নতুন বই
এইসময়ের পনেরজন একলব্যের কাহিনি
জয়দীপ চক্রবর্তী
পাঁচ হাজারেরও কিছু বছর আগের কথা। এক কিশোর একা অরণ্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে একের পর এক তির নিক্ষেপ করে চলেছে। তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি নেই। তীর নিক্ষেপে এই আঙুলটিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ব্যতিরেকে প্রকৃত ধনুর্ধর হওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু পরিশ্রমে ঘাটতি নেই তার এতটুকু। যা নেই তা নিয়ে হা হুতাশের বদলে প্রাণপণ প্রচেষ্টা আর অলৌকিক মানসিক শক্তির জোর নিয়ে সে নিজেকে প্রমান করার সাধনায় ব্যাপৃত। সেই কিশোরের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হবার দীর্ঘলালিত স্বপ্নকে একদিন ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে দেবার জন্যে গুরুদক্ষিণা হিসেবে গুরু দ্রোণাচার্য চেয়ে নিয়েছিলেন তার দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। অথচ মনে মনে তাঁকেই গুরু মেনেছিল সেই কিশোর। একলব্য তার নাম। দ্রোণের মৃত্তিকামূর্তি সামনে রেখে একা একাই পরিশ্রম আর অনুশীলনের নিবিড়তায় নিজেকে এক অদ্ভুত উচ্চতায় উত্তীর্ণ করেছিল একক প্রচেষ্টায়। সে উচ্চতা এমনই যে তা দেখে দ্রোণের প্রিয় শিষ্য রাজপুত্র অর্জুন পর্যন্ত ভীত, লজ্জিত, অভিমানী এবং শঙ্কিত। এই অনার্য কিশোর যে ধনুর্বিদ্যায় তার থেকেও উন্নত! দ্রোণাচার্য প্রিয় শিষ্যকে খুশি করতে কৌশল করলেন।
নিশ্চিন্ত দ্রোণাচার্য এবং অর্জুন ভেবেছিলেন অতঃপর এই প্রতিবন্ধী কিশোর যুদ্ধক্ষেত্রে মহারথীদের সম্মুখীন হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল চিরকালের জন্যে। তার অক্ষম হাত আর কোওদিনই শরাসণ আকর্ষণ করে তীর নিক্ষেপ করতে পারবে না নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। কিন্তু একলব্য দমে গেলেন না। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছাড়াই তর্জনি ও মধ্যমার সহায়তা নিয়ে দুরন্ত তীরন্দাজ হয়ে উঠলেন কিছুকালের মধ্যেই। অক্ষম, অকর্মণ্য, এক প্রতিবন্ধী ও করুনার পাত্র হয়ে ওঠার বদলে মহাভারতে এই কিশোর হয়ে উঠেছিল প্রতিনায়ক। তার বিশেষ ক্ষমতার সৌজন্যে।
হাল আমলের কিশোর সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র রাজা রায়চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্ট কাকাবাবুর একটি পা অকেজো। অথচ কখনও হার না মানা মানসিকতা আর জেদ তাঁকে বাঙালি কিশোরদের আইকন বানিয়ে দিয়েছে। ক্রাচ নিয়েও আসমুদ্রহিমাচল দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি অনায়াসে ও রাজকীয় আত্মমর্যাদায়।
বাস্তবের পৃথিবীতেও এমন বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের অভাব নেই। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে যাঁরা হেলায় বাউন্ডারি লাইনের বাইরে বের করে দিয়েছেন। নকল পা নিয়ে মঞ্চে নাচের অনুষ্ঠান করেছেন, দৌড়েছেন ট্র্যাকে, সাঁতরে পার হয়েছেন ইংলিশ চ্যানেল। এইসব অসংখ্য হেলেন কেলার, মাসুদুর রহমান, যাঁরা আমাদেরই চারপাশে ছড়িয়ে আছেন, যাঁরা শরীরের আপাত অক্ষমতাকে অতিক্রম করে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হয়ে সমাজের আর পাঁচজন আপাত সক্ষম মানুষকেও সাফল্য ও কর্মদক্ষতায় ছাপিয়ে যেতে পেরেছেন তাঁদের নিয়েই ‘পত্রভারতী’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুধা মেনন এবং ভি আর ফেরোস রচিত ‘গিফটেড’। বাংলা ভাষায়।
এই বইটিতে বর্ণিত হয়েছে এমনই পনেরোজন আধুনিক একলব্যের কাহিনি, প্রতিবন্ধকতা যাঁদের হারিয়ে দিতে পারেনি। অসীম মানসিক জোর আর জেতার অকৃত্তিম ইচ্ছে তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। এইসব মহাজীবনের কাহিনি আমাদের চমৎকৃতই শুধু করে না, আমাদের প্রাণিতও করে। ছোট থেকে বড়, নিম্নবিত্ত থেকে ধনী, স্কুল পড়ুয়া থেকে উচ্চশিক্ষিত, সমস্ত ক্ষেত্রের মানুষের কাছেই বইটি অবশ্যপাঠ্য বলে মনে হয়েছে আমার। এমন একটি কাজের জন্যে লেখক সুধা মেনন এবং ভি আর ফেরোস আমাদের প্রণম্য হলেন। এ বিষয়ে ধন্যবাদ প্রাপ্য পত্রভারতী প্রকাশনা গোষ্ঠীরও। বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে যত্ন করে এই বইটি পরিবেশিত করার জন্যে। আর ধন্যবাদ এই বইয়ের বাংলা রূপান্তরকারী শ্রীমতি চুমকি চট্টোপাধ্যায়কে। ভাষান্তর করতে গিয়ে শুধুমাত্র ট্রানস্লেশনের একঘেয়েমি অনায়াসে অতিক্রম করেছেন তিনি তাঁর প্রাঞ্জল এবং ঝরঝরে প্রকাশভঙ্গীর মধ্যে দিয়ে। তাঁর বর্ণনা এতই মনোগ্রাহী যে বইটি পড়তে পড়তে অধিকাংশ সময়ে মনেই হয়নি এটি মৌলিক নয়, অনুবাদ লেখা। আন্তরিক উচ্চারণে যেভাবে এই গ্রন্থটিতে তিনি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের গল্প শুনিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
পরিশেষে একটিই কথা বলার আছে। সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে অত্যন্ত ওপরের দিকে থাকা এই বইটির নির্মাণ পরিকল্পনা, এবং প্রচ্ছদ যথেষ্ট আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও বইটিতে ব্যবহৃত কাগজ এবং ছাপার মান আর একটু উন্নত হবার অবকাশ ছিল। বইটির গুরুত্বের কথা ভেবে পরবর্তী সংস্করণে আশা করা যায় প্রকাশক মহাশয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত নজর দেবেন।
‘গিফটেড’ সুধা মেনন এবং ভি আর ফেরোস
ভাষান্তর চুমকি চট্টোপাধ্যায়
পত্রভারতী
দামঃ একশ পঁচাত্তর টাকা ।
জয়ঢাকের সমস্ত বুক রিভিউ আর বই নিয়ে লেখার লাইব্রেরি– বই পড়া