ভ্রমণ বাহামা ক্রুজ ও নাসাউ উমা ভট্টাচার্য শীত ২০১৭

 উমা ভট্টাচার্য  -র সব লেখা একত্রে

মধ্য অতলান্তিক সাগরের বুকে কিউবা ও হাইতির উত্তরে, ফ্লোরিডা উপদ্বীপের প্রায় দক্ষিণে অবস্থিত একগুচ্ছ ছোটোবড়ো দ্বীপের সমষ্টি নিয়ে বাহামা দ্বীপরাষ্ট্র। প্রায় ৭০০টির মতো দ্বীপ নিয়ে গঠিত লুসাইয়ান আর্কিপেলেগো বা  দ্বীপমালার একটা অংশ বাহামা, ‘কমনওয়েলথ অফ বাহামা’ নামেই পরিচিত। এর কাছেই ফ্লোরিডা। ওর্লাণ্ডো।  ফ্লোরিডার এক মনোরম সুন্দর শহর। শহরটির সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। অসংখ্য জলাশয়, তাতে আছে ফোয়ারা যাতে জলে চলন থাকে, জল ভালো থাকে। সে সব জলাশয়ে নানা জলচর পাখি ভেসে বেড়ায় সারাদিন; খাবার খুঁজে নেয় জলের তলে ডুব দিয়ে। গাছে গাছে নানা জাতের পাখি। আছে বড়ো বড়ো রিসর্ট আর নামীদামী হোটেল। অনেকগুলিই পাঁচতারা। ওর্লান্ডো থেকে পোর্ট ক্যানারভিলে বন্দর দিয়ে বাহামার দিকে যাত্রা শুরু হয় সমুদ্রপথে। পথে পড়ে ইন্ডিয়ানা আর বানানা নামে দুটি নদীর মাঝখানে ক্যানারভিলে অন্তরীপ। ক্যানারভিলে বন্দর থেকেই বিরাট বড়ো দুধসাদা জাহাজ়ে চড়ে আমার যাত্রা শুরু হল।

অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর (চেকিং) দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে এগোতে এগোতে জাহাজের ভিতরে প্রবেশ করা গেল। যাত্রীদের লাগেজ আগেই চলে গিয়েছিল জাহাজের পেটের খোলে। জাহাজের কর্মচারীরাই ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট রুম নম্বর দেখে দেখে লাগেজ পৌঁছে দিয়েছিল ঘরে ঘরে। জাহাজে উঠবার চেকিং যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানেই আমাদের পাসপোর্টের ছবি ও ডিটেল তুলে নিয়েছিল ওদের হাতে রাখা ট্যাবে। সেই ছবিই সারা জাহাজের সব প্রবেশপথে আর বহির্গমনের পথের কর্মরত দ্বারপালদের হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। কারচুপির বালাই নেই। সকলেরই আইনানুগ পরিচয়পত্র আছে। তাই জিনিস চুরি হওয়া বা বাজে লোকের খপ্পরে পড়বার কোনও ভয় ছিল না। আর শুরুতেই আমাদের দেওয়া হয়েছিল একটি সমুদ্রে প্রবেশের টিকিট ‘সী পাস’ যেটি জাহাজ়ে থাকবার চাবিকাঠি। হারালেই গেল। ক্যানারভিলে বন্দর থেকে যাত্রা শুরু হল সকাল এগারোটায়। ধীরে ধীরে নগর, বন্দর, স্থলভাগ দূরে সরে যেতে লাগল।

কয়েক ঘন্টা বাদে সব উধাও হল। তখন চারদিকে শুধু জল আর জল। এসময় জাহাজের সঙ্গী হল কিছু সামুদ্রিক পাখি। জাহাজের মাথার ওপর অনবরত পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতে লাগল। সমুদ্র আর আকাশের নীলিমার প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। পরদিন দুপুরবেলায় আমরা পৌঁছুলাম বাহামা দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী  নাসাউ দ্বীপে। পুরো একটি দিন চলেছিলাম অতলান্তিকের জলে ভেসে।

সমুদ্রের জলের যে কত শেড হতে পারে তা বুঝলাম অতলন্তিক মহাসাগরের বুকে জাহাজে বাহামা ভ্রমণে এসে।

সমুদ্রসবুজ (সী গ্রীন), আকাশনীল, ঘন নীল, তারপরে একসময় গভীর জল কালচে নীল হয়ে দেখা দিল। সেই নীল সমুদ্রের বুকের ওপর দিয়ে ভেসে চলল আমাদের ময়ূরপঙ্খী নাও – দুধসাদা চৌদ্দতলা জাহাজ ‘কার্নিভাল লিবার্টি’। মনে হল স্বপ্নরাজ্যে ভেসে চলেছি। মাথার ওপরে নীল আকাশ, নিচে নীল তরঙ্গময় সমুদ্র। তার ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে মাথার চিমনির পথে ধোঁয়া উড়িয়ে চলছিল বিরাট জাহাজ।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা এগিয়ে এল। সূর্যদেব বিশ্রাম নিতে চললেন পশ্চিম দিগন্তকে অস্তরাগে রাঙিয়ে দিয়ে। আপন মনেই গুনগুনিয়ে উঠলাম, ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো তোমার যাওয়ার আগে’। মধ্য অতলান্তিকের বুকে ভেসে ভেসে দিগন্তে সূর্যদেবের অস্তরাগের ফাগের খেলা দেখতে তখন সবাই উদগ্রীব। বাদ সাধল মেঘ। হঠাৎ কোথা থেকে মেঘের দল এসে ঢেকে দিল সূর্যকে। নড়নচড়ন নেই, কিছুতেই যেন সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেবে না। তবুও এক ফাঁকে তরল সোনার থালার একটুখানি দেখা গেল। কৃপা করলেন সূর্যদেব। যেটুকু দেখা পাওয়া গেল, প্রকৃতিপ্রেমীরা তখনই সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ছুটলেন তেরো তলার ছাদে। আমিও একটুকরো সূর্যকে ক্যামেরাবন্দী করলাম।

রাতের আঁধার নেমে এল পার্থিব জগতে। আকাশে তারাদের অবিরত ঝিকিমিকি দেখতে উঠে গেলাম তেরোতলার ডেকে। নিচে তো আলোর বন্যা আর মিউজিকের কলতান। নৈঃশব্দ নেই ক্রুজের ভাসমান শহরের ন’তলায়। সেখানে পুলে পুলে তখনও স্নান চলছে, সঙ্গে জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে নাচগানের অনুষ্ঠান। কখনও বা দেখাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশের প্রাণীদের কাণ্ডকারখানা। কখনও চলছে কোনও ফাটাফাটি সিনেমা। পৃথিবীর কত দেশের কত মানুষ যে সেই প্রমোদ অভিযানে সামিল হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সকলের পছন্দমতো অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে পাল্টে পাল্টে। পাঁচতলায় চলছে লাইভ সঙ্গীতানুষ্ঠান আর আনুষঙ্গিক নৃত্য। চারতলায় বিভিন্ন অংশে আছে দোকানপাট, নাটকের স্টেজ, আর বিশাল এলাকা নিয়ে আছে ক্যাসিনো। সারাদিন সেখানে খেলার লোকের অভাব নেই।

আমরা তখন বাস করছি সমুদ্রে ভাসমান বিলাসবহুল এক বিরাট শহরে। কী নেই সেখানে! অফুরান আনন্দের উপকরণ মজুত আছে ক্রুজে। ন’তলায় জনারণ্য। কারণ, সেখানেই রয়েছে ছোটোবড়ো পাঁচটি সুইমিং পুল, হট ওয়াটার স্পা। ছোটোদের জন্য সুইমিং পুলগুলি জাল দিয়ে ঘেরা। সারাদিন, এমনকি সারারাত সেগুলিতে চলছে হুটোপুটি। চৌদ্দতলার ডেক থেকে নেমে এসেছে একটি ঘোরানো স্লিপ খাওয়ার জায়গা। ঠিক ওয়াটার রাইড বলা যাবে না, তবুও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে লাইন থাকছে। বাচ্চা-বড়ো ভেদ নেই, সকলেই সেই স্লিপ বেয়ে দূরন্তগতিতে নামতে নামতে এসে পড়ছে সুইমিং পুলে। জল ছিটকে উঠছে, আনন্দে হুল্লোড় করে উঠছে সবাই। সারি দিয়ে পরপর নেমে আসছে লাইনে দাঁড়ানো সবাই একে একে। সে যে কী আনন্দসায়রে ভাসছে তারা, মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আমার দেশের দরিদ্র মানুষগুলোর মুখ মনে পড়ে গেল। ভাবতে লাগলাম, তারা কি কোনওদিন হতে পারবে এমন আনন্দযজ্ঞের অংশীদার!

আমি ক্রুজের ভেতরের ডাইনিং হল, বিভিন্ন জলসা আর ভেতরের চমকদার সাজসজ্জার কিছু ছবি নিলাম। একটি ছোট্ট ভিডিও তুললাম চলতে থাকা আনন্দ অনুষ্ঠানের।

দিনের বেলায় জাহাজের তেরোতলার ডেকে দাঁড়ালে দিগন্তের মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল ছোটো ছোটো দ্বীপ, আর ‘কে’। যেসব ভূমি সমুদ্রের তল থেকে সবেমাত্র মাথা চাড়া দিচ্ছে সেগুলি হল ‘কে’ । এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম লুসাইয়ান আর্কিপেলেগোর কাছে। সেই দ্বীপমালার নানা ছোটোবড়ো দ্বীপের পাশ দিয়ে চলতে চলতে এসে পৌঁছুলাম বাহামা দ্বীপরাষ্ট্রের নিউ প্রভিডেন্স দ্বীপের নাসাউ বন্দরে। একসময়ে ক্যারিবিয়ান পাইরেটদের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠা নাসাউ আজ বাহামার প্রাণচঞ্চল রাজধানী শহর।

বন্দরে জাহাজ পৌঁছুবার পর সঙ্গে সঙ্গেই নামা যাবে না। জাহাজের বিভিন্ন ফ্লোর থেকে যাত্রীরা লাউড স্পিকারের নির্দেশ অনুসরণ করে নেমে আসছিল। লাইন করে এসে জাহাজের একতলায় পৌঁছুবার পর বাইরে যাওয়া যাবে। বেরোবার পথে আবার চেকিং হল। সী পাস আর পাসপোর্ট দেখানো হল। ট্যাবে তোলা পাসপোর্টের ছবির তথ্য আর হাতের পাসপোর্টের তথ্য মিললে তবেই বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। সব নিয়মের বেড়া টপকে বাইরে বেরিয়ে এলাম দলের সবাই। সামনেই দেখা গেল ‘নাসাউয়ে স্বাগত’ লেখা গেট। এগোলাম বাহামার রাজধানী শহর নাসাউয়ের দিকে। বিরাট নাসাউ বন্দরটি আটলান্টিক সমুদ্রপথে খুবই গুরুত্বপুর্ণ।

আমাদের জাহাজের বিপরীতদিকের ঘাটেই এসে থেমেছিল আরেকটি জাহাজ। সেখান থেকেও কাতারে কাতারে মানুষ নেমে আসছিল। পথ ভোলার ভয়ে আমাদের দলের সবাই একত্র হলাম একটি শেডের নিচে। আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই, প্রকৃতি বোধহয় নীলের পাত্র উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে সেখানে। সূর্যের প্রচন্ড কিরণ থেকে বাঁচাতে ক্ষণিকের ছায়া এনে দিচ্ছে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ভেলা।

একটু এগোতেই সামনেই দেখা গেল কিছু মানুষ, দ্বীপের আদিম মানুষদের জাতীয় পোশাক, পাখির পালক, গাছের পাতা দিয়ে বানানো শিরস্ত্রাণ, হাতে বল্লমের মত অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। উপজাতীয় পোশাকে সেজে তারা স্বাগত জানাচ্ছে নানা দেশে থেকে আগত মানুষদের। তাদের দেশ দেখতে আসা মানুষজনকে আহ্বান জানাচ্ছে তাদের সঙ্গে ছবি তোলবার জন্য। অনেকে তাদের সঙ্গে ছবি তুলছে। ছবি তুললে সেই ছবি পর্যটককে দেবার বিনিময়ে মিলবে অর্থ, খানিকটা আয় হবে। নাসাউয়ে পর্যটনই প্রধান শিল্প। এর ওপরই এই দ্বীপের অধিকাংশ মানুষের জীবন নির্ভর। তাই পর্যটক তাদের কাছে অতিথি নারায়ণ।

এবার আসি নাসাউয়ের কথায়। হাজার বছরের মধ্যে অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করেছে নাসাউ। বাহামার নানা দ্বীপের মতো বর্তমানের নাসাউ, অতীতের চার্লস টাউন। নাসাউয়ের গা ঘেঁষেই রয়েছে এর উপগ্রহের মতো ছোট্ট অথচ সুন্দর দ্বীপ ‘প্যারাডাইস আইল্যান্ড’। এইসব দ্বীপের আরণ্যক পরিবেশে সভ্যজগতের নানা জটিলতার বাইরে একসময় সুখেই ছিল আদিম লুসাইয়ান উপজাতির নানা শাখার বনজীবি মানুষেরা। এখানকার আদিম টাইনো উপজাতির মানুষরা জায়গাটির নাম রেখেছিল ‘বাহামা’ – ওদের ভাষায় এর অর্থ হল ‘বিগ আপার মিডল ল্যান্ড’। স্পেনিয়রা বাহামা দখল করার পর নাম দিয়েছিল ‘বাজা মার’, অর্থাৎ অগভীর সমুদ্রের দেশ। সত্যি এর চারপাশের সমুদ্রের গভীরতা খুব বেশি নয়। এসব অজানা দ্বীপের জগৎ নিয়ে ইউরোপের নানা দেশের মানুষদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ ছিল। যেমনটি ছিল মশলা, সোনা, রূপা, নানা দামী পাথরের দেশ অজানা ভারতবর্ষকে নিয়ে।

ভারতবর্ষের সম্পদের লোভে ভারত আবিষ্কারের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন স্পেনিয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস। ১৪৯২ সালে জানা বিশ্বের বাইরে এই বাহামা দ্বীপপুঞ্জের পূর্বাংশে প্রথম পা রেখেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন এশিয়া তথা ইণ্ডিজে পৌঁছে গেছেন তিনি। নতুন দেশটির নাম দিয়েছিলেন ‘ইন্ডিজ’। পরে বুঝতে পারলেন সেটি ইণ্ডিয়া বা ভারত নয়। সেখানে তিনি প্রায় পোশাকহীন, বন্য কালো আদিম মানুষদের সন্ধান পান। লুসাইয়ান-ট্রাইনো উপজাতির আদিম, অরণ্যজীবি প্রায় ৩০,০০০ হাজার মানুষের বাস ছিল তখন এইখানে। এই মানুষেরা হিসপ্যানিওলা বা হাইতি আর কিউবা থেকে এসে এইসব জনহীন দ্বীপগুলিতে বসতি করেছিল একাদশ শতকে।

নতুন দেশ আবিষ্কার করলেও আশাভঙ্গ হওয়াতে কলম্বাস সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করলেন না। ফিরে গেলেন তিনি। কিন্তু সেখানে রয়ে গেল তাঁর সঙ্গে আসা কিছু লোভী স্পেনিয় নাবিক। কিছুদিনের মধ্যেই এরা দ্বীপের সরল সাদাসিধে, কর্মক্ষম মানুষগুলিকে বন্দী করে জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে যেতে লাগল বিভিন্ন দ্বীপে। বিক্রি করতে  লাগল ‘দাস’ হিসাবে। আটলান্টিক পথে ক্রীতদাস ব্যবসার শুরু হল সেই থেকে। দাসব্যবসা করে ধনী হয়ে উঠতে লাগল স্পেনিয় নাবিকরা। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য আরও দেশ এই ব্যবসা শুরু করে। আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা কলোনির বাসিন্দা ইংরেজরাও প্রচুর দাস সংগ্রহ করেছিল। তাদের লোভের শিকার হয়ে ১৫১৩ থেকে ১৬৪৮ সালের মধ্যেই বাহামার দ্বীপগুলো প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল। সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে ১৭১৮ সালের মধ্যে প্রায় জনহীন বাহামা হয়ে উঠেছিল ক্যারিবিয়ন জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্য।

যে ইংরেজরা ব্রিটেন ছেড়ে এসে উত্তর আমেরিকার পূর্বাঞ্চল জুড়ে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তেরোটি রাজ্য নিয়ে গড়ে তোলা কলোনিগুলি দীর্ঘদিন ব্রিটেনের রাজার শাসনাধীন ছিল। ১৬৭০ সাল নাগাদ কিছু অর্থবান ব্রিটিশ পরিবার কলোনি ছেড়ে নাসাউয়ে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের প্রত্যেকের দখলে ছিল প্রচুর জমি। তারা নাসাউয়ে ‘চার্লস টাউন’ নামে শহর স্থাপন করেছিল। এ শহরটিও ছিল ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস-এর শাসনাধীন। তাদের বসতির দক্ষিণ দিকে কাছেই ছিল নাসাউ বন্দর। ধীরে ধীরে আরও অনেক ব্রিটিশ পরিবার এসে সেখানে বসতি গড়ে তোলে। শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্রথমে তারা চার্লস্‌ টাউনে একটি দুর্গ স্থাপন করে। সেখানে গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র মজুত থাকত। ১৬৮৪ সালে স্পেনিয়রা অতর্কিতে আক্রমণ করে চার্লস টাউনকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

দশ বছরের মধ্যেই, ১৬৯৫ সালে ইংরেজ গভর্নর নিকোলাস ট্রটের তত্ত্বাবধানে আবার নতুন করে গড়ে উঠেছিল চার্লস টাউন। এবার নাম হল নাসাউ। ব্রিটেনের তৎকালীন রাজা তৃতীয় উইলিয়মের ডাচ নাম ছিল ‘অরেঞ্জ নাসাউ’। তাঁর নামেই নতুন টাউনের নাম রাখা  হল নাসাউ। নতুন নাসাউয়ের জন্ম হল। ট্রটের পরে সুশাসকের অভাবে নাসাউ-এর আবার দুর্দিন এল।

১৭০৩ সালে সুযোগ বুঝে ফ্রান্স আর স্পেন একযোগে আক্রমণ করল নাসাউ। এক অরাজক সময়ের মধ্য দিয়ে চলল নাসাউ ১৭১৮ সাল পর্যন্ত। একদিকে শত্রুদেশের আক্রমণ, অন্যদিকে জলদস্যুদের উৎপাত। তখন নাসাউতে প্রায় ১০০০ ডাকসাইটে জলদস্যুর বাস ছিল। নাসাউকে জলদস্যুরা ‘পাইরেট রিপাবলিক’ বলে ঘোষণা করেছিল। অল্পসংখ্যক সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিক যারা ছিল তারা দস্যুদের ভয়ে দ্বীপ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেই অরাজক অবস্থায় নাসাউয়ের গভর্নরের দায়িত্ব  নিয়ে এলেন ইংরেজ ক্যাপ্টেন উডস রজার্স। শক্ত হাতে দমন করলেন পাইরেটদের। রাস্তাঘাট তৈরি করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করলেন, রাস্তা ঘাট পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করলেন, নাগরিক প্রশাসনের সংস্কার করলেন, সুরক্ষার জন্য দুর্গ স্থাপন করলেন আরেকটি। সেখান থেকে আক্রমণকারীদের গতিবিধির ওপর আর নাসাউ বন্দরের ওপর নজর রাখা হত।

ওদিকে ১৭৭৫ সালে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের সেই তেরটি উপনিবেশ ইংল্যান্ডের শাসন থেকে মুক্ত হবার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছিল। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ। নয় বছর ধরে চলাকালীন যুদ্ধের সময় অনেক মানুষ আমেরিকার মূল ভুখন্ড ছেড়ে নাসাউ চলে আসতে থাকে। এছাড়া ব্রিটিশ উপনিবেশের যেসব মানুষ স্বাধীনতাকামী রাজ্যগুলির প্রতি সহানুভুতিশীল ছিল, যুদ্ধের সময় তাদের সাথে ছিল, ১৭৮৩ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে সেইসব বিশ্বস্ত মানুষেরা উপহার হিসাবে অনেক জমিজমা পেল  নাসাউয়ে। নাসাউ তো আগে থেকেই ইংরেজ উপনিবেশ ছিল। দলে দলে বিত্তশালী শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ আমেরিকানরাও এসে বসতি করল নাসাউয়ে। এইসব পরিবারের সঙ্গে এদের বহুসংখ্যক ক্রীতদাসও এসেছিল। তারা ঝোপ-জঙ্গল কেটে চাষের জমি তৈরি করল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পরোক্ষ ফল হিসাবে শুরু হল নাসাউয়ের উন্নয়ন। নাসাউ আবার জমজমাট শহর হয়ে উঠল। নাসাউয়ের অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুরু হল।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হতে হতেই আবার বিপর্যয় নেমে এল নাসাউয়ে। ১৭৭৬ সালে ঘটল নাসাউ যুদ্ধ। চিরশত্রু ব্রিটেনের উপনিবেশ বলে নাসাউকে জলে স্থলে একযোগে আক্রমণ করল ফ্রান্স আর স্পেন। আটলান্টিক বাণিজ্যপথে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ নাসাউ বন্দর দখলে রাখার জন্য বিদেশি নানা দেশের চেষ্টার অন্ত ছিল না।

উনিশ শতকে নাসাউয়ের শহরীকরণ শুরু হল। নতুন নাগরিকদের অর্থে নাসাউয়ের অনেক উন্নতি হল।  তেইশ হাজারের মতো নতুন বাড়ি তৈরি হল, রাস্তাঘাট তৈরি হল, রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা হল। স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির জন্য ম্যালেরিয়া নিবারণের উপায় হিসাবে মশার আঁতুড়ঘর ছোটো ছোটো জলাশয়, ডোবাগুলি বুজিয়ে ফেলা হল, নতুন দুর্গ তৈরি হল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার এল।

ইউরোপিয়রা বাড়িঘর বানাল উত্তর দিকের সমুদ্রের তীর ধরে পুব থেকে পশ্চিমে। তাদের বসতির পূর্ব সীমায় ছিল মন্টেগু ফোর্ট আর পশ্চিম সীমায় ছিল সান্ডার্স বেলাভূমি। বিংশ শতাব্দীতেও আর শ্বেতাঙ্গ মানুষ এসে বসতি স্থাপন করল, পুব থেকে পশ্চিমে আরও বাড়িঘর তৈরি হল। অর্ধচন্দ্রাকারে গড়ে ওঠা সেইসব বসতি বজায় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত। শহরের কেন্দ্রস্থলে ছিল সরকারি অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভবন যা এখনও আছে। নিকটবর্তী বাহামা দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য দ্বীপ থেকেও মানুষেরা এখানে এসে বসতি গড়েছিল। ক্রীতদাস হিসাবে আসা আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের বসতি ছিল বর্তমান নাসাউ শহরের দক্ষিণ দিকে গ্রান্টস টাউন, ব্রেইন টাউন ও আরও কয়েকটি নির্দিষ্ট শহরে সীমাবদ্ধ।

ক্রমে নাসাউয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ল সভ্য দুনিয়ার নানা দেশে। নীল, সবুজ জলের মাঝে নাসাউ আর তার গা ঘেঁষে জেগে থাকা নাসাউয়ের সঙ্গী দ্বীপ ‘প্যারাডাইস আইল্যান্ড’ হয়ে উঠল বিশ্বের ধনীদের আবাস স্থল, ব্যবসার জায়গা। অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ হয়ে উঠল পর্যটকদের গন্তব্য। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য হোটেল তৈরি হতে লাগল। সবচেয়ে দামী বিলাসবহুল ‘হোটেল আটলান্টিস’ স্থাপিত হল প্যারাডাইস দ্বীপে। বিপুল বৈভবের অধিকারী বিশ্বের তাবৎ মানুষদের গন্তব্য এই হোটেলে আছে মিউজিয়াম, ওয়াটার পার্ক, ডলফিন এনকাউন্টার সেন্টার, সবচেয়ে বড়ো মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম, কৃত্রিম ঝরনা, বোটিং করার জন্য কৃত্রিম জলাশয় – যার স্বচ্ছ জল সমুদ্রনীল, ধারের দিকগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত কোরালের চাদরে ঢাকা । অন্দর সজ্জার উপকরণের মধ্যে আছে নানান মডেল আর বিশ্বের তাবড় শিল্পীদের দিয়ে তৈরি করানো গ্লাস ওয়ার্ক আছে, আছে অসংখ্য ক্যাসিনো, সেখানে দিবারাত্র খেলা চলছে। গাছপালার মধ্যে পাম, খেজুর আর নানা ফুলের গাছ। আমাদের দেশের সাদা চাঁপাফুলের গাছও আছে।

নাসাউয়ে প্রবেশের মুখেই দেখলাম সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত চুল বাঁধার দোকান। আফ্রিকানদের নিজস্ব স্টাইলে চুল বাঁধা হয় সেখানে। অনেক পর্যটক সেখানে চুল বাঁধতে বসে গেছে।

১৯৬০ সালের পর সরকার থেকে নিম্নবিত্তদের জন্য সরকারি সহায়তায় স্বল্পখরচে বাড়িঘর তৈরির ব্যবস্থা করার পর প্রচুর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ বসতি পেল। ১৯০১ সালে নাসাউয়ে যেখানে জনসংখ্যা ছিল ১২,৫৩৪ জন মাত্র, ২০১৬ সালে দেখা গেল সেই জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২,৭৪,৪০০ জনের মতো। সমগ্র বাহামার জনসংখ্যার ৭০%-এরই বাস নাসাউ-এ। নাসাউতেই আছে বাহামার সবচেয়ে বড়ো মনুষ্যবসতি। ৮৫% আদি জনজাতি আর আফ্রিকান, ১২% ইউরোপিয়ান আর বাকি ৩% এশিয়ান আর হিস্পানিক।

এরপর আমাদের আফ্রিকান আমেরিকান গাড়িচালক আমাদের নিয়ে চলল নাসাউয়ের নানা দ্রষ্টব্য স্থান দেখাতে। প্রথমেই দেখা গেল পার্লামেন্ট স্কোয়ার, যেখানে আছে সমস্ত সরকারি ভবন। বাড়িগুলি সবই গোলাপি আর সাদা রঙের। প্রথম দেখলাম পার্লামেন্ট ভবন, যার সামনে রয়েছে রানি ভিক্টোরিয়ার কম বয়সের একটি প্রতিকৃতি। এখনও রানিকে তারা মানে, সেকথা জানাল আমাদের গাড়ির চালক। এরপর দেখলাম সুপ্রিম কোর্ট ভবন, সেনেট  বিল্ডিং, প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাসাউয়ের যুদ্ধ শহীদদের স্মৃতিতে তৈরি রেমেমব্রান্স পার্ক এবং শহীদ বেদী। ঘোড়ায় টানা গাড়িও দেখা গেল, যাতে চড়ে বহু বিদেশিরা নগরদর্শন করছে।

 পথে পড়ল ‘ট্রেজারি বিল্ডিং’ পুরনো কেল্লার ভগ্নস্তূপের ওপর তৈরি করা ‘ব্রিটিশ কলোনিয়াল হিলটন হোটেল’, ডাইভারস ক্লাব। চলার পথে দেখলাম ইয়াট ক্লাব, সারি সারি ইয়াট রাখা আছে সেখানে।

এবার চললাম পুরনো কেল্লা ফোর্ট ফিনক্যাসেল দেখতে। ক্যাসেলের সামনেই সারি সারি দোকান। পোশাক, ব্যাগ, মেমেন্টো, রঙিন চটি, পাতায় বোনা রঙবেরঙের টুপি, বাচ্চাদের খেলনা, হাতপাখা – কী নেই সেখানে! অপূর্ব  সেসব হাতের কাজ। আফ্রিকান উপজাতির মানুষদের নিপুণ হাতে তৈরি কাঠ ও বাঁশের নানা জিনিস, সুন্দর সুন্দর মুখোশ, তলোয়ার, ফুলদানি ইত্যাদি নানা হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা।

তীব্র রৌদ্রের তাপে ক্লান্ত পর্যটকদের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য আছে ডাব। দা দিয়ে সুন্দর করে কেটে দিচ্ছে। খাবার পর শাঁসটুকুও খাওয়া যাচ্ছে। তবে মুদ্রামূল্য আমাদের কাছে একটু বেশি লাগল, একটি ডাব পঁচিশ ডলার।

এবার ঢোকা গেল ফিনক্যাসেল দুর্গের ভিতর। দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু জায়গা সোসাইটি হিল ওরফে বেনেট’স হিলের ওপর দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৯৩ সালে। লর্ড ডানমোরের দ্বিতীয় উপাধি ছিল ভাইকাউন্ট ফিনক্যাসেল। তাই তাঁর নামেই দুর্গটির নাম রাখা হয়েছিল। গভর্নর ডানমোরের পরিকল্পনায় একটি প্যাডেল-স্টিমারের আকারে তৈরি হয়েছিল দুর্গটি।

 স্পেন ও ফ্রান্সের অতর্কিত আক্রমণ ঠেকাতে আর নাসাউ বন্দরের ওপর সতর্ক নজর রাখার জন্য তৈরি দুর্গটি শহরের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত ছিল। তাই চারদিকে নজর রাখা যেত। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে গেলে ডানদিকে রয়েছে সারি সারি ফাঁকা (গোলাবারুদের) কুঠুরি । সেগুলিতে রয়েছে কয়েকটি পাতলা কাঠের তক্তার ওপর আঁকা প্রতিষ্ঠাতা ও শাসকদের   ছবি, নিচে নাম ও পরিচয় লেখা । রেলিং দেওয়া ছাদের ওপর আছে কাঠের ডায়াস। সেখান থেকে জাহাজঘাটা, , সমুদ্র, বিশাল পানীয় জলের ট্যাঙ্ক, সাধারণ মানুষদের বাড়িঘর, প্যারাডাইস আইল্যান্ড, হোটেল আটলান্টিস, হোটেল হিল্টন – সবকিছু নজরে আসে। দূর দিগন্তে সমুদ্র আর আকাশ মিলেমিশে মিতালি করছে, তাও দেখা যায়।

এখানে আত্মরক্ষার জন্য প্রচুর গোলাবারুদ মজুত থাকত একসময়। বিভিন্ন রেঞ্জের ৬টি কামান এখানে ফিট করে রাখা ছিল। যার কয়েকটি এখনও আছে। ১৮১৭ সাল পর্যন্ত দুর্গটি এলাকার লাইট হাউস হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্যারাডাইস আইল্যান্ডে একটি লাইট হাউস নির্মাণের পর এটির মাথায় বসানো টাওয়ার থেকে সিগনাল স্টেশনের কাজ করে চলেছে। বন্দরে আমদের জাহাজটিকেও নোঙর করা দেখলাম দুর্গের ছাদ থেকে। এখানে পাইরেট সেজে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে, একটি পাতলা কাঠের মানুষের অবয়ব আঁকা, পরনে পাইরেটের পোশাক আর হাতে বন্দুক থাকলেও মাথায় পাকানো পাগড়ি। মনে হয় কোন সান্ত্রীর পোশাকের আদলও হতে পারে। কারণ, ইংরেজ জমানায় সান্ত্রীদের মাথায় পাগড়িই থাকত। কাঠের কাঠামোর মুখের জায়গাটি কাটা। পিছনদিকে একটি  পাথরখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে মুখটি বাড়ালেই ওই বেশে ছবি তোলা যাচ্ছে।

একে একে সকলেই এই মজার ছবিটা তুলল। তবে সব মজার ব্যাপার ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। তাই কিছু ছবির ব্যবস্থা। সপ্তাহে সাতদিনই সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত খোলা থাকা দুর্গটি দেখতে দেশবিদেশের পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।

আমাদের ক্যাবটির (ওদেশে ভাড়ার ট্যাক্সিকে বলে ক্যাব) চালক ‘রভি’ চলার পথে অনর্গল ইংরেজিতে করে আমাদের বোঝাচ্ছিল নাসাউয়ের নানা কথা। দেখব, না শুনব ভাবতে ভাবতে আর চারদিকের দৃশ্যের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম আর এক পুরনো দুর্গ মন্টেগু ফোর্টে।

নাসাউয়ের পূর্বাংশে সমুদ্রতীরে, রাজধানীর প্রধান যোগাযোগকারী সড়ক বে স্ট্রীটের ধারেই বন্দরের দিকে মুখ করে  অবস্থান। বিখ্যাত নাসাউ সিটি সেন্টারের মাইল খানেকের মধ্যেই অবস্থিত। কয়েকটি কামান ছাড়া ভিতরে আর কিছু দেখার না থাকলেও চারদিকের দৃশ্য অতি মনোরম। মনে হবে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও বিরক্তি আসবে না। মাথার ওপর দুপুরের খর রৌদ্র থাকলেও দীঘার সমুদ্রের ঝাউবনের মতো পাম আর নারকেল গাছের হাওয়ায় শরীর মন জুড়িয়ে যায়।

ফ্রান্স ও স্পেনের বারংবার আক্রমণের হাত থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের ও দ্বীপকে রক্ষার জন্য দুর্গটি প্রথম তৈরি হয়েছিল ১৭২৫ সালে। এরপর আরও শক্তপোক্ত করার জন্য ১৭৪১ থেকে ১৭৪২ সালের মধ্যে আরও সংস্কার করা হয়। এখানে রাখা হয়েছিল বাইশটি কামান আর মজুত ছিল প্রচুর গোলাবারুদ। এই গোলাবারুদের জন্য এই দুর্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আক্রমণ চালিয়েছিল ‘ইউনাইটেড মেরিন করপ্স’। দুর্গরক্ষার জন্য প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে জেনে আটটি রণতরী পাঠিয়েছিল তারা। কিন্তু আক্রমণের আঁচ পেয়েই রাতের অন্ধকারে একজন আধিকারিক সমস্ত গোলাবারুদ নিয়ে অগাস্টিন দ্বীপে চলে গিয়ে আত্মগোপন করেন।

দুর্গের পিছনদিকেই রয়েছে অপ্রশস্ত নীল সমুদ্র, পরপারে প্যারাডাইস আইল্যান্ড, হোটেল আটলান্টিস ও অন্যান্য রিসর্ট দেখা যায়। তীরের কাছের জল পান্না-সবুজ, কিন্তু যত ভিতরের দিকে তত নীল। এখানে তীরের কাছে জলের গভীরতা কম। এখানে ওখানে পাতলা জলের নিচে ভেসে আছে কোরালের চাদর, কোথাও ঢিপির আকারে জমে জমে তৈরি হয়েছে প্রবালের প্রাচীর। সেই পথ বেয়ে সমুদ্রের খানিকটা মাঝখানে চলে যাওয়া যায়। তীরের একটু ওপরেই বালুকাবেলা। অর্ধচন্দ্রাকার সমুদ্রতীর ধরে আছে বাড়িঘর, রিসর্ট। সারি সারি পাম আর নারকেলগাছের পাতা সমুদ্রের জোরালো বাতাসে কাত হয়ে যাচ্ছে আবার সোজা হয়ে যাচ্ছে। শীতল বাতাসে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। সমুদ্রের কাছেই চাঁদোয়ার নিচে ছোটোখাটো দোকান। দোকানি হাসিমুখে অভ্যর্থনা করছে পর্যটকদের। সমুদ্রের নীল জলে পাল তুলে ভেসে যাচ্ছে হাল্কা ইয়াট।

এবার যাত্রা করলাম প্যারাডাইস আইল্যান্ডে। পথে দুই দ্বীপের মধ্যেকার সমুদ্রটুকু পার হলাম ব্রীজের ওপর দিয়ে। এখানে পরপর দুটি ব্রিজ আছে।, পথেই দেখলাম নাসাউ ইয়াট ক্লাবটি।

বাহামা দীর্ঘকাল ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ। পরাধীনতার বাঁধন ছিন্ন করে ১৯৭৩ সালের ১০ই জুলাই স্বাধীনতা লাভ করে। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের মতো মহোৎসবের মধ্যে পালিত না হলেও সাধারণ পার্টি, খাওয়াদাওয়া, খেলাধূলা, দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ছুটির আমেজে দিনটি উদযাপন করে। হোটেল হিলটন আর হোটেল আটলাণ্টিসে আগের রাতে বাজি প্রদর্শনী হয়। জাতীয় নৃত্য ‘জুনকানুর’ দৌড় প্রতিযোগিতা হয়। জন কানু নামে এক ব্যক্তি এই নৃত্যের  সৃষ্টিকর্তা। রঙবেরঙের পোষাক আর গয়না পরে বাজনার সাথে স্ট্রিট প্যারেডই এই নাচের বিষয়। ঐদিন ইয়াচ প্রতিযোগীতাও হয়।

সামুদ্রিক জলভাগ নিয়ে বাহামার মোট এলাকা প্রায় ৪৭০,০০০ বর্গ কিমির মধ্যে নাসাউয়ের আয়তন ২০৭ বর্গ কিমি মাত্র। আয়তনের তুলনায় অনেক বেশি লোকের বাস নাসাউয়ে। বাহামার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগই বাস করে রাজধানী শহর নাসাউয়ে। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বাণিজ্যিক শহর ও রাজধানী নাসাউয়ের অধিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২,৭৪,৪০০ জন। অধিকাংশই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। তারা স্বীকার করে যে তারা সেইসব দুর্ভাগা ক্রীতদাসদের বংশধর। তবে আজ তারা আর কারও কেনা গোলাম নয়। তারা স্বাধীন নাসাউবাসী, বাহামিয়ান।

নাসাউ নিরক্ষীয় মৌসুমী জলবায়ুর দেশ। শীত এবং গরম কোনওটাই চরম নয়। উষ্ণতা ১৫ ডিগ্রির নিচে কখনই নামে না। প্রায় সারাবছরই নাতিশীতোষ্ণ মনোরম আবহাওয়ার কারণে এখানে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। এছাড়া সুন্দর পরিবেশ, আরাম, আর ভোগবিলাসের সমস্ত উপকরণ মজুত থাকার কারণে বিশ্বের নামকরা ধনীদের ছুটি কাটানোর জায়গা, আর পর্যটকদেরও গন্তব্য হয়ে উঠেছে নাসাউ। আর এই পর্যটন শিল্পই হয়ে উঠেছে নাসাউবাসীদের স্বাধীন জীবিকার উপায়। ক্যাব চালিয়েই প্রচুর মানুষ জীবিকা অর্জন করে। ভিখারি সেখানে দেখিনি। একমাত্র আটলান্টিস হোটেলই প্রায় ৬০০০ বাহামিয়ান কাজ করে। ক্রুজে ভারতীয় আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষজনই বেশি। ক্রুজের দুনিয়ায় নানা দোকানে, ফটোগ্রাফির দোকানে, পোশাকের দোকানে, গয়নাগাটি, ঘড়ি, ম্যাসেজ পার্লার সব দোকানের কর্মরত ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই এইসব দেশের  মানুষ। ক্রুজে কিচেনের সব রাঁধুনিই ছিল ভারতীয়। ডাইনিংয়ে প্রায় সব কর্মী ছেলেমেয়েরাই ছিল ভারত, জাপান, আর ইন্দোনেশিয়ার থেকে আসা।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এখানে বহু বিখ্যাত সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে মাথাপিছু আয় বেশ  বেড়েছে। বাহামার গর্ব এখানকার শিক্ষার অবস্থা। সাক্ষরতার হার শতকরা ৯৫ ভাগ। স্কুলে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। জাতীয় বাজেটের ২৪% শিক্ষার জন্য ব্যয়িত হলেও সরকারি স্কুলগুলিতেও পয়সা খরচ করে পড়াতে হয়। কোনওভাবেই ফ্রিতে পড়াশুনা করা যায় না বা স্কুলে ফ্রি লাঞ্চ কিছুই পাওয়া যায় না। তাই হয়তো পড়াশোনাটা ছেলেমেয়ে এবং অভিভাবকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ছোট্ট নাসাউ দেশটিতে শতকরা ৯১জন হাই স্কুল উত্তীর্ণ, শতকরা ৪৩ জন স্নাতক। স্কুলছুটের সংখ্যা নগণ্য, শতকরা ৯ জন।

নাসাউ হস্তশিল্প সংস্কৃতির উৎকর্ষতার জন্য ইউনেস্কোর ‘ক্রিয়েটিভ সিটিস নেটওয়ার্ক’-এ জায়গা করে নিয়েছে, ‘সিটি অফ ক্র্যাফটস এণ্ড ফোক আর্ট’-এর তকমা অর্জন করেছে। সব মিলিয়ে আজ ভালো আছে একসময়ের কেনা গোলাম হয়ে যাওয়া মানুষদের বংশধরেরা। বাহামা ক্রুজে গিয়ে এক অনবদ্য দেশ দেখলাম আর অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে নিয়ে ফিরে এলাম দেশে, যার সবটুকু বলা হল না।

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s