিকার করেছি। কিন্তু বেশ কয়েকবার বেটারা আমার খপ্পর থেকে পালিয়েও গেছে। দেখো যদি পারো!”
সে সময় গণেশ জেমাদার বাবার সঙ্গে বসে ছিল। সে বলে, “আমিও যাব। মীরসাহেবের এত নামডাক হয়েছে, দেখি তাঁর সঙ্গে একবার ঘিয়ে যদি এই বুড়ো ঠগির কপাল খোলে। কি মীর সাহেব, আপত্তি নেই তো?”
“না না, আপত্তি কিসের? চলুন না!” আমি জবাব দিলাম, “আসলে আমার মনে হয় কী জানেন, হাত আর মাথা যার দুটোই সাফ থাকে তার ভাগ্য খুলবেই। তবে ভালো ভুত্তোট কখনো ভালো সোথা হয় না।”
“কিন্তু মীরসাহেব, তুমি তো শুনেছি দুটো কাজই বেজায় ভালো পারো। তাছাড়া তোমার দলের লোকজন শুনেছি মরে গেলেও তোমার সঙ্গ ছাড়ে না।”
“হ্যাঁ, তা ছাড়ে না বটে। কেন জানেন? আমি ওদের সঙ্গে ব্যবহারটা ভালো করি। টাকাপয়সার ভাগও দিই বেশি।”
কথাটা দেখি গণেশ জেমাদারের খুব গায়ে লেগেছে। কড়া একটা জবাব দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিল গণেশ কিন্তু বাবা এসে মধ্যে পড়ল। বলে, “ছেড়ে দাও গণেশ। ছোকরার অহংকারটা একটু বেশি। কিন্তু সে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে কী লাভ? ওর কথায় তুমি কিছু মনে কোরো না।”
গণেশ অভিমানী গলায় বলল, “না ইসমাইল, বাচ্চা ছেলে, কী বলল না বলল তাতে আমি কিছু মনে করিনা, কিন্তু অহংকারীর একদিন না একদিন পতন হয় সেটা জানতো?”
আমার খুব রাগ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাবার সামনে আর কথা বাড়ালাম না। একা থাকলে এ কথার উপযুক্ত জবাব গণেশ তক্ষুণি পেয়ে যেত।
কাজেই পরের অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল আমাদের। তবে সে কথা বলবার আগে সুভান খানের কথাটা একটু বলে নিই।
ঝালোনে ফিরে আমি বাবার কাছে সুভান খানের কথাটা তুলতে বাবা সঙ্গেসঙ্গেই তাকে চিনতে পারল। বলে, “বদমাশটা এখন এত বড়লোক হয়েছে? ওর মত পাজি আমি খুব বেশি দেখিনি জীবনে। বেজায় ভিতু হওয়ায় ভুত্তোটের কাজটা কোনদিনই ভালো পারত না, তবে কথায় লোক ভুলিয়ে আনতে ওস্তাদ ছিল একেবারে। ওরকম সোথা আমি কম দেখেছে। আমরা দুজনেই জেমাদার ছিলাম। অনেককাল আগে একবার আমরা দুজন মিলে দল বানিয়েছিলাম। তাতে সোথার কাজটা দেখবে সুভান খান, আর বাকি কাজকর্ম আমি করব। দল গড়বার সময় ও আমার কাছে হাজারখানেক টাকা ধার নিয়েছিল। তা জয়পুরের কাছে সাহুকারের একটা দলকে নিকেশ করে লুটের মাল যখন ভাগ হচ্ছে তখন সুভানের ভাগে পড়ল বেশ ক’ছড়া মুক্তোর মালা। আমি তার থেকে ওই হাজার টাকা ধার বাবদ গোটাকয়েক মালা চাইলাম বউকে এনে দেব বলে। শুনে ভারি মিষ্টি মুখ করে বলে, কাল সকালে যতগুলো ইচ্ছে বেছে নিও। সকালে উঠে দেখি ব্যাটা নিজের জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়েছে। তার পর এই তোর কাছে তার আবার খোঁজ পেলাম। একটা ফুটো কড়িও দিবি না জোচ্চোরটাকে।”
আমারও মনে মনে সেই ইচ্ছেই ছিল। পয়সা দেয়া দূরস্থান আমি তাকে ঝালোন পৌঁছোবার খবরটাও দিলাম না। তার দেয়া ফিরিঙ্গী সাহেবের চিঠিটাকেও পুড়িয়ে ফেলে দিলাম যাতে কেউ কখনো কোন প্রমাণ না পায়।
।৩৯।
ঠগি সমাজে তখন আমার বেজায় সুনাম হয়েছে। কাজেই যেই লোকজন খবর পেল দশেরায় আমি আবার বের হবার তোড়জোড় করছি তখন এত লোক দলে ভেড়বার জন্য হাজির হল যে বাধ্য হয়েই আমায় কিছু লোককে বাদ দিতে হল।
দল গড়লাম একেবারে বাছাই লোকজনদের নিয়ে। এদের মধ্যে কিছু লোক বেছেছিলাম যারা নাচগানে বেশ দড়। শিকারকে বশ করতে এরা খুব কাজে লাগে। সে-সময় চারপাশে বেশ শান্তির হাওয়া বইছে। কাজেই আমার আশা ছিল অনেক বড় বড় রইস এ সময়টা রাস্তায় বের হবে। কাজেই আমি বাবাকেও এ-যাত্রা সঙ্গে আসতে বললাম। বাবার বয়স, নবাবি চেহারা আর কথাবার্তার বড়োমানুষী চাল এই ধরণের লোকজনকে ধোঁকা দিতে বেশ কাজে আসবে আশা করছিলাম আমি।
বের হবার আগে রাজার দরবারে গিয়ে সেলাম ঠুকে আসতে ভুললাম না। রাজাও আমার সঙ্গে মৌখিক ভদ্রতা দেখালেন যথেষ্ট। দেখাবার কারণও ছিল। তাঁর রাজত্বের জমিদার হিসেবে আমি কোনদিন খাজনাইয় ফাঁকি দিই না। তার ওপর ঝালোনের চারপাশে যত ঠগি এসে বাড়ি করেছিল আমাদের কাছাকাছি থাকবার জন্য, তারাও নিজেদের পরিচয় লূকিয়ে রাখবার জন্য রাজাকে মোটা টাকা নজর দিত নিয়মিত। সব মিলিয়ে আমার কল্যাণে রাজার আয়রোজগার তখন খুবই ভালো চলছে। শুধু রোকরিয়া অভিযানের পর ফিরে এসে আমি কপাল মন্দের অজুহাত দেখিয়ে রাজাকে বেশি কিছু দিইনি। বম্বে থেকে কেনা একখানা বন্দুক আর একছড়া মুক্তোর মালা দিয়ে কাজ সেরেছিলাম। রাজা তাতে সামনাসামনি কোন আপত্তিও করেননি। তবে আড়ালে আড়ালে তিনি যে আমার সঙ্গে ভয়ংকর একটা শত্রুতা করবার ফন্দি এঁটেছেন সেটা আমি তখনো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি।
আমাদের এই বের হওয়া নিয়ে আজিমাও আর আপত্তি করে না এখন। প্রত্যেকবার ফিরে আসবার পর আমাদের অবস্থা আরও ভালো হয়, সে নিজে আরো গয়নাগাঁটি আর খরচের টাকা পায়, আমাদের বাড়িটাও আরো বড় হয়, এতেই তার সুখ। কারণ অবস্থা আমাদের যত ভালো হবে তত আমরা মেয়েটার জন্য আরো ভালো পাত্র জোটাতে পারব। সত্যি বলতে কি তখনই তার বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়ে গেছে। তার মধ্যে দু-একটা প্রস্তাব তো বেশ ভালো। পাত্র অবস্থাপন্ন, আর সবচেয়ে বড় কথা আমাদের পেশার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।
এই ব্যাপারটাই আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। আজিমা কিছু না বুঝলেও আমি তো জানি কী ভয়ানক বিপদ মাথায় নিয়ে পথে চলতে হয় আমাদের পেশায়! একটা ছোট্ট ভুল, একজন মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা—তাতেই সুখের স্বর্গ থেকে আমাকে সর্বনাশের পাতালে ছুঁড়ে ফেলতে পারে আমার নিয়তি। আমি তাই মনেপ্রাণে চাইছিলাম মেয়েটা আমার যেন তেমন ঘরে না পড়ে। আহা সে যেন সুখেশান্তিতে ঘরকন্না করতে পারে।
তবে, সে সময় যে সম্বন্ধগুলো এনেছিল আজিমা তাদের ব্যাপারে আমি তাকে মানা করে দিয়েছিলাম। যে অভিযানটায় তখন চলেছি তাতে বড়োসড়ো লাভ হবার আশা ছিল। সেটা হলে পরে ফিরে এসে বিয়ের বন্দোবস্ত দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে ধুমধামটাও আরো বড় আকারে করা যাবে, যৌতুকটাও আরো বেশি চোখ ধাঁধানো হবে। আজিমারও দেখলাম তাতে আপত্তি নেই। যৌতুক যত বেশি হবে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির জীবন তত আরামের হবে, এই তো আমাদের দেশের নিয়ম।
বাবা, আমি, পীর খান আর গণেশ জেমাদারের নেতৃত্বে তিনশোর কিছু বেশি ঠগির দলটা নিয়ে আমরা ঝালোন ছেড়ে রওনা হলাম দশেরার পর। পথে লোকজনের কাছে আমাদের পরিচয় ছিল আমরা হায়দরাবাদের নবাবের ভাড়াটে সেনা। ছুটি কাটিয়ে কাজে যোগ দিতে চলেছি।
আমাদের সঙ্গে পীর খানের এক ভাগ্নেও বের হয়েছিল সেবারে। বছর দশেকের ছেলে। নাম আলম খান। যেমন চেহারা, তেমন তার বুদ্ধি। মা-বাপ মরা ছেলেটাকে পীর খান নিজের ছেলের মতই মানুষ করছিল। আমার মরা ছেলেটার কথা মনে পড়তে আমি পীর খানকে অনেকবার বলেছিলাম ছেলেটাকে আমায় দিয়ে দিতে। ইচ্ছে ছিল তাকে আমি দত্তক নেব। কিন্তু পীর খান সে প্রস্তাবে কখনো রাজি হয়নি।
ছেলেটাকে আমি একটা তেজি টাট্টুঘোড়া উপহার দিয়েছিলাম। তাইতে চড়ে সে হইচই করতে করতে আমাদের দলের আগে আগে পথ চলত সারাদিন। দলের পেছন পেছন আসতে তার ভারি আপত্তি।
রওনা হবার পর আমাদের প্রথম শিকার জুটল চারটে লোকের একটা দল। তাদের যখন মারা হবে তখন ছেলেটাকে একরকম জোর করেই দলের পেছন দিকে পাঠিয়ে দিয়ে কয়েকটা লোককে লাগিয়ে দিলাম তাকে পাহারা দিতে। কাজ চলবার সময় যেন সে কোনমতে সামনে চলে আসতে না পারে।
সবে ঝিরনিটা দিয়েছি, লোকচারটে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে; একটা লোক তো চিৎকারও করছে প্রাণপণে, এমন সময় আলম খান তার টাট্টুতে চেপে তিরবেগে সামনের দিকে এসে হাজির। প্রথমে সে, আমাদের ঠকিয়ে দিয়ে কেমন ফের সামনে চলে এল সেই বলে আনন্দে চিৎকার করছিল, কিন্তু তারপর চোখের সামনে গোটা দৃশ্যটা দেখে তার হাবভাব বদলে গেল একেবারে। ভয়ানক আতংকে যেন একরাশ কালি ঢেলে দিল কেউ তার ফর্সা মুখটাতে। আর তারপর আমরা কিছু বোঝবার আগেই সে তার টাট্টু থেকে অজ্ঞান হয়ে নীচে পড়ে গেল।
তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে কী করব তাই ভাবছি এমন সময় তার জ্ঞান ফিরে এল। মড়াগুলোকে সরাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা তখন। চোখ খুলেই পাশে পড়ে থাকা একটা মড়া মানুষের ঠেলে বের হয়ে আসা চোখ আর জিভওয়ালা মুখটা দেখে সে ফের চিৎকার করে উঠল, “ওগুলো কী মামা? কী করলে তুমি ওদের? ওদের—” বলতে বলতে বালিতে মুখ গুঁজে থরথর করে কাঁপছিল সে। মুখ দিয়ে তখন গ্যাঁজলা বের হচ্ছে তার।
“মড়াগুলোকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নাও,” বলে হুকুম দিয়ে আমি লোকজন ডেকে ছেলেটাকে নদীর ধারে বয়ে নিয়ে গেলাম। একটা মড়া মানুষের পাগড়িটা খুলে নিয়ে জলে ভিজিয়ে তাই দিয়ে তার মুখ মুছে দিচ্ছি এমন সময় সে ফের চোখ খুলল। চোখ খুলে পাগড়িটা দেখেই ফের তার চিৎকার শুরু হয়ে গেল। কী করি বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমরা। কাছাকাছি একটা গ্রামও নেই। আর থাকলেও সে অবস্থায় কোন হাকিম ডেকে আনা অম্ভব হত না। ছেলেটা বিকারগ্রস্তের মত বারংবার সেই মরা মানুষগুলোর কথা যেভাবে বলে চলেছে তখন, সেসব কথা বাইরের কোন লোকের কানে গেলে আমাদের সবকিছু ফাঁস হয়ে যেত।
তাকে কোনমতে একটু শান্ত করে টাট্টুর পিঠে উঠিয়ে নিয়ে খানিক বাদে ফের রওনা হলাম আমরা। কিন্তু ক্রোশখানেক পথ যেতে না যেতে ফের তার কাঁপুনি শুরু হল। রাস্তার পাশে নামিয়ে তাকে শোয়াতে সে অজ্ঞান হয়ে গেল ফের। মাঝে মাঝে চোখ মেলছিল যখন তখন দুর্বল গলায় শুধু বারবার বলে চলছিল, “ওই আসছে, ওই এল, ধরলো, তোমরা ওদের কী করলে মামা–”
আস্তে আস্তে তার গলা আরো দুর্বল হয়ে এল। তারপর সন্ধের মুখমুখ একেবারে থেমে গেল সে।
পীর খান তার শরীরটার পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। আমি কাছে গিয়ে তার গায়ে হাত দিয়ে ডেকে বললাম, “দুঃখ করে লাভ নেই পীর খান। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন এর শরীরটাকে তো কাছাকাছি কোন গ্রাম অবধি নিয়ে যাওয়া দরকার!” পীর খান বলল, “যা ইচ্ছে হয় করো মীর সাহেব। আমায় আর ডেকো না। আমার বুক ভেঙে গেছে। কলজের টুকরো ছিল ছেলেটা আমার!”
পরের গ্রামে আস্তানা ফেলবার পর সেদিন রাতে মশালের আলোয় কবর খুঁড়ে আমরা ছেলেটাকে গোর দিয়ে দিলাম। পীর খান তখন একেবারে নীরব হয়ে গেছে।
সেদিন মাঝরাতে পীর খান এসে আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুলল। বলে, “মীর সাহেব, আমি আর আগের পীর খান নেই। বুকটা আমার একেবারে ভেঙে দিয়ে গেছে ছেলেটা। আমায় আপনি যাবার অনুমতি দিন। আল্লাই আমায় এই শাস্তি দিলেন। এবার আমি বাড়ি ফিরে গিয়ে বাকি জীবনটা তাঁর পথেই চলবার চেষ্টা করব।”
তার শান্ত গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে আমি বুঝতে পারলাম, তাকে আটকানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না কোন। মাথা নেড়ে বললাম, “তাই যাও তুমি পীর খান। শান্তি পাও। আল্লা তোমায় কৃপা করুন। মনে রাখবে আমরা এতদিন একসঙ্গে কাজ করেছি দুই বন্ধুর মত, দুই ভাইয়ের মত। দলে তুমি থাকো বা না থাকো সেই সম্পর্কে কোন ছেদ পড়বে না। আর, কোনদিন যদি আবার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে, আমার দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকল জানবে।”
পীর খানের চোখ দিয়ে বড় বড় জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল। আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে সে কিছু বলবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বের হল না। খানিক বাদে হঠাৎ উপুড় হয়ে পড়ে আমার পায়ের ওপর চুমু খেয়ে হাঁটুদুটো জড়িয়ে ধরে বসে রইল কয়েকমুহূর্ত। তারপর উঠে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল আমার তাঁবু থেকে। আর কোনদিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। সে অভিযানের শেষে ঝালোনে ফিরে এসে শুনেছিলাম, ফিরে আসবার কয়েকদিনের মধ্যে মারা গিয়েছিল পীর খান।
ঘটনাটার পর কয়েকদিন দলে একটা দমচাপা দুঃখের ভাব ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে ফের সব স্বাভাবিক হয়ে এল। জব্বলপুর পৌঁছবার দিন দুয়েক আগে খবর পেলাম আমাদের আগে আগে এক পয়সাওয়ালা মুন্সি নাগপুরের দিকে চলেছে। তাড়াতাড়ি পথ চলে জবলপুর ছাড়াবার একদিন পরে আমরা তার নাগাল ধরে নিলাম। কাছাকাছি পৌঁছে দেখি মুন্সির দলটা বিরাট। তাতে দুটো বড় বড় তাঁবু, গোটাকয় উট আর ঘোড়া, পালকি বেহারা, চাকরবাকর, কি নেই! দলের চেহারা দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গেছিলাম আমরা। বুঝতে পারছলাম না এদের কাছে ঘেঁষা উচিত হবে কিনা। নিজেদের মধ্যে সে নিয়ে একটু শলাপরামর্শ করে নিলাম আমরা। ভবানীর সংকেত বিচার করে দেখা গেল দেবী তুষ্ট আছেন। তাছাড়া আমাদের দলটাও কম বড় নয়। হতিনেক লোক রয়েছে তাতে। সবদিক বিচার করে দেখে তখন কাজটা করে ফেলাই স্থির হল।
দিনদুয়েক আমরা মুন্সির দলটা কাছাকাছি হয়ে পথ চললাম। এমন অবস্থায় যা হয়, দু-দলের লোকজনের মধ্যে কথা চালাচালি শুরু হয়ে গেল। আমরা পয়সাওয়ালা ভদ্রলোক জানতে পেরে দ্বিতীয়দিন রাত্রে মুন্সি আমাকে আর বাবাকে তার তাঁবুতে নিমন্ত্রণ করল। আমরা তো আলাপ জমাবার সুযোগ খুঁজছিলামই। কাজেই নিমন্ত্রণ পেতে সঙ্গেসঙ্গে রাজিও হয়ে গেলাম।
মুন্সি লোকটা দেখা গেল প্রগাঢ় পণ্ডিত। বহু ব্যাপারেই তার গভীর জ্ঞান। দক্ষিণে ডাভটন সাহেবের কাছে কাজ করে। সম্ভবত সাহেবের নফরটফর গোছের কেউ হবে। উপস্থিত ছুটি কাটিয়ে পরিবার নিয়ে কাজের জায়গায় ফিরে চলেছে। সাহেবদের ব্যাপারে তার যেমন গভীর জ্ঞান, তেমন শ্রদ্ধা। সেদিন সন্ধেবেলার আসরে সাহেবদের ব্যাপারে আমাদের অনেক ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছিল সে। যেমন ধরুন, বাবা হঠাৎ তাকে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা মুন্সিজি, সাহেবরা ভগবানের দেয়া আঙুল থাকতে কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার খায় কেন?”
জবাবে মুন্সি বলে, “আগে আপনারা বলুন তো আপনারা এ ব্যাপারে কী জানেন?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “লোকে বলে এদের নোখের গোড়ায় নাকি এত বিষ যে হাতে করে খাবার খেলে নিজেদের বিষে নিজেরাই মরে পড়ে থাকবে। তাই খাবারে আঙুল না ছুঁইয়ে কাঁটাচামচ দিয়ে খায়। কি ঠিক কিনা?”
শুনে মুন্সি অনেকক্ষণ ধরে হাসল। এমনকি তার পেছনে তাঁবুর ভেতর থেকে মেয়েদের গলার হাসিও ভেসে আসছিল আসরে। বুঝলাম আমায় নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে। খানিক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে মুন্সি বলে, “না না মীর সাহেব। কে যে এমন মিথ্যে কথা বানিয়েছে কে জানে! আসলে ফিরিঙ্গিদের দেশের নিয়মই এমন। হাতের আঙুল এঁটো করা ওদের বারণ। তাছাড়া ওদের রান্নাবান্নাও তো অন্যরকম। যেমন ধরুন ওরা অর্ধেকটা ভেড়া একবারে পুড়িয়ে নিয়ে তার থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। ছুরি কাঁটা ছাড়া খালি হাতে ওসব খাবে কেমন করে?”
আমার আর একটা প্রশ্ন করবারও খুব ইচ্ছ ছিল। সেটা হল সাহেবরা দল বেঁধে মদ খেলেই চিৎকার করে হিপ হিপ—এসব বলে কেন? আমার ধারণা ছিল, ওতে কোন জাদুমন্ত্রের ব্যাপার আছে। তবে একবার হাসির খোরাক হবার পর মুন্সিকে আর সে প্রশ্নটা করবার সাধ আমার বাকি ছিল না।
রাতে যখন ফিরে আসছি ততক্ষণে ঠিক হয়ে গেছে আমাদের দলদুটো একসঙ্গে চলবে পরদিন থেকে, আর রোজ সন্ধ্যাবেলা গল্পের আসর বসবে একসঙ্গে। আমরাও এটাই চাইছিলাম। চলেছি নিজামের এলাকা দিয়ে। সেখানে এমনিতেই ঠগিদের খুব খাতির। এই এলাকার সব গ্রামে আমাদের চেনা লোকজন। গ্রামের প্যাটেলকে পয়সা দিলে বুক ফুলিয়ে কাজ করা যায়। অনেকে তো এই অঞ্চলে কাজ হয়ে যাবার পর এলাকায় কিছু পয়সা ধরে দিয়ে মরাগুলো গোর না দিয়েই চলে যায়। কেউ কিছু বলে না। কাজেই মুন্সির দলটাকে এই এলাকায় নিকেশ করে ফেলতে বিশেষ সমস্যা হবার ভয় ছিল না আমাদের।
দু-একদিন পর আমরা বিশনেই নামে একটা গ্রামে এসে পৌঁছোলাম। গ্রামের প্যাটেল লোকটি ভালো। আমাদের কাজকর্মের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত। তবে মাঝেমধ্যে দশবিশটা টাকা, কি একটা রেশমি পাগড়ি, এই পেলেই খুশি হয়ে মুখ বুজে থাকে। কিছুদিন আগে এই প্যাটেল অন্য এক ঠগির মুখে আমার কাছে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল যে তার একটা বিলিতি পিস্তল দরকার। এ যাত্রা সে পিস্তল আমি জোগাড় করে সঙ্গে রেখেছিলাম। সেটার সঙ্গে একটা সুন্দর পাগড়ি আর কোমরবন্ধও এনেছিলাম। গ্রামে পৌঁছেই প্যাটেলের বাড়ি গিয়ে আমি নিজে হাতে পাগড়িটা তার মাথায় পরিয়ে দিলাম, আর অন্যান্য উপহারের সঙ্গে সঙ্গে কুড়িটা টাকাও ধরে দিলাম হাতে।
প্যাটেল খুশি হয়ে বলে, “তা মীর সাহেব, একসঙ্গে এত দামি জিনিসপত্র উপহার দিয়ে ফেললে, ভালো বুনিজ সঙ্গে এনেছ মনে হচ্ছে?”
“আরে না না, কী যে বলেন! বুনিজটুনিজ কিছু নয়,” আমি বিনীতভঙ্গীতে বললাম, “আসলে, অনেকদিন পরে এদিকে এলাম তো, তাই একটু আধটু জিনিস হাতে করে নিয়ে এসেছি আরকি—”
“ভালো, ভালো। ওপরওলা আপনার মঙ্গল করুন, কিন্তু মীরসাহেব, শাঁসালো বুনিজ যে আপনার সঙ্গে আছে, সে আমি বেশ বুঝতে পারছি। নইলে আপনাদের তাঁবুতে অন্য লোক কী করছে? আর একসঙ্গে এত বড় দলই বা জড়ো করেছেন কেন এখানে? আপনাকে তো আর আজ থেকে চিনি না! আমার কাছে আপনি কিছু লুকোতে পারবেন না।”
“আরে আমি লুকোতে চাইছি কে বলল?” আমি জবাব দিলাম, “আপনি পুরনো বন্ধু,আপনার কাছে আর লুকোছাপা কীসের?”
“হ্যাঁ তা তো বটেই। তবে ব্যাপার কি জানেন মীরসাহেব, দিনকাল বদলেছে। এই এলাকায় এখন ফিরিঙ্গিদের জমিদারী সে খবর রাখেন তো?”
“আরে প্যাটেলজি তাতে হলটা কী?”
“না হয়নি কিছু, তা আপনি ঘোড়সওয়ারগুলোকে দেখেননি?”
“ঘোড়সওয়ার? কীসের ঘোড়সওয়ার?”
“আর বলবেন না, আমাদের গ্রামের দুর্নাম ফিরিঙ্গিদের কান অবধি গিয়ে পৌঁছে গেছে যে! একজন দফাদারকে দিয়ে ছ’খানা ঘোড়সওয়ার সেপাই পাঠিয়ে দিয়েছে ফিরিঙ্গিরা গ্রাম পাহারা দেবার জন্য।”
“হুঁ। এই দফাদার লোকটা কেমন?”
“দফাদার হিতা সিং আর তার সেপাইয়ের দল, সবাই ভোজপুরি হিন্দু।”
“ভোজপুরি? বাঃ বাঃ। তাহলে এরা নিজেরাই তো ঠগি প্যাটেলজি! সৎ ভোজপুরি ভূ-ভারতে কোথাও আছে নাকি?”
“না মীর সাহেব। এরা ঠগি নয়। ঠগিদের সংকেত শব্দ এদের সামনে আমি বলে দেখেছি। বুঝতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, সুযোগ পেলে হিতা সিং নিজের জন্য যা খুশি করে ফেলতে পারে, এইটুকু আমি বলতে পারি।”
“বহুত খুব। লোকটা কোথায়?”
“ডাকব?”
“ডাকুন। বুঝিয়ে দেখি একবার। তারপর কথা যদি না শোনে, তো দলে তো আমরা তিনশোজন। ছ’টা সেপাই মিলে করবেটা কী?”
“একটু সাবধানে মীরসাহেব। ফিরিঙ্গীরা যদি জানতে পায় আমার এলাকায় গন্ডগোল হয়েছে তাহলে আমায় আর এখানে থাকতে দেবে না।”
“ভালোই তো। তাড়িয়ে দিলে তখন আমাদের ঠগির দলে এসে ঢুকবেন। কিন্তু ওসব কথা থাক এখন প্যাটেলজি। লোকটাকে ডাকুন।”
“প্যাটেলজি ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে খানিক বাদে একটা বেঁটেখাটো লোককে সঙ্গে করে ফিরে এলো। লোকটার মুখচোখ দেখেই আমি বুঝতে পারছিলাম এ সুবিধের লোক নয়। বদমায়েশির ছাপ মারা রয়েছে তার চেহারায়।”
“দফাদার সাহেব, আমরা কে সেটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?”
সে মাথা নাড়ল।
“বেশ, বেশ। তাহলে আমরা এখানে কী করতে এসেছি সেটাও আপনি আন্দাজ করতে পারেন?”
“খানিকটা পারি। তবে আমি আপনাদের চিনি না।”
“এইটাই তো চাই দফাদার সাহেব। আপনি আমাদের চেনেন না। আমাদের ব্যাপারে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে আপনি কিছুই জানেন না। এক কাজ করুন, গ্রামের মধ্যেই থাকুন। বাইরে যা খুশি হোক, গ্রাম ছেড়ে সেখানে পা দিতে আসবেন না। কথা দিচ্ছি, কাজ মিটলে আমরা আপনাকে খুশি করে দিয়ে যাব। আর তাতে যদি রাজি না থাকেন, তাহলে মনে রাখবেন দলে আমরা তিনশো জন।”
“আরে না না। সেটুকু বুদ্ধি আমাদের পেটে আছে। ভোজপুরিদের এতটা বোকা ভাববেন না। আপনারা যা ভালো বোঝেন করুন, আমি গ্রাম থেকে বাইরে পা দিচ্ছি না।কিন্তু টাকাপয়সার ব্যাপারটা–”
“কত চাইছেন?”
“তা ধরুন গিয়ে শ’দুয়েক হলেই চলবে। কী বলেন?”
“আমি রাজি দফাদার। প্যাটেলজি সাক্ষি রইলেন।”
“ঠিক আছে তাহলে। রাত্রিবেলা আমি আপনাদের ওখানে টাকাটা নিতে আসব।”
“টাকা নিতে গেলে এখন আসুন দফাদার সাহেব। কাজ শেষ করে আমরা আর এখানে একমুহূর্তও অপেক্ষা করব না।”
দফাদার প্যাটেলের দিকে ঘুরে বলে, “প্যাটেলজি, আপনি সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে গিয়ে টাকাটা নিয়ে আসুন। আমার যাওয়াটা ভাল দেখাবে না।”
“বেশ। যে যাবেন তাড়াতাড়ি চলুন। সময় বেশি নেই হাতে, বলতে বলতে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
“এদিকে আবার আসছেন কবে সৈয়দ সাহেব?” দফাদার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রশ্ন করল। আমি হেসে বললাম, “কোন ঠিক নেই। তবে এ জায়গাটায় কাজকর্মের সুযোগ এত ভালো যে মাঝেমাঝেই আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে আপনার।”
“আসবেন, আসবেন। এখানে অনেক গোন্দ, মাঙ, ঢের এইসব জাতের বুনোরা চুরি ডাকাতি করে বেড়ায়। আপনারা যখন আমার এলাকায় এসে কাজ করবেন তখন তখন এদের দু-একটাকে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দিলেই হবে। দু-একবছর ঘানি ঘোরালে ব্যাটাদের ভালো বই মন্দ হবে না।”
লোকটা এমন ঠান্ডা মাথায় কথাগুলো বলছিল যে শুনলে হাসি আটকানো মুশকিল। কথাগুলো অবশ্য সত্যি। এ দেশে এমন অনেক দফাদার চিরকালই আছে। তারা এইভাবেই ডাকাত আর সরকার দুইয়ের কাছ থেকেই রোজগার করে, আর তার জন্য অনেক লোক কোন অপরাধ না করেও জেল খাটতে বাধ্য হয়।
।৪০।
প্যাটেলজিকে নিয়ে আমাদের ঘাঁটির দিকে দিকে যেতে যেতে বললাম, “লোকটা ভালো। আমাদের কাজে আসবে।”
“দফাদার অ্যাদ্দিন রকম একটা সুযোগ খুঁজছিল,” প্যাটেল বলল, “এমনিতে মুখে কখনো কিছু না বললেও ব্যাটা মাঝেমাঝেই আমাকে আকারে ইঙ্গিতে কথাটা বলবার চেষ্টাও করেছে। আমার তো মনে হয় ঠগিদের নাগাল ধরবার জন্যই লোকটা এই গ্রামে কাজ নিয়ে এসেছে।”
“টাকার পরিমাণটা ঠিক দিয়েছি তো?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। এত টাকা ও আশাও করেনি।”
“হ্যাঁ, একটু বেশিই দিলাম। খরচটা আমাদের কাজে লাগবে।”
“সে কথা ঠিক, কিন্তু আমায় কি ভুলে গেলেন নাকি মীরসাহেব?”
“আরে সে কী কথা প্যাটেলজি। আপনার আসল জিনিস তো রাখা আছে আমার কাছে। চলুন, গিয়ে দিচ্ছি।”
“কত দিচ্ছেন মীরসাহেব? হাতে টানাটানি চলছে আমার কিছুদিন ধরে।”
“ত্রিশ টাকা।”
“ওটা পঞ্চাশ করে দিন। টাকাটা আমার সত্যিই দরকার মীরসাহেব।”
আমি নিমরাজি মুখ করে বললাম, “ঠিক আছে পাবেন। কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমরা চলে যাবার পর এখানে কিছু লোক আসতে পারে। লোকগুলো ডাকু। তাদের সঙ্গে টাট্টুঘোড়া থাকবে কিছু। তাতে অনেক মালপত্র থাকবে। যদি তারা আসে তাহলে একটা চিঠি দিয়ে আমার কাছে লোক পাঠিয়ে দিতে হবে আপনাকে।”
“নিশ্চিন্ত থাকুন মীরসাহেব। আমি আমার ছেলেদুটোকে পাঠিয়ে দেব। আপনাদের খুঁজে বের করতে ওদের কোন সমস্যাই হবে না। তা লোকগুলো কোত্থেকে আসবে বলছিলেন?”
“হায়দরাবাদ থেকে নাগপুর হয়ে এই রাস্তা দিয়ে ফিরবে। রাস্তায় ধরতে পারি তো ভালো কথা। কিন্তু আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারে যদি তাহলে এইখান দিয়ে ওদের যেতেই হবে।”
“ঠিক আছে। আমি চোখকান খোলা রাখব। কিন্তু কাজ হলে আমার ভালো কিছু জিনিস চাই সে কথা আগেই বলে রাখলাম।”
“আরে না না। আপনার কথা আমি ভুলে যাব এ কথা ভাবলেন কী করে প্যাটেলজি। কিন্তু সে কথা থাক। ঘাঁটিতে এসে গেছি। এই যে—এদিকে আসুন। টাকাগুলো সাবধানে নিয়ে যাবেন। কারো চোখে না পড়ে যায় আবার।”
“আরে সে নিয়ে একদম ভাববেন না মীরসাহেব। আমরা হলাম গিয়ে এ পথের পুরনো পাপী সব। কোন চিন্তা নেই। টাকাটা নিয়ে আমি গিয়ে একবার মুন্সিকে দেখে তারপর যাব। ঘাড়ের কাছে মৃত্যু শ্বাস ফেলছে লোকটার, কিন্তু বেচারা কিচ্ছু জানে না। সঙ্গে আবার বউবাচ্চাও রয়েছে।”
“হ্যাঁ, তা ঠিক। বউটাকে না মেরে উপায় নেই। সেটা একটা দুঃখের ব্যাপার। তবে ছেলেটা চার বছরের। আমি ওটাকে দত্তক নেব। ওপরওলা তো আমায় আর নিজের একটা ছেলে দিলেন না!”
প্যটেল টাকাকড়ি নিয়ে বিদেয় হলে গণেশ জেমাদার এল আমার কাছে। বলে, “জায়গাটা ঘুরে দেখে নিলাম। মুন্সির তাঁবুর পেছনদিকে একটা কুয়ো খোঁড়া হচ্ছিল বোধ হয়। তার গর্তটা এমনি পড়ে আছে। আমাদের গর্ত খোঁড়ার খাটুনিটা বেঁচে গেল।”
“লুগাইরা গর্তটা দেখে নিয়েছে?”
“হ্যাঁ। ভবানীকে সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম। সে দেখে বলল, ঠিকই আছে।”
“এবারে কাজটা কীভাবে করা হবে বলো গণেশ।”
“আপনি তাঁবুর ভেতরের কাজটা সারুন, বাইরের ব্যাপারটা আমরা সামলে দিচ্ছি। মুন্সিকে তাঁবুতে একাই পেয়ে যাবেন।কোন ঝামেলা হবে না।”
“ঠিক আছে।তবে একটাও সহিস বা উটওয়ালা যেন পালিয়ে না যায় সেটা খেয়াল রাখবে। অনেকগুলো আছে কিন্তু।”
“ষোলজন। আমি গুণে নিয়েছি। ধরুন গিয়ে—আটজন পালকিবেহারা, দুটো উটওয়ালা, তাদের একজনের সঙ্গে আবার বউ রয়েছে, হল গিয়ে এগারো। রইল দুটো খিদমতগার, একটা চাকরানি, আর চারটে সহিস। সব মিলিয়ে হল গিয়ে ষোল।”
“ষোল নয় গণেশ, আঠারো–”
“ওই একই ব্যাপার হল। অন্ধকার নামলে সবগুলো যখন একসঙ্গে গান শুনতে বসবে তখন একসঙ্গে ঘিরে ফেলে কাজ মিটিয়ে ফেলব।”
দফাদারের গল্প শুনে গণেশ বলে, “হিতা সিংকে তো আমি চিনি! একবার আরা জেলায় সেপাইরা আমায় ধরে ফেলেছিল। তখন এই হিতা সিং-ই তো কালেক্টরের কাছে গিয়ে জামিন হয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিল। লোকটা ভালো মীরসাহেব,তবে টাকার খাঁই একটু বেশি। দুশো টাকা দিয়ে ভালো করেছেন। ও আর আমাদের ব্যাপারে মুখ খুলবে না দেখবেন।”
সন্ধের নামাজের পর বাবাকে নিয়ে আমি গিয়ে মুন্সির তাঁবুতে উঠলাম। মুন্সি তার ছেলেকে হাঁটুতে বসিয়ে দোল দিচ্ছিল। ভারি সুন্দর দেখতে ছেলেটা। আমি হাত বাড়াতে উঠে আমার কোলে চলে এল। আমি তাকে অনেক আদর করে আমার তলোয়ারটা দেখতে দিলাম। আজিমাও নিশ্চয় এমন সুন্দর একটা ছেলে পেয়ে খুশি হবে খুব! মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে একে নিয়েই ওর সময় কেটে যাবে বেশ।
মুন্সি আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। খানিক বাদে বলে, “আপনার ছেলেপুলে নেই বোধ হয়, না মীরসাহেব?”
“না না আছে। একটা মেয়ে। ছেলেও একটা দিয়েছিলেন ওপরওয়ালা, কিন্তু এই সাহেবজাদার মত বয়সেই আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। তাঁর মর্জি–”
“কী আর করবেন মীরসাহেব? ভগবানের ওপরে তো আর কারো হাত নেই! এই আমার কথাই ধরুন না!ছেলেপুলে হয় না হয়না করতে করতে চুলে পাক ধরে গিয়েছিল। আশা যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, তখন ওপরওলার দয়ায় এই সোনার চাঁদ ছেলে পেলাম।”
“আহা একশো বছর বেঁচে থাক কোল আলো করে! আমার তো আর ছেলেপুলে হবার কোন আশা নেই।”
এমনিভাবে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলবার পর বাইরে থেকে খবর এলো সব তৈরি। তখন মুন্সিকে আমি বললাম, “আপনি রঙ্গরস, গানবাজনা ভালোবাসেন দেখে আমার দলের লোকজন আপনার জন্য একটা বহুরূপীর অনুষ্ঠান করবে বলে ঠিক করেছে আজ সন্ধেয়। এমন কিছু আহামরি নয় অবশ্য, কিন্তু সাহেবজাদারও হয়ত ভালো লাগবে দেখবেন।”
“হয়ত মানে? এ জঙ্গলে ভালো জিনিস যতটুকু যা দেখতে পাওয়া যাবে সবটাই তো লাভ। সত্যি বলছি মীরসাহেব, আপনারা না থাকলে এতটা পথ কীভাবে যে কাটত আমাদের জানিনা। আপনি দলটাকে তৈরি হতে বলুন, আমি জেনানার ভেতর ওনাদেরও একবার–”
খানিক বাদে আমাদের দলের ছ-জন শক্তপোক্ত লোক তাঁবুর ভেতর ঢুকে এল। তাদের মধ্যে দুজন মেয়ে সেজে হাতে সেতার আর তবলা নিয়ে গোঁসাইনি সেজেছে। সেসব বাজিয়ে, চোখমুখ ঘুরিয়ে তারা এমন নাচ জুড়ল যে দেখে আমরা হেসেই অস্থির। মুন্সির ছেলের তো হাসি আর থামেই না তাদের কান্ডকারখানা দেখে। তাঁবুর একদিকটা খোলা। নাচগান শুরু হতেই মুন্সির দলের বাকি সব লোকজন সেখানে এসে জড়োহয়ে গেল। আমিও এটাই চাইছিলাম। খেয়াল করে দেখলাম, সবার মনোযোগ এড়িয়ে তাদের প্রত্যেকের কাছ ঘেঁষে এসেছে দুতিনজন করে বাছাই করা ঠগি। ঝিরনিটা দিতে যাব ঠিক এমন সময় বাধা এল। তাঁবুতে ঢুকে এসে এক ঠগি বলে আমায় বাইরে ডাকছে। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না। আমি হাতের কাজ রেখে বাইরে বের হয়ে এলাম।
এসে দেখি গণেশ ভয়ে কাঁপছে। আমায় দেখে বলে, “সর্বনাশ হয়ে গেছে। ফিরিঙ্গি এসেছে গ্রামে–”
“ফিরিঙ্গি!”
“হ্যাঁ মীরসাহেব। এবার কী হবে? এত ভালো বুনিজ হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যাবে?”
“কি-কিন্তু এখানে হঠাৎ ফিরিঙ্গি এল কী করতে? তুমি নিজে চোখে দেখেছ?”
ক্রমশ