জ্যোতির্ময় দালালের আগের ভ্রমণ –হাতিপাওয়ের পথে
ঝটিকা সফরে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন
জ্যোতির্ময় দালাল
নিমপাতা চিবানোর মতো মুখ করে প্রায় তিন দশক আগে যখন স্কুলের পরীক্ষায় (অ)সাধারণ জ্ঞান নামে এক অতি বিচ্ছিরি সাবজেক্টের জন্য প্রথম মুখস্থ করেছিলাম, পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাত হল আমেরিকার কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, তখন অতি বিচিত্র কল্পনাতেও আসেনি যে একদিন সেই প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের একটির সামনে সশরীরে দাঁড়াবার সুযোগ পাব!
যেহেতু আমাদের স্কুল-বেলায় মোবাইল ইন্টারনেট দুরঅস্ত, কম্পিউটারের অবধি টিকি দেখিনি, তাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নামটা আর দশটা অদরকারি, নেহাত পরীক্ষা পাশের তথ্য হিসেবে মগজের ডাস্টবিনে অনায়াসে চলে গিয়েছিল। অবশ্য বছর দশেক আগে পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার পর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মাহাত্ম্য নতুন করে উপলব্ধি করি। কিন্তু তালেগোলে সে যাত্রায় কোনওদিনই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই গতবছর নভেম্বরে কর্মসূত্রে যখন পশ্চিম আমেরিকার ফিনিক্স শহরে আয়োজিত এক কনফারেন্সে যাওয়ার সুযোগ হল, তখন মনস্থির করলাম, এইবার আর মিস করলে চলবে না। অ্যারিজোনার ফিনিক্স থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ভুবন-বিখ্যাত সাউথ রিম (দক্ষিণ-দ্বার?) যাবার জন্য অনেক ডে ট্রিপ-এর বন্দোবস্ত আছে। তেমনি এক ট্যুর কোম্পানিকে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা পাকা করা হল।
সেইমতো এক নভেম্বরের কাকভোরে বেশ বড়োসড়ো একটা পিক-আপ ভ্যান এসে থামল আমার হোটেলের দোরগোড়ায়। এক কেতাদুরস্ত শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে করমর্দন করে এবং আমার নাম প্রায় নির্ভুল উচ্চারণ করে (মার্কিন জিহ্বা জ্যোতিকে প্রায়শই জুতি বানিয়ে ছাড়ে!) যাচাই করে নিলেন যে আমিই সঠিক ব্যক্তি কি না।
ভ্যানে উঠে দেখলাম আমি প্রথম যাত্রী। এরপর ভ্যান চলল আরও গোটা দুয়েক হোটেলের দিকে। আমার এক সহকর্মী ও জনাদুয়েক পরিচিত ভারতীয় উঠলেন সেই পরবর্তী দুই হোটেল থেকে। তৃতীয় হোটেল থেকে উঠলেন আমাদের শেষ সহযাত্রী, এক দক্ষিণ কোরীয় ভদ্রমহিলা। সবাইকে নিয়ে এবার ভ্যান চলল ফিনিক্স শহর ছেড়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উদ্দেশ্যে। লম্বা জার্নি। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা যেতে লাগবে। মাঝে গোটা কয়েক জায়গায় থামা হবে দশ থেকে পনেরো মিনিটের জন্য। লাঞ্চের পর আমরা পৌঁছাব গন্তব্যস্থলে।
শহর পেরোনোর পর ফ্রি-ওয়ের দু’দিকের পটপরিবর্তন হচ্ছে মাঝে মাঝে। অ্যারিজোনা ডেজার্ট বলতে মনশ্চক্ষে রাজস্থান-সুলভ ধু ধু মরুভূমির ছবি ভেসে আসতেই পারে। কিন্তু এ মরুভূমি অত রুক্ষ, সবুজহীন নয়। এর ‘ডেজার্ট’ উপাধির প্রাথমিক কারণ চাষবাসের উপযুক্ত জমি না থাকা। কিন্তু অজস্র হলদে-সবুজ কাঁটা ঝোপ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র রুক্ষ রক্তাভ পাহাড়ের গায়ে। জটায়ুর দেখা শনিমনসার দানবিক সংস্করণ—সারি সারি ক্যাকটাসের দল যেন আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে রয়েছে। হ্যাঁ, উট অবশ্য নেই এ মরুরাজ্যে।
ফ্রি-ওয়ে ধরে প্রায় ৮০ মাইল বেগে চলেছে আমাদের ভ্যান। চালক একবার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সামনের আকাশে হট এয়ার বেলুনের সারিতে। এই বেলুনে চেপে মরুদর্শন রীতিমতো জনপ্রিয় স্পোর্টস এখানকার বহু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের কাছে। আরও বেশ কিছুটা চলার পর আমরা দেখলাম দূরে ব্রাড-শ পর্বতমালা, তার কয়েকটি শৃঙ্গ সাদা তুষারে ঢাকা।
পেশাদারিত্ব মার্কিন রক্তে। এত লম্বা জার্নি যাতে ক্লান্তিকর না হয়ে পড়ে তার জন্য যথাসাধ্য আয়োজন। ফ্রি-ওয়েতে ট্রাফিক একটু কম হতেই আমাদের ড্রাইভার-কাম-গাইডের হাতে উঠে এল হেড ফোন। ভ্যানের মধ্যেই রয়েছে সাউন্ড সিস্টেম। গাড়ি চালাতে চালাতে ভদ্রলোক ধারাভাষ্য শুরু করলেন—আমরা কোন কোন জায়গা দিয়ে চলেছি, তাদের স্থান-মাহাত্ম্য, আর কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্যাদি। আমাদের কোনওরকম প্রশ্ন থাকলে যেন নির্দ্বিধায় করে ফেলি, সেটাও জানিয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ডে ট্যুর কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে কোন কর্পোরেট সংস্থায় কাজ করতেন। তাঁর নিজের কথা অনুযায়ী, তিনি সেই চাকরিতে থাকলে আজকের তুলনায় অন্তত তিন গুণ মাইনে পেতেন। কিন্তু এই কাজটা তাঁকে দিয়েছে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি, আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে আসা হরেক কিসিমের চরিত্রের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ। বলা বাহুল্য, এতে তাঁর নিজের জ্ঞানের পরিধি যেমন বেড়েছে যথেষ্ট, তেমনি বেড়েছে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর নিজের দেশ আর সভ্যতাকে বোঝার ক্ষমতাও।
পথের একঘেয়েমি দূর করতে আমাদের সারথি এবার নিজের গল্পের ঝুলি খুললেন। ‘নো কোশ্চেন ইজ ডাম্ব কোশ্চেন’ এই আপ্তবাক্য সাধারণত মার্কিন ট্যুর গাইডরা মেনে চলেন, বিশেষত যদি তাঁদের নিয়মিতভাবে বিদেশি পর্যটক সামলাতে হয়। কিন্তু কখনও কখনও কিছু প্রশ্নের গুগলি সামলাতে তাঁকেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এক ফিলিপিনো টুরিস্ট নাকি এই পথে এক সকালে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যাওয়ার সময় তাঁকে আচমকা জিজ্ঞেস করেন, “আচ্ছা, আমাদের ফিরতে ফিরতে কি সূর্য ডুবে যাবে?”
উত্তরে ‘হ্যাঁ’ শুনে তিনি আরও চিন্তিত হয়ে জানতে চান, “তাহলে আমরা কী করে ফিরব?”
খানিক মস্তিষ্ক সঞ্চালনের পর আমাদের গাইড শেষমেশ বুঝতে পারলেন, বিসমিল্লায় গলদ! ঐ ভদ্রলোক রাস্তার দু’ধারে কোনও লাইট পোস্ট দেখতে পাননি। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা, আমেরিকার কোনও ফ্রি-ওয়েতেই আলোর ব্যবস্থা নেই। গাড়ির হেড লাইটের আলোয় রাস্তায় টানা হলুদ বা সাদা লাইন, ট্রাফিক সাইন সব জ্বলজ্বল করে ওঠে এবং তা ফলো করেই দুরন্ত গতিতে গাড়ি চলে। লাইট পোস্ট থাকলে বরং অতিরিক্ত আলো চোখে লেগে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়ে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ডেকে আনতে পারে। বলা বাহুল্য, ওই ভদ্রলোকের দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা মার্কিন মুলুক নয়, বরং ভারতের সঙ্গে তুলনীয়। কাজেই রাস্তায় আলো না থাকলে চুরিডাকাতি রাহাজানির আশঙ্কা তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। আপাতদৃষ্টিতে হাসির ঘটনা, কিন্তু সারথি ভদ্রলোকের চোখে এটা নিজের চেনা ধ্যান-ধারণার গণ্ডির বাইরে একটা আলাদারকমের, হয়তো বা আপাত-অনুন্নত এক ভিন্ন জীবনের ছবি ফুটিয়ে তোলে। জ্ঞাতসারেই হয়তো বা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু বার্তা দিলেন ভদ্রলোক, কাউকে চটজলদি বিচার করে ‘ট্যাগ’ অর্থাৎ দেগে দেওয়ার যে এক বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান অসুস্থ প্রবণতা চলছে। এমনিভাবেই একবার আরেক ভদ্রমহিলা ওঁকে জিজ্ঞেস করে বসেছিলেন, রাস্তার দু’ধারে এতরকমের ক্যাকটাস ইত্যাদি জংলি গাছপালা সরকার থেকে লাগানো হয়েছে কি না!
তাঁর আজকের ট্যুরিস্টদের মধ্যে ভারতীয়রাই যেহেতু দলে ভারী, তাই অভিজ্ঞতার ঝাঁপি থেকে মজাদার গল্প শোনালেন কিছু কিছু ভারতীয় ট্যুরিস্টদের সম্পর্কে। উঠে এল এক বয়স্কা দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রমহিলার প্রসঙ্গ। হাঁটুর ব্যথায় কাতর সেই ভদ্রমহিলাকে ভ্যানে উঠতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে আমাদের চালক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। তা দেখে ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠে দু’পা পিছিয়ে যান। শেষমেশ নিজের চেষ্টাতেই তিনি কোনওক্রমে ভ্যানে ওঠেন, কিন্তু ম্লেচ্ছ-পুঙ্গবের পাণিগ্রহণ করেননি। ব্যাপার দেখে আমাদের গাইড ভেবেছিলেন বুঝি শুচিবায়ুগ্রস্ত ইন্ডিয়ান বুড়ি তাঁকে টিস্যু ব্যবহারকারী আনহাইজিনিক ডার্টি আমেরিকান ভেবে অমন করেছেন, যা তাঁর পক্ষে কিঞ্চিৎ অপমানকরও বটে। অবশেষে তিনি অন্য কোনও ভারতীয় ট্যুরিস্টের থেকে কট্টর দক্ষিণী বৃদ্ধার কাছে ঐ পাণিগ্রহণের মাহাত্ম্য বুঝে আশ্বস্ত হয়েছিলেন।
ঘন্টা দেড়েক একটানা চলার পর আমরা থামলাম একটা গ্যাস স্টেশনে। কিছু স্ন্যাক্স ও কফি সহযোগে হাত-পাগুলোকে একটু খেলিয়ে নেওয়া গেল। তারপর আবার যাত্রা শুরু।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন! অনন্তকাল ধরে প্রকৃতি তার রংতুলির বিচিত্র আঁচড়ে পরম যত্নে এঁকেছে এই তিলোত্তমাকে, গোটা পৃথিবীতে সৌন্দর্যে যার জুড়ি মেলা ভার।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভূমিক্ষয়, অগ্নুৎপাত, শিলাস্তরের উত্থান-পতন, ক্ষয়ীভূত শিলারাশির থিতিয়ে পড়া—এরকম বিবিধ ভৌগোলিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিণাম এই প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের একটি। যেন মহাকাল তাঁর চরণচিহ্ন রেখে গেছেন রক্তিম শিলার স্তরে স্তরে। দিবারাত্রির আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আলোছায়ার লুকোচুরিতে অগণন রঙের শোভায় ভরে ওঠে এই সুবিশাল দিগন্তব্যাপী রুক্ষ ক্যানভাসের প্রতিটি পিক্সেল!
প্রকৃতির এই বিপুল বিস্ময় কিন্তু বহু শতাব্দী ধরে এক অজানা জগত হিসেবে রয়ে গিয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। নেটিভ আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের বিভিন্ন সম্প্রদায় – যেমন হোপি (Hopi) আর নাভাহো (Navajo) উপজাতির বাস ছিল এখানে। আধুনিক বিশ্বের সামনে এই বিস্ময় প্রথম প্রকট হল যখন ১৮৬৯ সালে মেজর জন পাওয়েল প্রথম কলোরাডো নদীর গতিপথ ধরে অভিযান চালালেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১৯০৮ সালে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে জাতীয় স্মারক বা ন্যাশনাল মনুমেন্ট বলে ঘোষণা করেন। এরপর প্রেসিডেন্ট উড্রু উইলসন ১৯১৯ সালে শেষমেশ একে ন্যাশনাল পার্কের মর্যাদায় অভিহিত করেন।
***
ঘড়িতে সাড়ে বারোটা প্রায়। লাঞ্চের জন্য আমাদের ভ্যান এসে থামল ঐতিহাসিক ক্যামেরন ট্রেডিং পোস্টে। এখান থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দক্ষিণ দুয়ার (South Rim) মোটামুটি আধঘন্টার পথ। ১৯১৬ সালে তৈরি এই ক্যামেরন ট্রেডিং পোস্টই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নগামী যাত্রীদের জন্য তৈরি প্রথম হোটেল। এখন এটি নিজগুণেই এক অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। আমেরিকার আদি বাসিন্দা বা নেটিভ
আমেরিকানদের নানাবিধ হস্তশিল্পের নিদর্শন এর প্রতিটি কোণে। এই মোটেল-কাম-ডাইনিং-রুম-কাম-আমেরিকান ইন্ডিয়ান গিফট শপে ঢুকে আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। সুবিশাল এই গিফট শপে থরে থরে সাজানো অগুনতি রকমারি হাতের কাজের নিদর্শন দেখতে একটা গোটা দিনও যথেষ্ট নয়। আছে বহুমূল্য অ্যান্টিক জিনিসপত্র, অসাধারণ কারুকার্য করা কার্পেট, মাটির পাত্র, বাস্কেট, নানারকমের পুতুল, রুপো আর পুঁতির মালার হরেকরঙা অলঙ্কারের পসরা।
আর অবশ্যই রয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ছবিওয়ালা অজস্র সুভেনিয়র, মাউস প্যাড, কী-রিং ইত্যাদি। অবশ্য আমাদের জন্য শাপে বর হল। অধিকাংশ জিনিসেরই দাম এতটাই বেশি যে আমাদের সীমিত ডলারের পুঁজি নিয়ে স্রেফ দেখেই আশ মেটাতে হবে। ভালো ব্যাপারটা হল, কোনও জিনিসই প্রাণভরে দেখতে বা ছবি তুলতে বাধা নেই।
দ্রুতপায়ে গোটা গিফট শপটা ঝটপট চক্কর লাগিয়ে যে যে সাধের জিনিসগুলো সাধ্যের মধ্যে পেলাম, সেগুলোকে জড়ো করে ফেললাম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিলঃ (১) ক্যাকটাসের জ্যামের শিশি আর (২) একটা খরগোশের ট্যান করা চামড়া। মাউস প্যাড, কী-রিং এসবের সাথে কিনলাম গোটা তিনেক স্যান্ড পেইন্টিং—নাভাহো উপজাতির হাতের কাজ। তারপর দোকানের এককোণে রাখা একটা পূর্বপরিচিত ‘পেনি প্রেস মেশিন’ দেখে যন্ত্রটার দিকে হাঁটা দিলাম। যারা জানে না তাদের জন্য যন্ত্রটার বিশেষত্ব বুঝিয়ে বলি। সাধারণত পপুলার ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে এই যন্ত্র বসানো থাকে সস্তায় নিজের সুভেনিয়র নিজে তৈরি করে নেওয়ার জন্য। যন্ত্রের গায়ে একটা ডায়ালে তিন-চারটে ছবি দেওয়া থাকে, যেমন এই মেশিনটায় ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক’ কথাটাই লেখা ছিল নানা স্টাইলে বিভিন্নরকম ক্যাকটাসের ছবির সঙ্গে। এখন কোনও একটা ছবি পছন্দ করার পর একটা হ্যান্ডেলকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওই ডায়ালের ছবিটাকে একটা পয়েন্টারের সামনে আনতে হবে। তারপর যন্ত্রের গায়ে একটা স্লাইডারের কয়েকটা স্লটের মধ্যে নির্দেশিকা অনুযায়ী একটা পেনি অর্থাৎ আমেরিকান ১ সেন্ট আর গোটা দুয়েক কোয়ার্টার বা ২৫ সেন্ট ঢোকাতে হবে ঠিকঠাক অর্ডারে। তারপর স্লাইডার ঠেলে সব কয়েন চালান দাও যন্ত্রের পেটে। সবশেষে হেঁইয়ো বলে একটা হ্যান্ডেল ঘোরাতে হবে বেশ দম লাগিয়ে। তার ফলে যন্ত্রের ভিতরে আখ মাড়াইয়ের স্টাইলে তোমার ফেলা ১ সেন্টটা চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে ডিমের আকার নেবে আর তারও পর খোদাই হয়ে যাবে তোমার পছন্দসই সেই ছবি। বলা বাহুল্য, তোমার ফেলা কোয়ার্টারজোড়া মেশিনটি হজম করে নেবে প্রণামী বাবদ। আমার এক ভারতীয় সঙ্গীকে যন্ত্রের গুণাগুণ বুঝিয়ে মানি ব্যাগ হাতড়ে পেনি, কোয়ার্টার ইত্যাদি বের করে একবার হাতেকলমে ডেমো দিতে সে ছোকরা ভয়ানক উৎসাহী হয়ে একে একে সবক’টা ডিজাইনের সুভেনিরই বানিয়ে পকেটস্থ করল।
যাই হোক, এর মধ্যে আমাদের গাইড চটজলদি লাঞ্চ সেরে আমাদের সবাইকে বেদম তাড়া দিয়ে ভ্যানে তুলে আবার রওনা দিল। পথিমধ্যে আমাদের চেনাবার চেষ্টা করল Juniper, Palo Verde Tree আর Pondorosa Pine গাছ। শেষেরটি অ্যারিজোনার সবথেকে লম্বা গাছ।
***
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পার্কের এন্ট্রি পয়েন্টে সবার পাস সংগ্রহ করে আমরা চললাম সাউথ রিমের একেবারে পূর্বপ্রান্তের দিকে। সেখানে রয়েছে ডেজার্ট ভিউ ওয়াচ টাওয়ার। আমাদের সবার হাতে এসে গেছে গাইড ম্যাপ। ডেজার্ট ভিউ এন্ট্রান্স স্টেশনের এক পার্কিং লটে গাড়ি রেখে আমাদের সারথি এবার ওয়াকিং ট্যুর গাইডের ভূমিকায়। আমাদের নিয়ে চললেন ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। চারদিকে ট্যুরিস্ট গিজগিজ করছে। জানা গেল, যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার জন্য এই সাউথ রিমেই অধিকাংশ ট্যুরিস্ট আসেন। নর্থ রিমে সে তুলনায় অনেক কম লোকে যায়। দুই রিমের এরিয়াল ডিসটেন্স ১০ মাইল হলেও আসলে গাড়ি রাস্তায় প্রায় ২০০ মাইলের ওপর ব্যবধান।
ডেজার্ট ভিউ ওয়াচ টাওয়ারে ঢুকলাম আমরা। ৭৫ ফুট উচ্চতার এই টাওয়ার তৈরি হয়েছে ১৯৩২ সালে। এই টাওয়ারের বাইরের দেয়ালে এক অদ্ভুত রুক্ষতার ছাপ রয়েছে যা আর্কিটেক্ট Mary Colter-এর সৃষ্টি, যা পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে অতি সুন্দরভাবে। টাওয়ারের মধ্যে প্যাঁচানো সিঁড়ি ধরে ওঠা শুরু হল। ভিতরের প্রতিটি দেয়াল হোপী উপজাতিদের অজস্র ওয়াল পেইন্টিংয়ে সুসজ্জিত।
টাওয়ারের প্রতিটি তলে আছে একাধিক ঝকঝকে পরিষ্কার কাচের জানালা। কয়েকটিতে আবার টেলিস্কোপ লাগানো! আমাদের ক্যামেরায় ধরা পড়তে থাকল গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের অসাধারণ রূপের প্রতিচ্ছবি। আমাদের গাইডের রীতিমতো কড়া নির্দেশ ছিল প্রতিটি পয়েন্টে ত্রিশ মিনিটের বেশি নয়। কারণটা বোঝা গেল অচিরেই। আমরা ডেজার্ট ভিউ টাওয়ারে ফটো-সেলফি ইত্যাদি সেশন সেরে মিটিং পয়েন্টে পৌঁছতে তিনি হাঁড়িমুখ করে জানালেন, আমরা মিনিট দশেক লেট। কীভাবে যে সময় বয়ে গেছে আমরা খেয়ালই করিনি। সূর্যাস্তের আগেই আমাদের ফেরার পথ ধরতে হবে। ফিনিক্স শহরে পৌঁছতে আবার সাড়ে তিন ঘন্টা ড্রাইভ।
সাউথ রিম ধরে আমরা দ্রুতপদে চললাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একে একে এল Moran Point, Grand View Point, Yaki Point, Pipe Creek Vista এবং Mather Point। Stephen Mather ছিলেন ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের প্রথম ডিরেক্টর। যাদের হাতে বেশ সময় আর শরীর ফিট, তাদের জন্য এই পুরো সাউথ রিম বরাবর ওয়াকিং ট্রেইল ধরে হাইকিং খুবই আকর্ষণীয়। আছে পৃথক সাইক্লিংয়ের পথও। সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় ভিজিটরস সেন্টারে। এই ট্রেইলের পুরো পথটা অবশ্য হেঁটে চলার সাধ্য ছিল না আমাদের। যেখানে দুটো পয়েন্টের মধ্যে দূরত্ব বেশি সেখানে ভ্যানে চলেছি আমরা। আর নভেম্বরে দেখা গেল এই গাড়ি-রাস্তায় পাবলিক বাসও চলেছে ভালোই ফ্রিকোয়েন্সিতে।
এগিয়ে চলা হল রিম ট্রেইল ধরে। এল Yavapai Point। সেখান থেকে আমাদের গাইড দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন বেশ দূরের একটা পাহাড়চূড়ার দিকে। বহু শতাব্দীর প্রাকৃতিক ক্ষয়ের ফলে সেটা যেন একটা মন্দিরের আদল নিয়েছে। আমাদের অবাক করে দিয়ে তিনি জানালেন, ঐ শিখরের নাম বিষ্ণু টেম্পল। এরকম নাকি আরও কিছু কিছু শৃঙ্গের নামকরণ করা হয়েছে ব্রহ্মা, শিব, কৃষ্ণ, রাম প্রভৃতি হিন্দু দেবতার নামে। তাজ্জব ব্যাপার!
নক্ষত্রভরা রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করে যেমন এককালে জ্যোতির্বিদরা কল্পনা করেছেন অজস্র পৌরাণিক চরিত্রের, ঠিক তেমনটাই ঊনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক ভূবিজ্ঞানী আর সার্ভেয়াররা যারা এই অজানা জগতে প্রথম পা রাখেন, মহাকালের এই অদ্ভুত ভাস্কর্যের মাঝে কল্পনা করেছেন বিবিধ দুর্গ, মন্দির-চূড়া, এমনকি পাখির আদলও। দেখলাম সেই বিখ্যাত প্রাকৃতিক ভাস্কর্য – Duck on a Rock।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাউথ রিমের মুখ্য আকর্ষণ হল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজ, যাকে এখানকার ভাষায় বলে হিস্টোরিক ডিস্ট্রিক্ট। এখানে আমরা কাটালাম প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এখানে আছে ‘হোপী হাউস’, যেখানে দেখা মিলবে আমেরিকার ইন্ডিয়ান উপজাতিদের তৈরি অগুনতি শিল্পকর্মের। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তথ্যসমৃদ্ধ বেশ কিছু ভালো বই ও ছবি সুভেনিয়র পাওয়া গেল এখানে। এই হোপী হাউস তৈরি হয় ১৯০৫ সালে গোটা বিশ্বের পর্যটকদের সামনে স্থানীয় জনজাতির হস্তশিল্পসামগ্রীর প্রচার ও বহুল বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে। এখানকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান হল El Tovar হোটেল।
আর তার বিপরীতেই অসাধারণ সুন্দর এক রেল স্টেশন Santa Fe। এই দুই আকর্ষণের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে রেল লাইন! ফেরার পথে গাড়ি থেকে দেখেছিলাম সেই স্টেশনে একটা ভারি সুন্দর ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
এবার ফেরার পালা, কারণ সূর্যের আলো ক্রমশ পড়ে আসছে। মনে হল, কত তাড়াতাড়ি সময়টা আজ যেন কেটে গেল। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের নয়নাভিরাম সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য এ-যাত্রা আর দেখা হল না। কারণ, সূর্যাস্ত অবধি অপেক্ষা করে ফিরতে হলে ফিনিক্স পৌঁছতে মাঝরাত হয়ে যাবে। অনেক ট্যুরিস্টই একরাতের জন্য ক্যাম্পিং করে থাকেন এখানে। কিন্তু আমাদের অতি সংক্ষিপ্ত আমেরিকা সফরে সেই বিলাসিতার স্থান নেই। তাই এই আধবেলা ঝটিকা সফরের স্মৃতির মণিমুক্তো নিয়েই ফেরার পথ ধরলাম আমরা।
ছবিঃ লেখক