নিউস্ক্রিপ্ট
১২০টাকা।
লেখিকা সম্পর্কে প্রকাশক অমিতানন্দ দাশ জানাচ্ছেন, “তিনি সুদীর্ঘকাল ধরে সুন্দরবনের এক একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক। আপন উৎসাহে কখন যেন নিজেকেই উৎসর্গ করে ফেলেছেন সুন্দরবনের কাছে।”
কাঠুরিয়াদের সাথে ঘুরে জেনেছেন মাটি চেনা, গাছ চেনা, মৌলেদের থেকে শিখেছেন মৌচাক খুঁজে বের করার কৌশল, চাক কাটার পদ্ধতি, মধু সংরক্ষণের কৌশল, জেলেদের কাছ থেকে চিনেছেন নদী, খা্ বিল, শিখেছেন মাছ-কাঁকড়া ধরার পদ্ধতি, বোটের হাল ধরা আর নৌকো চালানো। বাঘসুমারি ছাড়াও অলিভ রিডলে, হক্সবিল আর বাটাগুর বাসকা, সামুদ্রিক কচ্ছপদের নিয়েও তার তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
সাড়ে তিন দশক সুন্দরবনে, সে বড়ো কম কথা নয়। তবে বাঘ কুমীর সুন্দরবন পড়তে পড়তে সব ছাপিয়ে আমার মনে হয়েছে, সুন্দরবনের জঙ্গলের প্রতি, তার গাছেদের প্রতি, সেখানকার মানুষ সহ প্রতিটি প্রাণীর জন্য তুমুল মায়া মমতা ভালোবাসা না থাকলে এমন লেখা হৃদয়ে ধারণ করা যায় না। লেখা তো তার অনেক পরে।
বাঘকে আমরা ভয় পেতেই শিখেছি, অথচ সন্তানের মতো তাকে ভালবাসার ওম দেওয়া যায় সেকথা এই বই পড়ে জানলাম, এর আগে আমি জানিনি। নইলে কেই বা ভেবেছে খাঁচায় আটক আহত বাঘের কাছে গিয়ে ক্রমাগত গলার আওয়াজে তাকে শুশ্রুষা দেবার কথা! কে ভেবেছে ক্রমাগত তাকে বলা, ও বাবু জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কী করব, আরেকটু কষ্ট কর সোনা আমার …বাঘও যেন বুঝতে পারে, অশান্ত বাঘ মাথা নিচু করে বুঝে নেয় তার মানুষ মায়ের সমব্যথী স্বর।
অথবা হঠাৎ গ্রামের পুকুরে চলে আসা নদীর বিশাল কুমীরকে ফের ধরে নিয়ে আবার নদীতে ছেড়ে দেবার সময়, কিছুতেই নড়াতে না পেরে লঞ্চের ওপর মানুষ-মায়ের অস্ফুট গলার আওয়াজেই কাজ হয়, আলতো স্পর্শে বনের ভয়াল সরীসৃপ এক লহমাতেই বুঝে ফেলে এবারে তাকে জলে নেমে যেতে হবে। কত সহজে কতো গভীর উপলব্ধির কথাগুলি গল্পের আড়ালে ঠাঁই পেয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যথেষ্ট নয়।
গরিব মানুষগুলির প্রতিও অনুরাগ কম কিছু নেই। মকবুল চাচা, চাঁদনি, মৌলেদের সদ্য বিয়ে হয়ে আসা বউটা, সদানন্দ, আক্রম, গোবিন্দ, করুণা, প্রকাশ, লক্ষণ, আবদুল – মানুষের মিছিল। আর হ্যাঁ পেটের তাড়নায় জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাওয়া, গভীর জঙ্গলে চাক ভেঙে মধু আনতে যাওয়া, চিংড়ির মীন, কাঁকড়া ছেঁকে তোলা, খাঁড়িতে ঢুকে মাছ ধরা এসবের মধ্যে ওঁত পেতে থাকা বড়ো শেয়াল। দক্ষিণ রায়- এর করুণায় জঙ্গলের গভীর থেকে রুজিরুটির জোগাড়। তবু হলুদ মৃত্যুর চকিত লাফ চলতেই থাকে। জীবনের পাশাপাশি মর্মান্তিক মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকে। অসতর্ক মুহূর্তে বাঘের শিকার হয় জঙ্গলে যাওয়া মানুষ। কয়েক মুহূর্ত মুহ্যমান থাকে সে, আবার জঙ্গল ডেকে নেয় তাকে, অসীম সাহসে বইতে থাকে জীবন।
এমনি নানান ঘটনার সাবলীল বর্ণনা বইটিতে। সহজ সুন্দর গল্প বলার ঢংটি মুখের ভাষার কাছাকাছি, আর প্রতিটা শব্দের মধ্যেও অসীম মায়া টের পাওয়া যায়, এমনই প্রকাশের ভঙ্গী। টুকরো টুকরো গল্প হলেও, একজন অবলোকনকারী আছেন বইটিতে, তিনি ফটোগ্রাফার অনীক। জঙ্গল ভালোবাসার আরো একটি মানুষের সাথে আলাপ করিয়ে দেন লেখিকা। অজান্তেই অনীককে আমাদের খুব ভালো লেগে যায়, অনীক আমাদের খুব আপন হয়ে ওঠে। সুন্দরবনের মানুষের সুখে দুঃখে সেও যে জড়িয়ে পড়ে, তাদের দুঃখে আনন্দে যে তার মনে জোয়ার ভাঁটা খেলা করে, তাই তাকে আপন না করে আমাদেরই বা উপায় কি?
একটা জিনিস পরিষ্কার। লেখিকার আস্তিনে এমন গল্পের ভান্ডার অফুরন্ত, তার শিরায় উপশিরায় সুন্দরবনের জল, হাওয়া, মানুষ, জঙ্গল। এ বইটুকু সবে তার ভূমিকা মাত্র। আমরা পাঠকেরা অপেক্ষায় থাকব, নাকি ওঁৎ পেতে?
আলোচনা করেছেনঃ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়