টাইম মেশিন ঠগির আত্মকথা অলবিরুনি বসন্ত ২০১৭

আগের পর্বগুলো

time09

।৩১।

    বাড়ি ফিরে গিয়ে আজিমার যা দশা দেখেছিলাম সে কথা বলে আরেক বার নিজেকে দুঃখ দিতে চাইনা আমি। থাক সে কথা।

ফিরে আসবার কয়েকদিন বাদে বাবা একদিন আমায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, চারপাশে শোনা যাচ্ছে, আমাদের ওপরে লোকজনের সন্দেহ হয়েছে। এ গ্রাম আর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। গুজবটা কতটা সত্যি সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও এ ব্যাপারে কোন ঝুঁকি না নেওয়াই উচিত। ঠিক করলাম আমি আর বাবা কয়েকজন লোককে নিয়ে বের হব কাছাকাছি যেসব এলাকায় তখনো ইংরেজ শাসণ ঢোকেনি তেমন কোন জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সিন্ধিয়ার রাজত্বে যেমন আমাদের বেরাদরি লুটের টাকার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ হিস্যা রাজাকে খাজনা হিসেবে ধরে দিয়ে গ্রামে থাকে, নতুন কোন রাজত্বে গিয়ে তেমন কোন ব্যবস্থা করবার ইচ্ছে ছিল আমাদের।

সেই মত বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে কাছাকাছির মধ্যে বুন্দেলখন্ডের বিভিন্ন রাজাদের রাজত্বে ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর শুরু করলাম। পুরনো গ্রাম ছেড়ে বেশি দূরে যাবার ইচ্ছে ছিল না আমাদের।

খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ঝালোনের রাজার সঙ্গে দেখা করা গেল। আমাদের গণেশ জেমাদার তখন তাঁর আশ্রয়ে থাকে। তাকে নিরাপদে থাকবার সুযোগ দেবার বদলে তার লুটের টাকার একটা মোটা হিস্যা রাজা পান। তারই সুপারিশ রাজা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন।

রাজার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হল আমাদের। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন আমাদের আশ্রয় দিয়ে না তাঁর আবার কোন বিপদআপদ হয়। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো আর উপদেষ্টাদের মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে বশ করে ফেলতে অবশেষে রাজার আপত্তি থামল। বছরে তিনশো টাকার খাজনা আর খুব দামি কিছু গয়নাগাঁটি লুট করলে তার হিস্যা, এই শর্তে রফা হল। ঠিক হল বাবা এলাকায় নিজের পরিচয় লুকোবার জন্য ঝালোনের রাজধানীর কাছাকাছি তিনটে গ্রামের জমিদারি নিয়ে সেখানে চাষবাসের কাজ করবে।

কথাবার্তা শেষ হলে রোকরিয়াদের থেকে পাওয়া জিনিসপত্র থেকে একটা মুক্তোর মালা, আমার তলোয়ারটা আর আরো কিছু জিনিসপত্র মিলে সবশুদ্ধু পাঁচ হাজার টাকার নজরানা দিয়ে আমরা ফিরলাম। বাবা, কয়েকজন লোককে নিয়ে রয়ে গেল সেখানে সব বিলিব্যবস্থা করবার জন্য আর আমি বাকি দলটা নিয়ে গ্রামের দিকে ফিরলাম আমাদের বাড়ির লোকজনদের নিয়ে আসবার জন্য।

নিজের ছোটবেলার গ্রাম ছেড়ে নতুন জায়গায় যেতে কারই বা ভালো লাগে। এইখানে আমাদের সবার ছোটবেলা কেটেছে, এইখানেই আমরা বড় হয়েছি। গ্রামের লোকজনও ভদ্র ব্যবহারের জন্য আমাদের ভালোবাসত খুব। তবু সব ছেড়ে আমাদের নতুন জায়গায় যেতেই হল। কিন্তু খারাপ লাগলেও  বাবার এই দুরদর্শিতায় আমাদের ধনপ্রাণ রক্ষা হয়েছিল সেবার। কারণ তার শোনা গুজবটা মিথ্যে ছিল না। ইংরেজরা কী করে যে আমাদের খবর পেয়েছিল জানি না, কিন্তু আমরা চলে আসবার কয়েকমাস পর আমাদের মূরনির গোটা পরগণাটা ইংরেজরা আক্রমণ করে। গ্রামের পর গ্রাম একটা একটা করে ধরে সেখানকার ঠগিদের নিকেশ করে দিয়েছিল তারা। বহু নামকরা ঠগি তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ দেয়, বহু ঠগি পালিয়ে গিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শুধু আমাদের মত কিছু অল্প যারা আগেভাগে অন্য ডেরা খুঁজে নিয়েছিল তারা বেঁচে যায়।

এরপর আমি নিজেও একটু সাবধান হলাম। যতদিন জমা টাকা হাতে আছে ততদিন বিনা কারণে নতুন কোন ঝুঁকি নেবার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না। দ্বিতীয় অভিযান সেরে ফেরবার সঙ্গেসঙ্গেই আমায় ‘সুবেদার’ উপাধিটা দেয়া হয়ে গিয়েছিল। ঠগিদের মধ্যে সেটাই সর্বোচ্চ উপাধি। ফলে টাকাপয়সা আর সম্মান দুটোই তখন আমার হাতে এসে গেছে। তিনটে গ্রামের জমিদারীর থেকেও রোজগার মন্দ হত না আমাদের। জমিদারী চালাবার কাজে বাবাকে সাহায্য করে, হেসেখেলেই দিন কাটছিল আমাদের। ঠগিগিরি তখন কিছুদিনের জন্য একেবারে বন্ধ আমাদের দলের।

শুধু একজনের এমন শান্ত জীবন মোটেই পছন্দ হছিল না। সে হল গণেশ জেমাদার। মাঝেই মাঝেই সে জেদ ধরত তার সঙ্গে নতুন অভিযানে বের হতে হবে। আমি তাতে মত দিতাম না। শান্তিতে থাকতে ভালোই লাগছিল আমার। এই গণেশ জেমাদারকে দেখলে আমার ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হত। তার সামনে এলেই আমার মনে হত এর সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখা হয়েছে। ভীষণ যন্ত্রণার একটা ভুলে যাওয়া স্মৃতি বারবার আমার মাথার ভেতরে ধাক্কা দিয়ে জেগে উঠতে চাইত। লোকটার চেহারা বেশ শক্তিশালী। মুখটা ভয়ংকর। দেখলে বুকের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে। তবে তার কথা এখন থাক। যথাসময়ে গণেশের কথা ফের বলা যাবে।

বছরতিনেক এইভাবে সুখেশান্তিতে কাটল আমাদের। তিনটে গ্রামের জমিদারি ততদিনে বেড়ে সাতটা হয়েছে। গত অভিযানের সময় আজিমার একটা মেয়ে হয়েছিলো। সে এখন ভারী সুন্দরী হয়ে বড় হয়ে উঠছে। আর কোন ছেলেপিলে হয়নি আমাদের। চতুর্থ বছরে এসে আমাদের দুঃখের দিন শুরু হল। রাজা কী কারণে হঠাৎ সন্দেহ করলেন আমরা তাঁকে ঠকাচ্ছি। কাজেই ভয় দেখাতে শুরু করলেন যে আমাদের তিনি ধরিয়ে দেবেন। সেইসঙ্গে আবার সে বছর দারুণ খরা হয়ে ফসলটসল কিছু হল না। রাজা কিন্তু তাতে না দমে আমাদের কাছ থেকে সাতটা গ্রামের পুরো খাজনাই আদায় করে নিলেন। ফলে জমা টাকাপয়সা যা ছিল সব ফুরিয়ে এল একেবারে। বাধ্য হয়েই আমি তখন নতুন অভিযানের কথা ভাবতে বসলাম।

দল গড়তে গিয়ে নতুন মুশকিল শুরু হল। আমাদের দলটা তখন ভেঙেচুরে ছড়িয়ে গেছে দূর দূরান্তরে। তাদের খুঁজেপেতে আনতে সময় আর টাকা দুটোই নষ্ট হবে অনেক। ঠিক এই সময় জনরব উঠল, নামকরা পিন্ডারি নেতা চিতু নাকি বিরাট একটা দল জুটিয়ে দশেরার পর থেকে ইংরেজ রাজত্বে ঢুকে লুটপাট করবার ছক করছে। কথাটা শুনে ইস্তক আমার খুব আগ্রহ হচ্ছিল। পেশায় না হলেও মানসিকতায় আমি আসলে একজন সৈনিক। সামনাসামনি লড়াই করায় আমার খুব আগ্রহ আছে। ভাবলাম, কয়েকটা বাছাই লোক আর ভালো ঘোড়া নিয়ে যদি চিতুর দলের কোন একটা শাখায় ভিড়ে যেতে পারি তাহলে ঠগি অভিযান করলে যা পাব তার চেয়ে লাভ বেশি বই কম হবে না। বিশেষ করে সে’বছর পিন্ডারিদের দল পথে বের হবে; ধরতে পারলে তারা কাউকেই ছেড়ে কথা কয় না। ঠগি থেকে মহারাজা কারো নিস্তার নেই তার হাতে পড়লে। তাছাড়া ঠগিদের সঙ্গে তাদের বিশেষ একটু শত্রুতাও আছে।

পীর খান আর মোতিরাম তখনও আমাদের কাছাকাছি আছে। তাদের ডেকে পরিকল্পনাটা বলতে তারা এককথায় রাজি। তখনো তাদের কাছে টাকাপয়সা কিছু বেঁচে আছে। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা ঘোড়াটোড়া, বর্মচর্ম কিনে নিয়ে এসে হাজির হল। সঙ্গে আরো পাঁচজন বাছাই করা লোকও জুটিয়ে এনেছে। তবে মুশকিল হল, সে লোকগুলোর ঘোড়া নেই। পায়ে হেঁটে পিন্ডারিদের দলে গেলে কোন লাভ হবে না। শেষে উপায় না দেখে আমি গিয়ে রাজাকে ধরে পড়লাম। রাজা আমায় বিশেষ স্নেহ করতেন। ফলে অল্প কসরতেই রাজি হয়ে গেলেন তিনি। ঠিক হল রাজার আস্তাবল থেকে পাঁচটা ঘোড়া ধার পাব আমরা। অভিযান থেকে ফিরে আসবার পর ঘোড়ার বাজারদরের দ্বিগুণ হারে ধার শোধ দিতে হবে তাঁকে। সাজগোজসহ প্রত্যেকটা ঘোড়ার দাম ধরা হল তিনশ টাকা করে।

ঘোড়া জোটাবার কয়েকদিনের মধ্যে সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়ে গেল আমাদের। গ্রাম ছাড়বার আগে, ঠগি অভিযানে যাবার আগে যেসব পুজোপাঠ হয় ঠিক সেইরকমভাবেই পুজোপাঠ সেরে দৈবি সংকেত নেয়া হল। দেখা গেল সব সংকেত শুভ। খুশি মনে রওনা হয়ে গেলাম আমরা।

কয়েকদিনের মধ্যেই চিতু পিন্ডারির শহর নেমাওয়ারে পৌঁছে দেখি গোটা জায়গাটা সারা হিন্দুস্তান থেকে আসা হরেক চেহারা আর পোশাক-আশাকের সেপাইতে থিকথিক করছে। বড়োসরো লুটপাটের সুযোগ মেলবার আশায় রোজই আরো লোক এসে পৌঁছোচ্ছে দলে দলে।

পৌঁছোবার পর প্রথমেই আলাপ হল চিতুর এক বিশ্বস্ত সর্দার, গফুর খানের সঙ্গে। লোকটার হিংস্র মুখেচোখে পিন্ডারি শব্দটা যেন বড় বড় করে লেখা।  যোদ্ধা হিসেবে তার খুব সুনাম। চিতুর দলে ঢোকবার আগে দোস্ত মহমদ আর কুরীম খানের দলেও কাজ করেছে নাকি সুনামের সঙ্গে। সে-ই আমায় সঙ্গে করে চিতুর দরবারে নিয়ে গেল। আমার সেরা পোশাকটা পরে গিয়েছিলাম আমি। চিতুর সামনে নিচু হয়ে তলোয়ারের বাঁটটা এগিয়ে দিয়ে সম্মান জানিয়ে বললাম, আমি ঝালোনের একজন সৈয়দ। তার দলে যোগ দিতে এসেছি।

চিতুও দেখলাম আমাকে বেশ সম্মান দেখাল। আমার চেহারাটা তার বেশ মনে ধরেছে বোঝা যাচ্ছিল। বলে, “ঝালোন? তার মানে তুমি তো অনেক দূর থেকে এসেছ হে? ভালো, ভালো। আমার দলে স্বাগত। যে কোন বীরপুরুষের জন্যই সবসময় আমার দলের দরজা খোলা। আমার কাছে কাজ করবার নিয়ম টিয়ম জেনেই এসেছ নিশ্চয়! আমি মাইনেপত্র কিছু দিই না। লুটপাট যা করবে তার মধ্যে আমার প্রাপ্য একটা অংশ আমায় বুঝিয়ে দিয়ে বাকি সব তোমার থাকবে। আমার প্রাপ্য কতটা সেটা তুমি লোকজনের কাছেই জেনে নিও। আশা করি আমায় ঠকাবে না। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি জোচ্চোর নও।”

“নিয়মকানুন আমি সব জেনেই এসেছি,” আমি জবাব দিলাম, “তবে একটা অনুরোধ আছে। আমার সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু এসেছে যারা আপনার দলে যোগ দিতে চায়। হুজুর যদি অনুমতি দেন তো তাদের আমি পেশ করতে পারি।”

“নিশ্চয় দেখব, তবে এখন নয়। সন্ধের সময় মাঠে এস। সেখানেই আমি তোমার তোমাদের সবার সঙ্গে আলাপ করব আর তোমাদের ঘোড়াটোড়াগুলোও দেখে নেব একবার। সে’সব দেখবার পর বাহিনীতে তুমি কী পদ পাবে সেটা ঠিক করব।”

এই চিতু সর্দারের মত মানুষ আমি বেশি দেখিনি। যেমন গায়ে শক্তি, তেমন তার সাহস আর দম। তাকে দেখে দলের লোকেরা সবসময় আরো বেশি কাজ করবার উৎসাহ পেতো সবসময়। অনেকবার এমন হয়েছে যে সারাদিনের পথচলায় ক্লান্তিতে আমরা যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে টলে পড়বার দশায়, চিতু তখন , যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গীতে তার ঘোড়াটাকে দৌড় করানো শুরু করেছে। লোকটার যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত মরাটা উচিত ছিল, কিন্তু ভাগ্যের সঙ্গে কারো কোন জোর তো খাটে না। বড় করুণভাবে মৃত্যু হয়েছিল তার। তবে সে গল্প এখন নয়।

চিতুর দরবার থেকে বের হয়ে গফুর খান আমায় বলল, “শহরের বাইরে যে বড় মাঠটা আছে,বিকেলবেলা তোমার লোকজনকে নিয়ে সেইখানে হাজিরা দেবে। খেয়াল রেখো ঘোড়াগুলো যে ভাল অবস্থায় থাকে। তোমার লোকজনের পোশাক আশাক যেন ঠিকঠাক হয়। আমি চেষ্টা করবো তোমাকে আমার রিসালায় ঢুকিয়ে নিতে। জান তো, আমার রিসালা হচ্ছে লুটপাটে সবার সেরা। চাইকি আমার রিসালার শ দুশো লোকের সর্দার বানিয়ে দেবারও চেষ্টা করে দেখতে পারি। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি নেতা হবার জন্যই জন্মেছ।”

“আমিও মনেপ্রাণে তাই চাই,” আমি জবাব দিলাম, “আপনি যদি আমায় একটু দেখেন তাহলে আমার সে স্বপ্নটা পূরণ হতে পারে। আমি আগে কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে যাইনি বটে, কিন্তু আপনার কাছে থাকলে শিখে নিতে সমস্যা হবে না।”

সেখান থেকে ফিরে গিয়ে আমি তাড়াতাড়ি দলের সবাইকে ঠিকঠাকভাবে তৈরি করে নিয়ে মাঠের দিকে রওনা হলাম। ঘোড়া আর মানুষ সবাই তখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করে বেশ তাজা হয়ে উঠেছে। পরিদর্শনের জন্য আমি নিজে সবজি খানের বর্মচর্ম আর তলোয়ার দিয়ে সাজলাম। মাঠে পৌঁছে দেখি সেখানে তখন শ’খানেক ঘোড়সওয়ার এসে জমা হয়ে গিয়েছে।

সূর্য অস্ত যাবার বেশ খানিক আগেই চিতু শহর থেকে বের হয়ে পরিদর্শনের মাঠে চলে এল। তাকে ঘিরে ছিলো তার বিশ্বস্ত সর্দারের দল। সবার আগে আগে আসছিলো আপাদমস্তক বর্মে মোড়া গফুর খান।তাকে দেখলেই আন্দাজ করা যায় কতবড় বীর সে। তার দিকে দেখিয়ে আমি পীর খানকে বললাম, “ওই দেখ। ওর কাছেই আমরা কাজ করব।”  বলতে বলতেই আমি আমার অধৈর্য হয়ে ওঠা ঘোড়াটাকে পা দিয়ে টোকা মেরে দৌড় করিয়ে এগিয়ে গেলাম চিতুর দিকে। তার কাছে পৌঁছে হাতের তলোয়ারটাকে একেবারে নিচু করে জিনের ওপর থেকে কোমরের কাছে মাথা নুইয়ে বললাম, “আপনার আদেশ মুতাবিক বান্দা হাজির হুজৌর। এখন হুকুম করুন।”

ঘোড়াটাকে ভালো করে দেখি নিয়ে চিতু হাসিহাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাঃ বাঃ। তুমায় দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভালো কাজ দেবে তুমি। সঙ্গের লোকজনও তো বেশ ভালোই। এমন বেশ কিছু লোক পেলে আমার বড় সুবিধে হত হে।” বলতে বলতে পাশ ফিরে বলে, “কী হে গফুর খান। একে তোমার দলেই নেবে তাহলে? শ’কয়েক লোক হবে নাকি মীর সাহেবের হাতে দেবার জন্য?”

“নিশ্চয় হবে হুজুর,” গফুর খান হাঁক দিয়ে বলে উঠল, “দেখে তো মনে হচ্ছে সাক্ষাত রুস্তম! আমি প্রথমবার দেখেই বলেছিলাম– ”

“তাহলে যাও, ওকে তোমার হাতেই দিলাম। খেয়ালটেয়াল রেখো একটু–”

গফুর খুশি খুশি মুখে আমার দিকে ফিরে বলল, “এসো হে মীর সাহেব, এখানে কারো থেকে একটা লম্বা খেলার বল্লম নাও দেখি। চলো, তুমি কেমন বাহাদুর তার একটু পরীক্ষা নিয়ে নিই।”

বললাম, “আমি তলোয়ারবাজি জানি। মাটিতে দাঁড়িয়ে তলোয়ার হাতে আমি দুনিয়ার যেকোন মানুষের মহড়া নিতে পারি। তবে ঘোড়ায় চড়ে বল্লমের খেলা আমার জানা নেই। কিন্তু তাতে আমি ভয় পাই না। আসুন–”

আমি একজনের কাছ থেকে একটা বল্লম জোগাড় করে নিলাম। জিনিসটা একটা লম্বা বাঁশের ডান্ডা। তার মাথায় তুলোর একটা বল গোঁজা আর সরু সরু কাপড়ের ফিতে লাগানো।

মাঠে এসে আমাদের দুটো ঘোড়াই একে অন্যকে ঘিরে ক্রমাগত পাক খেতে লাগল। ঘোড়ার পিঠ থেকে আমরা বল্লম নিয়ে পরস্পরকে খোঁচা মারবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম,কিন্তু কেউই কাউকে ছুঁতে পারছিলাম না। আমাদের ঘিরে বাকি ঘোড়সওয়াররা বেশ কৌতুহল নিয়ে হিন্দুস্তানের সেরা যোদ্ধার সঙ্গে একেবারে অপরিচিত একজন নতুন যোদ্ধার কশরত দেখছিলো। একেকবার একজন যখন অন্যজনের আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে জটিল একটা ভঙ্গী করে ঘোড়া নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায় অমনি চারপাশে সাবাশ সাবাশ শব্দ ওঠে। এমনিভাবে বেশ খানিকক্ষণ চলবার পর একবার হঠাৎ ঘোড়া পিছিয়ে নিতে সামান্য দেরি হওয়ায় গফুর খানের বল্লম আমার হাতটাকে ছুঁয়ে  দিতেই সে ছোটা থামিয়ে বলল, “আমি জিতে গেছি।”

বললাম, “আর এক হাত হবে নাকি?”

সে বলল, “সাবধান হে ছোকরা। আবার মুখোমুখি হলে আমি কিন্তু অত সহজে ছেড়ে দেব না তোমায়। পাঁজরাতে দু একটা খোঁচা খেলে নতুন যোদ্ধাদের বেশ ভালো শিক্ষা হয় জানো তো?”

উত্তরে আমি কিছু না বলে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আক্রমণের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গফুর খান এইবার দেখি সর্বশক্তি নিয়ে আমার ওপর আক্রমণ শানাচ্ছে। তবে তার ঘোড়াটা আমার ঘোড়ার চেইয়ে একটু মোটা হওয়ায় তার আক্রমণগুলো আমি এড়িয়ে যেতে পারছিলাম। খানিকক্ষণ এইভাবে আমার ওপর আক্রমণ চালাবার পরে যেই দেখলাম তার ঘোড়াটা একটু ক্লান্ত হয়েছে অমনি আমি পালটা আক্রমণে গেলাম। কয়েকবার তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ শানিয়ে খেয়াল করলাম গফুর খান রেগে উঠছে। একটা নতুন ছেলের হাতে এমন হেনস্থা হতে তার মোটেই ভালো লাগছে না। খুব শিগিগিরই সে তিতিবিরক্ত হয়ে সবকিছু ভুলে আমার দিকে তেড়ে এল সোজা। আমি হঠাৎ আমার ঘোড়াটার মুখ একপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে গফুর খানের ঘোড়াটার পেটবরাবর তাক করে বল্লমটা চালিয়ে দিতে সেটা গিয়ে সটান তার বুকে লাগল।  ধাক্কাটা বেশ জোরেই লেগেছিল তার। চারদিকে তখন সাবাশির ঝড় উঠেছে। হতভম্ব অবস্থাটা কাটিয়ে উঠে গফুর খানও সেই চিৎকারে যোগ দিল। বলে, “মীর সাহেব আপনি আমায় ঠকিয়েছিলেন। এ খেলায় আপনি তো ওস্তাদের ওস্তাদ। অথচ বলছিলেন এ খেলা আপনার জানা নেই!”

timemachinethogi01-medium

আমি বললাম, “আমি কোরাণ ছুঁয়ে বলতে পারি আমি আগে কখনো বল্লম হাতে নিয়ে দেখিনি। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা ঘটে গেছে। আপনার বেশি লাগেনি তো?”

“না হে, আমার তেমন কিছু লাগেটাগেনি। তবে তলোয়ারেও যদি তোমার এমন হাত হয় তাহলে এখানে এমন কোন লোক তো দেখি না যে তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবে।”

আমি বললাম, “অহংকার করছিনা, তবে  চিতু হুজুর যদি ইচ্ছা করেন তাহলে কাল সকালে আমি কিছু মহড়া নিয়ে দেখাতে পারি।”

চিতু খুশি হয়ে বলে, “বেশ বেশ।” অন্যরাও দেখি এ ব্যাপারে বেজায় উৎসাহ দেখাচ্ছে। ঠিক হল পরদিন চিতুর বাড়িতে তলোয়ারের খেলার পরীক্ষা হবে আমার।

তৃতীয় পর্ব

।৩২।

    পরদিন বিকেলে একটা ছোট মাঠে ফের আমাদের জমায়েত হল। চিতু পিন্ডারিদের প্রথা মেনে মাঠের একপাশে একটা কার্পেট বিছিয়ে তার সর্দারদের নিয়ে সেখানে বসেছে। চোখেমুখে তার বেশ কৌতুহলের ছাপ। আমি আসতে আমাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসাল। সামনে মাঠের ওপর দুজন শক্তপোক্ত চেহারার রাজপুত তখন ঢাল আর কাঠের তলোয়ার নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে লড়ছে। কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না অবশ্য।

    “কী হে এদের দিয়ে চলবে?” চিতু আমায় প্রশ্ন করল।

আমি বললাম,“এদের মধ্যে যাকে আপনি বলবেন হুজুর–”

“সাবধান। চেহারাগুলো দেখেছ তো? দেখো, আবার গোহারা হেরে বোসো না।”

উত্তরে আমি বললাম, “আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো হুজুর।”

পীর খান একটা কাঠের তলোয়ার আর বেতের ঢাল জোগার করেই রেখেছিলো। সেগুলো হাতে নিয়ে আমি ময়দানে নেমে পড়লাম। তার আগেই গায়ের জামাটা খুলে রেখে একটা রুমাল দিয়ে কোমরে কষে বেঁধে নিয়েছি। মাঠের মধ্যে দুই রাজপুতের একজন বসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আমায় আসতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। চারপাশে লোকজন দেখি ফিসফাস করছে খুব। লোকটার মুশকো চেহারার পাশে আমার হালকা-পলকা চেহারাটা দেখে তাদের তখন ধারণা হয়েছে এর সঙ্গে এঁটে ওঠা আমার কর্ম নয়। এ খেলায় গায়ের জোরের চেয়েও দক্ষতার দাম যে অনেক বেশি সে কথা এরা ততটা জানে না বলে মনে হচ্ছিল আমার।

মাঠের মাঝখানে এসে পৌঁছে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বললাম, “নিয়মটা কী হবে? প্রথম যে অন্যকে ভালোরকম একটা ঘা দিতে পারবে সে জিতবে, তাইতো?” 

সে বলল, “রাজি। তবে আমি বেশ জোরে মারবো কিন্তু। সাবধান!”

“ভালো কথা,” আমি জবাব দিলাম, “এবার তৈরি হও।”

সে একপাশে সরে গিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আমায় ভালো করে দেখে নিল, তারপর তলোয়ার নাচিয়ে নাচিয়ে আমায় ঘিরে পাক খেতে খেতে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি কিন্তু জায়গা ছেড়ে একচুল নড়লাম না। তলোয়ারটা উঁচুও করলাম না। লোকটা ভেবেছিলো আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে শুরু করবো বুঝি। আমার দাঁড়িয়ে থাকাদেখে সে একটু ঘাবড়ে গেল প্রথমে। তারপর হাতের তলোয়ার মাথার ওপর উঁচিয়ে দুই লাফে কাছে এসে আমার মাথা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালিয়ে দিল।

আমি পুরোপুরি তৈরি ছিলাম এই আক্রমণটার জন্য। এমন আক্রমণ বেশির ভাগ সময়েই ঘটে থাকে। ঢালটা উঁচিয়ে আমি তার আঘাত ঠেকালাম, তারপর ঢাল দিয়েই তার তলোয়ারটাকে আটকে ধরে রেখে আমার কাঠের তলোয়ার দিয়ে তাকে এমন মার মারলাম যে সে অনেকদিন তা মনে রাখবে। চারদিকে তখন হাততালির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এইবার অন্য রাজপুতটা এগিয়ে এসে আমাকে সেলাম করে বলে, “ভীম সিংকে তো বেকায়দায় পেয়ে হারিয়ে দিলেন। এবার আমার সঙ্গে এক হাত হয়ে যাক, কী বলেন?”

এই লোকটা দেখা গেল আমার লড়বার কায়দাটা চেনে।তার সঙ্গে তলোয়ারবাজি করতে করতে আমার মনে হচ্ছিল যেন সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি আবার, আবার আমার অস্ত্রবিদ্যার গুরুর সঙ্গে লড়ছি। কিন্তু গুরুকে আমি পরের দিকে বারংবার হারিয়েছি, কাজেই এই লোকটাকেও আমার ভয় ছিল না। খানিক লড়বার পরেও কেউ যখন কাউকে ছুঁতে পারলাম না, তখন দুজনেই লড়াই ছেড়ে একটু বিশ্রাম নিতে বসলাম। তখন চিতু উঠে দাঁড়িয়ে বলে “যথেষ্ট হয়েছে। দুজনেই ভালো লড়েছ। কেউ কাউকে হারাতে পারো নি। আজ এই পর্যন্তই থাক।”

“না খোদাবন্দ,” আমি বললাম, “আমাদের মধ্যে একজনকে আজ জিততেই হবে। আমার এই বন্ধুটিও তাই চায়।”

রাজপুতটি হাসতে হাসতে বলে, “নবাবসাহেবের হাত বটে একখানা। আপনার গুরু কে বলুন তো! আমার সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিতে পারে এমন কাউকে এই প্রথম দেখলাম।”

“ঠিক আছে,” চিতু হাত উলটে বলল, “তবে দেখো, এর থেকে আবার দুশমনি না তৈরি হয়ে যায় দুজনের মধ্যে।”

আবার অনেকক্ষণ লড়াই চলল আমাদের, কিন্তু কেউ কাউকে আর ছুঁতে পারি না। দু একবার দুজনেরই পা পিছলেছে। দুজনেই তা সামলে নিয়েছি। লোকটার দম আমার চেয়ে বেশি। কাজেই একটা সময় খেয়াল করলাম আমি যতটা ক্লান্ত হয়েছি সে ততটা হয়নি। আমি তখন লড়াইয়ের কৌশল বদলালাম। আক্রমণ বন্ধ করে দিয়ে আমি আত্মরক্ষা করতে লাগলাম শুধু, আর তারই মধ্যে সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। লোকটা ভাবল এইবারে আমায় বাগে পেয়েছে। ঝড়ের বেগে আঘাতের পর আঘাত করতে করতে কখন যে তার একটা পাশ অরক্ষিত রেখে দিয়েছে তার খেয়াল নেই। মুহূর্তের মধ্যে আমার কাঠের তলোয়ার গিয়ে গুঁতো মারল তার খোলা পাঁজরের গায়ে। এত জোরে মেরেছিলাম যে সবাই সে শব্দটা শুনতে পেয়েছিল সেদিন। লোকটার দম বন্ধ হয়ে গেছিল এক মুহূর্তের জন্য। তলোয়ারটা সত্যিকারের হলে ওই এক ঘায়ে তার শরীরটা নিঃসন্দেহে দুটুকরো হয়ে যেত সেদিন।

“দারুণ দারুণ,” বলে সাবাশি দিয়ে উঠল  চিতু। তারপর রাজপুতের দিক তাকিয়ে বলে, “রামদিন সিং, তুমি আজ হেরে গেছ কিন্তু এই হারে কোন লজ্জা নেই।”

রাজপুতটি শুনে একগাল হাসল। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা সবাই জানো তলোয়ারবাজিতে আমার ক্ষমতা কতটা। সেই আমাকে এ আজ হারিয়ে দিয়েছে। অতএব সাবধান। মীরসাহেবের সঙ্গে পারতে কেউ লাগতে এসো না কখনো।”

আমি চিতুর দিকে ঘুরে বললাম, “আমার একটা প্রার্থনা আছে খোদাবন্দ। যদি অভয় দেন তো বলি।”

“বলো, কী চাই।”

“এই দুজন রাজপুতকে আমায় দিন। আপনার দয়ায় আমি একটা সৈন্যদলের সর্দার হতে চলেছি। সেই দলের মধ্যে এঁর হাতে পঞ্চাশ জন আর ভীম সিং-এর হাতে পঁচিশজন সেনার দায়িত্ব আমি দিতে চাই।”

“ভালো কথা। তাই হোক তবে,” বলতে বলতে গফুরের দিকে ঘুরে চিতু বলল, “দেখো গফুর খান, এরা যা চাইছে সব যেন ঠিকঠিক পায়। বিপদের সময় এরাই আমাদের ভরসা হবে।”

ক্রমশ

ছবিঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের টাইম মেশিনের লাইব্রেরি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s