অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
বামনের দেশ
চায়নার এক গ্রামের চল্লিশ শতাংশেরও বেশি মানুষ বামন। বিদেশীদের যেতে দেওয়া হয় না এই গ্রামে। রহস্যময় এই গ্রামের কথা জানিয়েছেন অরিন্দম দেবনাথ
তিব্বত মালভূমির অংশ দক্ষিণ পশ্চিম চায়ানার সাইচুন (Sichun) প্রদেশ পুরোটাই পাহাড়ি। চির সবুজ গাছে ছাওয়া উঁচুনিচু পাহাড়ের ঢাল। অধিকাংশ পাহাড়ের চূড়া মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে বছরভর। আর মেঘের দেশ ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে যাওয়া পাহাড়চূড়াগুলো বরফের মুকুট পরে থাকে সর্বক্ষণ। হিমবাহ থেকে নির্গত বিভিন্ন নদী এই সাইচুন উপত্যকাকে করেছে উর্বর। ধান, গম সহ প্রচুর ফসল ফলে এই অঞ্চলে। এছাড়া এই অঞ্চলে ফলের চাষ হয় বহুল পরিমাণে। বিশেষত লেবু, পেয়ারা, পিচ, আঙুর।
আখ চাষে চায়নায় এগিয়ে আছে সাইচুন। উৎকৃষ্ট মানের মশলা বিশেষত গোলমরিচ প্রচুর জন্মায় এখানকার পাহাড়ি ঢালে। সারা দেশের শুয়োরের মাংসের চাহিদা অনেকটাই মেটায় সাইচুনের খামারগুলো। রেশমের সুতো তৈরির জন্য গুটিপোকার চাষ হয় এখনকার গ্রামে গ্রামে। ১৩২ ধরনের খনিজ পদার্থের পর্যাপ্ত ভাণ্ডার রয়েছে এখানকার মাটির তলায়।
চায়নায় প্রাপ্ত খনিজ সম্ভারের ৫০ শতাংশের বেশি ভ্যানাডিয়াম, টাইটেনিয়াম, লিথিয়াম, খনিজ লোহা এখানকার মাটির তলায় সঞ্চিত। এছাড়াও এখানকার মাটির তলায় আছে বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার। প্রকৃতি যেমনি অকৃপণভাবে সাজিয়েছে এই অঞ্চলকে তেমনি দু’হাতে ঢেলে দিয়েছেন ঐশ্বর্য।
ঐশ্বর্য ডালিকে কাজে লাগিয়ে চায়নার বিশাল বিশাল শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে এই প্রদেশের নানা প্রান্তে। গড়ে উঠছে অনেক লৌহ-ইস্পাত কারখানা। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, আসবাবপত্র তৈরি, সিল্কের কাপড় তৈরির অসংখ্য কারখানা। এছাড়াও এই সাইচুন প্রদেশে আছে বিমান ও সামরিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কারখানা। সাইচুনের অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে সারাবছর প্রচুর পর্যটক বেড়াতে আসেন এখানে।
এহেন সাইচুন প্রদেশের একটা ছোট গ্রাম ইয়াংসি (Yangsi) পৃথিবীজোড়া তাবড় বৈজ্ঞানিকদের নজর কেড়েছে। এই গ্রামের চল্লিশ শতাংশের বেশি মানুষ বেঁটে-বামন। প্রতি আশিজন গ্রামবাসীর ছত্রিশজনের উচ্চতা দু’ফুট এক ইঞ্চি থেকে তিন’ফুট দশ ইঞ্চি। এই ছোট উচ্চতার মানুষের জন্য এই গ্রামের বিশ্ব জোড়া পরিচিতি বেঁটে বামনের গ্রাম ‘ভিলেজ অফ ডোয়ার্ফ।’
১৯৫১ সালে ইয়াংসির এই বিচিত্র রোগের কথা চায়নার ডির্স্টিক্ট গেজেটিয়ারে প্রকাশ পায়। জানা যায় ওই গ্রামে জন্মানো অধিকাংশ শিশুরই শরীরের বৃদ্ধি জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিকৃতি দেখা দিচ্ছে এবং শরীরের বৃদ্ধি ঘটছে না। মানুষগুলো হয়ে থাকছে বামন। ১৯৮৫ সালে এক সরকারি সমীক্ষায় জানা গেল ওই গ্রামে বেঁটে বামনের সংখ্যা ১১৯। শুধু তাই নয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে একই ঘটনা ঘটছে। ২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় জানা গেছে ৮০ জন গ্রামবাসীর মধ্যে ৩৬ জন বামন।
বেঁটে হবার জন্য দায়ী জিনঘটিত জটিলতা। পূর্ণবয়স্ক মানুষের বৃদ্ধি চার ফুট নয় ইঞ্চিতে আটকে থাকলেই তাকে বামন বলে ধরা হয়। বামন মানুষদের গড় উচ্চতা চার ফুট দুই ইঞ্চি।
মূলত দু’ধরনের বামন মানুষ হয়।
এক)এদের শরীরের কিছু অংশ সাধারণ মানুষের মত বা তার থেকে আকারে বড় আর কিছু অংশ অস্বাভাবিক ছোট। এদেরকে বলে অসমঞ্জস বামন – ডিসপ্রোপরসানেট ডোয়ার্ফ (disproportionate dwarfism)
দুই) এদের অঙ্গপ্রতঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু শারীরিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক মানুষের মত হয় না। এদেরকে বলে সামাঞ্জস্য বামন – প্রোপরশনেট ডোয়ার্ফ (proportionate dwarfism)
চায়নার বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা ইয়াংসিতে গিয়ে সেখানকার জল, মাটি, খাদ্য সব পরীক্ষা করেও এমন কিছু বৈসাদৃশ্য খুঁজে পেলেন না, যাকে এই গ্রামের অধিকাংশ লোকেদের বেঁটে হবার কারণ বলে ধরা যেতে পারে। বেঁটে হবার যুক্তি, রহস্য হয়েই রইল।
চায়না সরকার এই গ্রামের অস্তিত্ব অস্বীকার না করলেও, বিদেশীদের এই গ্রামে ও এই অঞ্চলে ঢুকতে দিতে নারাজ। এই গ্রাম বাইরের জগতের মানুষের জন্য নিষিদ্ধ। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ছবি ও এই অঞ্চলের প্রচলিত কিছু গল্পগাথা শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে চায়নার বাইরের বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডঃ কারেল রবিন (Dr. Karyl Robin) এই দুর্গম উপত্যকায় বেশ কয়েকশো বেঁটে-বামনের দেখা পেয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু তার কিছুকাল পর থেকেই এই অঞ্চল বিদেশীদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তারও আগে ১৯১১ সালে এই অঞ্চলে বেঁটে বামনদের আধিক্যের খবর এসেছিল।
বেঁটে-বামন দেখা পাওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়। প্রতি কুড়িহাজার মানুষে একজন বেঁটে হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে এক সাথে এতগুলো বেঁটে মানুষ জন্মানো উল্লেখযোগ্য ঘটনা বইকি। এটা কোনমতেই দৈবঘটনা হতে পারে না। কিন্তু কারণটা যে কী সেটাই তো আঁধারে! ১৯৯৭ সালে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের একটা তত্ত্ব খাড়া হল। কিন্তু তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না। বিষাক্ত গ্যাসের আরও একটা তত্ত্ব হাজির হল। বলা হল জাপানীরা যখন এই অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল তখন তারা বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করেছিল যার ফলশ্রুতি মানুষের শরীরের এই বিকৃতি। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন জাপানীরা কখনও এই অঞ্চলে আসেইনি। কাজেই এই মতবাদও গ্রহণযোগ্য হল না। তাই স্বভাবতই বাকি রইল উপকথা।
স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করে তাদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী অশুভ শক্তি। প্রচলিত মতের একটি হল, প্রাচীনকালে তাদের কোন পূর্বপুরুষের মৃত্যুর পর ঠিকমত তার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম না করার ফলশ্রুতি এই অভিশাপ। আবার আরও একটি মতবাদ হল, বহু বছর আগে ওয়াং নামের এক গ্রামবাসী একটি অদ্ভুত পা-ওয়ালা কালো রঙের কচ্ছপ ধরেছিল। গ্রামের অনেকেই বলেছিল কচ্ছপটাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কচ্ছপটাকে ছেড়ে না দিয়ে গ্রামের কিছু লোক মিলে কচ্ছপটাকে মেরে ঝলসিয়ে খেয়ে নিয়েছিল। তারপর থেকেই নাকি এই গ্রামে নতুন জন্মানো শিশুদের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছিল। আরও একটি বিশ্বাস হল গ্রামের বাস্তু ঠিক নেই। চীনারা বাস্তুতন্ত বা ফেনশুইকে খুব মান্য করে।
বেঁটে বামন শিশুর জন্মানো এড়াতে ওই গ্রামের অনেকে পরিবারই গ্রাম ছেড়ে অন্য অঞ্চলে পাড়ি জমাচ্ছে। হয়ত ভবিষ্যতে জানা যাবে বেঁটে হবার রহস্য।
চিত্র সৌজন্য ; রেক্স ফিচার / কুইরকি চায়না নিউস