ভ্রমণ ফিলিপিনসের গপ্পো যশোধরা রায়চৌধুরী শরৎ ২০১৭

 যশোধরা রায়চৌধুরী র সব লেখা একত্রে

সুমান মানে জানিস?

সুমন? মানে, সুমনের গান-এর সুমন?

আরে না না, সুমান । অই দেখ। লেখা রয়েছে, এস ইউ এম এ এন… মানে জানিস?

না তো! কী রে? খুব লুব্ধ হয়ে তাকালাম। সার সার খাবারের স্টল, অদ্ভুত দর্শন কিছু প্যাকেটে বিবিধ সুখাদ্য বন্দি। আর ওপরে পত পত করে উড়ছে ফ্লেক্সের ব্যানার। রোমান হরফেই লেখা রয়েছে, সুমান,  সুমান মোরিয়েকোস, সুমান পিনিপিগ…

একটা খাবার জিনিসের নাম হচ্ছে সুমান… তাই না? আমার চোখ জ্বলে উঠল।

ধ্যাত , সেটা তো একটা শিশুও বলে দিতে পারে। একটু এগিয়ে গেল রিন্টি। এই যে ভাই, সুমান মানে কী গো?

মানে ঠিক এই ভাষায় না বললেও, টোনটা এমনি। ইংরিজিতে বলল উত্তরটাই এল ইংরিজিতে, কিন্তু সে ভঙ্গিটাও বেশ দিশি…

ভাঙা ইংরিজি, স্প্যানিশ-ইংরিজি-ফিলিপিনো মিশ্রিত উচ্চারণ। রাইস কেক। দিস ওয়ান। একটা প্যাকেট দেখাল টাইট টি শার্ট পরা, চুলে পনিটেল আঁটা যুবক।

ফিলিপিন্সের মানুষ খুব ভাত খেতে ভালোবাসে। অনেক অনেক বার ভাত খায় ওরা। দিনে মিনিমাম পাঁচবার ত খায়ই। সব অফিসের ক্যান্টিনে, সব রেস্তোরাঁয় , ছোট ছোট খাবারের দোকানেও , কফি বা চা খাবার কাগজের কাপের মত কাপে ঠাসা ভাত থাকে। একটা করে কাপ টেনে নাও আর সঙ্গে কোন একটা সব্জিমাংসের ঝোল বা তরকারি নিয়ে তাই দিয়ে খাও। মাংসের ভাগটাই বেশি যদিও, কিন্তু সেই মাংসটা আবার মালাইকারির মত খেতে হতেই পারে ( নারকেলের দুধটুধ দিয়ে রান্না করা)… কারণ কে না জানে যে মালাইকারি কথাটা এসেছে মালায়া –কারি থেকে, আর মালায়া মানে মালয় দেশ, মানে বর্তমানের মালয়েশিয়া ফিলিপিনসের থেকে বেশি দূরে নয়।

তা সেই কাপের ভাতকে কী বলে জানি না, শুধু জানি স্ন্যাক্স বলতেই ফিলিপিনোরা সারাক্ষণ ভাতই খায়… তবে এটা ভাতের কেক। এই সুমান। কলাপাতা বা পামগাছের পাতা দিয়ে জড়ানো থাকে।

ফ্রেশমার্কেটে আর কী কী পাওয়া যায়? আস্ত গরু বা মোষের রোস্ট পাওয়া যায়। অসংখ্য ধরণের মাছের চাট বা চাটনি জাতীয় জিনিশ পাওয়া যায়। নুডলসের রকমফের। নানা ধরণের সবজি আর ফল তো থাকবেই কারণ ওটাই আসল আকর্ষণ। বিশেষ করে আনারস বা পেঁপে,  ফুটির মত ট্রপিকাল ফল। রাশি রাশি আতা দেখলাম স্তূপ করে রাখা। রিন্টিকে দেখালাম, অনেক কাঁচা আম। পাকা আম। তবে আমের স্বাদ তত মিষ্টি নয় আমাদের ভারতের মত। ছড়ায় ছড়ায় কলা… ছোট কমলালেবু জালের ব্যাগে করে বিক্রি হচ্ছে। কিনে খেয়ে দেখি না লেবু না কমলালেবু, মাঝামাঝি। বেশ টক। এদের নাম ট্যাঞ্জারিন। যতই ভিটামিন সি তে ভরপুর হোক, আমাদের জিভে টকভাব বেশি লাগবেই।

আর হ্যাঁ, দারুণ জিনিশ দেখলাম, যেভাবে আমাদের এখানে পাতলা প্লাস্টিকের ক্লিং র‍্যাপ দিয়ে মাঝে মাঝে এপ্রিকট শুকনো পাওয়া যায় বা খেজুর, যেগুলো সব মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে…সেইরকম ওরা বিক্রি করছেন সদ্য ছাড়ানো বাতাপি লেবুর গোলাপি গোলাপি কোয়া! কী দারুণ।

সেরকমই ট্রে আকারের থার্মোকলের পাত্রে ওপরে স্বচ্ছ ক্লিং র‍্যাপে মোড়া রাশি রাশি সি ফুড আছে। চিংড়ি। আছে কাঠি কাবাবের মত দেখতে কাঠিতে গোঁজা মাংস। চিকেন ইনাসাল নাম দিয়ে বিক্কিরি হচ্ছে।  মাছ মাংসের পাড়ায় এসে পড়লে আর রক্ষে নেই। ভাজা ভাজা, সেঁকা, ঝলসানো শূল্য মাংস, ভাজা মাছ, কত রকমের যে মাছমাংসের পদ।

কতরকমের যে পাখির ডিম। কোয়েলের ডিমে গোলাপির ওপরে বেগুনি ছিটছিট । আরো ছোট কী এক পাখির ডিম। আবার বিশাল বিশাল ডিমও আছে। অস্ট্রিচের বোধ হয়! মানুষ কী না খায়।

আছে বিশাল অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখা স্কুইড, অক্টোপাস ইত্যাদি সিফুড। দেখ, বাছ , আর ব্যাগে করে বাড়ি এনে রান্না কর তেলমশলা কষে।

অন্যদিকে আছে বাটার কেক, রাম লোফ, রেড ভেলভেট কেক, বাটার লোফ, চকলেট মুস কেক , ডেট ওয়ালনাট লোফ। বেকারির প্রডাক্ট অনেক রকমের… ফুলকো ফুলকো, বাদামি বাদামি।

মাংস আর মাছের গন্ধে আমোদিত বাজারে বেশিক্ষণ ঘুরলেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম।

এই ফ্রেশ মার্কেটটা বসে একটা ফাঁকা প্লটে। মাকাটি সিটির ফাটাফাটি মার্কেট, সপ্তাহে একদিন, শনিবার। সারাদিন চলে।

মাকাটি সিটি জায়গাটা কিন্তু আসল ম্যানিলা নয়,  নতুন গজিয়ে উঠেছে, ওল্ড ম্যানিলা থেকে একটু সরে। এটাই ম্যানিলার বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট। পুরোদস্তুর ব্যাঙ্ক ও  ব্যাক অফিস পাড়া, গাদা গাদা বহুতলে ঠাশা, হোটেল, কেতাদুরস্ত এক দুখানা রেস্তোরা ছাড়া দোকান সে অর্থে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাস্তাগুলো সোজা সোজা, নির্জন। অফিস থেকে বলে দিয়েছিল, এ পাড়ায় একলা একলা সঙ্গে ক্যামেরা, টাকাকড়ি নিয়ে সন্ধের পর বেশি না হাঁটাই ভাল। ছিনতাই হতে পারে। করলেই বা দেখতে যাচ্ছে কে। সন্ধের পর অফিসে কাজ করা সব ছেলেমেয়েদের ভিড় হাপিশ, তখন তো রাস্তাগুলো গুন্ডাদের স্বর্গ রাজ্য।

ছেলেমেয়ে? ব্যাপারটা বুঝলে না? সেক্টর ফাইভে গেছ কখনো? বা কোন দাদা দিদি গুরগাঁও বা বেঙ্গালুরুতে চাকরি করে? জান না, আজকের দিনে বেশির ভাগ ব্যাংক, বেশির ভাগ সেলুলার কোম্পানি, বেশির ভাগ ইনভেস্টমেন্ট আর সফটওয়্যার কোম্পানির কর্মীকুলের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে?  ম্যানিলা হল বৃহত্তর সেক্টর ফাইভ। বিশ্বের যাবতীয় তা-বড় কোম্পানি এখানে অফিস খুলেছে, আর সে অফিস মাত্রেই তো ব্যাক-অফিস। ফিলিপিনসের শিক্ষিত শ্রেণী সারা পৃথিবীর বাজারে সাপ্লাই দিচ্ছে অপেক্ষাকৃত স্বল্প দামের কর্মীকুলকে।  মার্কিন বা অন্য দেশের বহুজাতিকের লাভের অংকটা ধরে রাখা হাজার হাজার ছেলেমেয়ে।

বিকেল হলেই রাস্তায় উগরে দেয় এই অসংখ্য অফিসবাড়ির বহুতলেরা, অসংখ্য ফিলিপিনো ছেলেমেয়েকে।  বেশির ভাগই মেয়ে, রোগা ছিপছিপে। ওয়েস্টার্ন পোশাক পরা। খোলা সোজা সোজা চুল, লাজুক নরম হাসি । অফিসের পর দল বেঁধে শপিং মলে গিয়ে হাজির। এরা সব্বাই  এই মাকাটি এরিয়ায়, পিল পিল করে কাজ করতে আসে, দূর দূর রেসিডেনশিয়াল এলাকা ছেড়ে, ম্যানিলার বিখ্যাত জিপনি –তে চড়ে। মেট্রো ম্যানিলাকে পুরো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে কিছু দশক আগে ফিলিপিন্স যাদের দখলে ছিল, সেই  মার্কিন সেনার ফেলে যাওয়া এই বড় সাইজের জিপগুলো।  যেগুলো এখন সাতরং-এ রেঙে , চক্রাবক্রা সাজ পরে, জমকালো হয়ে দাঁড়িয়েছে কলকাতার অটোর এক একটি বৃহত্তর সংস্করণ। হপ অন হপ অফ, মানে যেখান থেকে খুশি ওঠ, যেখানে খুশি নাম।  পেসোর ওপর দিয়ে যাক।

পুরনো মানিলার মালিন্যের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে তুমি যখন মাকাটির দিকে যাবে , এয়ারপোর্ট থেকে , তখন কিন্তু পুরনো মানিলাকে খুব খুব চেনা মনে হবে তোমার। কারণ সেই কলকাতা বা মুম্বই বা দিল্লির পুরনো অঞ্চলগুলোর মতই সরু সরু রাস্তা। ফুটপা্ত অপরিচ্ছন্ন, বাড়ির দেওয়ালে চুণকাম নেই, অনেক রকমের ছাপ ছোপ গ্রাফিতি ।  কলকাতার মত ফ্লেভারের নোংরা নোংরা বাড়ি। ছোট ছোট দোকান। বেশ চমত্‌কার

তারপর মনে হবে সুসজ্জিত, একেবারে মাপে কাটা  মাকাটি সিটি যেন  নিউ ইয়র্ক। বহুতল সব অফিস বাড়ি, হোটেল আর ছোট ছোট ৭-১১ ধরণের দোকানে ভরা।

এ দেশের পোশাক আশাক সব খুব পাশ্চাত্যের। কারণ বহু বছর স্পেনীয়দের দ্বারা উপনিবেশ হয়ে ছিল এ দেশ।  ফিলিপিন্স নামটিও তাদেরই অবদান। ১৫২১ সালে এখানে আসেন ফার্দিনান্দ মাগেলান মানে স্পেনীয় আবিষ্কর্তা। তারপর ১৫৪৩ সালে ভিলালোবোস নামে আর এক স্পেনীয় অভিযাত্রী এ দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করলেন, স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের নামে, লাস ইসলাস ফিলিপিনাস বা ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জ।

১৯০০ সাল নাগাদ  স্পেনের কাছ থেকে আমেরিকা দখল করে ফিলিপিনস কে। তারপর বেশ কিছুদিন আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রথম ফিলিপিন রিপাবলিক। কিন্তু তবু বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকটা  ফিলিপিন্স ছিল আমেরিকার অধীনেই।  কিছুদিন, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ জাপানের অধিকারেও চলে যায় দেশটি।

 তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগে পর্যন্ত  আমেরিকার শাসনে  ফিলিপিন্স, এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিগণিত হয় ১৯৪৫ সালে।

তাই ফিলিপিনসে বেশ কিছু মানুষ মুসলমান হলেই, খ্রীষ্টধর্মই প্রতিষ্ঠিত ও সবচেয়ে বেশি মানুষের ধর্ম। ইংরিজি ভাষার ওপর সবার দখল থাকলেও, কষ্ট করে হলেও ইংরেজি বললেও, ওরা নিজের দেশের ভাষাকেও মান্য করেন, বলেন।

 অনেক গুলি দ্বীপের সমাহার এই দেশ।  সঠিক করে বললে ৭৬৪১ টা দ্বীপ! ভাব একবার। জল আর ডাঙা, ডাঙা আর জল। দ্বীপের দেশ বলেই অনেক জঙ্গল এখানে, আর মাঝে মাঝেই ভূমিকম্প আর টাইফুন হয়। চিন সমুদ্র, ফিলিপিন সমুদ্র দিয়ে ঘেরা এই দ্বীপপুঞ্জে মানুষ দূরে দূরে যায় সমুদ্রের মাছ আনতে। আর নানা ধরণের কাঠ, নানা ধরণের বাঁশ ও বেতের জিনিশ তৈরি করে গ্রামের মানুষ। ভারি চমৎকার গড়ন তাদের।

দ্বীপের কথা যখন উঠল, তখন সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতাটি দিয়ে শেষ করি। আমরা  টাগাটায়ে  দ্বীপে গেছিলাম… বেশ ঘন্টা দুইয়ের গাড়ির পথ, তারপর এক হ্রদ, হ্রদের নাম তাল । সে  তাল লেক পেরোতে হয়  অসামান্য একটা রবারে তৈরি ডিঙিনৌকোর ভ্রমণে, গায়ে বেলুনের মত লাইফ জ্যাকেট পরিধান বাধ্যতামূলক।

নৌকো থেকে নেমে  দ্বীপে উঠে, কিছুটা হেঁটে, দেখা যাবে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খচ্চরের দল। বাদামি রঙের ঘোড়া আর গাধার মাঝামাঝি প্রাণীটি। তিনিই নাকি আমাদের উদ্ধার করবেন, পথের সাথী হবেন।

আবার  খচ্চরের পিঠে চেপে  দ্বীপের ঠিক মাঝামাঝি পাহাড়ের চুড়োয় চাপা… সে পাহাড়ের পথে পথে, উঁচুনিচুর মধ্যে মধ্যে, পাথরের ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরোচ্ছে গরম ধোঁয়া। টাগাটায়ে যদি পাহাড়ের নাম তো আগ্নেয়গিরির নাম হ্রদের নামে তাল।  মৃত নয় বেশ জীবিত একটি আগ্নেয়গিরি সেটি। পথটা পুরোটাই চড়াই উতরাই, খচ্চরের পিঠে বসে কোমর ভেঙে যাবার দাখিল…

রিন্টি শেষমেশ খচ্চর থেকে নেমেই পড়ল, বলল, তার নিজেকে নাকি সোনার কেল্লার সেই উটের পিঠে চাপা লালমোহনবাবুর মতন লাগছে।

আমারও খুব কোমরে ব্যথা করছিল। পাহাড়ের চুড়োয় উঠে দেখলাম একটা জায়গায় বেড়া করা আছে, তার ওপাশেই আগ্নেয়গিরির মুখ। এখন সে মুখে শুধুই সবুজ টলটলে জল। মাটির ভেতর থেকে সামান্য সামান্য সালফারের ধোয়াঁ উগরে দিচ্ছে বটে আগ্নেয়গিরি, তবু সে অনেকটাই শান্ত লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে রয়েছে। সবুজ জলের শান্ত হ্রদের মত একটি মুখ দেখলে কে বলবে কোন এক দিন এখানে আগুন ঝরত, লাভা বেরিয়ে আসত গলগলিয়ে!

 মানুষ যেমন, কখনো শান্ত, কখনো অশান্ত।

ফেরার সময় পাহাড় থেকে নামা, তখন তো আর ওঠার কষ্ট নেই। পায়ের তলায় গড়িয়ে যাচ্ছিল ছোট পাথর, নুড়ি। তবু হেঁটেই নামলাম। সঙ্গের বাচ্চা ছেলেটি অনেক গল্প বলল।  একদল কিশোর যুবক যারা খচ্চর চালায়, তাদের সঙ্গেই হেঁটে নামলাম।

 তারা টাকা পেল অবশ্য পুরো পথেরই। ওটাই ওদের রুজিরুটি। ট্যুরিস্টদের পাহাড়ের মাথায় চাপানো আর নামিয়ে আনা এটাই ওদের কাজ। ছেড়া শার্ট পরা, সাধারণ সরল মুখের বারো তেরো বছরের ছেলেটির ভাঙা ভাঙা ইংরেজি কথা কানে লেগে রইল শুধু।

ছবিঃ লেখক

সমস্ত জয়ঢাকি ভ্রমণ একসাথে

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s