বিতস্তা ঘোষাল
পর্ব ২
“তারপর আর কিছু নেই, এবার চলো।” বলে মন্দির থেকে বাইরে এলাম।
পুরোহিত ছেলেটি এবার নিজের থেকেই রুক্মিণীর ছেলে-মেয়ের নাম বলতে শুরু করল। রুক্মিণী মায়ের দশ ছেলে- প্রদ্যু্ম্ন, চারুদেষ্ণ, সুদেষ্ণ, চারুদেহ, সুষেণ, চারুগুপ্ত, ভদ্রচারু,চারুবিন্দ, সুচারু ও চারু। আর এক মেয়ে চারুমতী। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে ফটাফট নিজের মোবাইলে আমার আর ভোরের সঙ্গে কিছু বোঝার আগেই সেলফি তুলে নিয়ে বলল, “আমার সাথে মন্ত্রী, ফিল্মস্টার, সিঙ্গার সবার ছবি আছে। খালি রাইটারের নেই। সেই শখ ভগবান কৃষ্ণ মিটিয়ে দিলেন। বলো কৃষ্ণ ভগবানকী…” আশপাশ থেকে সব বলে উঠল, “জয়।” আবার বলল, “বলো দেবী রুক্মিণী মাতা কী…” সমবেত স্বরে প্রতিধ্বনি উঠল, “জয়…”
সেখান থেকে সরে এসে আমি তখন ভাবছিলাম যদি হরপ্পা খনন করে পাওয়া তামা, জিনিসপত্র সব আমরা প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিই, তবে হয়তো আরো খনন করলে অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্রের তলায় বিলীন আরো প্রাচিন এই সভ্যতার অস্তিত্বও প্রমাণিত হবে, যার রাজা ছিলেন কৃষ্ণ নামধারী কোনো ব্যক্তি, যিনি আপন ক্ষমতাবলে, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, দিয়ে ক্রমশ দেবতা বা ভগবানের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। এ-কথা তো ঠিক সাধারণ মানুষের থেকে উন্নত মানুষকেই আমরা ভগবানের মর্যাদা দিই। যেমন আমাদের অতি পরিচিত রামকৃষ্ণ, আরো আগে পয়গম্বর হজরত মহম্মদ কিংবা যিশুখৃষ্ট যারা মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই।
দেখা শেষ করে আবার ফিরলাম স্টিমারে। রোদে পুড়ে যাচ্ছে চামড়া, কিন্তু মন অদ্ভুত শান্ত। শেখভাই বললেন, “দ্বারকা যদি সত্যিই সোনার নগরী ছিল তো সোনা কী যেভাবেই হোক কেউ তুলে আনত না!” কথাটা শুনে মনে হল, তাজমহলেরও অনেক স্তম্ভ সোনার ছিল, ফতেপুর সিক্রি দেখার সময় গাইড দেখিয়ে ছিলেন, সোনার স্তম্ভগুলো আগুন দিয়ে গলিয়ে বৃটিশ কিভাবে চুরি করে নিয়েছিল। আমরা এর কোনোটাই দেখিনি। অথচ বিশ্বাস করেছি। কে বলতে পারে সমুদ্রের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা সভ্যতা খুঁড়লেও এমন কিছুই জানা যাবে কিনা! আমরা কি আদৌ আমাদের প্রাচীন সভ্যতা খনন করেছি! সবটুকুই তো সেই কবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন, তাও বৃটিশ আমলে। সব কি আমরা জানতে পেরেছি! কে জানে! এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পরল, সাম্প্রতিক কালে একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম, বেট দ্বারকার সমুদ্রে প্রচুর শঙ্খর অস্তিত্ব রয়েছে। তাই এ ভূমির নাম বেট শঙ্খদ্ধার।
বিষ্ণু পুরাণে বলছে, অবন্তীপুরে সান্দীপনি মুনির কাছে অস্ত্র শিক্ষার পর কৃষ্ণ বলরাম দুই ভাই যখন গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলেন, তখন মুনি বললেন, প্রভাসে লবণ সমুদ্রে মৃত তার পুত্রকে জীবিত অবস্থায় এনে দিতে হবে। গুরুর কথা শুনে তারা দুজনে উপস্থিত হল সেখানে। ভয় পেয়ে সমুদ্র বলল, সান্দীপনি মুনীর ছেলেকে আমি নিই নি। তাকে হরণ করেছে পঞ্চজন নামে এক অসুর। সে এখন আমার জলে শঙ্খ রূপে আছে। এই কথা শুনেই কৃষ্ণ সমুদ্রে প্রবেশে করে পঞ্চজনকে বধ করে তার অস্তিতে উৎপন্ন শঙ্খটা গ্রহণ করলেন। কৃষ্ণের অপর নাম তাই পাঞ্চজন্য। আর কৃষ্ণ তো শঙ্খ বাজিয়েই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আলোচিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। কী অদ্ভুত সাযুজ্য!
হঠাৎ মনে পড়ল শেখভাই বলছিলেন, দ্বারকা এখানে ছিল না। বিস্তারিত জানার জন্য সেটাই তার থেকে জানতে চাইলাম।
শেখভাই বললেন, “বিশ্বাস হবে না নির্ঘাৎ। কিন্তু জানতে চাইছেন বলে বলছি। আপনি তো জার্নালিস্ট। এটাও লিখে দেবেন বইতে।”
বললাম, “আপনি বলুন, আমি রেডি।”
“সে অনেক যুগ আগের কথা। আমার পিতাজীর মুখে শোনা। তিনিও কারোর থেকে শুনেছেন। এসব কাহিনি তো মুখে মুখেই আগে বলা হত, অনেক পরে লেখা হয়।”
ভোর ফিসফিস করে বলল, “মা বেদের অপর নাম তাই শ্রুতি, তাই না?”
“হুম। এখন চুপ করে ওঁর গল্পটা শোনো।”
শেখভাই গাড়ি চালাতে চালাতে বলতে লাগলেন, “ডাকোর বলে মহারাষ্ট্রের কাছে একটা জায়গা আছে। আগে সেটা সৌরাষ্ট্রের অন্তর্গত ছিল। এখন মুম্বাই থেকে কাছে। সেখানকার এক বিষ্ণুভক্ত, নাম তার বোদানো। প্রতি বছর সে দ্বারকায় যায় রণছোড়জির দর্শন করতে। তার হাতের তেলোয় অদ্ভুতভাবে গজায় তুলসীর গাছ। তিনি সেই তুলসী গাছের পাতা রণছোড়জির চরণে নিবেদন করেন। দীর্ঘদিন ধরেই সে এভাবেই পায়ে হেঁটে যায় আর দর্শন করে ফিরে আসেন।
“ক্রমশ তিনি বুড়ো হলেন, আগের মতো আর হাঁটতে পারেন না,তবু অতি কষ্ট করে এলেন রণছোড়জির কাছে। ভগবানের দুয়ারে এসে কেঁদে বললেন, ‘আমি কী আর তোমার দর্শন পাবো না?’ ভক্তের চোখের জল দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না প্রভু। তিনি গভীর রাতে স্বপ্ন দিলেন, ‘তোকে আর আসতে হবে না, আমিই যাব এবার তোর সঙ্গে ডাকোরে। এবার থেকে সেখানেই থাকব আমি।’
“আনন্দে বোদানোর ঘুম ভেঙে গেল। সে ভোরে যাত্রা শুরু করল ডাকোরের উদ্দেশ্যে। প্রভুও চললেন তার সঙ্গে।” ভোর শুনছিল মন দিয়ে। সে বলল, “সত্যি মা?”
আমি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করে শুনতে বললাম।
শেখভাই বলছিলেন, “পরদিন সকালে পুজারী গুগলি ব্রাহ্মণেরা আশ্চর্য হয়ে দেখল যে মন্দিরে ঠাকুর নেই,তারা ভাবল নির্ঘাত বোদানোর মূর্তি চুরি করে নিয়ে গেছে। তখন তারা কাবা নামে ব্যাধদের সঙ্গে নিয়ে ছুটল বোদানোকে ধরার জন্য। এই ব্যাধেরা ছিল সাংঘাতিক। তীর ধনুকে দারুণ পারদর্শী। একবার ধরে ফেললে মেরেই ফেলবে।”
“তারপর…”
ভোরের তারপর বলা শুরু হয়ে গেল। শেখভাই গাড়ি চালাতে চালাতে মাথাটা একটু ঘুরিয়ে আবার বলতে লাগলেন, “ভক্তের বিপদ দেখে প্রভু ভক্তকে নির্দেশ দিলেন তাঁকে গোমতীর জলে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু পুজারী ব্রাহ্মণরাতো ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বিগ্রহ পেল জলের তলায়। খোঁজার সময় বর্শার ফলা লেগেছিল প্রভুর গায়ে। সেই দাগ এখনো আছে।”
“মা আমরা ভাল করে দেখলাম নাতো!”
“আমরা কি অত কাছ থেকে দেখেছি ভোর!”
“তাও ঠিক। আঙ্কল তারপর কী হল?”
আমাদের আগ্রহ দেখে শেখভাই আবার নতুন উদ্যমে বলা শুরু করলেন, “বোদানোর পরিণতি নিয়ে নানা মত আছে। কেউ বলে কাবাদের তীর লেগে সে মারা গেছিল, ভগবান তার স্ত্রীকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন। আবার কেউ বলে, প্রভু ব্রাহ্মণদের বলেন, কেউ তার ভক্তের গায়ে হাত দিতে পারবে না। তার বদলে বোদানো তাদের সমমূল্য সোনা দেবে। কিন্তু বোদানোর কাছে অত সোনা তো নেই। সেটা ভগবান জানতেন। ভক্তকে অভয় দিয়ে বলেন, তোর ঘরে যা সোনা আছে তাতেই হবে।
“পুজারীরা তাতেই রাজি হলেন। একদিকে বিগ্রহ রাখা হল। কিন্তু অন্য দিকে সোনা তো নেই। তখন বোদানোর স্ত্রী কানের এক জোড়া দুল প্রভুর নাম নিয়ে রাখল। সবাই তো তা দেখে হাসছে। এতটুকু সোনার পাশে অতবড় বিগ্রহ! দেখা গেল বিগ্রহের ওজন মাত্র একটা ছোটো দুলের সমান। ব্রাহ্মণরা আর কী করে! তারা সেই একটা দুল নিয়েই ফিরে গেল। আর ডাকোরে প্রতিষ্ঠিত হল রণছোড়জি।”
“তাহলে দ্বারকায় যে রণছোড়জির মূর্তি সেটা কবেকার?” তনয় যে গল্প শুনছিল সেটা এতক্ষণে খেয়াল করলাম।
শেখভাই বললেন, “শোনা যায়,রণছোড়জি পুজারীদের স্বপ্ন দিয়ে বলেছিলেন, দ্বারকায় সাবিত্রী ভাবেতে একটা মূর্তি পাওয়া যাবে। সেই মূর্তিই যেন তারা নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করে। ক’দিন পর তারা সত্যিই সেখানে মূর্তি পেয়ে প্রতিষ্ঠা করল ভগবানকে।”
“মা ভাব মানে কী?”
উত্তরে শেখভাই বললেন, “কুয়ো।”
ভোর এবং তনয় দুজনেই এবার আমার দিকে তাকাল। বুঝলাম এরা জানতে চাইছে শেখভাই যা বললেন, ঠিক কিনা! যেন আমি সবজান্তা পন্ডিত। আমি নিজের মাথার মধ্যে ব্রেন স্টর্মিং শুরু করে শেখভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ডাকোরের মন্দির কত দিনের প্রাচীন?”
উত্তর যেন তার ঠোঁটে ডগায় ছিল। সঙ্গেসঙ্গেই বললেন, “শুনেছি ১৭৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। গোপাল জগন্নাথ তাম্বেকের এক লক্ষ টাকা নাকি এর জন্য খরচ হয়েছিল। কষ্টিপাথরে তৈরি বিষ্ণুমূর্তি, হাতে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম। সোনার সিংহাসনে তিনি বসে। সিংহাসন দিয়েছিলেন, বরোদার গাইকোয়াড়,তার দাম নাকি তখনকার সময়ই ছিল, সোয়া লক্ষ টাকা।”
“শেখভাই আপনি দেখেছেন সে মন্দির?”
একটু চুপ করে গেলেন শেখভাই। তারপর বললেন, “না। আল্লা বা ভগবান সবার, কিন্তু মন্দির সম্প্রদায়ের হাতে।” আর এই নিয়ে কোনো কথা হল না। মানুষের সৃষ্টি এই ভেদাভেদ কবে যে মুছবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, একটা বইয়ের কথা। সেখানে পড়েছিলাম, কবি গোপালদাস নাকি লিখেছেন, ১২১২ সংবতের বৃহস্পতিবার কার্তিক পূর্ণিমার দিন বোদানো এই বিগ্রহ দ্বারকা থেকে ডাকোরে নিয়ে গেছিলেন। সরকারি গেজেটিয়ারেও এর উল্লেখ আছে। ১১৫৫ খ্রিষ্টাব্দে এই বিগ্রহ সরানো হয়েছিল। সেখানে আরো লেখা ছিল, দুর্গাশঙ্কর শাস্ত্রী নামে এক পন্ডিত ব্যক্তি মনে করেন যে, গজনি যখন সোমনাথ লুঠ করেন তখন দ্বারকা কোনো তীর্থস্থান ছিল না। থাকলে তিনি সেটাও লুঠ করতেন এবং তার প্রমাণ থাকত। তীর্থ হিসেবে দ্বারকা মর্যাদা পায় আরো পরে। সম্ভবত ১২০০ সংবতের পর।
অবশ্য আমি নিজে নিশ্চিত হলাম না এই বইয়ের তথ্যে। কারণ তাই যদি হয় তবে বরাহ পুরাণ বা লক্ষ্মীধরের তীর্থকল্পতরুতে দ্বারকার নাম থাকত না। কিন্তু অজস্রবার উল্লেখ আছে এখানে। এগুলো দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকের রচনা।
হোটেলে ফিরে ভোর নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল, “মা দেখ এখানে বলছে, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ভারত বিচিত্রার পঞ্চদশ বর্ষ মার্চ ১৯৯৮ ফাল্গুনচৈত্র ১৩৯৪, পৃষ্টা ২৪-২৮তে গোয়াস্থ ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অব ওশেনোগ্রাফি এর মেরিন আরকিওলজি সেন্টারের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর ডঃ এস আর রাও এর লিখিত ও শ্রী নান্টু রায়ের অনুদিত “সমুদ্র প্রত্নতত্ত্বের বিস্ময় জলধি নিমগ্ন মন্দিরময় শহর দ্বারকাকে খুঁজে পাওয়া গেছে” র্শীষক এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ-প্রবন্ধে বলা হচ্ছে, উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বহু চেষ্টা করে জলমগ্ন ও ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারের মাধ্যমে পুরানো সময়ের সমুদ্রতীরবর্তী জাহাজ নির্মাণ ও তত্কালীন শিল্প সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে দ্বারকা নগরীর সন্ধান লাভের এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। এই ডুবে যাওয়া জাহাজ ও জলমগ্ন শহর সমুদ্রতলে টাইম স্কেল (Time Scale)হিসেবে কাজ করেছে। প্রায় ২১০ টি জাহাজের ভগ্নাবশেষ এ-পর্যন্ত পাওয়া গেছে এবং এর মধ্যে ৩২টির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ (Geological Survey) করে দেখা গেছে যে, ভারতীয় সমুদ্র উপকূলে অনেক প্রাচীন বন্দর ডুবে গেছে, আর এর মধ্যে দ্বারকা হচ্ছে একটি। দূর নিয়ন্ত্রিত (Remote Controlled) সাইডস্ক্যান সোনার (Sonar) ও সাব এটম প্রোফাইলারের সাহায্যে খোঁজাখুজি করে দ্বারকা নগরীর সমুদয় লুপ্ত নিদর্শন উদ্ধার করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়েছে। কেননা ৫-৮ মিটার নীচে সমুদ্র বক্ষে জমাটবদ্ধ ও চলনশীল বালুকণারাশি ভূতাত্ত্বিক জরিপের কাজে বেশ অন্তয়ায় সৃষ্টি করে। এছাড়া সমুদ্রে অবিরাম ঢেউ ও তীব্র স্রোত। লক্ষ্যবস্তুর ছবি তোলা ও খনন কাজ করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
“মা, এখানে আরো বলছে, বেট দ্বারকার (Bet Dwarka) আশেপাশে এখনো ভয়ঙ্কর সব অক্টোপাসের বাস করছে যা ডুবুরিদের জন্য বেশ বিপজ্জনক। এসব অসুবিধে ও বাধা অতিক্রম করে সমুদ্র প্রত্নতত্ত্ব অভিযানের বিজ্ঞানী ও ডুবুরিরা দুর্গপ্রাচীর ও অন্যান্য ভবন পাথরের তৈরি বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন, লোহার নোঙ্গর, বিভিন্ন মুদ্রা,পট,পুঁতির মালা আবিস্কার করতে পেরেছেন। ডুবন্ত দ্বারকা ও বেট দ্বারকায় ১৯৮২থেকে ১৯৮৬
এই চার বছরে সর্বমোট ৫ ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে। আরব সাগরে থেকে সমুদ্র নারায়ণের
যে মন্দির দেখা যায় সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। কারন এখানেই প্রাচীনকালে সমুদ্র দেবতা (Sea God) মন্দির নির্মিত হয়েছিল। ৫৭৪ খ্রীস্টাব্দে রাজা গরুলকের (Garulaka King) নানা লিপি থেকে পূর্বোল্লিখিত দ্বারকার কথা জানা যায়। যদিও পুরানো দ্বারকার ওপরেই নতুন দ্বারকা অবস্থিত তবুও এর প্রকৃত পরিচয় ১৯৭৯-৮০ সালের আগে জানতে পারা যায়নি। এ সময় দ্বারকাধীশ মন্দিরের সম্মুখে ভূমি খুঁড়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪-১৫ শতকের ৩টি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে ডুবন্ত নগরীটির বাস্তুধ্বংস আবিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতকে নির্মিত বিষ্ণুমন্দির সবচেয়ে কম পুরোনো। এখানে বিষ্ণু, শিব ও অন্যান্য দেবদেবীর চমৎকার সব ছবি উৎকীর্ণ রয়েছে। প্রথম দিকের মৃত্তিকাস্তরে একটি উজ্জ্বল লাল বর্ণের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। এটি প্রভাসক্ষেত্রের এবং বয়স ১৫শ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ( কার্বন-১৪ প্রণালীতে বয়স পরিমাণ করা হয়েছে)। মা, তারমানে দ্বারকা আর বেট দ্বারকা সত্যি ছিল, তাই না?”
“সেরকমই তো মনে হচ্ছে রে। চল, এবার খেয়ে শুয়ে পড়ি।”
আমাদের রুমে ডাইনিং রুম আলাদা থাকলেও সবার সঙ্গে একসাথে খাব ভেবে কমন ডাইনিং রুমেই খেতে গেলাম। ভেন্ডি আলুর একটা ঝাল কারি, রুটি, ভাত আর পাঁপড়ের বেশি এখানে কিছুই রান্না হয় না জানালেন এখানকার কুক। তবে আলু ফ্রাই করে দিতে পারেন অর্ডার দিলে, সেটাও বললেন।
ভোর বলল, “আজ খেয়ে নাও মা, কাল দেখা যাবে।”
আমি হাসলাম। আমার সঙ্গে বাইরে ঘুরতে ঘুরতে মেয়েটা কবে যেন সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে শিখে গেছে ভেবে একটা অদ্ভুত ভাল লাগায় মন ভরে উঠল।
*****
ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্য মহাভারতের মহানানায়ক, শ্রীকৃষ্ণর রাজত্ব দ্বারকায় এখন আমরা। ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা ৬টা। সূর্য এখনো আকাশে। দেখে মনে হচ্ছে তিনটে -চারটে হবে, এতটাই তেজ তার। শহরের মধ্যেই এই পবিত্র স্থান। মনে করা হয় দ্বারকা হিন্দুদের চারটি প্রধান ধর্মীয় স্থান বা চারধামের একটি। দ্বারকা শব্দের ‘দ্বার’ -অর্থ দরজা আর ‘কা’ অর্থ স্বর্গ কিংবা মোক্ষ। সে অর্থে দ্বারকা মানে ‘স্বর্গের দ্বার’ কিংবা মোক্ষ লাভের উপায়। মন্দির চত্বরে প্রাচীন রাজ তোরণের মত গেট ঢোকার মুখেই যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
মন্দিরে ঢোকার মুখে গাড়ি রেখে মূল মন্দিরের ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে এত বড় মন্দির রয়েছে। অনেকটা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাঁচিলের মত উঁচু পাঁচিল চারদিকে। জুতো রাখতে গিয়ে পরিচয় হল, এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে। আমরাও ব্রাক্ষণ জেনে নিজেই পুরো মন্দির ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব নিলেন।
৮০০ বছর পুরানো ও ৫৭ মিটার উঁচু কৃষ্ণ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সেই গাইড বলছিলেন, অতীতে দ্বারকা শুধু পৌরাণিক গল্প হিসেবে মনে করা হলেও ২০০০ সালে এই স্থানে এক প্রত্নতত্ত্বীয় অভিযানে সমুদ্রের নিচে খোঁজ মেলে প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষের, যা আসলে সেই প্রাচীন নগরী দ্বারকা।
তিনি আরো বললেন, পৌরাণিক নগরী দ্বারকার কথা মহাভারত সহ ভগবত গীতা, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণপুরাণ, হরিবংশ ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
আমার তখন মনে পড়ছিল মহাভারতে পড়া ঘটনাবলী। কৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন তৎকালীন মথুরার অত্যাচারী রাজা। পরবর্তীতে কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করেন। এ খবর শুনে কংসের শ্বশুর, মগধের রাজা জরাসন্ধ রেগে গিয়ে এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু ১৭ বার মথুরা আক্রমণের পরও জরাসন্ধ মথুরা জয় করতে ব্যর্থ হন। তবে এতবার আক্রমণে মথুরার অধিবাসী যাদবরা দুর্বল হয়ে পড়ে। কৃষ্ণ যখন বুঝতে পারেন জরাসন্ধ আর একবার আক্রমণ করলে তারা আর তা প্রতিরোধ করতে পারবেন না, তখন তিনি তাঁর লোকজন নিয়ে মথুরা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নতুন এক শহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করেন। কারো কারো মতে কৃষ্ণ গরুড়ে চড়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমের সৌরাস্ট্রে আসেন এবং সেখানে দ্বারকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। আবার কারো মতে, নতুন এই শহর প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষ্ণ নির্মাণের দেবতা বিশ্বকর্মার সাহায্য নেন। বিশ্বকর্মা কৃষ্ণকে জানান, যদি সমুদ্রের দেবতা তাদের কিছু জমি প্রদান করেন তবেই এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কৃষ্ণ তখন সমুদ্রদেবের পূজা করেন এবং সমুদ্রদেব খুশি হয়ে কৃষ্ণকে ১২ যোজন জমি প্রদান করেন। জমি পাওয়ার পর বিশ্বকর্মা সেখানে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন।
এইসব ভাবতে ভাবতে চারপাশ দেখছিলাম। গাইড ভদ্রলোক বললেন, “ব্রাহ্মণ ছাড়া এ মন্দিরে কেউ পুজো করতে বা গাইড হতে পারেন না। এমনকি মন্দিরের চূড়ায় যে ধ্বজা বাঁধা হয় রোজ পাঁচবার করে, তাও ব্রাহ্মণরাই বদলান। আরো বললেন, এই ধ্বজা ৪০ মিটার কাপড় দিয়ে বানানো হয়। সবুজ আর কালো রং বাদে সব রঙেরই ধ্বজা হয়। সবুজ নয় কেন জানতে চাইলে তিনি বললেন, সবুজ মুসলিমদের পতাকার রং,তাই. .।
আমি মনে মনে ভাবলাম, হে ঈশ্বর, তোমার এখানেও এত ভেদাভেদ। ধর্ম, জাত, এসব থেকে বেরতে পারছে না কেউ-ই! অথচ কৃষ্ণ মন্দিরে এমন হওয়া উচিত নয়। সব ধর্মের মানুষ কেবল একটি মন্ত্রেই প্রাণ খুলে নাচে গায়। ভোর নিজের মনেই গাইছিল, হরি হরায় নম কৃষ্ণ যাদব ভাই নম. .
সেটা শুনতে শুনতে বললাম, “পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এই ধ্বজা বাঁধার কাজ করে হরিজন সম্প্রদায়ের ১৮ বছরের নিচের বাচ্চা ছেলেরা।”
শুনে তিনি বললেন, “জগন্নাথ তো আসলে আদিবাসী দেবতাই ছিলেন। তাই তাঁর কাছে নিচু সম্প্রদায়ের মানুষেরাও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।” পরমুহূর্তেই বললেন, “কৃষ্ণ ভগবানও সবার উপরে মানুষকেই মর্যাদা দিয়েছিলেন।” যাহোক, তিনি বোঝাচ্ছিলেন, মহাভারত অনুযায়ী দ্বারকা ছিল শ্রীকৃষ্ণ তথা যদুবংশীয়দের রাজধানী। খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা করেই দ্বারকানগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগরচত্বর, সোনা, রূপা ও দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ, জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান ও লেক ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল দ্বারকা নগরী। প্রায় ৭ লক্ষ ছোটবড় প্রাসাদ ছিল এ নগরীতে। এখানে ছিল ‘সুধর্ম সভা’ নামের এক বিশাল হলঘর, যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। গোটা নগরীটি ছিল জলবেষ্টিত। এটি ছিল মূলত একটি দ্বীপ-নগর। চারপাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করত।
দ্বারকা নগরী ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। একটি মূল দ্বারকা নগরী ও অন্যটি দ্বীপ-দ্বারকা, যা মূলত ‘বেট-দ্বারকা’ নামেই পরিচিত।
কৃষ্ণ তাঁর বাকি জীবন এই দ্বারকা নগরীতেই অতিবাহিত করেছিলেন। শেষের দিকে তিনি ভাল্কা তীর্থের এক বনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দুর্ঘটনাবশত এক শিকারীর তিরবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর গোটা দ্বারকা নগরী এক বিশাল বন্যায় সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায়।
কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই দ্বারকা নগরী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর বহু শতাব্দী ধরে বহু সভ্যতার মানুষ সেই স্থানে তাদের শহর নির্মাণ করে এসেছে। বর্তমানে সেখানে যে দ্বারকা নগরী রয়েছে সেটি ঐ স্থানে এমনই ভাবে নির্মিত সপ্তম শহর। দ্বারকার মূল মন্দিরটির বর্তমান নাম দ্বারকাধীশ মন্দির।
গাইড আরো বললেন, “অনেকের মতে, এই পাঁচতলা মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত। আমাদের বিশ্বাস ৫০০০ বছরের পুরোনো এই মন্দির তৈরি করেছিলেন কৃষ্ণের প্রপৌত্র, কৃষ্ণর স্মৃতি স্বরূপ।”
গোমতী নদীর তীরে সমুদ্রের সঙ্গে নদীর মিলনস্থানে নির্মিত এই মন্দির ৫০০০ হাজার বছরের নাকি ৫০০ বছরের তা নিয়ে না ভেবে দু’চোখ ভরে দেখলাম এর স্থাপত্য, ভাস্কর্য।
আরো খানিকক্ষণ মন্দিরের ভেতরের রাধা, রূক্মিণী, জাম্ববতী, মা দেবকি, সুদামা, ঋষি দুর্বাসা, সরস্বতী, বলরাম, রাধাকৃষ্ণ যুগল, গোপাল কৃষ্ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ, অম্বিকা, মীরাবাঈ, দত্তাত্রেয়, নবগ্রহ, শঙ্করাচার্য সহ একাধিক দেবদেবীর মূর্তি দেখে গোমতি নদীর তীরে তনয় ও ভোরা উটে চেপে চারপাশ ঘুরল।
আমি নতুন নির্মিত সুদামা ব্রিজের নানা আলোর ঝরনা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কালো পাথরে তৈরি চতুর্ভূজ মূর্তি আমি এর আগে কোথাও দেখিনি। এ যেন আমাদের দেখা পরিচিত কৃষ্ণ নন। বৈকুন্ঠের ভগবান নারায়ণ। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গোমতী, যদিও বাঁধানো, বিস্তার বা প্রসার কোনোটাই বিশাল নয়, তবু সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই নদীর তীরেই হয়তো কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতেন।
একটা বাচ্চা মেয়ে মন্দিরা বাজিয়ে গাইছিল। সুরটা চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না গানটা।
হঠাৎই পাশে কারো ডাক শুনলাম, “বেটি।” সেদিকে তাকাতে দেখি এক বৃদ্ধ লোক। আমাকে বললেন, “বেটি এ হল কৃষ্ণের রাজধানী। এখানেই মীরাবাঈ তাঁর সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছেন। তুমি দেখেছ?”
আমি কিছু না বলে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, “মীরাবাঈয়ের বাড়ি ছিল মেবারে। সেখানেই তাঁর শ্বশুরঘর ছিল। কিন্তু তিনি সারাদিন কৃষ্ণভজনে মগ্ন থাকতেন। তাই স্বামী তাঁকে ছেড়ে দেন। তিনি তখন এখানে চলে আসেন। সারাদিন তিনি এখানে বসে গান করেন। ওদিকে তখন স্ত্রীকে ত্যাগ করে রাণাও ভাল নেই। তিনি তাঁর রাজ্যের বৈষ্ণব ব্রাহ্মণদের পাঠালেন মীরাকে স্বমর্যাদায় মেবারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তাঁরা এলেন। কিন্তু মীরা তখন রাজপ্রাসাদের মোহ ত্যাগ করে পুরো সাধিকা হয়ে গেছেন। শোনা যায় আকবরও নাকি তাঁর ভজন শোনার জন্য এখানে এসেছিলেন চুপিচুপি। সঙ্গে এসেছিলেন তানসেন। তুমি তানসেনের নাম শুনেছ?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আকবরের সভার বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, যার গানের মুর্চ্ছনায় আগুন জ্বলে উঠেছিল।” শুনে বৃ্দ্ধ খুশি হলেন। বললেন, “এখন আর কেউ এ-সব জানে না, জানতেও চায় না। তারপর যা বলছিলাম, মীরা সেই ব্রাক্ষণদের ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু তারা তো তাঁকে না নিয়ে ফিরবেন না। মন্দিরের দরজাতেই তাঁরা বসে রইলেন। তখন মীরা বললেন, ‘বেশ তবে আমি রণছোড়জির অনুমতি নিয়ে আসি। নইলে তো যেতে পারব না।’ বলে তিনি মন্দিরে ঢুকলেন, কিন্তু আর ফিরে এলেন না। পরদিন সকলে দেখল রণছোড়জির গায়ে মীরার শাড়ি। মীরাবাঈ তাঁর শরীরে বিলীন হয়ে গেছে চিরতরে।”
শুনতে শুনতেই গানের কথাটা মনে পড়ে গেল। বলো রাম বলো শ্যা্ম/ জগ মে সুন্দর হৈ দো নাম/ চাহে কৃষ্ণ কহো ইয়া রাম… এক হৃদয় মে প্রেম ভার আভে এক তাপ সন্তাপ মিটাভে…।
গুনগুন করে গেয়ে উঠে পাশ ফিরে দেখি বৃ্দ্ধ, মেরে তো গিরিধর গোপাল দুসর ন কঈ… গাইতে গাইতে মন্দিরের দিকে চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আরো কিছুক্ষণ বাদে ভোরেরা ফিরে এল।
সেখান থেকে সাড়ে আটটা নাগাদ বেরোলাম ২ কিমি দূরের রুক্মিণী মন্দির দেখতে। চারপাশটাই প্রায় ফাঁকা। এতক্ষণের জাঁকজমক এখানে প্রায় উধাও। লাইটগুলোরও তেমন যেন জোর নেই। ভক্তের সংখ্যাও বেশ কম। গুটিকয় মহিলা পুরুষ দাঁড়িয়ে। বোঝা যাচ্ছে তাঁরা স্থানীয় এবং প্রায়ই আসেন। কাছাকাছি লোকালয় দেখা যাচ্ছে না। দূরে ছোটো ছোটো বাড়ি। মনে পড়ল, শেখভাই বলেছিলেন, টাটাদের সিমেন্টের কারখানা আছে এদিকে। এগুলো তাহলে কারখানার কর্মীদেরই বাড়ি। পাঁচিলের পিছনে দেখলাম অগভীর জলা জমি। সমুদ্রের জল বোধহয় কোনোভাবে এখানে এসে পড়ছে। তবে সেটা খুব কমই মনে হল সেই রাতের অল্প আলোয়।
মন্দিরের প্রধান স্থলে রুক্মিণী দেবীর পুজো দিয়ে নামার সময় পুজারী বললেন, “এখানে জল দান করতে হয়।”
ভোর যথারীতি জানতে চাইল, “কেন?”
পুরোহিত বললেন, “এই মন্দিরে এসে জল দান না করলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় না।”
তনয় বলল, “ওসব কিছু না, আসলে সবই এদের ব্যাবসা।”
পুরোহিত বললেন, “ভক্তি দিয়ে বিচার করলে ব্যাবসা মনে হয় না। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।”
ভোর বলল, “বাবা এত খরচ তো হচ্ছে, দাও না টাকা!”
তনয় মেয়ের কথা শুনে পকেট থেকে টাকা বের করে দেওয়া মাত্রই পুরোহিত পরিষ্কার বাংলায় বললেন, “কোথায় বাড়ি? কলকাতা?” তারপর উত্তরের প্রত্যাশা না করেই গল্প জুড়ে দিলেন, “আমার বাড়ি কালিঘাট। বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম। বাবা সিমেন্ট কারখানায় কাজ করত। আমার স্কুল যেতে ভাল লাগত না। ব্রাহ্মণের ছেলে। পুজা মন্ত্র শিখে নিলাম। আরে বাবা সৎ পথে থেকে অর্থ রোজগার করে পরিবারের ভরণ পোষণ করতে পারলেই তো হল,কী বলেন!”
তনয় তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ল। ভোর বলল, “মা তুমি ততক্ষণ বলো কেন জল দান করতে হয় এখানে?”
পুরোহিতমশাই নাম বললেন না। পদবি জানালেন। ভট্টাচার্য। শুনতে পেলেন বোধহয় ভোরের প্রশ্ন। বললেন, “এদিকে এসো, আমি বলছি…”
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তিনি বলতে লাগলেন, “কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের কূলপুরোহিত ঋষি দুর্বাসা কৃষ্ণ ও রুক্মিণীর অনুরোধে তাঁদের নবনির্মিত বাড়ি দ্বারকায় আসতে ও ভোজন করতে সম্মত হন। শর্ত একটাই। কৃষ্ণ ও তাঁর স্ত্রীকে যেতে হবে তাঁকে আনতে, এবং ঘোড়া টেনে নিয়ে আসবেন তাঁরাই। কৃষ্ণ সম্মতি প্রদান করেন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঋষিসহ ঘোড়া টেনে আনার সময় রুক্মিণীর প্রবল জলতেষ্টা পেল। সময়টা চৈত্র মাসের এক দুপুর। পিপাসায় কাতর স্ত্রী নারায়ণ বা কৃষ্ণর কাছে জল চাইলে কৃষ্ণ মাটিতে পায়ের আঙুল দিয়ে চাপ দিলে জল মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে তৃষ্ণার্ত রুক্মিণীর তৃষ্ণা মেটাল। কিন্তু তাঁর অনুমতি না নিয়ে জল খাওয়ায় ঋষি রেগে গিয়ে তাঁদের শাপ দেন। তিনটি শাপের প্রথম শাপ হল, স্বামী-স্ত্রীকে ১২ বছর আলাদা থাকতে হবে। তখন কৃষ্ণ স্ত্রীর জন্য দ্বারকা থেকে ২ কিমি দূরে জঙ্গলে এই বাড়ি তৈরি করে দেন। দ্বিতীয় শাপে পুরো অঞ্চলের জল নোনতা হয়ে যায়। আর তৃতীয় শাপের ফলে ক্ষেতি জমি মেলা ভার।”
ভোর শুনে বলল, “দুর্বাসা, সে তুমি মুনিই বলো আর ঋষিই বলো, খুব রাগী আর অহংকারী ছিলেন। কথায় কথায় খালি অভিশাপ। কারো কোনো ভাল করেছিলেন কিনা যতটা জানি, তার থেকে বেশি খারাপ করেছিলেন।”
তনয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে কন্যা বলল, “ক্রোধ অহংকার উগ্র রাগ মানুষের ভিতরের ভালকে নষ্ট করে দেয়, তোমার যদি এতই শক্তি তাহলে এমন কিছু শাপ দাও যাতে সারা দেশের মানুষের মঙ্গল হয়। বলতে পারত, এখানে আজ থেকে আর খাবার জলের অভাব হবে না, কিংবা এত ফসল ফলবে যে কাউকে খাবারের জন্য বাইরে যেতে হবে না। আসলে জানো মা, মানুষ ক্ষমতা অর্জন করলে তাকে কীভাবে শক্তির অপব্যবহার করে তার উদাহরণ হচ্ছেন আগেকার মুনি ঋষিরা। এমনকি বলা উচিত নয়, কৃষ্ণ পর্যন্ত নিজের ছেলে শাম্বকে অভিশাপ দিয়েছিল।”
আমি ভোরের কথাগুলো শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ, মুনি ঋষি আছেন, যারা নিজেদের গোপন রেখে সকলের ভালোর জন্য দিনরাত প্রাণপাত করছেন। তাই আমরা এখনো অত লড়াইয়ের পরেও রয়ে গেছি। ভোরকে বললাম, জানো তো যেটা খারাপ সেটা দ্রুত প্রচার পায়, কারণ খারাপটা লোকে বেশি গ্রহণ করে, ভালটার প্রচার করার দরকার পরে না। তা নীরবে হতে থাকে। ফল্গু নদীর মত ভেতরে ভেতরে কাজ করে যায়।
“মা তুমি চিরকাল সবার ভাল দেখো, আজ অবধি আমি ছাড়া কারোর সমালোচনা করলে না।” ভোর বলা মাত্র তনয় কান থেকে মোবাইল সরিয়ে বলল, “না না, তোমার মা আমি ছাড়া পৃথিবীর সবাই কে ভাল দেখে। যত খারাপ আমি। আসলে তোমার মা খারাপকে খারাপ বলতে ভয় পায়।”
মেয়ে আর বাপের কথা চলতেই থাকবে, সেদিকে মনযোগ না দিয়ে আমি রুক্মিণী মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে বারোশো শতাব্দীতে তৈরি মন্দিরের আকারটা অবাক হয়ে দেখছিলাম। মানুষের বিভিন্ন ভঙ্গির ভাস্কর্য দিয়ে পরিবৃত মন্দিরটার শেপ অনেকটাই হাতির মত। কী ভীষণ সুন্দর রুক্মিণীর মুখটাও।
চলবে
এরপর আগামী সংখ্যায়