ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
লগারিদ্মিক টেব্লের জনক : জন নেপিয়ার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
পড়শিরা বলত লোকটা নাকি কালো যাদু জানে। গায়ে কালো পোশাক, মাথায় কালো ফেট্টি বাঁধা। আবার সে নাকি দিনরাত ঘাড় গুঁজে লেখাপড়া করে। মাঝেসাঝে খাতায় কীসব বিচিত্র আঁকিবুঁকি কাটে। এদিকে আবার নাকি বেজায় পয়সাকড়ির মালিক, থাকে বিশাল এক প্রাসাদোপম বাড়িতে। প্রতিবেশীরাও তাই কিছুটা যেন সমীহ করে চলে মানুষটাকে।
এ অঞ্চলের লোক অবশ্য বেশ ধনী। তবে কালো যাদুকরের মতো সম্পত্তি নেই কারো। বিশাল চেহারার যাদুকর একদিন রেগে কাঁই – নিজের জমির শস্য তার বাড়ির উঠোনে শুকোতে দিলে নাকি প্রতিবেশীর পায়রাগুলো রোজ খেয়েদেয়ে সাফ করে দেয়। এই নিয়ে, লোকটা একদিন বেজায় রেগেমেগে, “তোমার পায়রাদের আমি দেখে নেব,” বলে প্রতিবেশীকে শাসাল। পায়রাদের মালিক তো হেসেই খুন। পায়রাদের কী আর করে নিতে পারে লোকটা!
পরদিন সকালে দেখা গেল, কালো যাদুকরের শস্য খেতে এসে পায়ারাগুলো আর নড়াচড়া করতে পারছে না। ওড়ার চেষ্টা করেও কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে।
আসলে সে কোনও যাদুকর ছিল না। তার ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি। রোজ রোজ শস্য খেয়ে যাওয়ার জন্য পায়রাগুলোকে একটু শাস্তি দেওয়ার জন্য, সে কেবল নিজের বুদ্ধির সাহায্য নিয়েছিল। নিজের শস্যগুলো মদে ভিজিয়ে, ছড়িয়ে রেখেছিল উঠোনে। আর যেই না পায়রাগুলো শস্য খেয়েছে, ওমনি তারা মাতাল হয়ে আর নড়াচড়া করতে পারেনি। এরপর কী হয়েছিল জিজ্ঞেস কর না। কারণ এ বিষয়ে আর কোনও বিশদ তথ্য কারো জানা নেই।
কালো যাদুকর আসলে ছিলেন এক খ্যাপাটে বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ – জন নেপিয়ার, লগ টেব্লের আবিষ্কর্তা হিসাবে যাঁর কথা গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা চিরকাল মনে রাখবে। মদে ভেজানো শস্য ছড়িয়ে রেখে দুষ্টু প্রতিবেশীদের নাজেহাল করাই শুধু নয়, নানারকম উদ্ভট কান্ডকারখানা করে কালো যাদুকর হিসাবে বাজারে বেশ দুর্নাম ছিল জন নেপিয়ারের।
১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে, স্কটল্যান্ডের এডিনবর্গ শহরে, এক ধনী পরিবারে জন নেপিয়ারের জন্ম হয়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি স্কুলের পরীক্ষা শেষ করে সেন্ট এ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকে পড়াশুনোতে মাথাটা বেশ সরেস ছিল তাঁর। অঙ্কের দিকে বেজায় ঝোঁক ছিল। পারিবারিক পরিস্থিতিতে তাঁকে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনো করতে হয়েছিল। সেই সময়ে স্কটল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। রাজনীতির সঙ্গে মিশে ছিল ধর্ম। যদিও চতুর্দশ শতাব্দীতেই স্কটল্যান্ড ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে ইংল্যান্ডের রাজারা স্কটল্যান্ডের উপর আধিপত্য কায়েম করার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর, স্কটল্যান্ডের পার্লামেণ্ট রানীর উপর চাপ দিতে থাকে প্রটেস্টাণ্ট ধর্মকে রাজকীয় ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিতে। এদিকে ইংল্যান্ডের রাজ পরিবার রোমান ক্যাথলিকের সমর্থক। তাই ইংল্যান্ডের শাসকেরা নানারকম ফন্দিফিকির খুঁজত, কীভাবে জোর করে স্কটল্যান্ডের অধিবাসীদের রোমান ক্যাথলিক বানিয়ে দেওয়া যায়! তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল স্কটল্যান্ডের উপর আধিপত্য খাটিয়ে সেখানকার সম্পদ লুট করা। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ ততদিন স্কটল্যান্ডের মানুষ পেয়ে গেছে। কাজেই খুব সহজে ইংল্যান্ডের বশ্যতা শিকার করার পাত্র তারা ছিল না।
এই অস্থির সময়ে, একটানা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে জন্ম নিয়ে, নানা টানাপড়েনের মধ্যে বড় হতে থাকেন জন নেপিয়ার। ইল্যান্ডের সঙ্গে ধর্মযুদ্ধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে কূট তর্কবিতর্ক লেগেই থাকত। নেপিয়ার নিয়মিত সেই সব বিতর্কে সক্রিয়ভাবে যোগ দিতে থাকেন। কোনও বিশেষ কারণে হটাত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনো ছেড়ে তিনি পাড়ি দেন ইউরোপে। সুইজারল্যান্ড তখন স্কটিশ ছাত্রদের লেখাপড়ার বৃন্দাবন। নেপিয়ার সুইজারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। অনুমান করা হয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশ, যেমন ইতালি, জার্মানি ও হল্যান্ডেও তিনি গিয়েছিলেন। ফলত ইউরোপিয়ান ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন এবং শিল্প সংস্কৃতি, জন নেপিয়ারকে সব দিক থেকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
বিদেশে পড়াশুনো শেষ করে মাত্র একুশ বছর বয়সে যখন নেপিয়ার স্কটল্যান্ডে ফিরে আসেন, দেশে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। একদিকে স্কটল্যান্ডের রানী প্রটেস্টান্টদের মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন জনমতের চাপে, অন্যদিকে বালক রাজা জেমসকে সমর্থন করছে সৈন্যবাহিনীর আর এক দল। ফলে সৈন্যবাহিনী দুই দলে বিভক্ত। নেপিয়াররা থাকতেন স্কটল্যান্ড রাজপ্রাসাদের পিছনে মার্চিস্টন দুর্গে। জন নেপিয়ারের অভিজাত পরিবার, দুই বিবাদ রত দলের মধ্যে সাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নেপিয়ার পরিবারকে একরকম গৃহবন্দী অবস্থায় দিন কাটাতে হয়।
দুই সৈন্য দলের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে নেপিয়ারদের মার্চিস্টন দুর্গের প্রভূত ক্ষতি হয়। অতি অল্প বয়সে জন নেপিয়ার তার চোখের সামনে যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেন। যুদ্ধাবস্থা স্থিত হয় ১৫৭৩ সালে, রাজা জেমসের সমর্থকেরা জিতে গেলে। জন নেপিয়ারের বাবা আর্চিবল্ড নেপিয়ার, নাইট উপাধির পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অতিরিক্ত সম্পত্তির অধিকারী হন।
জন নেপিয়ারের সঙ্গে একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের বিয়ে হওয়ায়, তিনি পৈত্রিক সম্পত্তির সঙ্গে স্ত্রীর সম্পত্তিরও মালিক হন এবং নিজের এস্টেট গার্টনেসে বসবাস করতে থাকেন। সুন্দর বাগান ঘেরা নতুন এস্টেটের মালিক হয়ে, জন নেপিয়ার তার অবসর সময় বিজ্ঞান চর্চায় নিয়োগ করেন – হয়তো কিছুটা হলেও সঙ্গোপনে। বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধর্মতত্ত্ব নিয়েও কাজ করতে থাকেন।
গৃহযুদ্ধের ফলে স্কটল্যান্ডে কৃষি ক্ষেত্রের প্রভূত ক্ষতি হয়। এই দেশের প্রধান শস্য ভুট্টা ও বার্লি উৎপাদন কমে যায়। নেপিয়ার কৃষিক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থার উন্নতির কাজে মন দেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের উদ্ভাবিত ‘আর্কিমিডিস স্ক্রু’ সংশোধন করে নেপিয়ার স্কটল্যান্ডে সেচ ব্যবস্থায় সেই যন্ত্র ব্যবহার করেন। বিভিন্ন প্রকার চাষের মাটির জন্য উপযুক্ত লবণের মিশ্রণের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এক তালিকা প্রস্তুত করে প্রকাশ করেন, যা চাষিদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। গবাদি পশুদের চারনক্ষেত্রে ঘাসের উৎপাদন বাড়ানো হয় নেপিয়ারের ফর্মুলা ব্যবহার করে।
রসায়ন শাস্ত্র চর্চা করবার জন্য বেশির ভাগ সময়ে জন নেপিয়ার গৃহবন্দী হয়ে থাকতেন। ফলে সাধারণ মানুষের ধারণা হয়, নেপিয়ার তার বাড়িতে বসে কালো যাদু প্রয়োগ করেন। এই ধারনার অন্যতম কারণ ছিল তার অন্তর্মুখী স্বভাব ও কালো পোশাক আশাক। জানা যায়, তার চলা ফেরা ছিল কিছুটা সন্দেহজনক। কালো যাদু করার অপরাধে সেই সময়ের প্রথা অনুযায়ী যে কোনও লোককে বিচারে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হত। কিন্তু যেহেতু জন নেপিয়ার স্কটল্যান্ডের রাজার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং চার্চেও তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল, তাঁকে কোনোদিন অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
একবার নেপিয়ারের এস্টেটে কিছু জিনিষপত্র চুরি যায়। নেপিয়ারের সন্দেহ পড়ে তাঁর চাকরবাকরের উপর। অসংখ্য চাকরের মধ্যে থেকে চোরকে ধরার এক অপূর্ব রাস্তা বার করেন নেপিয়ার। নেপিয়ারের এক পোষা বড়সড় কালো মোরগ ছিল। তিনি চাকরদের জানিয়ে দেন যে তার এই মোরগটি সাধু আর অসাধু মানুষের তফাত বোঝে। তাই যদি কোনও অসাধু লোক মোরগের গলায় হাত দেয়, তবে তার হাত কালো হয়ে যায়। এবার নেপিয়ার করলেন কী, তিনি মোরগের গলায় কালো কালি মাখিয়ে সেটাকে একটা অন্ধকার ঘরে বেঁধে রাখলেন, আর চাকরদের বললেন এক এক করে সেই ঘরে ঢুকে মোরগের গলায় হাত বুলিয়ে বাইরে চলে আসতে। দেখা গেল, একটিমাত্র লোকের হাত পরিষ্কার। ব্যস চোর ধরা পড়ে গেল। আসলে নেপিয়ারের জানা ছিল যে, আসল চোর মোরগের গলায় হাত দিয়ে হাত কালি করতে ভয় পাবে। কিন্তু নির্দোষ ব্যক্তি ভয় না পেয়ে নিশ্চিন্তে মোরগের গলায় হাত বুলাবে এবং তার হাত কালো হয়ে যাবে।
কোনও সমস্যার উদ্ভট সব সমাধান চকিতে করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন জন নেপিয়ার। সেই কারণে মানুষ তাকে সমীহ করে চলত। স্কটল্যান্ডে একটা লোক ডাকাতি করে বেশ বড়লোক হয়ে গিয়েছিল, তার নাম ছিল রবার্ট লোগান। সে একবার নেপিয়ারের কালো যাদুর খ্যাতি শুনে তাকে চেপে ধরল – পাহাড়ের উপরে এক পরিত্যক্ত দুর্গে লুকানো সোনা খুঁজে দিতে হবে। সোনা খুঁজে পেলে, কোন অনুপাতে সেই সোনা নিজেদের মধ্যে ভাগ হবে, তার খতিয়ান তৈরি করেন নেপিয়ার নিজে। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই সোনা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নেপিয়ারের জীবনীকারেরা মনে করেন, নেপিয়ার লোভী কোনোদিনই ছিলেন না। হয়তো লোগানের ডাকাতে জীবনের কথা তার জানা ছিল না এবং সে বিষয়ে জানতে পেরে তিনি সোনা উদ্ধারের কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
১৫৮৮ সালে স্পেন ইল্যান্ডকে আক্রমণ করার জন্য সেনা পাঠায়। নেপিয়ার ঠিক সেই সময়ে একটি ধর্মপুস্তক প্রকাশ করেন, যাতে তিনি অঙ্ক কষে দেখিয়ে দেন, ঠিক কোন তারিখে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে আর নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার কাজ করবে ভগবান। স্কটল্যান্ডে তখন প্রটেস্টান্টদের রমরমা। জন নেপিয়ার প্রটেস্টান্টদের সমর্থক। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, ছোটবেলা থেকে যুদ্ধের পরিবেশে বেড়ে ওঠায়, নেপিয়ারকে যুদ্ধের আতঙ্ক ঘিরে ধরে। তাই তিনি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার নিয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু আসলে তার মধ্যে বাস করত এক বিজ্ঞানী। তাই তিনি স্পেনের আক্রমণ থেকে বাঁচার অগ্রিম কল্পনা করে কিছু যুদ্ধাস্ত্রের পরিকল্পনা করে ফেলেন। এই যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে আজকের দিনের ট্যাঙ্ক ও সাবমেরিনের তুলনা করা যায়। প্যারাবোলিক আয়না ব্যবহার করে সূর্যের আলো ঘনীভূত করে যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে দেওয়ার স্কেচ জমা করেন স্কটল্যান্ডের রাজার দরবারে।
বিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্রের সমস্ত ডিজাইন নেপিয়ারের নির্দেশে তার মৃত্যুর আগেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। নেপিয়ার তাঁর এই নির্দেশের কারণ হিসাবে বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়ার মতো অনেক যুদ্ধাস্ত্র অনেক আগে থেকেই মানুষের কব্জায় আছে, তাই আর নতুন কোনও মারণাস্ত্রের দিশা তিনি মানব সমাজকে দিতে চান না।
ষোড়শ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের জগতে অনেক নতুন আবিষ্কার হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন পথের সন্ধান দেন কোপার্নিকাসের মতো বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের ঘটনাবলী বিশ্লেষণে অঙ্কের ব্যবহার ও বিকাশ আবশ্যক হয়ে পড়ে। এদিকে স্পেন ও পর্তুগালের দুঃসাহসিক অভিযাত্রীরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন নতুন দেশ আবিষ্কারে। তাদের ক্ষেত্রেও দিকনির্ণয় যন্ত্র ব্যবহারে অঙ্কের গণনা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই জটিল অঙ্ক সহজে সমাধান করা যেত না।
১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে জন নেপিয়ার তাঁর বিখ্যাত বই – “Mirifici Logarithmorum Canonis Descriptio” প্রকাশ করেন। এই বইটিতে নব্বই পাতার লগারিদ্মিক টেব্ল এবং সেই টেব্ল ব্যবহার করার ছত্রিশ পাতার নির্দেশ দেওয়া হয়। লগারিদ্মিক টেব্ল ব্যবহার করে লম্বা লম্বা গণনা চটজলদি করে ফেলার রাস্তা দেখান নেপিয়ার। এই বইটিতে এরিথম্যাটিক প্রগ্রেশন এবং জিওমেট্রিক প্রগ্রেশনের মধ্যে সম্বন্ধ ও সেই সম্বন্ধের ফল লগারিদ্মিক ও এন্টি লগারিদ্মিক টেব্লের উদ্ভব সম্বন্ধে আলোচনা করেন নেপিয়ার। বইটি ল্যাটিন ভাষায় লেখা হয়। এই টেব্ল ব্যবহার করে বড় সংখ্যার বর্গফল, ঘনফল ও অন্যান্য ঘাত সহজে এবং কম সময়ে গণনা করা সম্ভব হয়। সেই সময়ে বেশির ভাগ বৈজ্ঞানিক তথ্য ল্যাটিন ভাষায় লেখা হত। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর, লন্ডনের গ্রেশাম কলেজের গণিতের অধ্যাপক হেনরি ব্রিগস স্বয়ং এডিনবর্গে এসে জন নেপিয়ারের সঙ্গে দেখা করেন এবং আলোচনা করে লগারিদ্মিক টেব্লের আরও উন্নয়ন করেন, যা আজকের দিনে সারা পৃথিবীতে লগারিদ্মিক টেব্ল হিসাবে পরিচিত।
লগারিদ্মিক টেব্ল বৈজ্ঞানিক গণনার কাজ সহজ করে দিতে জন নেপিয়ার গণিত ও বিজ্ঞান মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে নেপিয়ার ‘Rabdologiae’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন, যাতে ক্যাল্কুলেটিং রড, প্রমচুয়ারি ডিভাইসের সন্ধান পাওয়া যায়। ক্যাল্কুলেটিং রডকে বলা হয় নেপিয়ার বোন্স। এটি আসলে চার কোনা যুক্ত কাঠের তৈরি রড, যাতে লেখা সংখ্যা দেখে বড় বড় যোগ বিয়োগ গুন ভাগ সহজেই করে ফেলা যায়। নেপিয়ারের আগেও হাতির দাঁতের তৈরি এই ধরণের রড ব্যবহার করে গণনা করার চল ছিল, যার পদ্ধতি খুব একটা সহজ ছিল না।
প্রমচুয়ারি ডিভাইস হচ্ছে দুটি চ্যাপ্টা ধাতব পাতের সমন্বয়ে তৈরি, যাতে সংখ্যা লেখা থাকত। এই সরল পদ্ধতি ব্যবহার করে জটিল গুণ ও ভাগ নিমেষে করে ফেলা যেত। আজকের আধুনিক কম্পিউটারে যে বাইনারি কোডের ব্যবহার হয়, নেপিয়ারের বইটিতে তার হদিশ পাওয়া যায়।
১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে জন ৬৭ বছর বয়সে নেপিয়ারের মৃত্যু হওয়ার পর তার উদ্ভূত লগারিদ্মিক টেব্ল আরও জনপ্রিয় হয়। জানা যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল গণনায় নেপিয়ার প্রণীত লগারিদ্মিক টেব্ল ব্যবহার করে গ্রহ নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হন জোহান্স কেপলার। লগারিদ্মিক টেব্ল থেকে উদ্ভূত হয় স্লাইড রুল; দুফুট লম্বা এই রুলটি ইঞ্জিনিয়ারিঙে আজও ব্যবহৃত হয়। গণিতে জন নেপিয়ারের অবদানে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দুনিয়ায় জোয়ার আসে। মার্চিস্টন এস্টেটে ১৯৬৪ সালে এডিনবর্গ নেপিয়ার ইউনিভার্সিটি খোলা হয়। আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় উনিশ হাজার ছাত্র ছাত্রী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিভিন্ন শাখায় পড়াশুনো করে।
তথ্যসূত্র:
1. Beyond Logarithm and Bones – A short history of John Napier and his legacies, by Gary Seath.
2. The Works of John Napier, by Gareth Cronin
3. John Napier and Logarithms, by Tyler Lemings
ছবিসুত্র: ইন্টারনেট