বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
গল্পটা আমার বড়োমামার মুখ থেকে শোনা। আজ থেকে বহুবছর আগের কথা। বড়োমামা তখন দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং থানার ‘বড়বাবু’। চারদিক সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যভরা এই পাহাড়ি ছোটো শহরটি। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে ঝর্না, আর তার পাশ দিয়ে একেবেঁকে চলে গিয়েছে টয়ট্রেনের লাইন। সেই সময় কার্শিয়াং জায়গাটি এখনকার মতো এতটা জমজমাট ছিল না। এখানে বেড়াতে আসা লোকেদের থাকবার জন্য হাতে গোনা কয়েকটি হোটেল আর কয়েকটা দোকানপাট। খুন, জখম, রাহাজানি, ছিনতাই সেই অর্থে এখানে নেই বললেই চলে। থানাতেও কাজের চাপ খুবই কম। একদিন দুপুরবেলা আমার বড়োমামা থানায় ডিউটিতে রয়েছেন। হঠাৎ থানার বাইরে অনেক লোকের কোলাহল। তাদের থেকে যেটা জানা গেল সেটা শুনে সবাই একেবারে হতভম্ব। বড়োমামা থানার মেজোবাবুকে বললেন, “এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে। জিপটাকে বের করতে বলুন আর আপনি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন।”
হাসপাতালে গিয়ে জানা গেল, কিশোর তামাংয়ের অবস্থা আগের তুলনায় একটু ভালো। তাকে এখন ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে আজ রাতে তাকে শিলিগুড়ির বড়ো হাসপাতালে পাঠাবার জন্য। কারণ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার আরও ভালো চিকিত্সার প্রয়োজন।
কার্শিয়াং থেকে একটা সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে আধঘন্টা উপরের দিকে গেলে ছোটো একটা পাহাড়ি গ্রাম। সাত-আট ঘর পরিবার বাস করে এই গ্রামে। পুরুষেরা মালবাহকের আর মেয়েরা চা-বাগানে চাপাতা তোলার কাজ করে কোনওরকমে জীবিকা নির্বাহ করে।
কিশোর তামাং এই গ্রামের ছেলে। বয়স পনেরো, কিংবা ষোলো। পাহাড়ি ছেলে, অত্যন্ত কর্মঠ। দূরে চারদিকের তুষার-আবৃত পাহাড়ের চূড়োগুলো দেখে মনে মনে ভাবে, সেও একদিন তেনজিং নোরগের মতো মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠবে।
প্রতিদিন সকালবেলায় কিশোর তাদের গ্রামের থেকে আরও উপরের পাহাড়ে ভেড়ার পালকে চরাতে নিয়ে যায়। সঙ্গে থাকে তার পোষা একটা রাস্তার কুকুর।
ভেড়াগুলো আপন খেয়ালে ঘাস খাচ্ছে। কিশোর একটা বড়ো গাছের তলায় পাদুটো ছড়িয়ে বসে বিশ্রাম করতে গিয়ে তার একটু ঝিমুনিমতো এসেছিল। হঠাৎ যেন খেয়াল হল, তার ডানপায়ের পাতার কাছে কিছু একটা ভারী জিনিস ঠেকছে। পায়ের পাতায় তাকিয়ে দেখেই কিশোর একেবারে আঁতকে উঠল। পাহাড়ি ছেলে, দেখেই বুঝতে পারল সামনে তার বিরাট বিপদ। এখান থেকে চিৎকার করে ডাকলেও কেউ শুনতে পাবে না তার এই মহাবিপদের কথা। সে দেখল, একটা মোটা অজগর সাপ তার পায়ের পাতাটাকে কামড়ে ধরে রয়েছে। তার লেজটা কোথায় শেষ হয়েছে সেটাও সে বুঝতে পারছে না জঙ্গলের গাছপালার জন্য। কিশোর তামাং মনে মনে ঠিক করে নিল তাকে হেরে গেলে চলবে না। অসীম মনের জোর নিয়ে অজগরটার সঙ্গে তাকে মোকাবিলা করতে হবে। তার দু’হাত দিয়ে অজগরটার কামড়ে থাকা চোয়াল ধরে টেনে পাটাকে ছাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু গায়ের জোরেও সাপটার চোয়াল কিছুতেই ফাঁক করতে পারল না। হঠাৎ দেখল, সাপটা তার পা ধরা অবস্থায় মুখটাকে বেলুনের মতো ফোলাচ্ছে আর একটা নিঃশ্বাসের টানে তার পায়ের আরও কিছুটা অজগরটার মুখের ভেতরে চলে যাচ্ছে। অন্যসময় তার কোমরে একটা ভোজালি গোঁজা থাকে। আজ সেটা আনতেও ভুলে গেছে।
এরপর অজগরটা মাঝে মাঝে মুখটাকে বেলুনের মতো ফোলাচ্ছে আর সাপটার নিঃশ্বাসের টানে পায়ের একটু করে অজগরটার শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কিশোর খুব ভালোভাবেই জানে, এইভাবে পাহাড়ি অজগরগুলো বড়ো বড়ো জন্তুজানোয়ারগুলোকে যদি একবার ঠিকমতো ধরতে পারে, তবে পুরোটাই গিলে নেয়। সে অজগরটার আচরণ দেখে বুঝতে পারছে, এরপর তার কী অবস্থা হতে পারে। কিন্তু সে তখনও তার মনোবলকে অটুট রেখে বাঁচার জন্য প্রাণপণে লড়াই করে যাচ্ছে। একটা সময় অজগরটা মুখটাকে বেশ বড়ো করে ফুলিয়ে আর শক্তি সঞ্চয় করে তাকে টেনে নেবার চেষ্টা করছে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য।
হঠাৎই কিশোরের তার পোষা কুকুরটার কথা মনে পড়ে যেতে সে কুকুরটাকে তার মতো করে ডাকা শুরু করল। কুকুরটা আশেপাশে কোথায় হয়তো ছিল। কুকুরটা এসে বোধহয় বুঝতে পারল, তার মনিব বিপদে পড়েছে। হঠাৎ করেই কিশোরের পোষা কুকুরটা অজগর সাপটার মুখের উপর তার ধারালো পায়ের নখগুলো দিয়ে আঁচড়াতে শুরু করল। কিছুক্ষণ এই ধারালো নখ দিয়ে আঁচড়ানোর ফলে কিশোর অনুভব করল অজগরের চোয়ালটা তার পা কামড়ে ধরার থেকে একটু আলগা হয়েছে। এই সুযোগে কিশোর দেরি না করে আরও মনের জোর সঞ্চয় করে তার হাতদুটো দিয়ে অজগর সাপটার চোয়ালটাকে ফাঁক করেই মুখের ভেতর থেকে পাটাকে টেনে বের করে ফেলল। পা থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। এই অবস্থায় কোনওরকমে টলতে টলতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তায় নেমে দূরে একটা জিপগাড়ি দেখেই অজ্ঞান হয়ে গেল। জিপটা ছিল বনদপ্তরের। তারাই কিশোরকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।
মাস তিনেক হাসপাতালে থেকে পায়ে একটা অপারেশন করে কিশোর সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরে। বাড়িতে আসার পর সে থানায় আসে দেখা করতে। প্রয়োজনীয় কথা হয়ে যাবার পর হঠাৎই আমার বড়োমামাকে উদাস হয়ে বলে, “স্যার, আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে এভারেস্ট অভিযানে যেতে পারব তো? স্যার, আমার জীবনের স্বপ্ন, আমিও একদিন তেনজিং নোরগের মতো বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরের চূড়ায় উঠে দেশের পতাকা পুঁতব।”
আমার মামা তাকে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই পারবে। যদি তোমার মনের জোর, অধ্যবসায় আর কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকে তাহলে কোনও বাধাই তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না। তুমি জয়ী হবেই হবে।”