টমাস ডান। ডাকাতসর্দার। কথিত আছে, রাজা প্রথম হেনরি একে রোখবার জন্য ডানস্টেবল নামে একটা শহরের সৃষ্টি করেছিলেন। জীবন্ত খণ্ড খণ্ড করে কেটে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
বেডফোর্ডশায়ার-এর কেম্পসটন আর এলসটোর মাঝামাঝি একটা ছোট্ট গ্রামে সমাজের নিম্নতম স্তরে জন্ম। একেবারে ছোটোবেলা থেকে চুরিতে হাত পাকিয়ে এমন কুখ্যাত হয়ে ওঠে যে বলা হত, কোনও কিছুতে আঙুল ছোঁয়ালে সেটা তার আঙুলে নিজে নিজেই সেঁটে যায়।
বড়ো হয়ে উঠতে তার দুষ্কর্ম শুধু চুরিতে সীমাবদ্ধ রইল না। হেন কুকীর্তি নেই যাতে সে হাত পাকায়নি। সে কাজ করবার জন্য নিজেকে তৈরিও করেছিল অসাধারণভাবে। কথার ফাঁদে ফেলে যেকোনও মানুষকে বশ করে ফেলতে তার জুড়ি ছিল না। আবার যেকোনও ছদ্মবেশ নেয়াতে তার প্রতিভা ছিল জন্মগত। আজ দেখা গেল সে একজন সেপাই সেজে ঘুরছে, আবার কাল সে বনে গেল মাঝবয়েসি কোনও ব্যবসায়ী। তার পরদিন হয়তো একটা ধুলোময়লা মাখা ভিখিরি। কোনও দুষ্কর্ম করবার জন্য ছেঁড়া কাপড়জামা গায়ে জড়িয়ে, প্লাস্টার দিয়ে মুখের ভোল বদলে সে যখন পথে নামত, বলা হয় তার নিজের মাও তাকে চিনতে পারত না।
অন্ধ বাঁশিওয়ালা সেজে কোনও কুকর্ম সেরেই ভোল বদলে খোঁড়া ভিখিরি সেজে সে রওনা হত পরের ডাকাতির জন্য। বেকায়দায় পড়লে অক্লেশে দু-তিনটে জোয়ানের মহড়া নেয়া তার বাঁহাতের খেল ছিল।
একদিনের ঘটনা বলা যাক। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ডানের হঠাৎ চোখে পড়ল এক গাড়িওয়ালা পাঁচ ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে যব নিয়ে যাচ্ছে বেডফোর্ডের বাজারে। রাস্তায় লোকজন ছিল না বিশেষ। অতএব ডান সটান এসে গাড়িওয়ালার গলা টিপে তাকে নিকেশ করে দিল। তারপর ধীরেসুস্থে রাস্তার ধারে একটা গর্ত খুঁড়ে শরীরটাকে পুঁতে ফেলে তার জামাকাপড় গায়ে চাপিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলল বেডফোর্ডের বাজারের দিকে। বাজারে গিয়ে যব, গাড়িঘোড়া সব বেচেবুচে দিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে সে হাওয়া।
শুরুতে একলা একলাই কাজ করত ডান। তবে খানিক বড়ো হয়ে সে বুঝতে পারছিল, একা হাতে খুচরো ডাকাতি ছিনতাই ছাড়া কোনও বড়ো কাজ করা যাবে না। ওদিকে এলাকায় ততদিনে বদনামের চোটে টেকা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে তার। অতএব ডান কয়েকজন বদমাশ স্যাঙাত জুটিয়ে গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে আস্তানা গাড়ল।
গভীর জঙ্গলের বুকে অজস্র গুহা, ঘন গাছপালা। ফলে কোনও দুষ্কর্ম ঘটিয়ে ফিরে এসে লুকিয়ে থাকবার সমস্যা নেই। কাজেই এই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে এইবার ডান বড়ো বড়ো ডাকাতিতে মন দিল। বনের পাশ দিয়ে সেন্ট অ্যালবানস থেকে টোকাস্টার অবধি বিস্তীর্ণ হাইওয়ে গেছে। শিকারের অভাব নেই।
কিছুদিনের মধ্যেই ডান-এর দলের ভয়ানক সব কীর্তিকলাপের কল্যাণে এ রাস্তাটা সাধারণ মানুষের কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠল। প্রায় প্রতিদিন সেখানে ডাকাতি, খুনোখুনি লেগেই আছে। বাধা দেবার লোক নেই। শেষমেশ অবস্থা এতটাই গুরুতর হয়ে উঠল যে খবর গেল রাজা প্রথম হেনরির কাছে।
রাজার সৈন্যও ডানকে ধরতে এসে হার মেনে গেল। নিরুপায় হয়ে হেনরি শেষমেশ তাকে রুখতে বেডফোর্ডশায়ারের কাছে আস্ত একটা শহরই গড়ে ফেললেন একটা পাকাপোক্ত সেনাঘাঁটি বসাবার জন্য। তাতে ফল তো কিছু হলই না, উলটে লোকের মুখে মুখে কিছুদিনের মধ্যেই সে শহরের নাম হয়ে গেল ডানস্টেবল।
গুণের কদর দিতে জানত ডান। দলের লোকজন বেছেছিল খুব হিসেব করে। তাতে ওস্তাদ যোদ্ধারা ছিল; সেইসঙ্গে ছিল তালাভাঙার নিপুণ কারিগর, নকল চাবি বানাবার ওস্তাদেরাও। কেউ আবার নিঃশব্দে লোহার শিক কাটতে পারে এমন উখো তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। দলে শৃঙ্খলা রাখবার জন্য নিজস্ব আইনকানুনও বানিয়ে নিয়েছিল সে অনেক ভেবেচিন্তে।
একবার ডানের গুপ্তচরেরা খবর আনল, বেডফর্ডের শেরিফ তার সেপাইদের নিয়ে তাকে খুঁজতে জঙ্গলে ঢোকবার মতলব করেছে। খবর পেয়েই ডান তার দলবল নিয়ে জঙ্গলে একেবারে গভীরে গিয়ে গা ঢাকা দিল। স্বয়ং শেরিফ আসছে দলবল নিয়ে। অতএব এক্ষেত্রে তার গতিবিধির খবর নেবার জন্য নজরদারদের ওপর ভরসা করল না ডান। দুর্দম সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী মানুষটা তার দলকে নিরাপদে লুকিয়ে রেখে নিজে ভিখিরির ছদ্মবেশ নিল। তারপর সটান চলে গেল জঙ্গলের বাইরে।
শেরিফের দলটা বিশেষ বড়ো ছিল না। ভিখিরির ছদ্মবেশে ডানকে তারা চিনতে পারল না। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের ভালো করে দেখে নিয়ে যখন আস্তানায় ফিরল ডান তখন তার মুখে চওড়া হাসি ফুটেছে। বলে, “ভাইসব, লোকটার সঙ্গে লোকজন বেশি নেই। এবার আমাদের খেলা।”
শেরিফকে নিছক যুদ্ধ করে হারানো ডানের মত অপরাধশিল্পীর উদ্দেশ্য ছিল না। তার মাথায় তখন অন্য বুদ্ধি খেলে গেছে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে সে এবারে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শেরিফের সেপাইদের ওপরে। নামমাত্র যুদ্ধ করেই সেপাইরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে শুরু করলে ডানের আসল খেলা শুরু হল। এগারোটা সেপাইকে তাড়া করে ধরে আনল তার দল। তারপর তাদের গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে তাদের পোশাক-আশাক, বর্মচর্ম খুলে নিয়ে সেইগুলো পরে আশপাশের গ্রাম-শহরে ক’দিন ধরে চুটিয়ে ডাকাতি করে বেড়ালো। সব বদনাম জমা হল শেরিফের খাতায়। লোকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারল না এটা ডানের কীর্তি।
কয়েকটা ডাকাতি এভাবে করবার পর ডানের সাহস গেল বেড়ে। একদিন রাত্রে শেরিফের সেপাইদের পোশাক পরে জঙ্গলের একধারে দাঁড়ানো একটা দুর্গের দরজায় গিয়ে হানা দিল তার দলবল। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, “তোদের দুর্গে ডান আর তার দলবল লুকিয়ে আছে। আমাদের কাছে খবর আছে। রাজার নামে আদেশ দিচ্ছি, দরজা খোল।”
দুর্গের পাহারাদাররা তো শেরিফের লোকজন দেখে ভয়টয় পেয়ে দরজা হাট করে খুলে দিল। যত তারা বলে ডানকে ঠাঁই দেবার মতন কুকর্ম তারা করেনি, ডান তত তাদের ধমকায়। শেষে তার ‘সেপাই’রা অস্ত্রশস্ত্র বাগিয়ে দুর্গে ঢুকে পড়ে গোটা চত্বর তন্ন তন্ন করে তল্লাশি নেয়া শুরু করল। যথারীতি কোনও অপরাধীর টিকির দেখাও মিলল না। তখন দুর্গের তোষাখানায় গিয়ে বড়ো বড়ো সিন্দুকগুলো দেখিয়ে ডান বলে, “এর মধ্যে বদমাশগুলোকে লুকিয়ে রাখিসনি তো? চাবি এনে সিন্দুক খোল। আমরা দেখব।”
সিন্দুক খোলা হতে তার থেকে টাকাপয়াসা সোনাদানা যা ছিল সব লুটে নিয়ে ডান আর তার দলবল ফের দুর্গের সেপাইদের বেজায় ধমকচমক দিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে বেরিয়ে সোজা জঙ্গলের আস্তানায় গিয়ে উঠল।
দুর্গের মালিক প্রথমে ঘাবড়ে গিয়ে ‘শেরিফের লোকজন’কে কিছু বলেনি। কিন্তু ধনরত্ন চুরি হয়ে যেতে দেখে এবারে সে বেজায় রেগে গিয়ে সটান রাজা হেনরির দরবারে গিয়ে বেডফোর্ডের শেরিফের বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকে দিল একটা। শুনে রাজাও ভয়ানক রেগে উঠলেন। শেরিফ আর তার সেপাইদের বিরুদ্ধে পরওয়ানা জারি হতেও দেরি হল না।
রাজার সৈন্য এসে তাদের ধরতে শেরিফ তো আকাশ থেকে পড়লেন। এটা ঘটনা, যে কয়েকদিন আগে জঙ্গলে ডানকে ধরতে গিয়ে তাঁর দলের কয়েকটা সেপাই দলছুট হয়ে উধাও হয়ে গেছে, কিন্তু তারা গা ঢাকা দিয়ে এমন কুকর্ম করতেই পারে না। কিন্তু শেরিফের কথায় ভবি ভোলবার নয়। দুর্গের মালিক স্বচক্ষে দেখেছে সরকারি পোশাক পরা সেপাইদের। অতএব ভয় দেখিয়ে সত্যিটা বের করবার জন্য শেরিফের এক সেপাইকে তৎক্ষণাৎ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হল। কিন্তু তাতেও কেউ অপরাধ স্বীকার করে না।
এইভাবে হয়তো একে একে শেরিফ আর তার সব সেপাইকেই ফাঁসিতে যেতে হত। কিন্তু তাদের ভাগ্য ভালো। তদন্ত শুরু হবার কয়েকদিনের মধ্যে একজন খবর আনল, জঙ্গলে এগারোটা মৃতদেহ ঝুলছে। শরীরগুলো উদ্ধার করে আনবার পর দেখা গেল, সেগুলো সেই গা ঢাকা দেয়া এগারোজন সেপাইয়ের শরীর। তাদের গায়ে কোনও পোশাক ছিল না। এইবার বোঝা গেল, ডান কোন শয়তানী চালটা চেলেছিল। অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও কোনওমতে বেঁচে গেল শেরিফ আর তার সেপাইয়ের দল।
এইবার ডান-এর কুখ্যাতি এমন আকাশছোঁয়া হয়ে উঠল যে রাজাগজা হোক কি সাধারণ মানুষ, তার এলাকায় পা দেবার সাহস রইল না আর কারও। ভুল করেও কেউ সেখানে এসে ঢুকলে, তা সে যত অস্ত্রধারী দলই হক না কেন, প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরত না তাদের একজনও।
এইভাবে দীর্ঘ কুড়িটা বছর কেটে গেল ডান-এর। ইয়র্কশায়ারের ঔসে নদীর ছড়ানো উপত্যকা জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় তার পঞ্চাশজন অশ্বারোহী ডাকাতের দল। সামনে পড়লে পুরুষ, মহিলা, শিশু, কেউ তার হাত থেকে বেঁচে ফেরে না। অমানুষিক নৃশংসতায় শিকারদের খুন করত ডান। তাকে আটক করা দূরস্থান, তার দলের মুখোমুখি হবার সাহসও আর অবশিষ্ট ছিল না সে অঞ্চলের মানুষজনের।
তবে সব কুকীর্তিরই একটা সীমা থাকে। আস্তে আস্তে পাপের ভারা পূর্ণ হয়ে আসছিল ডান-এর। মানুষ তাকে ভয় পেত, কিন্তু সেইসঙ্গে দেশ জুড়ে একটা গভীর রাগও গড়ে উঠছিল তার বিরুদ্ধে। শুধু উপযুক্ত একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল মানুষ। চরদের মুখে সে খবর তার কাছে পৌঁছোত নিয়মিত। কিন্তু তাতে ডান-এর স্বভাবে কোনও বদল আসেনি কখনও। নিজের শক্তির গর্বে সে তখন মাতোয়ারা হয়ে আছে। অন্যের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালানো তখন তার জীবনের একমাত্র নেশা, একমাত্র ধর্ম। কোনও ভয়েই সে-পথ সে তখন ছাড়বে না বলে পণ করেছে।
অহংকার দুঃসাহসী করে তুলছিল ডানকে। কখন থামতে হয় তাও ভুলতে বসেছিল সে। মাঝেমাঝে জঙ্গল ছেড়ে একেবারে একলা একলাও বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াত সে। কেউ যে তার দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারে এমন কথা তখন আর তার মাথায় আসে না। এমনই একদিন তার কাছে খবর এল, ডানস্টেবল-এর একটা লোক, তাকে দু-তিনদিন একলা একলা ঘুরতে দেখে তাকে ধরবার ফন্দি এঁটেছে। কায়দাটা সহজ। শেরিফের পাঁচ-ছ’টা সেপাই লোকটার বনের ধারের বাড়িতে এসে লুকিয়ে থাকবে। তারপর ডানকে একলা একলা জঙ্গল থেকে বের হতে দেখলেই এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর।
খবরটা শুনে ডান যদি শুধু একটু সাবধান হত তাহলেই কিন্তু কোনও বিপদ হত না তার। কিন্তু সে হল ও অঞ্চলের মুকুটহীন রাজা। তার বিরুদ্ধে এমন চাল চালবার কথা যে কেউ ভাবতে পেরেছে এইতেই ভারি সম্মানে লেগে গেল তার। মাত্র পাঁচ-ছ’টা সেপাই দিয়ে স্বয়ং ডানকে ধরবার স্বপ্ন দেখছে এ! একে শিক্ষা দিতে হবে। অতএব একদিন রাত্রে বিরাট দলবল নিয়ে সে এসে হানা দিল লোকটার বাড়ির সামনে।
কপাল খারাপ ছিল ডান-এর। বাড়িটার ওপর এলাকার লোকজনের নজর ছিল। ডান-এর দলবলের সেখানে জড়ো হয়ে চিৎকার চেঁচামেচির খবর অতএব আগুনের মতো ছড়িয়ে গেল চারপাশে। সেদিন হঠাৎ সব ভয় ভুলে গোটা শহর পথে নেমে এল। এলেন শেরিফও, তাঁর পূর্ণশক্তি নিয়ে। শুরু হল তাড়া।
এইবার প্রমাদ গুনল ডান আর তার দলবল। তাদের সব ছলচাতুরীর জাল কেটে জীবনে এই প্রথম সরাসরি তাদের মুখোমুখি হয়েছে মানুষ। এত বড়ো একটা ফুঁসতে থাকা মানুষের দলের সঙ্গে যোঝবার শক্তি তাদের নেই।
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাল তারা। যে যেদিকে পারে, যেভাবে পারে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাইল। কেউ ধরা পড়ে মানুষের মার খেয়ে মারা গেল, কেউ বা পালিয়ে আশ্রয় নিল জঙ্গলে বা অন্য কোনও গ্রামে।
ডান নিজেও মানুষের সেই বেড়াজাল থেকে পালাতে পেরেছিল। ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে কাছাকাছি অন্য একটা গ্রামে পৌঁছে একটা সরাইখানাতে আশ্রয় নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলেছিল। কিন্তু তবুও শেষরক্ষা হল না। মানুষ সেদিন তার রক্ত দেখতে চায়। তাকে অনুসরণ করে একটা বিরাট দল কিছুক্ষণের মধ্যেই সে সরাইয়ের দরজায় পৌঁছে গেল।
বাড়িটাকে ঘিরে রাখা মানুষ আর সেপাইদের মধ্যে দু’জন শক্তপোক্ত লোক অস্ত্র হাতে তার দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা ভেতরে হানা দেবার আগেই একটা গর্জন করে ছুরি হাতে বাইরে ছিটকে এল ডান। কেউ কিছু বোঝবার আগেই ছুরির নির্ভুল আক্রমণে চোখে পলকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দুটো মৃতদেহ।
ঘটনার আকস্মিকতা আর নিষ্ঠুরতায় এক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সরাই ঘিরে থাকা মানুষেরা। সেই মুহূর্তটার সদ্ব্যবহার করল পাকা অপরাধী ডান। মুহূর্তের মধ্যে সরাইয়ের উঠোনে দাঁড়ানো নিজের ঘোড়ার বাঁধন কেটে তার পিঠে সওয়ার হল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকটা হাত উঠে এসে ঘোড়া থেকে আছড়ে ফেলেছিল তাকে, কিন্তু অমানুষিক শক্তিতে সে হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে ফের ঘোড়ায় সওয়ার হল ডান। তারপর তলোয়ার চালিয়ে পথ করে, মানুষের ব্যূহ ভেঙে উধাও হল বাইরের অন্ধকারে।
কিন্তু নিয়তি সেদিন তাকে অত সহজে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। গোটা এলাকা জেগে উঠেছে ততক্ষণে। যেদিকে ছুটতে যায় ডান, অসংখ্য মানুষ হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, লাঠি, যে যা পেয়েছে হাতের কাছে তাই নিয়ে এসে তার পথ রুখে দাঁড়ায়।
তবুও পালাচ্ছিল ডান। একসময় তার ঘোড়াটা মারা পড়ল। তবুও হার মানল না সে। পায়ে হেঁটেই অন্ধের মতো ছুটে গিয়ে একটা ভুট্টার ক্ষেতে ঢুকে পড়ে গা ঢাকা দিল। তার তখন দম ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। তবুও অমানুষিক শক্তির স্বাক্ষর রেখে খোঁজারুদের ফাঁকি দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে আরও প্রায় দু’মাইল পথ পাড়ি দিয়ে যখন ফের নদীর ধারে এসে বেরিয়েছে তখন তার আশা হয়েছিল, এবার বুঝি একটু বিশ্রাম জুটবে কপালে। কিন্তু বাইরে বের হয়ে সে দেখল, প্রায় তিনশো মানুষের একটা দল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে পাহারায় রয়েছে। মশালের আলোয় দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে গোটা এলাকা।
উপায়ন্তর না দেখে ডান এইবার গায়ের জামাকাপড় খুলে ফেলে দিল। তারপর তলোয়ারটা দাঁতের ফাঁকে ধরে ঝাঁপ দিল ঔসের গভীর জলে।
সাঁতরাতে সাঁতরাতেই মাথা তুলে একবার ওপরের দিকে দেখেছিল ডান। সেখানে তখন নদীর পাড় জুড়ে মানুষের সার। আশেপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে মানুষজন বের হয়ে এসে নদীর ধারে থানা দিয়েছে। এই রাক্ষসের শেষ আজ দেখে ছাড়বে তারা। তাদের মধ্যেই কেউ কেউ আবার নদীতে নৌকা নামানোর তোড়জোড় করছিল তখন।
দাঁতে তলোয়ারটা কামড়ে ধরে তীব্র স্রোতের সঙ্গে সাঁতরাতে সাঁতরাতে একসময় বুঝি তার দৈত্যের শরীরেও ক্লান্তির ছোঁয়া লাগল। নদীর মধ্যে ছোটো একটা চর জেগে আছে। সেইটা দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারল না হা-ক্লান্ত মানুষটা। জল ছেড়ে গিয়ে সে উঠল চরের অন্ধকার বুকে। একটু বিশ্রামের আশায়।
কিন্তু তার শত্রুরা তখন বসে নেই। অন্ধকারের মধ্যেই জল চিরে ছুটে আসছিল নৌকোগুলো। তার আরোহীদের সতর্ক চোখ তখন ঠিকই দেখতে পেয়েছে তার জল ছেড়ে চরে গিয়ে ওঠার দৃশ্যটাকে।
তারা চরে পৌঁছোতে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল এন ডানের শরীরে। হাতের তলোয়ার মৃত্যুমুখী হয়ে উঠে ফের একবার ছুড়ে ফেলল তাকে ধরতে আসা লোকজনকে। তাদের ফাঁকি দিয়ে ফের একবার জলে ঝাঁপ দিল ডান।
কিন্তু জলে ভাসতে ভাসতে, নদীর স্রোতে ওলটপালট খেতে খেতে যুদ্ধ করা যায় না। তার ভেসে চলা শরীরটাকে ঘিরে তখন এগিয়ে চলছে নৌকাগুলো। সতর্ক চোখ আর নিপুণ হাতগুলো বইঠা তুলে একের পর এক আঘাত হানছিল তার গায়ে মাথায়। অবশেষে ভারী বইঠার একটা সজোর আঘাত এসে মাথায় লেগে শেষ করে দিল ডান-এর সব প্রতিরোধ। এইবার রক্তাক্ত, অজ্ঞান শরীরটাকে নৌকোয় তুলে আনতে আর বিশেষ অসুবিধে হল না লোকজনের। দীর্ঘ কুড়ি বছরের অন্ধকার রাজত্বের পর অবশেষে ধরা পড়ল রাক্ষসমানুষ ডান।
প্রথমেই তাকে নিয়ে যাওয়া হল একজন ডাক্তারের কাছে। তার জ্ঞান ফিরিয়ে, প্রাথমিক চিকিৎসা করে খানিকটা সুস্থ করে নেয়া হল আগে। তারপর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের দরবারে তাকে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাকে বেডফোর্ড জেলে রাখবার হুকুম দিলেন। কড়া পাহারা বসানো হল জেলের সামনে যাতে ডান-এর সঙ্গীরা তাকে উদ্ধার করবার কোনও ফন্দি না করতে পারে।
দিন পনেরো লেগেছিল ডান-এর মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠতে। তারপর তার শাস্তির দিন এল। কোনও বিচার হয়নি তার। সরাসরি জেল থেকে তাকে নিয়ে আসা হল বেডফোর্ডশায়ারের বাজার এলাকায়। একদিন এইখানেই সে সেই গাড়িওয়ালাকে হত্যা করে নিজের খুনিজীবন শুরু করেছিল।
বাজারের মাঝখানে একটা মঞ্চ বানানো হয়েছে। ওর ওপরে ডানের মৃত্যুদণ্ড হবে। দু’জন জল্লাদ সেখানে অস্ত্র নিয়ে তৈরি। কিন্তু তাদের দেখেও ভয় পাওয়ার কোনও চিহ্নই দেখা গেল না ডান-এর আচরণে। কয়েকদিনের বিশ্রাম ফের তার গায়ের শক্তিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কুড়ি বছর ধরে এই অঞ্চলের অন্ধকারের রাজা হয়ে থাকবার অহংকারও ফিরে এসেছে পুরোপুরি। মঞ্চের ওপর পায়চারি করতে করতে লোকগুলোর দিকে আঙুল তুলে সে বলে, “আমায় শাস্তি দিবি? তোরা? এক পা যদি এগিয়েছিস তাহলে এমন শিক্ষা আমি তোদের দেব যে—”
বলতে বলতেই হঠাৎ দু’হাত মুঠো করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল জল্লাদ দু’জনের ওপর। অসুরের মতো শক্তিতে দু’জনকে মঞ্চের ওপর ঠিক ন’বার আছড়ে ফেলেছিল সে। তারপর আস্তে আস্তে গায়ের জোর ফুরিয়ে এল তার। মঞ্চের ওপর আছড়ে পড়া শরীরটার দু’পাশে লাফিয়ে এসে কবজি থেকে হাতের চেটোদুটোকে কেটে ফেলে দিল তার জহ্লাদরা। তারপর একে একে কনুইয়ে কাছ থেকে তার হাতদুটো, কাঁধের কাছ থেকে দুটো বাহু, একইভাবে ভাগে ভাগে তার পাদুটোকে কেটে ফেলা হল। তারপর মাথাটাকে কেটে ফেলে তার শরীরটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হল। মাথা আর কেটে নেয়া হাত-পাগুলোকে বেডফোর্ড শহরের নানা জায়গায় টাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল সরকারের তরফে। অপরাধীর সাজা কত ভয়ংকর হয় সে নিয়ে মানুষকে সচেতন করবার জন্য।
এমনি করেই শেষ হল ডাকাত ডান-এর জীবন। তারপর কয়েকটা শতাব্দী কেটে গেল। মানুষ ডানকে ভুলে গেল। তার নামটা শুধু বেঁচে রইল ডানস্টেবল শহরের নামটার মধ্যে।
দারুন লাগলো
LikeLike
Bapre.. Ruddhoswash ghatona
LikeLike
বেশ সুন্দর সহজ ভাষা ব্যবহার করে কঠিন সময়কে বোঝানো
LikeLike