ঠুমরি জানে,এই শিরশিরাণি এখন ডালপালা মেলবে তার মনের গভীর অতলেও। মনের উৎসুক চিলেকোঠায় ওর ইচ্ছে হয়ে জমে আছে কিছু গুপ্ত মুহুর্ত আবিষ্কারের নেশা। ইউ এস ক্যাপিটল নিয়ে শোনা হাজারো গুজব,লক্ষ জনশ্রুতির মধ্যে গল্পের বইএর পাতায় এক কোণে দুলাইনে সেরে দেওয়া সেই অনামী শ্রমিকের কষ্টের সাতকাহন। ইউ এস ক্যাপিটল তৈরির সময় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে জাহাজভর্তি করে নিয়ে আসা শ্রমিক আর ক্রীতদাসের দল কত কষ্ট,কত না দুঃখের পাহাড় ভেঙে তৈরি করেছিল এই সুবিশাল ইমারত! ঠুমরি জানে,দাসপ্রথা একটি অভিশাপ, প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসনব্যবস্থাতেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। অবশেষে আঠারো শতাব্দীর শেষদিকে ইউরোপে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছিল।
এই ইউ এস ক্যাপিটলের ফাউন্ডেশন অর্থাৎ ভিত নির্মিত হয়েছিল ১৭৯৪ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে। চাঁদিফাটা গরম,অবিশ্রান্ত বৃষ্টি আর অবিরাম তুষারপাতের মত নানা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে অস্বীকার করেই অগুনতি দাস ও শ্রমিক এই মহিমান্বিত ইমারত নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রাণপণ খেটে গিয়েছিল।
সেই অসংখ্য শ্রমিক ও দাসেদের মধ্যেই এক অনামী শ্রমিকের অস্বাভাবিক,গোপন মৃত্যু ঘিরে শোনা এক অদ্ভুত গুজব ঠুমরিকে অস্থির করে তুলেছে গত কয়েকদিন ধরেই। সে এক অনামী শ্রমিকের গল্প, যিনি ক্লান্ত দুপুরের পরিশ্রান্তিতে চুপি চুপি সবার অলক্ষে একাকি গিয়ে শুয়েছিলেন নির্মীয়মাণ ফাউন্ডেশনের এক নির্জন,নিঝুম কোণে। তারপর? তারপর নাকি সবার অজান্তেই,তার গভীর ঘুমের মাঝেই নাকি ভিতের সেই অংশের নির্মাণ কাজ শুরু করে দেওয়া হয়। কেউ জানতেই পারেনি, এক কোণে ঘুমিয়ে থাকা এক শ্রমিকের শরীরের ওপর স্যান্ডস্টোনের পাহাড় জমে গেছে,সেই পাহাড়ের নীচে সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে গেছে একটি তরতাজা প্রাণ। আজও নাকি ক্যাপিটলের দেওয়ালে দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় সেই অবরুদ্ধ মানুষটির হাহাকার! গভীর রাতে নাকি ক্যাপিটলের দেওয়ালে দেওয়ালে নখের আঁচড় শুনতে পাওয়া যায়, শুনতে পাওয়া যায় অদ্ভুত গোঙানি-কেউ যেন কিছু বলতে চাইছে…নাকি মুক্তি চাইছে সেই চিরন্তন মৃত্যুরূপী কারাগার থেকে?
এটা কী সত্যি,নাকি কেবলই গুজব? সুলেমান শাহসাহেব বলেছিলেন বটে, অতীতকে বদলানোর কোন ক্ষমতাই তার এই আওয়ার গ্লাসটার নেই। কিন্তু…
ঠুমরি কী করবে? সেই সময়ে ফিরে গিয়েই বা কী করতে পারবে ও? যা ঘটে গেছে তাকে তো আর বদলাতে পারবে না। তবু..মনের মধ্যে ওর খচ খচ করতে থাকে একটা ‘তবু’! কী বলতে চায় লোকটি? আঁচড় কাটার ভুতুড়ে চেষ্টা কি শুধুই বদ্ধ কালকুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষায়? নাকি অন্য কোন কারণ আছে তার? মনের মধ্যে ওর গুচ্ছের প্রশ্ন,অবাধ্য কৌতূহলের ঢিবি জমতে থাকে।
রেস্টরুমের একাকি অবসরে পকেট হাতড়াতে থাকে ঠুমরি। এই সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষাতেই তো ছিল ও! পকেট থেকে আওয়ার গ্লাসটা বার করে চোখ বুঁজে খালি মনে করতে থাকে সেই তারিখহীন,নামহীন,গোত্রহীন অবহেলিত দিনটার কথা। যে দিন… যে দিন…
ঠুংঠাং,খুটখাট,ধুপধাপ–চারিদিকের বিচ্ছিরি সব আওয়াজে ঠুমরির ঘোলাটে চোখের নেশালু ঘোরটা কেটে যায়। চোখ মেলে অবাক হয়ে দেখে, কী সুবিশাল এক কর্মকান্ডের সাক্ষি হতে চলেছে ও! এটাই কি সাউথ উইং? এই সাউথ উইং-এরই অনেকটা অঞ্চল জুড়ে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে এখন। ঠুমরি ঘুরে ঘুরে অবাক হয়ে দেখতে থাকে, কী অসাধারণ দক্ষতায় শয়ে শয়ে লোক একমনে কাজ করে চলেছে! এর মাঝে সেই অনামী শ্রমিকটিকে সে পাবে কোথায়? এযে খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতই অবস্থা! নাঃ,এবারটি বোধহয় আর ঠুমরির ইচ্ছেপূরণ হবে না!
উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ ওর চোখে পড়ে একটা বিশাল ফাউন্ডেশনের একটা অংশে
স্যান্ডস্টোন দিয়ে ভরাট পর্ব চলছে। বিরাট লিফটিং অ্যারেঞ্জমেন্টের সাহায্যে বিশাল বিশাল স্যান্ডস্টোনের চাঁই বসানো হচ্ছে বিস্তীর্ণ ফাউন্ডেশন জুড়ে। কিন্তু একী! দড়ি ছিঁড়ে হঠাৎই যে একটা স্যান্ডস্টোনের চাঙর ভেঙে পড়তে শুরু করেছে নীচে, আর ঠিক নীচেই-ও কী? ফাউন্ডেশনের সেই কোণেই পিঁপড়ের মত একটা মানুষের অবয়ব! মানুষটা চাপা পড়ে গেছে স্যান্ডস্টোনের চাঁইয়ের নীচে। এখনো বেঁচে আছে সে,পাথরের নীচ থেকে লিকপিকে হাত একটা বেরিয়ে আছে, থরথরিয়ে কাঁপছে সেটা! এখুনি চাঁইটা সরালে হয়ত বাঁচানো যাবে তাকে। ওই বিশাল স্যান্ডস্টোন কেটে তাকে বার করা-খুব কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু কারো মধ্যেই যেন কোন হেলদোল নেই! কয়েকজন শ্রমিক কাজ থামিয়ে বেদম চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলেও কোত্থেকে একজন হুমদোমতন হোমড়াচোমড়া লোক এসে ঘোষণা করতে শুরু করেছে-“অসাবধানতার ক্ষমা নেই। দুর্ঘটনা যে কোন সময়েই ঘটতে পারে। যারা কাজ করতে চাও,কাজ চালিয়ে যাও। আর যারা করতে চাও না,আজকের হিসেব বুঝে নিয়ে বিদেয় হও। তবে কাল থেকে তারা আর এমুখো হওয়ার স্পর্ধা দেখিও না!”
সব চিৎকার চেঁচামেচি থেমে গেছে। ক্ষমতাবানের নিষ্ঠুর অমানবিকতার তলায় চাপা পড়ে গেছে অতি সাধারণ একটি প্রাণের বেঁচে থাকার আকূতি! ঠুমরি চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল হল–ওর গলার আওয়াজ কেউ শুনতে পাবে না এখানে। কিন্তু একটা গোঙানি কানে আসছে যে ওর! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, সেই আটকা পড়া মানুষটি কী যেন বলছে—
“ডাউনটাউনের অস্থায়ী ক্যাম্পে–আমার মা হারা মেয়ে লিন্ডা-ক্যাম্পের পুবকোণে ওক গাছ আর বেড়ার মাঝে মাটির তলায় পুঁতে রেখেছি কিছু টাকা…”
গলার আওয়াজ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। ঠুমরি অসহায় আকুতিতে ছুটে বেড়াতে থাকে সাউথ উইংসের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কীভাবে বাঁচানো যায় লোকটিকে? কীভাবে কিছু করা যায়? কিছুই কি করা যায় না?
নাহ!এতগুলো লোকের নির্বিকার ব্যস্ততার মাঝে চাপা পড়ে গেছে সেই পাথরচাপা শ্রমিকের গোঙানি! নানা যন্ত্রপাতির আওয়াজ। স্যান্ডস্টোন নির্দিষ্ট আকার ও আয়তনে কাটার আওয়াজ। কর্মরত মানুষের হইহট্টগোল। উফ,ঠুমরির মাথাটা কেমন যেন ঘুরে যায়! একটা পিলারে কোনমতে বায়বীয় শরীরটাকে ঠেকো দিয়ে নিজেকে সামলে নেয় ঠুমরি। ইশ, কিছুই করা গেল না! কিছুই করতে পারল না ও। তাহলে এই মুহূর্তটায় এসে পৌঁছেই বা কি লাভ হল ওর? আওয়ার গ্লাসটা ওকে ঠিক এমন সময়েই এখানে এনে ফেলল যখন ওর সত্যি কিচ্ছু করার ছিল না। ইতিহাসের অতীত বিস্মৃতিতে তলিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলিকে মুছে ফেলতে পারবে না ও জানে। তবু ……তবু কেন মনের মধ্যে গুলিয়ে উঠছে অক্ষমতার অতৃপ্তি?
হঠাৎ কী মনে হতে চমকে সোজা হয়ে দাঁড়াল ঠুমরি। অস্থায়ী ক্যাম্প-ওক গাছের তলা…লিন্ডা। ডাউনটাউনে এখান থেকে কীভাবে যাবে ও?
ও বাব্বা! ভাবতে না ভাবতেই দেখে একটা বিশাল ওক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। দূরে ছাতার মত গজিয়ে ওঠা অস্থায়ী ক্যাম্প। কয়েকটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে রৌদ্রজ্জ্বল মাঠে। সময়টা বোধহয় শরতের শুরু। ওক গাছটার কোলজুড়ে তামাটে ঝরা পাতার রাশি গালিচা বিছিয়ে আছে। ওক গাছ আর কাঠের ভাঙাচোরা বেড়াটার মাঝে একটুখানি ফাঁক। তাহলে এখানেই..
“লিন্ডা। কিক দ্য বল!” ছেঁড়া ছেঁড়া কাপড়ের গুটুলি পাকানো একটা পুঁটলিকেই বল করে ওরা মনের আনন্দে খেলে যাচ্ছে। বছরসাতেকের ছোট্ট একটি কালো মেয়ে, কালো কোঁকড়ানো চুল ঝাঁপিয়ে পড়েছে রোগা কাঁধের কোণ বেয়ে,পায়ে বলটা পেয়ে কী খুশি কী খুশি!
ঠুমরি জানে,কেবল হাওয়ার ওপর নির্ভর করা ছাড়া ঠুমরির কিচ্ছু করার নেই।হাওয়া!তাইতো! হাওয়ার শক্তিকেই কাজে লাগাতে হবে।এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!যা করবার এক্ষুণি করতে হবে!ঠুমরি চট করে এক পাক ঘুরে নেয় বলটার চারপাশে।
হঠাৎ দমকা একটা হাওয়ায় বলটা পাক খেয়ে ঘুরে যায় লিন্ডার পায়ের কাছে। লিন্ডা বলটায় কিক মারতেই যাচ্ছিল,আচমকা বলটাকে লাট্টুর মত পাক খেয়ে যেতে দেখে থমকে যায়। কিন্তু সে কয়েক সেকেন্ডমাত্র-চারপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে –“কিক,লিন্ডা কিক!”
লিন্ডা লিকপিকে শরীরে গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে বলটায় একটা শট মারে। কিন্তু অবাক কান্ড, বলটা যে দিকে যাওয়ার কথা সেদিকে না গিয়ে প্রবল এক হাওয়ায় ডিগবাজি খেয়ে গিয়ে উলটে পড়ে ওক গাছটার গোড়ায়। শুধু পড়েই ক্ষান্ত হয় না, লাট্টুর মত পাক খেতে খেতে আবার এসে পড়ে লিন্ডার পায়ে। লিন্ডা শট মারার আগেই বলটা আবার গিয়ে লুটোপুটি খেতে থাকে গাছটার গোড়ায়। বাচ্চাগুলো ভয়ে থমকে গেছে। লিন্ডার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। শুধু দুএকটি সাহসী ছেলেমেয়ে, বয়সে খানিক বা বড়ই হবে, কী যেন অনুমান করে –“ম্যাজিক। লিন্ডা ম্যাজিক। বলটা তোর বাধ্য হয়ে গেছে। কিক,লিন্ডা কিক!” একজন আবার দৌড়েছে ক্যাম্পের ভিতরে, পরিবারের বড়োদের ডেকে আনবে বলে।
ঠুমরি প্রবল বেগে পাক খেয়ে যাচ্ছে বলটার চারিদিকে। ঘূর্ণির মত পাকিয়ে ঝড় উঠেছে ওক গাছের তলায়। শুধু এটুকুই তো ওর ক্ষমতা। এই ক্ষমতাটাকে কাজে লাগিয়েই তো অসাধ্যসাধন করতে হবে। ঝরে পড়া শুকনো বাদামী পাতার আড়াল সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে নরম মাটি- মাটিটা খোঁড়া হয়েছে টাটকা টাটকা,ঝুরো মাটির গুঁড়ো,ভেজা সুবাস,উল্টেপাল্টে যাওয়া সবুজ ঘাসের প্রলেপ –ঠিক সেইখানটিতেই বলটাকে ঘিরে প্রাণপণে পাক খেয়ে যাচ্ছে ঠুমরি।
বলের ঘষায় নরম মাটিতে আঁচড় কেটে বসছে বলটার শরীর। পরিবারের বড়োরা অনেকেই দৌড়ে এসেছিলেন মজা দেখবেন বলে। অনেকেই প্রথমে ভয় পেলেও, দু’একজন এগিয়ে এসে মন দিয়ে দেখে যেতে লাগলেন বলটার কান্ডকারখানা। বলটা ঘুরেই যাচ্ছে। মাটি কেটে বসছে। তবে কি এর কোন উদ্দেশ্য আছে? মাটিটা খুব সম্প্রতি খোঁড়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না? একজন হাঁক পাড়েন-“কোকো, ব্রিং মি দ্য শাভেল!”
বলটা থেমে যায়। বাধ্য ছেলের মত একটা কোণায় সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় চুপচাপ। মাটি খোঁড়ার ঝুপঝাপ আওয়াজ। কয়েকটা কোপ মারতেই একটা কাপড়ের পুঁটলি ছিটকে উঠে আসে বেলচার কোণার খোঁচা খেয়ে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পুঁটলিটার ভিতরে একটা কাগজে হিসেব লেখা-লিন্ডার খাইখরচার হিসেব, লিন্ডাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেওয়ার পরেও আর কত থাকবে সেই হিসেব। লিন্ডা একটু বড়ো হলে যাতে অন্নের জন্য ওকে অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে না হয়-তারই প্রস্তুতির গন্ধ যেন লেগে আছে ঝনঝনে পেনি আর এলোমেলো ডলারের গায়ে গায়ে!
ঠুমরি জানে, সে সময়কার অনেক মেয়েরাই সীমসট্রেস অর্থাৎ দর্জির পেশায়, সেলাইএর কাজ করে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে নিজের ও সংসারের প্রতিপালন করতেন। বেটসি রসের কথা ঠুমরি শুনেছে-যিনি আমেরিকার প্রথম পতাকা সেলাই করে দিয়েছিলেন,আজো তিনি বেঁচে আছেন ঐ লাল,সাদা-নীলের উচ্ছ্বাসের মাঝে,আপামর আমেরিকাবাসীর হৃদয়ের গভীরে!
ঠুমরির মাথাটা ঝিমঝিম করছে কেন? তবে কি-তবে কি আওয়ার গ্লাসের সময় ফুরিয়ে এসেছে? ঠুমরি চোখ কচলে তাকায়,লিন্ডার চোখে উপচে পড়েছে হীরের দীপ্তি,গালের কোণে চিক চিক করছে বিকেলের অবাক শিশির! তবে কি লিন্ডা বুঝতে পেরেছে-ওর বাবা আর নেই? আজ রাতে কাজের শেষে যখন সবাই ক্যাম্পে ফিরে আসবে-একা লিন্ডার বাবা তো আর ফিরবে না! কোনদিনই ফিরবে না।
কিন্তু ঠুমরির যে ফেরার সময় হয়ে এসেছে।মাথাটা বেজায় ঘুরছে। অস্পষ্ট হয়ে আসছে চারপাশের সবকিছু। পকেট থেকে অনেক কষ্টে আওয়ার গ্লাসটা বের করে উল্টে দেয় ও—ইশশ-‘আওয়ার গ্লাসে’র ওপরের প্রকোষ্ঠটা প্রায় খালি হয়ে এসেছিল-আর একটু দেরি হলেই……!
ঠুমরির চটক ভাঙে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে। –“ঠুমরি,অ্যাই ঠুমরি! এতো দেরি হচ্ছে কেন? দরজা খোল!”
এই রে! ওর দেরি দেখে মা রেস্টরুমে এসে হাঙ্গামা বাধিয়ে দিয়েছেন। সিকিউরিটিও চলে এসেছে মায়ের হাঁকডাক শুনে। ওর রেস্টরুমের দরজায় ধুপধাপ আওয়াজ। ওরে বাব্বা! দরজাটা এরা ভেঙেই ফেলবে নাকি? কী কেলো রে বাবা! ঠুমরি গায়ের সমস্ত শক্তি জোগাড় করে হাতের বালিঘড়িটা পকেটে পোরে,তারপর চিঁচিঁ করে সাড়া দেয়—“এইতো, আমি আছি,ঠিক আছি,দরজা খুলছি। পেটটা কেমন গন্ডগোল করছিল!”
দরজার বাইরে বেরিয়ে দেখে অত্যন্ত চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে মা,সিকিউরিটি এবং আরো কিছু অজানাঅচেনা মহিলার মুখ। মায়ের চোখে চিন্তার গাঢ় ছায়া ভেদ করে ঝিলিক দিচ্ছে স্বস্তির আশ্বাস। আচ্ছা, ঠিক এমনটিই উজ্জ্বল দীপ্তি ঝলসে উঠেছিল না লিন্ডার চোখে? সারা আকাশ ছেয়ে থাকা অদ্ভুত একটা মনখারাপের মাঝেও কোথায় যেন মেঘ কেটে উঁকি মারতে শুরু করেছে সোনা রোদের ছটা। হঠাৎ কি মনে হতে মায়ের কোমরটা জড়িয়ে ধরে ঠুমরি,এক চির পরিচিত গন্ধ, চিরপরিচিত উষ্ণতার মাঝে ডুবে যেতে থাকে ও। মাথার ওপর মায়ের নরম,আদুরে আঙুলের আঁকিবুঁকি টের পায় সে।
এক নিঝুম,নিশ্চিন্ত,আয়েশি আরামে চোখ বোঁজে ঠুমরি!