বিতস্তা ঘোষাল
মে মাসের শেষে সোমবার রাতে যখন গুজরাতের আমেদাবাদ শহরের বল্লভভাই ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্টের বাইরে এলাম তখন বাইরের তাপমাত্রা ৩৯ডিগ্রী সেলসিয়েস। উষ্ণতা শহর জুড়ে এত রাতেও, মানে সকালে যে কী চলবে ভেবে একটু ভ্রু কুঁচকে গেল।
পরমুহূর্তেই সে ভ্রু নিজেই সোজা হয়ে গেল নতুন শহর দেখার আনন্দে। একটা শহর মানে শুধু কিছু বাড়ি ঘর, ফ্ল্যাট, নদী , রাস্তা নয়। একটা শহরের প্রধান আকর্ষণ সেখানকার অধিবাসীরা। সেখানকার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দর্শন, জীবনবোধ সব নিয়েই শহর।
আর সেই শহর যদি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ শহর হয় তবে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকবেই ইতিহাসের নানান পর্বমালা।
পরশু রাতেও জানতাম না, এখানে আসব। তনয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় রেগে জানিয়েছিলাম, “থাকো তোমার দেশ উদ্ধারের কাজ নিয়ে। আমি অমরকন্টক চললাম মেয়েকে নিয়ে।”
পরদিন সকালে মোবাইল অন করা মাত্র আমেদাবাদ যাবার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিট পেলাম। অবাক হইনি, এটাই আমার আর তনয়ের মধ্যে প্রধান মিল। যা ভাবি সঙ্গে সঙ্গেই সেটা করে ফেলি। তনয়ের মা বলেন, “উঠল বাই তো কটক যাই তোদের। কী করে যে ভাবামাত্র কোনো কিছু পরোয়া না করে বেরিয়ে পড়তে পারিস কে জানে! আমি তো ভাবতেই পারি না।”
এই-মুহূর্তে কথাগুলো মনে করে হাসলাম। কোথায় কলকাতা কোথায় আমেদাবাদ! ২০৮৬ কিমি রাস্তা। ফ্লাইটে দু’ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ট্রেনে ১ দিন ন’ঘন্টা, বাই রোডে NH27 ধরে ৩৭ ঘন্টা। অবশ্য আমরা আমেদাবাদে এক রাতই থাকব। গুজরাতি কলেজের পাশে আইটিসি ফরচুন পার্কে রাত্রিবাস। ফেরার পথেও রাতে থেকে পরদিন কলকাতা।
যাহোক, আপাত দৃষ্টিতে অন্য কোনো আধুনিক শহরের তুলনায় সবরমতী নদীর তীরে গড়ে ওঠা আমেদাবাদ, ছোটো থেকে ইতিহাস ভূগোলে পড়া আমেদাবাদের প্রভেদ সেভাবে চোখে পড়ে না। তবে শহর ছেড়ে হাইওয়েতে উঠলেই সুজলাং সুফলাং শস্য শ্যামলাং বাঙলার হাইওয়ের দুপাশের রাস্তার দৃশ্য এখানে অদৃশ্য। বরং রাজস্থানের সাথে কিছুটা মিল। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, দুপাশের মাটি কালো। ভোরাই বলল, “মা, এই কালো মাটিতেই সবচেয়ে ভাল কটন তৈরি হয়।”
তা হবে। কারণ আমেদাবাদ যে ইস্টের ম্যাঞ্চেস্টর তা তো জানি। ভারতের সবচেয়ে বেশি কটন এখানেই উৎপন্ন হয়।
এসব ভাবনার মাঝেই রাস্তার দুধারের কালো মাটি আর পাতা ঝরে পড়া পুড়ে যাওয়া গাছের সারি দেখতে দেখতে চলেছি। গন্তব্য দ্বারকা। হ্যাঁ, কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা। আমেদাবাদ থেকে ৪৫০ কিমি দূরে। বাসে ন’ ঘন্টা। গাড়িতেও প্রায় একই।
দ্বারকার কথায় আবার পরে ফিরে আসব। আপাততঃ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা। তার একটা অংশ, যে অঞ্চল চিহ্নিত লোথাল বলে সেটাই নাকি নতুনভাবে গড়ে ওঠা গুজরাত। একদা এই দেশের নাম ছিল গুর্জর দেশ।তবে এই গুর্জর নাম কোথা থেকে এল এই নিয়ে মতান্তর আছে।বাবা ইতিহাস পড়াবার সময় বলেছিলেন, গুর্জর একটা জাতি।হুনদের সঙ্গেই তারা ভারতে এসেছিল।তাদের উপনিবেশের নাম গুর্জর যা পরে গুজরাত হয়।অবশ্য গুর্জররা যে শুধু এখানেই ছিল তা নয়। তারা ভারতের প্রায় সর্বত্রই জাঁকিয়ে বসেছিল।পাঞ্জাব, গোয়ালিয়র, রাজপুতানা, পশ্চিম হিমালয়, এমনকি দক্ষিনভারতেও তাদের বাস ছিল, এখনো আছে।
এত অবধি বলার পর বাবা আরো বলেছিলেন, কবি বাণভট্টের হর্ষচরিতের নাম পড়েছিস নিশ্চয়ই। তাঁর এই গ্রন্থেও গুর্জর শব্দের উল্লেখ আছে। অনেকে বলেন, তিনি নাকি গুর্জর দেশের রাজা হর্ষবর্ধনের পিতা প্রভাকর বর্ধনের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, গুর্জর দেশের রাজা তিনি।
বাবা তাহলে এখনকার গুজরাত তখনো ছিল? আমার প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেছিলেন, না রে। হিউয়েন সাঙ যখন এ দেশে এসেছিলেন, তখন এই অঞ্চলটা বর্তমান গুজরাতের অনেক উত্তরে ছিল। তখন সেখান দিয়ে লুনি নদী প্রবাহিত হত। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় তিনি গুর্জর দেশের দক্ষিণ প্রান্তে ভিল্লমাল ছুঁয়ে সৌ্রাষ্ট্রের উজ্জ্বয়ন্ত পাহাড়ে এসেছিলেন। আর পাহাড়ের কোলে ছিল গিরিনগর। উজ্জ্বয়ন্তের বর্তমান নাম গির্ণার আর শহরের নাম জুনাগড়।
গুজরাতে অনেক নদী আছে তাই না বাবা?
হ্যাঁ। সবক’টা বড় শহর নদীর তীরে। আমেদাবাদ শবরমতির তীরে, সুরাত তাপ্তীর তীরে, দ্বারকায় গোমতী। আর পুরো শহরের পশ্চিমকূল আরব সাগর। মনে করা হয় এই পুরো রাজ্যটাই একসময় সিন্ধু ও হরপ্পা সভ্যতার অংশ ছিল। কোনো প্রাকৃতিক কারণে সবটাই আরব সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিল।
শবরমতি নদীর উপরের ব্রিজ পেরোতে পেরোতে বাবার কথাগুলো মনে পড়তেই ভাবলাম অমদাবাদও কি সিন্ধু সভ্যতারই অংশ? কে জানে! তবে এটা ১১ শতকে ভিলদের হাতে ছিল জানি। ভিলরাজ অশ্বপালকে যুদ্ধে পরাজিত করে চালুক্য বংশীয় সোলাঙ্কি রাজা প্রথম কর্নদেব এই আহমেদবাদের দখল নেন, এবং সবরমতী নদীর তীরে আজকের আমেদাবাদ তৈরি করেন। অবশ্য তখন এর নাম ছিল কর্নদেবের নামানুযায়ী কর্নাবতী।
১৩ শতক অবধি কর্নাবতী সোলাঙ্কি রাজাদের হাতেই থাকে। তারপর এর দখল নেয় দ্বারকার ভাগেলা রাজবংশ। ১৩ শতকের শেষ পর্যায়ে গুজরাত দখল করে দিল্লির সুলতান। তার অনুগত মুজাফরিদের হাত ধরে গুজরাটে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজাফরিদের উত্তরসুরী প্রথম আহমেদ শাহ ১৪১১ সালে নতুন আকারে তৈরী এই শহরকে সুলতানি সাম্রাজ্যের রাজধানী বলে ঘোষণা করেন।তাঁর নামানুযায়ী এর নাম হল আহমেদাবাদ। অবশ্য অনেকে বলেন চতুর্থ মুসলিম সন্ত আহমেদের নামেই সুলতান এই নাম রাখেন, যাতে রাজ্যের সমৃদ্ধি অক্ষুণ্ণ থাকে। সত্যিই নাকি তার আমলে আহমেদাবাদের হাত ধরেই গুজরাতের ব্যবসার প্রসার এতটাই হয়েছিল যে সারা হিন্দুস্থানে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পরেছিল দ্রুত।
ইতিহাস বলে যার উত্থান যত দ্রুত তার পতন ও শত্রুবৃদ্ধি তত দ্রুত। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। মোঘলরা ও মারাঠারা ঝাঁপিয়ে পরল এর দখল নিতে। ফলতঃ দীর্ঘদিন যুদ্ধে শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবস্থা ও ভঙ্গুর হয়ে পরল। ব্যাবসাবাণিজ্যের অবনতি দেখা দিল।
আর এই সুযোগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগলদের থেকে নিয়ে নিল আহমেদবাদ। অবশ্য মারাঠারা দ্রুত তাদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করলেও ৩য় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধে মারাঠাদের শোচনীয় পরাজয়ের পর ব্রিটিশ পুরোপুরি দখল নিল প্রাচ্যের প্রাচীন ম্যাঞ্চেষ্টার, বন্দর নগর শবরমতীর তীরে গড়ে ওঠা এই আমেদাবাদের।
এর প্রায় দেড় দশক বাদে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সারা বিশ্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নতুনভাবে চিহ্নিত করলেন ছোটোখাটো চেহারার খালি গা, একটুকরো ধুতি পরা এক সংগ্রামী, এই আমেদাবাদ থেকেই। মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী নামে সেই গুজরাতী আইনজীবি অহিংস আন্দোলনের জন্মদাতা- সকলের গান্ধিজী।
তাঁর কথায় আসার আগে বলি বাইরে তাপমাত্রা এখন ৪৬ ডিগ্রি। আমরা এখন আমেদাবাদ থেকে ১৩০ কিমি দূরে। রাস্তার ধারে দর্শন ধাবা কাম রেঁস্তরায় ভেজ স্যান্ডউইচ আর মিল্কশেক খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। বাইরে তীব্র লু। মুখে ওড়না চাপা দিয়ে প্রায় দৌড়ে গাড়িতে উঠলাম।
রাস্তার দু’পাশে এখন ফণিমনসার ঝোপ, আর কালো মাটির জমি। কোথাও মাটি খোঁড়ানো, কোথাও বেওয়ারিস ভাবে পরে। আরেকটা জিনিস চোখে পড়ছে কিছুদূর অন্তর। ওষুধের কারখানা। শুনলাম, এদেশের ৮০শতাংশ ওষুধের কারখানা নাকি গুজরাতেই।
আমাদের ইনোভা গাড়ির রজ্জাকশেখ ভাইয়ের এখন রোজা চলছে। এই তীব্র গরমে জল না খেয়ে এতদূর গাড়ি চালাচ্ছেন। ধর্ম, পাপপূণ্য, নিয়ম, নীতি কোনো কিছুতেই সে অর্থে শান্তি পাই না।
খুব যে সব মানি একথাও বলতে পারি না। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে সম্মান জানাই সারা পৃথিবীর রোজা করা মানুষগুলোকে এই সংযম দেখানোর জন্য। সেই যে ছোট থেকে জেনে এসেছি বাবার কাছ থেকে, কোনো কোনো সময় সংযমী জীবনের প্রয়োজন।
শেখ ভাইয়ের তিন ছেলেমেয়ে। দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে বিবিএ আর ছোট মেয়ে টেনে পড়ছে। ছেলে নাইন। বলছিলেন, “মেয়েদের ছেড়ে থাকতে বড় কষ্ট হয়। আগে তো ছোটো মেয়ে আমি রাতে বাইরে থাকলেই কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যেত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তার ইচ্ছা স্কুল টিচার হবে।”
“আর ছেলের কী ইচ্ছে?” তনয় জানতে চাইল।
“সে এখনো কিছু বলে না। তবে পড়ায় মতি আছে। তাই অত ভাবি না। আর ছেলে আমার মত গাড়ি চালিয়েও খেয়ে পরে বেঁচে যাবে। কিন্তু মেয়েদের চাকরি না করলে খুব চিন্তা।”
কথাটা শুনে বেশ অবাক হলাম। মুসলিম মেয়েদের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায় শুনেছি, আর পড়াশোনাও বেশি করার সুযোগ পায় না। সেখানে চাকরী তো অনেকদূরের বিষয়। অথচ এই ড্রাইভারভাই গাড়ি চালিয়ে স্বপ্ন দেখছেন মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড় করাবার। একটা অদ্ভুত ভাল লাগা গ্রাস করল সেই মুহূর্তেই।
গাড়ি চালাতে চালাতে রজ্জাকভাই বললেন, “ভাবী শাহাজাহান তাঁর বেগম মমতাজকে নিয়ে আমেদাবাদে ছিলেন প্রথম যৌবনে। যার নামানুযায়ী আমেদাবাদ তৈরি সেই আহমদ শাহের আমলের অনেক মসজিদ এখনো আছে। ফেরার সময় সুযোগ পেলে দেখবেন। আর নিশ্চয়ই কাপড়া,ড্রেস মেটেরিয়াল কিনবেন-ই। তো মাণিকচক মার্কেটে যাবেন।”
“মাণিকচক?”
“হ্যাঁ। মাণিকবাবা নামে এক যোগী ছিলেন। শোনা যায় তাঁর যোগবলে নগরের মজবুত প্রাচীরেও নাকি ফাটল ধরে। তাই তাঁকে স্মরণে রেখে তাঁর স্মৃতিতে আহমদ শাহ তাঁর মন্দির বানিয়ে বাজারের নাম রাখলেন মাণিকচক।
আজও সেই নামই আছে। আর আছে তিন দরজা, আহমদ শাহ্র কবর, বাণী সিপ্রির কবর ও অসংখ্য মসজিদ। সব মসজিদেই কিন্তু একটা মজার বিষয় আছে।”
“কী?” আমি জানতে চাইলাম।
“সবেতেই গুজরাতি সংস্কৃতির প্রভাব। অর্থাৎ মুসলিম বানালেও হিন্দু মুসলিম উভয়ের শৈলীরই স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে।”
সে তো হবেই। শিল্পীরা তো হিন্দু,তারা যতই মুসলিম রাজাদের জন্য কাজ করুক, স্থাপত্য বানাক, একটা প্রভাব তো থাকবেই। তবে গুজরাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব জৈনদের। আবু পাহাড়, গির্ণার পাহাড়, পলিতানায় তাদের সব বড় বড় মন্দির। মন্দিরের জন্যেই সেখানে শহর গড়ে উঠেছে। মনে পড়ল গান্ধিজীর উপর জৈন ধর্মের প্রভাবের কথা পড়েছিলাম।
এরপর বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা। দুদিকের সিনারিও আবার পরিবর্তিত। রুক্ষ কালো মাটির পথ এখন সবুজ। ডিভাইডার জুড়ে দোপাটির মেলা। গোলাপি সাদা দোপাটিতে পিচের কালো রাস্তা যেন তীব্র দহনের মাঝে একটু আশ্রয় চাইছে।
এই অঞ্চল যে একদা সমুদ্রের তলায় ছিল সেটার অনুমান কতটা যথাযথ তা বিশ্লেষণ করবেন ঐতিহাসিক ও ভূতত্ত্ববিদরা। আমার সাধারণ দৃষ্টিতে যতদূর চোখ যায় ফণি মনসা, বাবলা আর কালো মাটি, লোনাবালি -সবমিলিয়ে সমুদ্রের কথা মনে করায়।
*****
সন্ধে ৬.৫০ মিনিট। সূর্যের তেজ খানিক ম্লান। গরম হাওয়া এখনো বহমান। তবে দুপুরের পুড়ে যাওয়া হলকাটা নেই।
থামলাম একটা চটি দোকানে। চা খাওয়ার জন্য। পরিচয় হল পিঠা মালদেব চাওড়ার সঙ্গে। নিজেকে যাদব বলে অভিহিত করলেন। পরেও ছিলেন ট্রাডিশ্যানাল গুজরাতি পোশাক। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম। গল্প জুড়লাম। তিনি গুজরাতিতে আর আমি আমার ভাঙা হিন্দি আর বাংলা মি়শিয়ে। মাঝখানে দোভাষীর কাজ করলেন আমাদের গাড়ি চালক শেখ ভাই।
পিঠা সাব বলছিলেন, “ভগবান কৃষ্ণ এমন পোশাক পরতেন। আমাদের যাদব বংশের বয়স্ক মানুষেরা এমন পোশাকই পরি।”
জানা গেল, সামনে পিছনে প্রচুর ক্ষেতি জমি আছে তাঁদের। যে চটিতে বসে চা খাচ্ছি সেটাও তাঁর ভাইয়ের ছেলের।
বললেন, একটা স্কুল আছে তাঁদের, যেখানে ৪০০ বাচ্চা স্কুলের হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করে।
কারণ, গাঁ থেকে রোজ এসে পড়াশোনা চালানো কঠিন বাচ্চাদের পক্ষে। আরো জানালেন, তিনিও সেই স্কুলে পড়ান। তবে বয়স হয়েছে, ছেলেরাই সব সামলায়।
আমরা দ্বারকা যাচ্ছি শুনে হাসলেন। বললেন, “আপনারা যে দ্বারকাপুরী দেখতে যান তা কিন্তু কৃষ্ণের দ্বারকা নয়। আমরা যাদবরা পোরবন্দর বা সুদামাপুরীকে মূল দ্বারকা বলি। আসল দ্বারকা সেটাও নয়। সেখান থেকে মাইল তিরিশ দূরে দক্ষিণে ছিল কৃষ্ণের দ্বারকা। পোরবন্দর থেকে প্রভাসের দূরত্ব মাইল চল্লিশেক।
সেখানেই ছিল দ্বারবতী। আপনি নিশ্চয়ই জানেন,যদু বংশ ধ্বংস হবার পর কৃষ্ণ বলরাম বাণপ্রস্থে এসেছিলেন প্রভাসের কাছে এক জঙ্গলে। সেখানেই দুজনের মৃত্যু হয়।”
“তাহলে এখন আমরা দ্বারকায় গিয়ে কিছু দেখতে পাব না?”
“পাবেন না কেন? সেখানে আছে দ্বারকাধীশ রণছোড়জীর বিখ্যাত মন্দির। বৈষ্ণবদের পবিত্র তীর্থস্থান। ভাল লাগবে খুব। ঘুরে আসুন।
ফেরার সময় আমাদের কুটিরে আপনাদের নিমন্ত্রণ রইল, মোষের আর ভেড়ার দুধ খাবেন।”
হেসে মাথা নেড়ে প্রণাম জানিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম আমরা। ৭. ১৮ মিনিটে রোজা ভাঙলেন রজ্জাকভাই চা খেয়ে।
দু’ধারে এখন উইন্ডমিল। আর ফাঁকা জমি। সেগুলো পেরিয়ে সমুদ্র। নোনা বাতাস আর বালির গন্ধ নিতে নিতে চলেছি। আকাশ এখন লাল। সূর্যমামা অন্য প্রান্তে আলো ফোটাবে বলে এখানে বিদায় জানাচ্ছে। তাকে আমিও প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে চলেছি প্রাচীন দ্বারকা নগরীর সন্ধানে।
*****
দ্বারকার গুজরাট সরকারের ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের টোরেন গেস্টহাউসের স্যুটে ঘুম ভাঙল গণেশবন্দনার সমবেত সঙ্গীতের আওয়াজে। কোনোরকমে চোখ খুলে মোবাইলে সময় দেখলাম। ভোর সাড়ে পাঁচটা। পর্দা সরাতেই হাজার হাজার ওয়াটের আলো বিছানায় ছড়িয়ে পড়ল। ভোর গায়ের লেপটা ভাল করে মুখে ঢেকে নিয়ে পাশ ফিরল।
তনয় একবার চোখ খুলে জড়ানো গলায় বলল, “আলো জ্বালালে কেন? ঘুমোই আর একটু।”
আমি হেসে বললাম, “সূর্যদেব, আমার পতিদেবের নিদ্রাভঙ্গ হচ্ছে আপনার জন্য, প্লিজ আপনি আসুন এখন। আর আজ বেশি আলো দেবার দরকার নেই। একটু পরেই বেরোব। দেখবেন আপনার অতি উষ্ণ আলিঙ্গনে মাথা ঘুরে পড়ে না যাই।”
মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে হলকা হাওয়া টের পেলাম। এখনই এত গরম, তাহলে আর একটু বাদে কী হবে ভাবতে ভাবতে রুমে ফিরে চা বানালাম। এখন এই একটা সুবিধা ভাল হোটেল, সার্কিট হাউস বা সরকারী গেস্ট হাউসগুলোতে, ইলেকট্রিক কেটলি রুমে থাকে। আমার মত চা-খোর মানুষের এতে ভারি ভালো হয়েছে। ইচ্ছে মত চা পান করা যায়।
সাতটার মধ্যে স্নান সেরে পুরো রেডি হয়ে তনয় আর ভোরকে ডাকলাম। শেষ অবধি সাড়ে আটটায় যখন গাড়িতে উঠলাম তখন বাইরের টেম্পারেচর ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ডিজেল ভরে গাড়ি দৌড়াল লোকালয় ছেড়ে। আমাদের প্রথম গন্তব্য বেট দ্বারকা বা বেট শঙ্খধর। শেখভাই বলেছেন, সকালে বেট দ্বারকা দেখে নিলে বিকেলে দ্বারকা দেখতে ভাল লাগবে। কারণ অন্ধকারে সমুদ্রে স্পিড বোটে না ওঠাই ভাল। তার কথানুযায়ী আমরা চলেছি এখন।
রাস্তার কখনো এ-পাশে কখনো ও-পাশে সমুদ্র। তবে সমুদ্র শান্ত। কোথাও কোথাও বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টি হলে সমুদ্রর জল সেখানে এসে পড়ে, এখন অল্প জল।
যেতে যেতে প্রাচীনকালের কিছু ইটের বাড়ির ভগ্নাদেশ চোখে পড়ল। ছোটো বেলায় পুরোনো কোনো কোনো বাড়ি, এমনকি বিয়ের পর ৩৫০ বছরের পুরোনো শ্বশুরবাড়ি দেখেছিলাম, তখনো এমন ইঁট দেখেছি। বাবা বলতেন, এগুলো পাল যুগের। বাবা বুঝিয়েছিলেন, এখন আর এই ইট পাওয়া যায় না, তাই বাড়িগুলো সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।
যাহোক, এই বাড়ির ইটগুলো পাল যুগের কিনা জানি না, কিন্তু সংস্কার করানো যে যায়নি সে বুঝতে পারছি। অদ্ভুত স্ট্রাকচার এই বাড়িগুলোর। দেখলে মনে হচ্ছে প্রাচীন কালের কোনো সভ্যতার মুখোমুখি এসে পড়েছি। যা নেই, যা হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য, শুধু ক’টা কঙ্কাল রয়ে গেছে অতীতের স্মৃতি আকঁড়ে।
গাড়ি পুরো সমুদ্রের ধার ধরে যাচ্ছে। একদিকে সার সার ভারতের পতাকা লাগানো মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা, জাহাজ। রজ্জাক ভাই বললেন, “এই দু’দিকে যতটা সমুদ্র দেখছেন তা টাটা কোম্পানির নেওয়া। লবণ, সোডা, সিমেন্ট তৈরি হয় এখানে টাটাদের।”
আরও খানিকটা এগিয়ে দেখলাম, বাউন্ডারি দেওয়া এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত টাটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি।
শেখভাই জানালেন, “এসব কারখানা না থাকলে এখানকার অধিবাসীদের রুজি-রোজগার অসম্ভব হত। কোনো চাষাবাদের জমি নেই এখানে। সমুদ্রে মাছ ধরা আর এই কারখানাগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে এদের।”
আমেদাবাদ থেকে আসার সময় দেখেছিলাম রিল্যায়েন্স কোম্পানির রিফাইনারি ফ্যাক্টরি। শেখ ভাই তখনো দুদিকে হাত দেখিয়ে বলেছিলেন, “এগুলো সব আম্বানীদের। এখানে সাব, টাটা আর আম্মানি এই দুজনই রাজা। অর্ধেক এর তো অর্ধেক তার। আরো বলেছিল, সোমনাথে ধীরুভাইয়ের মোকান আছে। তিনি অনেক টাকা দিয়েছেন সেখানে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে।”
“বুঝলেন শেখভাই যে যত অন্যায়ভাবে লোক ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করে সে তত দানধ্যান করে পূণ্যসঞ্চয়ের চেষ্টা করে।”
তনয়ের কথা শেখভাই বুঝলেন কিনা বুঝলাম না, তিনি সে নিয়ে একটা কথাও না বলে বললেন, “আমার পিতাজী বলতেন, কৃষ্ণের দ্বারকা এখানে ছিল না।”
“তাহলে আমরা এখানে যাচ্ছি কেন?” তনয় জানতে চাইল, “কোথায় ছিল সেই দ্বারকা?”
“এখন দেখে নিন। পরে পিতাজির কথা বলব। নইলে ভাববেন, মুসলিম বলে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছি।”
তাঁর কথায় কোথাও একটা বেসুরো তান কানে এলেও সেদিকে মন দিলাম না। আমি এখন বেট দ্বারকার অতীতে খুঁজছি। মহাভারতের দ্বারকা পর্ব থেকে ভেট দ্বারকাকে মনে মনে খনন করছি আর প্রস্তুত হচ্ছি ঐতিহাসিক এক মন্দিরের দর্শনের জন্য।
মূল দ্বারকা থেকে ৩০ কিমি দূরে ওখা বেট দ্বারকা ফেরি পয়েন্ট যেতে সময় লাগল ১ঘন্টা ২০ মিনিট মত। আমার ছোটোবোন রম্যানি দ্বারকা থেকে ফিরে বলেছিল, বেট দ্বারকায় চারদিকে শুটকি মাছের গন্ধে প্রাণ যায় যায়। এটাও বলেছিল, নৌকা করে সমুদ্র পেরিয়ে অন্য প্রান্তে বেট দ্বারকা। রজ্জাকভাই বলেছিলেন, “যদি ভেজিটেরিয়ান হন, তবে মছলির গন্ধ সহ্য করতে পারবেন না।”
আমি ভেজিটেরিয়ান নই, কিন্তু মাছ খাই না। গন্ধে সত্যি বমি আসে। আর একটা কথাও বলেছিল শেখ ভাই। একটা বোটে গাদাগাদি করে লোক নেয়, নাও ডুবে যেতে পারে। অনেকবার এমন ঘটনা ঘটেছে।এই দুটো নিয়েই মনের মধ্যে একটা মৃদু আশংকা ছিল। বিশেষ করে প্রথমটা নিয়ে।
আশ্চর্যের বিষয় আমার নাকে কোনো আঁশটে গন্ধ আসেনি। হয়তো মাছ ধরার মরসুম নয় বলে। কিংবা দেবভূমিতে কত ঘটনাই ঘটে যা যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না। আমি গন্ধ সহ্য করতে পারি না বলেই হয়তো এমন ঘটল।
পরের ঘটনাটাও মজার। তনয় ওখা ফেরিঘাটে গিজগিজ করা মানুষের দিকে তাকিয়ে পাহারারত কনস্টেবলকে কী একটা বলল। সঙ্গেসঙ্গেই তিনি তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছে গিয়ে কী যেন বলা মাত্র তিনি ছুটে এলেন। তারপর তনয়ের পরিচয় জেনে একটা বোট রিজার্ভ করে দিলেন গাইড কাম পুরোহিত সহ।
অজস্র স্টিমারের সঙ্গে আমাদের স্টিমারও পাড়ি দিল। মাঝির নাম সাবাশ। আর সহকারী যার নাম বুঝে উঠতে পারলাম না, তার বয়স খুব বেশি হলে ১০। তার সাহস দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। পরমুহূর্তে মনে হল, জীবনের নানা অভি়জ্ঞতা এদের শিখিয়ে দেয় কিভাবে চোয়াল শক্ত করে জীবন বৈতরণী পার করতে হয়।
স্টিমারে উঠে ভোর বলল, “মা এই জায়গাটার নাম ওখা কেন? এর মানে কী?”
আমিও সেটাই ভাবছিলাম। গাইড কাম পুরোহিত আমাদের কথা বুঝল কিনা জানি না, সে বলল, “ঊষা ছিলেন বাণ রাজার কন্যা। এই জায়গা তাঁর নামেই পরিচিত ছিল। ঊষা মন্ডল। সেখান থেকে ভাঙতে ভাঙতে ওখা মন্তুল হয়ে ওখা।”
“মা ঊষার গল্পটা কী?”
“জানি না,” বলে গাইডের দিকে তাকালাম। সে-ও “জানি না” বলে মোবাইল ঘাঁটতে লাগল।
মিনিট ২০ সমুদ্র যাত্রার পর গিয়ে নামলাম পাড়ে। দু’দিকে জিনিসের পসরা, তুলসীর মালার বিক্রেতাদের ডাকাডাকি পেরিয়ে মন্দিরে ঢুকলাম।
বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না ভিতরে এমন ঘর বা মন্দির রয়েছে। অবশ্য ভারতের সর্বত্রই একই ছবি দেখেছি। পুরীর জগন্নাথধাম, তিরুপতি মন্দির, বা যেকোনো প্রাচীন মন্দিরের বাইরের আবরণ দেখে ভিতরের কিছু আগে থেকে অনুমান করা যায় না। কোথাও হয়তো দূর থেকে কেবল চূড়াটা দেখা যায়। কিন্তু বাকিটা না দেখলে কেউ বুঝবেই না। মনে পড়ল, বাবা একবার বলেছিলেন, মধ্যযুগে ভারত আক্রমণে আসা মুসলিম সুলতানদের ভয়ে, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের সময় অধিকাংশ মন্দির এভাবেই বানানো হয়েছিল, যাতে বাইরে থেকে সম্রাট বা তাঁর অনুচররা বুঝতে না পারে এগুলো হিন্দু দেবদেবীর মন্দির। জানলেই তা ভেঙে গুড়িয়ে মসজিদ করে দেওয়া হবে।
পুরোহিত কাম গাইড ছেলেটি প্রথমে গণেশদর্শন করানোর পর যথাক্রমে কৃষ্ণের চার স্ত্রী রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী , ও রাধা মন্দির দর্শন করালেন। মন্দিরের বড় বড় দরজাগুলো রুপোয় মোড়া। তিনি বলছিলেন, এই মন্দিরের বয়স ৫০০ থেকে ৭০০ বছর। রাজা রঘু এই মন্দির নির্মান করেছিলেন। কোথাকার কোন বংশের রাজা জানা নেই তার। মনে মনে হিসেব করলাম। আওরঙ্গজেবের শাসনকাল ১৭০৭ অবধি। অর্থাৎ সেই হিসেবে এই মন্দির তৈরির বছরের সঙ্গে প্রায় মিলে যাচ্ছে। তাহলে বাবা ঠিকই বলেছিলেন, ভেবে বাবার জন্য হঠাৎ কান্না পেল। আসলে বাবা আমাদের প্রথাগত ভাবে পাঠ্যপুস্তক না পড়ালেও ইতিহাসের সাহিত্যের, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের গল্প এমনভাবে গল্পের ছলে বলতেন, যা এখনো ছবির মত মনের ভিতরে গাঁথা হয়ে আছে। চোখের জল মুছে নিয়ে পুরোহিতের কথায় মন দিলাম।
তিনি বলছিলেন, “এখানে ৯০ শতাংশ মুসলিম আর মাত্র ১০ শতাংশ হিন্দু পরিবার বাস। মন্দিরে ভগবানের ভোগ আসে ভক্তদের দেওয়া ডোনেশন থেকে। ৩০০ ব্রাক্ষণকে এখান থেকে চাল দেওয়া হয়।”
তাঁর কাছেই শুনলাম বেট দ্বারকা ছিল কৃষ্ণের বাড়ি। ব্যাধ ভুল করে অর্ধ শোওয়া কৃষ্ণকে তির মারলে তাঁর মৃত্যু হয়। কৃষ্ণ নাকি সমুদ্রদেবকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন তিনি মারা যাবার সাতদিনের মধ্যেই যেন পুরো অঞ্চল সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। তাই হয়েছিল।
একটা স্থান দেখিয়ে বললেন, “এখানেই কৃষ্ণ ভগবানের মৃত্যু হয়েছিল।”
আমি সেদিকে তাকিয়ে কল্পনা করছিলাম মহাভারতের সময়টা। কৃষ্ণ ছিলেন কিনা ইতিহাস বিচার করবে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটা উপাখ্যান, ক্রমশ মনের গভীরে আশ্রয় নিয়েছে কোটিকোটি ভারতীয়র মধ্যে। সেই স্থানে বসে রূপকথা শোনার মজাই আলাদা।
কথিত আছে, কৃষ্ণ নিজের পরিবার নিয়ে বেট দ্বারকায় চলে এসে বাড়ি বানিয়েছিলেন থাকার জন্য। গাইড বললেন, “অন্য যেখানেই যান না কেন, সেখানে ভগবানের নিজের বাড়ি নয়। এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে কৃষ্ণ নিজের থাকার জন্য বাড়ি বানিয়েছিল।”
ভোর বলল, “মা কৃষ্ণর তো মথুরায় জন্ম। আর রাধার সঙ্গে প্রেম বৃন্দাবনে। তা সেখান থেকে এখানে এসেছিলেন কেন?”
মেয়ের কথা শুনে তনয় তার অভিজ্ঞ মত দিল, “ভাল জায়গায় নির্ঘাৎ সস্তায় জমি পেয়েছিল।”
আমি হাসলাম তার কথা শুনে। তারপর বললাম, “পালিয়ে এসেছিল।”
“কেন মা?”
“কৃষ্ণের মামা ছিলেন কংস। কংসের স্ত্রী ছিল বিখ্যাত প্রভাবশালী রাজা জরাসন্ধের দুই মেয়ে অস্তি আর প্রাপ্তি। কৃষ্ণ কংসকে বধ করলে তার মেয়েরা বিধবা হলেন।তখন তিনি রাগে আঠারোবার মথুরা আক্রমণ করে তাঁর রাজধানী গিরিব্রজ থেকে গদা নিক্ষেপ করেছিলেন।”
“দেখলে, কৃষ্ণ পালিয়েছিল গদার ভয়ে। তাই এখানে দেখছ না কৃষ্ণ না বলে রণছোড়জি বলছে। তার মানেই তো রণ বা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালানো।” তনয় এবার বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো বলল। যেন, তার অনুমানই সত্য।
ভোর বাবার কথার গুরুত্ব না দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি কিছু বলার আগেই আমাদের পুরোহিত বলল, “স্যার কী বলে হাসছেন সেটা ঠিক বুঝতে না পারলেও একটা অনুমান করতে পারছি। তিনি বোধহয় বলছেন, কৃষ্ণ ভগবান এখানে পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। তিনি অকারণে লোক ক্ষয়, যাদবদের মৃত্যু এসব চাননি।তাই স্বেচ্ছায় চলে এসেছিলেন তাদের নিয়ে মথুরা থেকে।”
তাঁর কথার সত্যমিথ্যা বিচার করার মন নিয়ে আসিনি আমি। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম মন্দিরের আর্কিটেকচর। নিঁখুত সব ভাস্কর্য। কত নাম না জানা শিল্পী কত বছর ধরে বানিয়েছিলেন এই বাসভূমি। কোনো নাম যশের প্রত্যাশা না করেই নিমগ্ন ভাবে একটাই পাথর কেটে বানিয়ে চলেছিলেন এই প্রাসাদ। তখন ছিল না কোনো আধুনিক যন্ত্র, ছেঁদনি দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে নিঁখুত ভাবে রচনা করছেন শিল্প। যে বসত বাড়ি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা , দেবতাদের ইঞ্জিনিয়ার, সেই একই স্থাপত্য কয়েকহাজার বছর পর বানাচ্ছেন কোনো স্থপতি কেবল কল্পনার উপর ভর করে , ভাবতেই অদ্ভুত লাগে।মনে মনে সেই সব নাম না জানা ভাস্কর্য শিল্পীদের প্রণাম জানাই আর ভাবি আসলে সবার মধ্যেই লুকিয়ে ভগবান নানা রূপে নানা বেশে। তাই এমন শিল্প সম্ভব।
গাইড বলছিলেন, খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা করেই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগরচত্বর, সোনা, রূপা ও দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ, জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান ও লেক ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল দ্বারকা নগরী। প্রায় ৭ লক্ষ ছোটবড় প্রাসাদ ছিল এ নগরীতে। এখানে ছিল ‘সুধর্ম সভা’ নামের এক বিশাল হলঘর, যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। গোট অঞ্চল ছিল জলবেষ্টিত। এটি ছিল মূলত একটি দ্বীপ-নগর। চারপাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতো। দ্বারকা নগরী ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। একটি মূল দ্বারকা নগরী ও অন্যটি দ্বীপ-দ্বারকা, যা মূলত ‘বেট-দ্বারকা’ নামেই বেশি প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন সূত্রানুযায়ী এই দুই দ্বারকার মাঝে ছিল অগভীর সমুদ্র। মূল অংশের সাথে দ্বীপ শহরটি নানা ব্রিজ ও বন্দর দ্বারা যুক্ত ছিল। জোয়ারের সময় মূল দ্বারকা থেকে দ্বীপ দ্বারকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আবার ভাটার সময় যুক্ত হয়ে যেত।
আমি জায়গাগুলো ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা করছিলাম।আর অবাক হচ্ছিলাম, এত যুগ আগে এত উন্নত পরিকল্পনার কথা ভেবে।
গাইড এরপর শোনাচ্ছিলেন কৃষ্ণ বন্ধু সুদামার কথা। পাটরানি রুক্মিণী, রাধা, সত্যভামা, জামম্ববতীর কথা।
ভোর বলল, “রাধা তো কৃষ্ণের বৌ নয়, প্রেমিকা। তাহলে এখানে রাধাকে পাটরানি বলছে কেন? আর পাটরানি মানে কী?”
“পাটরানি মানে প্রধান বৌ। বলা হয় কৃষ্ণের ষোলোহাজার রানীর মধ্যে পাটরানি ছিলেন আটজন। তবে বাকি চারজনের নাম আমি ঠিক জানি না।” বলে পুরোহিত মশাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি জানেন বাকি চারজনের নাম?”
তিনি বোধহয় কখনোই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হননি। বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে আর মন্দিরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর রুক্মিণীদেবীর ঘরের সামনে বসে থাকা পুরোহিতের কাছে গিয়ে গুজরাতিতে কিছু জিজ্ঞেস করলে, তিনি একটা লক্ষ্মীর পাঁচালির মতো পুঁথি বের করে বললেন কতগুলো নাম। আমি কিছুটা উদ্ধার করতে পারলাম তার মধ্যে। কালিন্দী, বিন্দা, সত্যা, মাদ্রী, জলহাসিনী, সুশীলা, লক্ষণা…। বাকিগুলোর উচ্চারণ কান অবধি এসে পৌঁছল না।
“মা, রাধার গল্প বলো।” বললাম, “বাবা বলেছিলেন, রাধার জন্মবৃত্তান্ত আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ভাগবত পুরাণ, পদ্মপুরাণে। কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতে নেই। বলা হয়, গোলকধামে রাসমন্ডলে বিষ্ণুর ইচ্ছায় তাঁর বাম অঙ্গ থেকে জন্ম নিয়েছিলেন রাধা। মর্তে এই রাধা কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুদামার শাপে কৃষ্ণের মামা আয়ান ঘোষের স্ত্রী হয়েছিল। আবার পুরাণে বলে, রাধা নয়, রাধার ছায়ার সঙ্গে আয়ানের বিয়ে হয়েছিল। আর আসল রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের।”
“তারপর রুক্মিণী কে?”
ভোর একবার প্রশ্ন করা শুরু করলে ‘মা তারপর তারপর’ করেই যায়। সেই ছোটো থেকে তার এটাই স্বভাব। কোনো গল্প শুরু করলে যতক্ষণ না তার মনের মত হচ্ছে, ততক্ষণ তারপর ‘মা…’ বলেই যাবে।
আমি আবার শুরু করলাম, “বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা হচ্ছে রুক্মিণী। চেদি বংশের রাজা শিশুপালের সঙ্গে তার বিয়ের ঠিক হয়েছিল। কৃষ্ণ রুক্মিণীর রূপের কথা শুনে তার সঙ্গী যাদবদের নিয়ে বিয়ের আগের দিন সেখানে উপস্থিত হল। এদিকে রুক্মিণীও কৃষ্ণের নানা শক্তি আর গুনের কথা শুনে মনে মনে তার অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। সে যখন বিয়ের আগে মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরছিল তখন কৃষ্ণ তাকে নিজের রথে তুলে নিলেন, মানে হরণ করলেন। ফলে যুদ্ধ হল। কৃষ্ণ জিতে দ্বারকায় নিয়ে এসে তাকে বিয়ে করে নিলেন।”
ভোর আবার তারপর বলার আগেই পুরোহিত বলল, “আপনি কি মহাভারত পুরো মুখস্থ করেছেন? আপনি কি প্রফেসর?”
আমি জানতে চাইলাম, “হঠাৎ এমন ধারণা হল কেন? আমায় দেখে কী টিচার মনে হচ্ছে?”
সে কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলে উঠল, “আপনি বহুত পন্ডিত আছেন।” শুনে তনয় হেসে বলল, “আপনি ঠিক বলেছেন, ইনি খুব পণ্ডিত। কিতাব লেখেন।”
পুরোহিত যেন বই লেখে এমন কোনো মহিলাকে এই প্রথম দেখলেন, এমন ভাবে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “আমি তাই ভাবছিলাম।” তারপর খানিক থেমে বললেন, “ম্যাডাম আমাকে সত্যভামা আর জাম্ববতীর গল্পটা বলবেন? অনেকে জানতে চান, কিছুই বলতে পারি না।”
আমি মনে মনে ভাবলাম, একা রামে রক্ষা নেই, সঙ্গে সুগ্রীব দোসর জুটে গেল। তনয় আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। ভাবটা এমন, দেখলে তো কেমন ফাঁদে ফেললাম! মুখে বলল, “ভোর তোমার মাকে বলো গল্পটা বলতে। গরমে এত অপেক্ষা করা যায় না।”
রাগে আমার গা-পিত্তি জ্বলে গেল। ইচ্ছে হল তক্ষনি দুই এক কথা শুনিয়ে দিই। নিজেকে শান্ত করলাম। ধর্মীয় স্থানে এসে মাথা ঠান্ডা রাখো, নিজেকেই বোঝালাম। তারপর ভোরের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম।
“প্রথমে বলি জাম্ববতীর কথা। জাম্ববতী হল রামায়ণের রামের প্রধানমন্ত্রী জাম্বুবানের মেয়ে। মহাভারতে বলছে, সুর্যের উপাসনা করে সত্রাজিৎ পেয়েছিলেন স্যমন্তক মণি। শুদ্ধভাবে পবিত্র মনে ধারণ করলে এই মণি প্রতিদিন আট ভার সোনা প্রসব করে। কিন্তু যদি কেউ অশুদ্ধভাবে অন্যায় উদ্দেশ্যে এটা ধারণ করে তাহলে তার মৃত্যু হবেই।
“সত্রাজিৎ মণি নিয়ে দ্বারকাতে এলে সকলেই তা দেখে মুগ্ধ হল। কৃষ্ণ ভেবেছিল এটা তার দাদু উগ্রসেনের গলাতেই শোভা পাবে। কিন্তু সত্রাজিৎ সেই মণি নিজের কাছে না রেখে তা দিয়ে দিল নিজের ভাই প্রসেনজিৎকে। একদিন প্রসেনজিৎ মৃগয়া করতে গিয়ে আর ফিরলেন না। তখন সবাই ভাবল কৃষ্ণ নির্ঘাত মণির লোভে তাকে মেরে ফেলে মণি নিয়ে নিয়েছে।
“এই শুনে কৃষ্ণ গেল জঙ্গলে। তাকে এই বদনাম থেকে উদ্ধার পেতেই হবে। গিয়ে বুঝতে পারলেন, একটা সিংহ প্রসেনজিৎকে বধ করেছে। সেই সিংহকে হত্যা করে জাম্ববান সেই মণি নিয়ে নেয়। কৃষ্ণ জানতে পেরে তার সঙ্গে যুদ্ধ করলে পরাজিত হয়ে সে মণি তো ফেরত দিলেনই, তার সঙ্গে নিজের মেয়েকেও দিয়ে দিলেন কৃষ্ণকে। মণি নিয়ে কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরলে সত্রাজিৎ কৃষ্ণের নামে মিথ্যে কলঙ্ক রটানোর লজ্জায় ,অনুশোচনায় নিজের মেয়ে সত্যভামাকে কৃষ্ণের হাতে সমর্পণ করলেন।”
টানা গল্প বলার পর একটু থামতেই ভোর বলল , মা তারপর…
এরপর আগামী সংখ্যায়
ফটোগ্রাফিঃ লেখক
জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি