ভ্রমণ জলেজঙ্গলে শেষপর্ব প্রদীপ্ত ভক্ত শরৎ ২০১৮

জলেজঙ্গলে-১জলেজঙ্গলে-২

জলে জঙ্গলে – শেষ পর্ব

প্রদীপ্ত ভক্ত

পাখির কিচমিচ আর পেছনের পল্টনের ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে ঘর, এবার চলা শেষ’, ছাপিয়ে আরেকটা আওয়াজ পাচ্ছিলাম, চেনা গম্ভীর আওয়াজ, সমুদ্রের গর্জন। ডাবল বেডরুম ভাড়া করেছিলাম, তাদের অ্যাটাচড বাথরুম নাই জানা গেল।

রাগী ভদ্রমহিলা তো পারলে আইল্যান্ড ডুবিয়ে দেন, অবশ্য ওঁর রাগ পুরোপুরি অযৌক্তিক তাও না। আমাদের না হয় শয়নং যত্রতত্র ভাব, বাচ্চা, মহিলা সমেত এ-অবস্থায় ভালো লাগার কথাও না।

সইসাবুদ করে, ব্যাগ রেখেই সমুদ্রের জলে। না, স্নান এখানে করা যায় না, কারণ যেখানে সেখানে গাছের গুঁড়ি, মূল থাকতে পারে, সমুদ্র এগিয়ে আসছে। তবু সমুদ্রপাড়ে এসে কি জল না ছুঁয়ে থাকা যায়? 

সমুদ্রের গর্জন আছে কিন্ত বেলাভূমি শান্ত। লোক নেই জন নেই, একধারে জঙ্গল আরেকধারে সমুদ্র, আর একটা ভার্জিন বিচ।

‘কেবল পেটে বড় ভুখ না খেলে নাই কোনো সুখ’। সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি, খাওয়া হয় নাই প্রায় কিছুই, অল্প কেক বিস্কুট ছাড়া। কেয়ারটেকার ছেলেটার নাম শঙ্কর, আহা মিলটা দেখুন, ভিতরকণিকা হলো গিয়ে ওড়িশার অ্যামাজন আর সেখানে এক দ্বীপে বাস করে শঙ্কর।

যাকগে আপনারা আমায় গাল দেবার আগে খাবারটা খেয়ে নিই বরং। রাঁধে বেজায় ভালো ছেলেগুলো (আরো দু তিনজন আছে),অবশ্য খিদেও পেয়েছিল। এখানে খাবারের আলাদা কোনো জায়গা নেই বলেই মনে হয় খাবার দাবার ইনক্লুডেড থাকে এদের ঘরভাড়ার সাথে। খেয়ে দেয়ে আমরা আর বসলাম না, চারটে বাজে, সুতরাং আর খানিকক্ষণ আলো পাবো। সেই অনাঘ্রাতা সমুদ্রতীর ধরে হাঁটছি, বালিতে থেবড়ে বসছি জলের ভয় না করেই, কে জানে আবার কবে পাবো এমন ঝকঝকে সমুদ্রপাড়। সূর্য ক্রমে নেমে আসছে, ওই দূরে একটা বালিয়াড়ি টাইপ, কী জানি কী করে এ’রকম মরুভূমির মতো বালিয়াড়ি তৈরি হল।

বালিয়াড়ির গা ঘেঁষে একটা একলা মরে যাওয়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রর অপেক্ষায়। কবে যেন ও একবার ছোঁয়া পেয়েছিলো সমুদ্রের, সব পাতা ঝরে গেছে কবেই, তবু কিসের বিশ্বাসে কে জানে এখনো অপেক্ষায় রয়েছে।

এত নিস্তব্ধতা শেষ শুনেছিলাম সিকিমে, চুপ করে থাকলে সমুদ্র ক্রমে বুকের মধ্যেই ঢুকে যায়। ওহ না পুরো ফাঁকা না, আমরা ছাড়া দুটো কুকুর আছে।

সৌরভটা কুকুরপ্রেমী, দুটোকে একটু আস্কারা দিতেই লুটোপুটি খেয়ে প্যান্টুল কামড়ে একাকার করল, এদিকে আমি নিরাপদ দূরত্বে।

ওব্বাবা নিরাপদ বলে কোনো শব্দ হয়ই না আসলে, পিছন থেকে এক মক্কেল এসে গরুর মতো ঢুঁ দিয়ে গেলো হঠাৎ। ওদিকে সূর্যর রঙ বদলে গেছে, টকটকে লাল হয়ে আসছে ক্রমে। একটা গোটা সমুদ্র, একটা মস্ত সূর্য, কিছু নেড়া গাছ, আর কিছু সবুজ গাছ এর মালিক হয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি। লক্ষ্যশূন্য লক্ষ-বাসনাহীন হয়ে যাচ্ছি।

আরে একটা কাঁকড়াছানা খাবি খাচ্ছে না? ভালোবাসা মায়া দয়া এসবই আমার খুব কম, আমি একজন স্বার্থপর নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ তাও কাঁকড়াছানাটা দেখে একটু মনে হলো বেচারা বোধহয় জোয়ারের টানে শক্ত বালিতে এসে পড়েছে আর পৌঁছতে পারছে না। সেটাকে একটু জল অব্দি এগিয়ে দেওয়া গেলো। আসলে খেলা আর কি। 

একপাটি ছোটদের চটি পড়ে আছে, ঢেউ এর টানে চলে এসেছে কবে মনে হয়। এই জগত প্রপঞ্চময় আমি মানি, এইযে একলা গাছ, একপাটি চটি, ভাঙা ডাল এরা সবাই কথা বলে নিজেদের মধ্যে আমরা সে ভাষা পড়তে পারিনা। এই চটিটা মন খারাপ করছে না আনন্দ পাচ্ছে কে জানে।
“ওই পেছনের জঙ্গলটায় যাবি?” সৌরভের ডাকে সম্বিৎ ফেরে। হ্যাঁ হ্যাঁ চল। ওয়াচটাওয়ার বলে যে দোতলা বাড়িটা আছে তার পিছন দিয়েই একটা শুঁড়ি পথ চলে গেছে। মানুষ যাতায়াত করে তারমানে, খুব চাপের রাস্তা হবে না। কিন্তু এ জঙ্গলে বুনো শূয়োর, হায়না, শজারু আছে শুনেছি, তেনারা বৈকালিক ভ্রমনে বেরোলেই চিত্তির। সূর্য ডুবে গেলেও আলো এখনো আছে, পাখিদের কিচমিচ শোনা যাচ্ছে, জঙ্গুলে গন্ধ। এক জায়গায় গিয়ে রাস্তাটা শেষ হয়ে গেলো। আরো যাওয়াই যায়, তবে সে রাস্তাটা একটু বেশীই জঙ্গুলে হয়ে যাবে, ওদিকে আলো কমে আসছে দ্রুত। তাই ফিরেই এলাম দুজন, জঙ্গল ভালোবাসি, কিন্তু এ ভালোবাসা অনেকটা ওই ভার্চুয়াল ভালোবাসার মতো। জঙ্গলকে চিনে, জেনে তার বিছুটিপাতা বা পচা পাতার সংস্পর্শ গায়ে নিয়ে ভালোবাসা না, তাই জঙ্গল কি বলে আমরা বুঝবো এমন সাধ্য নেই, তাই জন্যই ফিরে যাওয়া উচিত।

ফিরে এসে সেই বেলাভূমি ধরে ফের হাঁটছি। চাঁদ উঠে গেছে তখন, আকাশ ভরে তারা। ষষ্ঠীর চাঁদে এতো জোর থাকে? দূরে গাছেদের মাথা ঢেকে কুয়াশা নেমে আসছে সি-বিচ-এ, কোন আদিম রাত নেমে এসেছে গহীরমাথায়। চুপ করে করে থাকা গাছগুলো কত কী বলছে আমি শুনতে পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি না, দীর্ঘদিনের মনুষ্য সভ্যতা আমাদের প্রকৃতি থেকে কেড়ে নিয়েছে ক্রমেই, আমরা অনর্থক বাজে বকে বকে প্রকৃতির কথা শুনতে পাই না আর।

সব কিছুর একটা নিয়ম থাকে, যেমন সন্ধে হলে পড়তে বসতে হয়, অফিসের সময় অফিসে থাকতে হয়, তেমনই, এই সময়টা চুপ করে থাকতে হয়। এই এক আকাশ ভরা তারা, চাঁদের আলো, চিকচিকে বালি, সমুদ্রের গর্জন, গাছেদের মাথা নাড়া এসব কিছুই তোমায় বুকে ভরে নিতে গেলে মুখ বুঁজে থাকতে হবে। এই গাছ, এই সমুদ্র, চাঁদের আলো কবে থেকে এইখানে রয়েছে, যেন আমরা অনধিকারচর্চা করে ফেলছি ওদের মাঝে। ফিরতে লাগলাম।

হোটেলের কাছে এসে দেখি sos পাঠানোর মতো করে কে যেন টর্চের আলো ফেলছে আমাদের দিকে। আমরাও ফেললাম। দেখি হোটেলের ছেলেটা, শঙ্কর, জঙ্গল থেকে হায়েনারা বেরোয় তাই আমাদের দূরে যেতে নিষেধ করছে। তাছাড়া চা-টা খেতেও ডাক দিচ্ছে আরকি।

চা খেয়ে হোটেল এরিয়াটা ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখি দুটো ছেলে রান্না বসিয়েছে, বদরু আর কামাল, মুর্শিদাবাদ এর ছেলে, রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে এসেছে। কড়াইতে সোয়াবিন হচ্ছে দেখে বললাম আরে সমুদ্রে এত মাছ ধরে খাও না কেন হে? তা বলে, দূর ধরতে পারি না।

ওরা (শঙ্কর এন্ড টিম) তো ওদের সাথেই খেতে বলে, কিন্তু রোজ রোজ অমন খাওয়া যায় নাকি, পয়সা নেয় না ওরা আবার। খুব বেশি বয়স না। একজনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ের ছবি দেখাল। তিনমাস বাড়ি যায়নি। এবার যাবে। যাবেই।

পিছনের জঙ্গলে সৌরভ একবার টর্চ ফেলে দেখাল। যেখানে টর্চের আলো শেষ সেখান থেকেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা আবার সমুদ্রের ধারে হাঁটা মারলাম। কুকুরটা পাহারা দেবার মত করে করে আসছে। আমরা থামলে সেও থামছে। ব্যাটা মানুষ ভালবাসে খুব।

কিন্তু আমি তো কুকুর ভালোবাসি না! জোর করা ব্যাপারটাই অপছন্দের আমার, সে যে কোনো কিছুই হোক। ভালোবাসাও জোর করে দিতে এলে বিরক্তি হয়।

রাতেও পেল্লায় খাওয়াদাওয়া করাল শঙ্কর। তারপর গল্প শুরু করল। ডুবুরিরর ট্রেনিং নিয়েছে সেই গল্প। ট্রেনিং এর কঠিন দিনগুলোর কথা, জলের নীচের কথা বলতে বলতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল ওর। ভালোবাসার কাজ পেলে যা হয়।

আবার ভোর তিনটেয় উঠবে সে। আমাদের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দেবে। ভবানী বলেছে সাতটায় বেরোবে। কোনো আলাবেজার নেই ছেলেটার মুখে। দিব্যি হাসতে হাসতে জানাল, কম ঘুমোলে ওর কোনোই অসুবিধে হয় না। রোজ বুকডন দেয় ও আশি একশোটা। দিব্যি আছে। সুখ শান্তি আসলেই সহজ ব্যাপার, চাইলেই দিব্যি পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়, আমরা চাইতেই জানি না।

সকালে নাকি অনেক শুশুক আসে, ছটায় উঠে পড়েছিলাম তাই। নাহ শুশুক দেখতে পাইনি। কিন্তু একটা চমৎকার সূর্য সকালবেলা স্নান-টান সেরে সমুদ্র থেকে টুপ করে উঠে আড়মোড়া ছাড়ল। তারপর কাজে লেগে গেল কেমন তাই দেখা হল। মরা কচ্ছপের খোলা পড়ে আছে একটা বালির উপর। কাল দেখিনি। আজ দেখলাম। কাল রাতে কেউ একজন বেরিয়েছিলেন। বালিতে পায়ের আর ক্ষুরের দাগ আঁকা, কুকুর না অবশ্যই। 

ব্রেকফাস্ট করে সকলের বেরোতে সেই সাড়ে সাতটা বেজেই গেল। গাছে গাছে টিয়া, মাছরাঙা, কাঠঠোকরাদের আড্ডা বসে গেছে, “কীরে কী খবর, আজ কী প্ল্যান? আজ ভাবছি ওপাড়ায় গিয়ে একটু ছানবিন করে আসব। ওবেলা কনসার্ট আছে আসছিস তো?”

নৌকা ধুয়ে মুছে রেখেছিলো ভবানীর সহকারী মাঝি। সকালের নরম রোদ মেখে মেখে চলতে বড় ভালো লাগছিলো। আমাদের ট্রেন সাড়ে তিনটের ধৌলি ওটা ধরতে না পারলে মুশকিল কাল আবার অফিস আছে। বোটে ওই বাঙালী পরিবারের যেই লোকটা সবচেয়ে বেশী লাফালাফি করছিলো তার সাথে আলাপ হয়ে গেলো। ভালো লোক, হুল্লোড়ে আসলে। পঁচিশে ডিসেম্বরের কেক খাওয়া হল। আমাদের বললেন ছেড়ে দেবেন ভদ্রক অব্দি। অচেনা অজানা দুটো ছেলেকে ফস করে গাড়িতে তুলে নিতে চাওয়া মোটেও সবাই করে না। এদের উপরেই আমরা কাল কি বিরক্ত হচ্ছিলাম, জঙ্গলে লাফালাফি করছিলো বলে। আসলে শুধু সাদায় কালোয় তো কেউ হয় না। যাই হোক আমরা ধন্যবাদ দিয়ে জানালাম দরকার নেই, আমরা চলে যাবো। জয়নগর ঘাটে এসে, পানিবাবু আমাদের উপর ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলো প্রায়। বলল, চাঁদবালী পৌঁছে দেবে দুশ টাকা লাগবে। যেই বললাম তুমি তো আগে বলোনি অম্নি খারাপ ব্যবহার করলো। আমাদেরও রাগ ধরে গেলো, বেশ যাবোই না, আর যেভাবেই যাই তোমার সাথে না।

ঘটনা হলো, ওইখান থেকে চাঁদবালী প্রায় এগারো-বারো কিলোমিটার। রাগের মাথায় না বলে তো দিয়েছি। ঘড়িতে বাজছে এদিকে বারোটা কুড়ি। ধৌলি সাড়ে তিনটে, ভদ্রক থেকে চাঁদবালী পৌঁছতে লেগেছিলো দু ঘন্টা। মানে একটার মধ্যে পৌঁছতেই হবে। হনহন করে খানিক হেঁটে এগিয়ে যাবার পর দেখি একটা বাইক আসছে। লিফট চাইলাম। বাচ্ছা ছেলে, আমাদের দুজনকে নিতে গিয়ে প্রায় কাত হয়ে যাচ্ছিলো। যাইহোক সে আমাদের যেখানে পৌঁছে দিলো সেখান থেকে রাজকনিকার অটো মেলে, তা সেটাও রেগুলার না, মাঝে মাঝে আসে, এখন উপায়? 
দাঁড়িয়ে আছি, ঘড়ির কাটা বারোটা চল্লিশ। এমন সময় মরুভূমিতে উটের মতো, শীতকালের নলেন গুড়ের মতো, গরমের শরবতের মতো দেখি আমাদের বোটের সঙ্গীরা। ওনারা নিজেদের গাড়ি চালিয়ে ফিরছেন। আমাদের বললেন ‘আরে তোমাদের খুঁজলাম আমরা, চলো, ভদ্রক অব্দি তো যাবো না রাস্তা খুব খারাপ, কালকেই টের পেয়েছি আমরা জাজপুর হয়ে চাঁদিপুর যাবো, যাইহোক তোমাদের রাজকনিকায় ছেড়ে দিচ্ছি।’ ধড়ে প্রাণ এলো। রাজকনিকায় অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে এলাম। সত্যি মানুষের কোথায় যে কোন পাওয়া জমে থাকে কে বলতে পারে। অবশ্য এ আমি বহুবার দেখেছি, রাস্তায় নামলেই দেখি, পথে প্রান্তরে লোকেরা সাহায্য করতেই প্রস্তুত বরং। খারাপ কি পাইনি? পেয়েছি কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এখনো মানুষ টিকে আছে এই ভালোবাসাগুলোর জন্যই। 
রাজকণিকায় অটো ভর্তি না হলে তো ছাড়বে না, বললাম চলো ভাই আমরা পুরো ভাড়া দিয়ে দেবো সবার। চাঁদবালীতে পৌঁছে দেখি একটা বাস ছাড়বো ছাড়বো করছে। সৌরভ ছুটলো সুলভ শৌচাগার আমি ছানাপোড়া কিনতে, আহা ও জিনিস মিস করলে ট্রেন ছাড়ার থেকেও বেশী পাপ হবে। 
বাস ছাড়লো, একটা কুড়ি, ধৌলি আধঘন্টা লেট দেখাচ্ছে, যাক তাহলে আরামসে পৌঁছে যাবো, চাপ নেই। ‘আছে আছে আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে’। কিন্তু ওই there are many slips between cup and the lips…. মফস্বলের বাস, সে নিজের মর্জিতে চলে। হয়ত দূরে কোনো বাড়ি থেকে বৌটি বাপের বাড়ি থেকে ফিরছে, সকলে আসছি আসবে ইত্যাদির পালা মেটানো অব্দি বাস অপেক্ষা করবে। তাই সেসব সেরে বাস যখন নামালো তখন বাজে চারটে, আর আমরা ওখান থেকে অটো ধরে স্টেশনে এলাম চারটে দশ। ধৌলি মিনিট দশেক আগেই বিদায় নিয়েছে!

যা গেছে তা যাক বলে চটপট মোবাইলে দেখা শুরু করলাম নেক্সট প্ল্যান কি। খড়গপুর চলে যাওয়া যায় একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন আছে, অথবা নেক্সট এক্সপ্রেস ট্রেন যেটা আসবে সাড়ে ছটা না পৌনে সাতটায় সেটার জন্য অপেক্ষা করা যায়। কি করবি? চল খরগপুর অব্দি এগিয়ে যাই, অন্তত অনেকটাই এগিয়ে যাবো আর ওখান থেকে অপশনও অনেক পাবো। আর এক্সপ্রেসটা যদি ঝোলায় তো পথে হয়ে যাবো। যদিও প্যাসেঞ্জার ট্রেন, তাও, কি বলিস? সুতরাং ঝটপট টিকিট কাটা হলো (খড়গপুর তক, অজ্ঞার কারনে হাওড়া অব্দি দিলো না), এক নম্বরে দাঁড়িয়েই আছে ট্রেন, রাইট টাইম যদিও চারটে কিন্তু ইন্ডিয়ারেলইনফো বলছে কুড়ি মিনিট লেটেই ছাড়ে। দৌড়াদৌড়ি করে যাও হলো, ইঞ্জিন বদলাচ্ছেরে, সৌরভ তুই ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে গেটের মুখেই থাক, আমি একটু হালকা হয়ে আসি, ছানাপোড়ার চক্করে যাওয়া হয়নি কিনা!

তা অত দৌড় ঝাঁপের দরকার ছিলো না, ট্রেন ছাড়লো পাঁচটায়। পাক্কা এক ঘন্টা লেট প্রথমেই। এটার পৌঁছনার সময় আট্টায়, সাড়ে আটটায় এক্সপ্রেস ট্রেনটা পৌঁছনোর কথা খড়গপুর। দেখা যাক। তেমন হলে টিকিট না কেটেই ট্রেনে উঠতে হবে এবং ফাইন দিয়ে নিতে হবে। অবশ্য অমরাবতী এক ঘন্টা লেট দেখাচ্ছে। সাব্বাশ পাগলা। আমরা তাড়াহুড়ো করে উঠেছিলাম একদম শেষ কামরায়। কদলী কদলী করে একবার একটা লোক ছাড়া আর কাউকে দেখলাম না খাবার বিক্রী করতে। হ্যাঁ একটা লোক ছিলো বটে, জ্যান্ত দেশী মুরগী নিয়ে, কিন্তু ইয়ে কাঁচাই খেয়ে নেবার মতো খিদে পায়নি কিনা। সৌরভ এদিকে লম্বা হয়ে ঘুম দিচ্ছে আরামসে। আমি খিদের চোটে কাওয়ালি গাইছিলাম, ‘কচুবনে হেগে গেলো কালো কুকুরে’। সৌরভ আঁতকে ধড়মড় করে উঠে বলল, কি হয়েছে হ্যাঁ ভাই, অবরোধ না অ্যাক্সিডেন্ট, কারা চেঁচাচ্ছে হ্যাঁ। নাহ কলিকালে গুনীর কদর নেই মশাই, আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, ওরে খেয়াল করেছিস কি, পুরো কামরা খালি? খাকি আমরাই পড়ে আছি? টিনটিন এর মতো আমাদের রেখে ট্রেন এগিয়ে যাবে না তো? 

সুতরাং আমরা এক এক করে কামরা এগোতে থাকলাম, কারণ প্রতি স্টেশনে এক মিনিট করে থামছে ট্রেন। আর ফেরিওয়ালা যতক্ষণ না দেখব আমরা থামব না।

শেষে একটা কামরা থেকে নামতে যাব তা দেখি এক মুড়িওলা আসছে!! আরে এসো এসো, মুড়ি চা খেয়ে ঘড়িতে আর স্টেশনে মিলিয়ে দেখি ট্রেন সেই এক ঘন্টা লেটেই ছুটছে। আচমকা মোহন সিরিজের গল্পের মতো কোথা হইতে কী হইয়া গেল, খড়গপুরের আগের স্টেশন থেকে এমন এল যে মাত্র চল্লিশ মিনিট লেটে পৌঁছে দিলো। বাহ বাহ কেয়াবাত। ওদিকে অমরাবতী তখনও আড়াই ঘন্টা লেটে। সুতরাং লাস্ট মেদিনীপুর লোকালই ভরসা।

ওই মেদিনীপুর লোকালে রাত পৌনে বারোটায় বসে বসেই পুরো জার্নিটা চোখের সামনে ঝালিয়ে নিলাম একবার, তিনদিন স্নান নেই, কোথাও তেলচিটে বালিশ চাদর দিয়ে ঢাকা হোটেল তো কোথাও কমন বাথরুমওয়ালা হোটেল, অপরিচিত লোকের বাইকে নির্জন সন্ধ্যেবেলা অজানা গন্তব্যে যাচ্ছি কখনো, কখনো অপরিচিত কেউ লিফট দিচ্ছে, ঝড়ে বেগে বাইকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। আবার আবছা অন্ধকারে কাঠের উনোনের ধারে বসে ডুবুরির গল্প শোনাচ্ছে কেউ। মসৃণ বালিতে প্রথম পায়ের ছাপ আঁকছি কোথাও। কখনো খিদেতে কোঁ কোঁ করছি…..সব মিলিয়ে যে মশলামুড়িটা মাখা হয়েছে আমতেল দিয়ে তার সুবাসে একটুও টায়ার্ড লাগছে না। এখনো হা হা করে হাসছি, ঠ্যাং টানছি আর, আর স্বপ্নমাখা চোখে পরের বেরোনোর প্ল্যান করছি

ফটোগ্রাফিঃ লেখক

 জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি

1 thought on “ভ্রমণ জলেজঙ্গলে শেষপর্ব প্রদীপ্ত ভক্ত শরৎ ২০১৮

  1. তোমার সব ভ্রমণের মত টাটকা,আচারের তেল দিয়ে মাখা মুড়ির মত জিভে জল আনা ঘোরার গন্ধ..ঘুরতে থাকো আর লিখতে থাকো 🙂

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s