ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
বহুমুখী বিজ্ঞানী এন্ডার মেরি আ্যম্পিয়ার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তেরো বছরের কিশোর এন্ডার মেরি পড়তে পড়তে ভাবছিল, বৃত্তের যে কোনও চাপের সমান দৌর্ঘের সরলরেখা টানার পদ্ধতি কী হতে পারে। কিন্তু এই জ্যামিতির জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (infinitesimal) গণনার কায়দা তার জানা ছিল না। কেননা তখনো সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্যালকুলাসের কোনও পাঠই পড়েনি। আর পড়বেই বা কী করে? সে কোনোদিন স্কুলেই যায়নি! তবে দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না সে মোটেই। তাই তার নিজের চিন্তাভাবনার উপর অগাধ বিশ্বাস রেখে, এই বিষয়ে একটা গবেষণা পত্র লিখে পাঠিয়ে দিল ফ্রান্সের একাডেমী দ্য লিয়নে। গাণিতিক সমাধানে ক্যালকুলাস ব্যবহার না করার অপরাধে একাডেমীর কর্তারা কিশোর এন্ডার মেরির পত্রটি ছাপলেন না। সে হাল ছাড়ল না, বরং আরও মন দিয়ে অঙ্কের জটিল বিষয়গুলো আরও বেশি করে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। এন্ডার মেরির বাবা তাকে অনেক অঙ্কের বই উপহার দিয়ে তার উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিলেন। একদিন তিনি ছেলেকে নিয়ে স্বয়ং উপস্থিত হলেন একাডেমী দ্য লিয়নে। আবদার করলেন তার পরিচিত এক অঙ্কবিদকে – ছেলেকে ক্যালকুলাসের পাঠ পড়াতে হবে। সেই প্রথম অঙ্কের তালিম নিতে শুরু করলেন এন্ডার মেরি। অঙ্কের সাথে সাথে পদার্থ বিজ্ঞানেও তার সমান আগ্রহ দেখা দিল। লিয়ন কলেজে তিনি এই দুটি বিষয় অধ্যয়ন শুরু করলেন।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে ফ্রান্সে শুরু হল ফরাসী বিপ্লব। এন্ডার মেরির পড়াশুনো শিকেয় উঠল। বিপদের এখানেই শেষ নয়, ফরাসী বিপ্লবের বিপ্লবীরা এন্ডার মেরির বাবাকে বিচার করে গিলোটিনে হত্যা করল। এই পারিবারিক দুর্ঘটনায় এন্ডার মেরি অত্যন্ত ভেঙে পড়ে এবং একবছর তার পড়াশুনো মুলতুবি থাকে। হতোদ্যম না হয়ে এন্ডার মেরি স্কুলের বাচ্চাদের অঙ্ক শেখানোর কাজ শুরু করে।
১৮০২ সালে এন্ডার মেরির প্রথম গবেষণষণাপত্র প্রকাশিত হয়। বিষয় ছিল – জুয়া খেলার সংখ্যাতত্ত্ব। তিনি এই পত্রটিতে প্রমান করে দেখান – একজন জুয়াড়ির যদি একজন প্রতিপক্ষ আর প্রচুর সম্পদ থাকে বা বহু প্রতিপক্ষ ও সীমিত সম্পদ থাকে, এই দুই ক্ষেত্রেই সে সীমিত সময়ের মধ্যেই হেরে যাবে। পত্রটি তাকে এত খ্যাতিমান করে তোলে, লিয়নের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অঙ্কের অধ্যাপকের চাকরি পেয়ে যান। খ্যাতিমান এই বিজ্ঞানী এরপর প্যারিসে চলে যান শিক্ষকতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে। এখানে তিনি তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্কের দলিল লেখেন, যার বিষয় ছিল ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস।
১৮২০ সালে পদার্থবিদ অয়ারস্টেড তাঁর ছাত্রদের কিছু পরীক্ষা করে দেখাবার সময় হটাত আবিষ্কার করেন –একটি তারের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ চালিত হলে, কাছাকাছি রাখা কম্পাসের কাঁটার বিচ্যুতি দেখা যায়। সারা ইউরোপ জুড়ে অয়ারস্টেডের এই আবিষ্কার আলোচিত হয়। এম্পিয়ারকে এই আবিষ্কার বিশেষ ভাবে নাড়া দেয় ও তিনি আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে থাকেন। কম্পাসের কাঁটার বিচ্যুতির কারণ হিসাবে এম্পিয়ার বলেন – তারে বিদ্যুৎ প্রবাহ স্থানীয় চুম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। তিনি আরও পরীক্ষা করে দেখেন, দুটি সমান্তরাল তারের মধ্যে দিয়ে একই দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ হলে, তাঁদের মধ্যে আকর্ষণ হয় এবং বিদ্যুৎপ্রবাহ উলটো দিকে হলে বিকর্ষণ হয় (নিচের ছবি দেখলে বোঝা যাবে)। অর্থাৎ এম্পিয়ারের আবিষ্কার জানিয়ে দিল, তড়িৎ প্রবাহ ও চুম্বক শক্তির মধ্যে যোগ আছে। তিনি তাঁর নব আবিষ্কৃত তত্ত্বের নাম দিলে – ইলেক্ট্রো-ডায়নামিক্স, পরবর্তীকালে যার নাম দেওয়া হল – ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজ্ম।
এম্পিয়ার তাঁর নতুন আবিষ্কারের ভিত্তিতে তৈরি করেন গ্যালভানোমিটার, যা বিদ্যুতের পরিমাণ মাপার কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। বিদ্যুৎ শক্তি ও চুম্বক শক্তির পরস্পর নির্ভরতা পদার্থবিজ্ঞানকে অনেকটাই অগ্রসর করে দেয়। এরপর এম্পিয়ার তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ – ‘এম্পিয়ারস সার্কিটাল ল’ হিসাবে পদার্থবিদ্যায় বিখ্যাত সমীকরণ প্রত্যাবর্তন করেন। এই সমীকরণ, চুম্বক ক্ষেত্রের প্রবলতা ও তড়িৎপ্রবাহের মানের সমতা সুত্র দেয়। পরবর্তী কালে জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, এম্পিয়ারের এই সুত্রকে স্থান দিলেন তাঁর বিখ্যাত তড়িৎ-চুম্বকীয় সমীকরণে।
গণিত ও পদার্থবিদ্যা ছাড়াও রসায়নে বিশেষ আগ্রহ ছিল এন্ডার মেরি এম্পিয়ারের। তিনি রাসায়নিক মৌল ফ্লোরিনের আবিষ্কর্তা। মেন্ডেলিভের পর্যায়ক্রম সারণী (periodic table) প্রবর্তনের অনেক আগেই এম্পিয়ার তখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত আটচল্লিশটি মৌলকে তাদের রাসায়নিক ধর্ম অনুযায়ী দলবদ্ধ করার প্রচেষ্টা করেন। যদিও তাঁর এই কাজে প্রচুর ভুলভ্রান্তি ছিল, কিন্তু ক্ষার ধাতু (alkali metals) – সোডিয়াম ও পটাশিয়াম এবং হ্যালোজেন মৌল – ক্লোরিন, ফ্লোরিন ও আয়োডিন সঠিক ভাবে পর্যায়ভুক্ত করেন। এ ছাড়াও রাসায়নিক যৌগের কেলাসিত গঠন (crystal structure) নিয়ে প্রচুর কাজ করেন এম্পিয়ার।
১৮৮১ সালে প্যারিস কংগ্রেস অফ ইলেক্ট্রিশিয়ান্স-এর অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তড়িৎ প্রবাহের এককের নাম দেওয়া হবে এম্পিয়ার। ১৯২৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ ওয়েটস এন্ড মেজার্স, এম্পিয়ারকে তড়িতের চরম একক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৪৮ সালে তড়িতের একক এম্পিয়ারের সংজ্ঞা নতুন করে লেখা হয়, যা আজও মান্যতা প্রাপ্ত। এই নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, যদি দুটি সমান্তরাল বিদ্যুৎবাহী তারের মধ্যে তড়িৎ পাঠালে প্রতি মিটারে ২ ×১০-৭ নিউটন বলের সৃষ্টি হয়, তবে বিদ্যুতের পরিমাণ হবে এক এম্পিয়ার।
প্রবাদ প্রতিম ক্ষুরধার মেধার এই মানুষটি সারা জীবন নানা শারীরিক, পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েও বিজ্ঞান চিন্তা ও কর্ম থেকে এক চুল বিচ্যুত হননি। মাত্র ৬১ বছর বয়সে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।