ঊর্মীর আগের ভ্রমণ ঃ বিপাশার বুকে র্যাফটের দোলায় , যেদিন উড়েছিলাম
রাজা চন্দ্রকেতুর কথা
আড়াই হাজারেরও বছর আগে এই বঙ্গদেশে এক প্রবল প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল চন্দ্রকেতু। গঙ্গার মোহনায় এক বিশাল সমৃদ্ধশালী রাজ্যের অধিকর্তা ছিলেন তিনি। রাজ্যের নাম গঙ্গাহৃদী। বা গঙ্গাহৃদয়। নাম মিলিয়ে রাজধানীর নাম গঙ্গে। বিদ্যাধরী নদীর ধারে, উঁচু প্রাচীর-ঘেরা এক বিরাট গড়ের মধ্যে ছিল সে বন্দর-নগর।
দেশ-বিদেশের সঙ্গে ব্যাবসা ছিল সে রাজ্যের বণিকদের। বিদ্যাধরী নদী দিয়ে গঙ্গা হয়ে যাতায়াত করত সমুদ্রগামী বড়-বড় জাহাজ। দেখবার মতো শহর ছিল গঙ্গে। শহরের মাঝখানে এক সুবিশাল পোড়ামাটির বিষ্ণু মন্দির। মানুষের পরনে দামী কাপড়। কানে, হাতে, গলায় রঙ-বেরঙের পুঁতির গয়না।
একবার চন্দ্রকেতু শুনলেন সুদূর পশ্চিমের দেশ থেকে আসা এক রাজা ঝিলম নদীর ধারে এক রাজ্য আক্রমণ করেছেন। নিজের রাজ্য বাঁচাতে চন্দ্রকেতু হাত মেলালেন পড়শি দেশ প্রাচী-র রাজার সঙ্গে। বিরাট বাহিনী নিয়ে যখন তাঁরা প্রস্তুত হলেন, তখন শুনলেন সেই আক্রমণকারী স্বদেশে ফেরার তোড়জোড় করছে। যুদ্ধ স্থগিত হোল।
তারপর একদিন চন্দ্রকেতুর রাজ্যে কোথা থেকে এলো এক পীর। নাম হজরত সৈয়দ আব্বাস আলী। লোকে ডাকত ‘পীর গোরাচাঁদ’। পীর রাজাকে বললেন ধর্ম পরিবর্তন করতে। রাজা ইচ্ছুক নন। পীর নাকি অনেক জাদু জানেন। রাজাকে ভয় দেখান। কিন্তু রাজারও যে অনেক ক্ষমতা সেটা তো পীর জানেন না! রাজা দুম করে একটি বেড়ার ওপর এক রাশ চাঁপাফুল ফুটিয়ে দেখিয়ে দিলেন তাঁর জাদুবিদ্যার দৌড়।
রাজায়-পীরে যুদ্ধ হোল। কে জিতল কে হারলো কে জানে! তবে পীর থেকে গেলেন। শহর থেকে কিছু দূরে তাঁর দর্গা তৈরি হোল। মারা যাবার পর তিনি কবরস্থও হলেন সেইখানেই। সেখানে আজও বছর বছর মেলা হয়।
শুধু হারিয়ে গেলেন রাজা চন্দ্রকেতু। একদিন সবাই ভুলে গেল তাঁকে ও তাঁর গঙ্গাহৃদীকে। শুধু রয়ে গেলো একটা নাম—চন্দ্রকেতুগড়।
ইতিহাসের রহস্য
রাজা চন্দ্রকেতুর যে গল্পটুকু বললাম তার মধ্যে অনেকটা কল্পনা, কিছুটা টুকরো টুকরো ইতিহাস, আর কিছুটা ইতিহাস হলেও হতে পারে। সমস্যা হল, কতটা কল্পনা আর কতটা ইতিহাস সেটা কেউই সঠিক বলতে পারেন না।
তাই রাজা চন্দ্রকেতুকে ঘিরে অনেক রহস্য। ঐতিহাসিক রহস্যগুলো আবার আলাদা আলাদা যুগের। সব তালগোল পাকিয়ে কী করে যে চন্দ্রকেতুগড় পৌঁছে গেলো তা ভগবানই জানেন। কিন্তু কোথায় সেই চন্দ্রকেতুগড়?
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৮ কিলোমিটার দূরে, উত্তর চব্বিশ পরগনার দেগঙ্গা থানা এলাকায় বেড়াচাঁপার তেমাথার মোড়। সে-ই যেখানে রাজা চন্দ্রকেতু নাকি বেড়ার ওপর চাঁপাফুল ফুটিয়েছিলেন।
বাঁ-দিক, ডান-দিক, ও সিধে চলে গেছে রাস্তা। ডান দিকে মোড় নিয়ে বড়-বড় গাছের ছায়া-ঢাকা পথ দিয়ে মাইলটাক গেলে কিছু উঁচু-নিচু ঢিবির সামনে একটি ফলক চোখে পড়ে। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এ.এস.আই)-এর ফলক। একটি ‘সুরক্ষিত স্মারক’-এর কথা বলা হয়েছে তাতে।
লেখা আছে, ‘এই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনটিকে প্রাচীন স্মারক, তথা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল…বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।’
ওই অবধি গাড়ি চলে। তারপর পায়ে হেঁটে আরও একটু এগোলে আবার একটি এ.এস.আই-এর ফলক। তাতে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তিতে’ বনভোজনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে।
আরও একটু এগোলে এ.এস.আই-এর শেষ ফলক। এই প্রথম পাওয়া যাবে নামটি—চন্দ্রকেতুগড়।
কিন্তু কোথায় সেই ‘পুরাকীর্তি’? একটি পায়ে-চলা পথ। ধারে ধারে আম কি নিমের গাছ। কিছু ঘাস-ঢাকা ঢিবি। তার ওপর হয়তো গরু-ছাগল চরছে। আর পথের ধারে, একটু নিচে, পাটের খেত। চন্দ্রকেতুগড় কোথায়?
এর উত্তর হল, ‘পায়ের নিচে’। গাছপালার ফাঁক দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে যে পথটি, যার অনেকটাই সবুজ ঘাসে ঢাকা, আর যার জায়গায় জায়গায় লাল ইঁট উঁকি মারছে, সেটি আর কিছুই নয়, রাজা চন্দ্রকেতুর সাধের গঙ্গে শহরের গড়ের ভগ্নাবশেষ। কিমবা বলা ভালো, হতেও পারে।
কালের খেয়ালে সে গড়ের প্রাচীর আজ একটি মেঠো রাস্তা যা একগুচ্ছ পাটক্ষেতের মাঝে হারিয়ে গেছে হঠাৎই। ঠিক যেমন হারিয়ে গেছেন রাজা চন্দ্রকেতু।
মাটির নিচে গুপ্তধন
চন্দ্রকেতুগড় যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ২০১১ সালে। তারপর আর যে যাওয়া হয়নি তার কারণ, যাকে বলে, ক্রমশ প্রকাশ্য।
তখন একটি বিশিষ্ট ইংরেজি খবরের কাগজে চাকরি করি। আমার এক বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী ও তাঁর এক পুরাতাত্ত্বিক ভাইয়ের সঙ্গে জুলাই মাসের এক মেঘলা সকালে হাজির হলাম চন্দ্রকেতুগড়। গড় নিয়ে তার আগেও লেখা হয়েছে। তাই এবার ঠিক কি নিয়ে লেখা হবে তার কিছু ঠিক নেই। যা যেমন পাওয়া যাবে।
স্মাগলিং-এর কথাটা আমরা সবাই জানতাম। চন্দ্রকেতুগড়ের ঢিবিগুলো খুঁড়লেই মাটির মূর্তি, সিল, পুঁতি ইত্যাদি পাওয়া যায়। আর গরিব দেশের মানুষের কাছে ইতিহাসের মূল্যের চেয়ে নিজের থালার ভাতের মূল্যটাই বেশি। তাই আমাদের আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস বিক্রি হয়ে যায় পশ্চিম দেশের বড়-বড় অকশন হাউজ, যেমন ক্রিস্টি’জ, সদবি’জ, ইত্যাদির কাছে। তারা সেগুলো অনেকগুণ দামে বিক্রি করে আরও বড়লোক হয়।
নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়ামেও চন্দ্রকেতুগড়ের মূর্তি আছে। এই ঘটনার দু মাস আগেই তা দেখে এসেছি।
আর গড়ের প্রাচীরের ইঁট দেখার জন্যে খুঁড়তেও হয়না। পায়ে-চলা পথটির ওপর সারাক্ষণ-ই তারা উঁকি মারে। আর সেই সঙ্গে পট-শার্ড বা মৃৎপাত্রের ভাঙা টুকরো।
পথটির ওপর দাঁড়িয়ে গায়ে কাঁটা দিল। পায়ের নীচে আড়াই হাজার বছরের পুরনো শহর! ভাবা যায়? পুরাতাত্ত্বিক বাবুটি পট-শার্ড নেড়ে চেড়ে বললেন সেগুলো বহু পুরনো। ‘কী করে বলছেন? ওগুলো দেখে তো এমনি ভাঁড়ের টুকরো মনে হচ্ছে,’ বললাম আমি।
উনি তখন একটি টুকরো ভেঙে দেখিয়ে দিলেন। ভাঙা জায়গাটা, অর্থাৎ যাকে ইংরেজিতে বলে ক্রস-সেকশন, সেটি কুচকুচে কালো। উনি বুঝিয়ে দিলেন যে নতুন হলে জায়গাটা বাকি টুকরোটার মতোই মেটে রঙ হত।
ছোট, বড়, মসৃণ, দাগ-কাটা অনেক ধরনের পট-শার্ড। বর্ষার জলে মাটি ধুয়ে গাদা গাদা টুকরো উঁকি মারছে পথের ওপর। কিন্তু এত পট-শার্ড কেন? পুরাতাত্ত্বিক বাবু বললেন তাঁর ধারনা এইদিকে হয়ত কুমোরপাড়া ছিল। তাই এত মৃৎপাত্রের টুকরো। হতেও পারে।
রাস্তা আর পাটক্ষেতের মাঝে একটা ১৫x১৫ ফুট মতো জায়গা জুড়ে দেড়-ফুট-গভীর গর্ত খোঁড়া। হয়ত এ.এস.আই-এরই কাজ। পাটক্ষেতের চাষিদের মধ্যে একজন বললেন যে যাঁরা খননের কাজ করছিলেন তাঁরা বর্ষার ঠিক আগেই চলে গেছেন। হয়ত আবার আসবেন।
পড়েছিলাম যে চন্দ্রকেতুগড়ে সবথেকে বেশি খননের কাজ করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালা। শেষ যে ফলকটির কথা বলেছিলাম, তাতেও লেখা আছে যে আশুতোষ সংগ্রহশালা ১৯৫৬-৫৭ থেকে ১৯৬৫-৬৬ পর্যন্ত খনন করে প্রাগমৌর্য (খৃষ্টপূর্ব ৬০০–৩০০) থেকে পালযুগ (৭৫০–১১০০ খৃষ্টাব্দ) অবধি টানা জনবসতির প্রমাণ পেয়েছে চন্দ্রকেতুগড়ে। মোট ১৭০০ বছরের হিসেব।
কুশান (৫০–৩০০ খৃষ্টাব্দ) ও গুপ্তযুগের (৩০০–৫০০ খৃষ্টাব্দ) রুপোর ও তামার মুদ্রা, মৌর্য (খৃষ্টপূর্ব ৩০০–২০০), শুঙ্গ (খৃষ্টপূর্ব ২০০–৫০ খৃষ্টাব্দ), কুশান, ও গুপ্তযুগের পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি, হাড়ের তৈরি মূর্তি, বিভিন্ন ধরনের পুঁতি, ও আরও অনেক রকমের প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছে। তা থেকে প্রমাণিত হয় যে এক কালে চন্দ্রকেতুগড় একটি সমৃদ্ধ নগর ছিল।
কিন্তু আজ অবধি কোনও রাজার নাম পাওয়া যায়নি। তাহলে চন্দ্রকেতুগড় নাম কেন? ফলকে লেখা, ‘কিংবদন্তি বিশ্রুত রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে মৃৎ-দুর্গপ্রাকার পরিবেষ্টিত এই বিস্তৃত প্রত্নক্ষেত্রটি চন্দ্রকেতুগড় নামে সমধিক পরিচিত’। তাহলে কি রাজা চন্দ্রকেতু শুধুই অলীক কল্পনা?
মেগাস্থেনিজের ‘গঙ্গারিডাই’ ও ‘স্যান্ড্রোকটাস’
ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনেকটাই পাওয়া যায় বিদেশী পর্যটকদের লেখায়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন গ্রীক পর্যটক মেগাস্থেনিজ। অ্যালেকজান্ডার ঝিলম নদীর ধারে রাজা পুরুর রাজ্য আক্রমণ করার (খৃষ্টপূর্ব ৩২৬) কিছুদিন পরেই মেগাস্থেনিজ ভারতবর্ষে আসেন। তাঁর লেখা ‘ইণ্ডিকা’ বইতে পাওয়া যায় ‘গঙ্গারিডাই’-এর ক্ষমতাশালী রাজা ‘স্যান্ড্রোকটাস’-এর কথা।
এতকাল ঐতিহাসিকরা ভেবেছেন যে এই স্যান্ড্রোকটাস হলেন মগধের রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। কিন্তু ২০১৬ সালে আই.আই.টি. খড়গপুরের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল দাবি করেন যে ‘স্যান্ড্রোকটাস’ চন্দ্রগুপ্ত নন, চন্দ্রকেতু। এবং এই দাবির স্বপক্ষে তাঁরা অনেক তথ্যপ্রমাণ দিয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়। গ্রিক পণ্ডিত টলেমির লেখাতেও পাওয়া যায় ‘গঙ্গারিডাই’-এর কথা। যার রাজধানী ছিল ‘গঙ্গে’। অন্যান্য গ্রিক ও লাতিন ঐতিহাসিকদের লেখাতেও পাওয়া যায় যে দুটি শক্তিশালী রাজ্য ‘প্রাসাই’ (প্রাচী) আর ‘গঙ্গারিডাই’-এর যৌথ আক্রমণের ভয়ে অ্যালেকজান্ডার ভারত ছাড়েন। এই প্রাচী হল অধুনা বিহার। কিন্তু গঙ্গারিডাই কোথায় গেল?
প্রত্যেকেই বলেছেন যে গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত ছিল গঙ্গারিডাই (গঙ্গাহৃদয়) বা গঙ্গারিডি (গঙ্গাহৃদী)। তাহলে কি চন্দ্রকেতুগড়ই সেই হারানো রাজ্য?
হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়। আজও চন্দ্রকেতুগড়ের মাত্র ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিদ্যাধরী নদী। এখন হয়ত বিদ্যাধরী বুজে এসেছে। কিন্তু এককালে বিদ্যাধরী নাব্য ছিল এবং এসে পড়ত আদীগঙ্গায়। গঙ্গা দিক পরিবর্তন করায় আদীগঙ্গা আজ একটি খাল মাত্র। কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগে ওটাই ছিল সমুদ্রের পথ। সুতরাং চন্দ্রকেতুগড়ের বন্দর-শহর ‘গঙ্গে’ হওয়াটা কিছুই বিচিত্র না।
তবে গোরাচাঁদ পীর অনেক পরে এসেছেন। তিনি চতুর্দশ শতকের মানুষ। হাড়োয়ায় বিদ্যাধরীর ধারে তাঁর দর্গা ও কবর আজও আছে ও প্রত্যেক বছর ফাল্গুন মাসে সেখানে মেলা হয়। তাঁর সঙ্গে রাজা চন্দ্রকেতুর নামটা কি করে জড়িয়ে গেল এটা বলা মুশকিল।
ইতিহাসের দাম ১৩০ টাকা
আমরা তিনজন এদিক ওদিক খুঁজছি কিছু পাওয়া যায় কিনা। আমার সঙ্গী দুজন কাঠি দিয়ে একটা ঢিবির মাটিতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছে। চারটি ছোট ছেলে একটি গাছের পেছন থেকে আমাদের কার্যকলাপ মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
শেষে আমার সহকর্মী তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ওরা কখনো কিছু পেয়েছে কিনা। একটু ইতস্তত করার পর একটি বছর বারোর ছেলে বলল ওরা হামেশাই কিছু না কিছু পায়। ‘আমাদের দেখাবি?’ বললেন আমার সহকর্মী। ছেলেটি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে ছুটল বাড়ির দিকে।
একটু পরের সে ফিরে এল। হাতে চারটে পুঁতি। দুটো লালচে বাদামি রঙের। তার মধ্যে একটা গোল আর একটা ঢোলের মতো। আর দুটো সাদা-কালো ডোরা কাটা, নলাকার। ‘বিক্রি করবি?’ সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেটি বলল তার কাকা আসছে। বিক্রিবাটার কথা কাকার সঙ্গে বলতে হবে।
ইতিমধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আমরা গাড়ির দিকে দৌড়তে দৌড়তে দেখি এর মধ্যেই কোথা থেকে এক পাল লোক জড়ো হয়ে গেছে। তার মধ্যে একজন ছেলেটির কাকা। বৃষ্টি থামতে আলাপ হয়। সবাই সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। আমার সহকর্মী সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন, ‘বিক্রি করবেন?’
লোকটি দর হাঁকে, ‘১৩০ টাকা’। আসল কি নকল না জেনে চারটে পুঁতির জন্যে এতগুলি টাকা শেষমেশ দেওয়া হয় না। চন্দ্রকেতুগড়ে ইতিহাসের ব্যবসার পাশেপাশেই আছে নকল ইতিহাসের ব্যবসা। অর্থাৎ মাটির মূর্তি, পুঁতি ইত্যাদির নকল বানিয়ে বিক্রি করা হয় আসল বলে।
কিন্তু ভাববার বিষয় হল, দেশের ২৫০০ বছরের ইতিহাসের দাম মাত্র ১৩০ টাকা!
খনা-মিহিরের ঢিবি
আশুতোষ সংগ্রহশালা যেখানে খনন কাজ করেছিল সে জায়গা দুর্গ প্রাচীরের দু’কিলোমিটার মতো উত্তরে। তাতে পাল যুগের এক বিশাল, বহুভুজ, উত্তরমুখী বিষ্ণু মন্দির বেরিয়েছিল। অবিশ্যি মন্দির না বলে মন্দিরের কঙ্কাল বলা ভালো। বেড়াচাঁপার মোড় থেকে বাঁ-দিকে গেলে সেই ‘মন্দির’।
কোনও বিশেষ আকার বোঝা মুশকিল। কোথাও একটু চৌকো, কোথাও একটু অর্ধচন্দ্রাকার, কোথাও বহুভূজ। ছাড়া ছাড়া ভাবে ইঁটের তৈরি আকৃতি। মাঝে মাঝে ঘাস গজিয়েছে। বিরাট বিরাট গাছ শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে জায়গা দখল করে আছে।
খুবই অদ্ভুতভাবে সেই জায়গার নাম ‘খনা-মিহিরের ঢিপি’ বা ‘বরাহ-মিহিরের ঢিপি’। কেন যে এমন নাম তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। বরাহ-মিহির তো ছিলেন রাজা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের (৩৮০–৪১৫ খৃষ্টাব্দ) নবরত্নের অন্যতম। তাঁরা থাকতেন উজ্জয়িনী নগরে।
খনা ছিলেন মিহিরের স্ত্রী। তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা সে বিষয়ই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কথিত আছে তিনি তাঁর শ্বশুর বরাহ দেবের চেয়ে ভালো ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। তাতে বরাহ দেবের অবমাননা হওয়ায় তিনি নাকি নিজের জিভ কেটে ফেলেন। এবার প্রশ্ন হোল, এরা সবাই চন্দ্রকেতুগড়ে কী করছেন। এরও অবশ্য কোনও উত্তর নেই।
খনা-মিহিরের ঢিপিতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা আবার ফিরে গেলাম দুর্গপ্রাচীরের দিকে। এবার আমাদের উদ্দেশ্য স্মাগলারদের খুঁজে বার করা। ওইদিকের রাস্তায় একটি মাত্র চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে দোকানী মহিলার সঙ্গে অল্পবিস্তর গল্প জোড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম তিনজন। বেশি কৌতূহল দেখানো যাবে না। তাতে সন্দেহ হতে পারে।
অবশ্য বেশি চেষ্টা করতে হলও না। মহিলা নিজে থেকেই গড়গড় করে অনেক কিছু বলে গেলেন। তাঁর পুকুরটি থেকে অনেক মূর্তি-টুর্তি বেরিয়েছিল। এ.এস.আই. সেটি খুঁড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি। কিন্তু অনেক বাজে লোক আছে যারা মূর্তি বেচে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছে, বাড়ি-গাড়ি করেছে, ইত্যাদি।
আমরা সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম এরকম কারো বাড়িতে উনি আমাদের নিয়ে যেতে পারবেন কিনা। আমরা গবেষক কিনা! দু-চারটে মূর্তি দেখতে পেলে আমাদের সবিশেষ উপকার হবে। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে রাজি। একজনের জিম্মায় দোকান রেখে বেরিয়ে এলেন আমাদের সঙ্গে।
পাঁচ-দশ মিনিট হেঁটে একটি সদ্য-রঙ-করা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন মহিলা। বাড়ির মালিক পাশের মসজিদে নমাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন।
একটি ছেলে গিয়ে আমাদের আসার উদ্দেশ্য বলল তাঁকে। দেখে মনে হল তিনি বেশ চিন্তিত। হয়ত সোজা না-ই বলে দেবেন। কিছু লোকের সঙ্গে ফিসফিস করে আলোচনা করে শেষকালে বলে পাঠালেন আমাদের বসাতে। দোকানী মহিলা বিদায় নিলেন। আর আমরা গিয়ে ঢুকলাম বাড়ির উঠোনের ধারে একটি গুদামঘরে।
চোরের গুদামঘরে
তিনজন তিনটি চেয়ারে চুপচাপ বসে। গুদামঘরটি দেখে মনে হচ্ছে সেটি তখনও তৈরি হচ্ছে। আকারে ১৫x১৫ ফুট মতো হবে। একটিমাত্র দরজা। মাটি থেকে অনেক ওপরে খুপরি খুপরি দুটি জানলা। ঘুলঘুলির চেয়ে সামান্য বড়।
প্রত্নতাত্ত্বিক বাবুটি গলা খাঁকরিয়ে বললেন, ‘বেশ একটা কাকাবাবু-সন্তুর অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে না? দাদা, তুমি হলে কাকাবাবু, আমি সন্তু, আর ওই যে একটা বিচ্ছু মেয়ে থাকতো মাঝে মাঝে, কি যেন নাম?’
‘দেবলীনা,’ বললাম আমি। ‘হ্যাঁ, দেবলীনা। ঊর্মি হতে পারে দেবলীনা,’ বললেন তিনি।
আমার সহকর্মী একটিও কথা বললেন না। সবারই বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তখন। হাজার হোক, লোকগুলো স্মাগলার। যদি তারা কিছু সন্দেহ করে কী করবে তার কোনও ঠিক নেই। দরজাটা আটকে দিলে পালাবারও পথ নেই। ওই খুপরি অবধি যদি পৌঁছতেও পারি, এবং যদি গলেও যাই, তাহলেও পড়ব বাড়ির উঠোনে। এবং পড়ে হাত-পা ভাঙা অবশ্যম্ভাবী।
অনেকক্ষণ পর বাড়ির মালিক ফিরলেন। এসেই ভুরু কুঁচকে সোজাসুজি প্রশ্ন, ‘কী চান আপনারা?’
আমার সহকর্মী গড়গড় করে আমাদের বানানো গল্পটা বলে গেলেন, ‘আমি ইতিহাসের শিক্ষক, এ আমার ছাত্রী। ইনি একজন গবেষক। আপনার কাছে যা প্রত্নবস্তু আছে তা দেখতে পেলে আমাদের কাজে সাহায্য হবে।’
আমরা বাকি দুজন ‘ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানিনা’ গোছের মুখ করে আছি। একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বাড়ির মালিক আমাদের উঠোনে নিয়ে গেলেন।
তিন-চারটি পেটমোটা সিমেন্টের বস্তা পড়ে আছে একপাশে। পাটের দড়ি দিয়ে মুখ বাঁধা। দড়ি খুলতেই বেরিয়ে পড়লো মাটিমাখা পোড়ামাটির মূর্তির টুকরো-টাকরা। কারুর মাথা, কারুর ধড়, একটি হাত, দুটি পা, কারুর কোমরের খানিকটা। দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস সিমেন্টের বস্তায় পচছে!
আমরা চেষ্টা করে কিছু জোড়া লাগালাম। একটি গণেশের মূর্তি গোটা পাওয়া গেলো। প্রত্নতাত্ত্বিক বাবুটি একটি দাঁত মাজার ব্রাশ চেয়ে নিয়ে ঘষে ঘষে মাটি পরিষ্কার করলেন। সুন্দর কারুকার্য করা মূর্তি সব। কিন্তু আসল না নকল? বোঝার উপায় নেই।
আমার সহকর্মী পাঁচটি টুকরো কিনলেন ৫০০ টাকা দিয়ে। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে হনহন করে গাড়ির দিকে হাঁটা। গাড়িতে বসে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
কলকাতায় ফিরে আমার সহকর্মী স্টেট ডিরেক্টোরেট অফ আর্কিয়লজি-তে নিয়ে যান সেই পাঁচটি টুকরো। দুটি তাঁরা ফেরত দিয়ে দেন ‘নকল’ বলে। আর সেই সঙ্গে উপদেশ দেন, ‘আগামী দশ বছর যেন আপনারা তিনজন ওই তল্লাট মাড়াবেন না।’
লেখাটি বেরবার এক হপ্তার মধ্যে স্মাগলিং র্যাকেটের একটি বড়সড় চাঁই ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। সেটি আমাদের সেই গুদামঘরের মালিক কিনা সেটা জানতে পারিনি। অবশ্য তাতে স্মাগলিং বন্ধ হয়নি।
হালফিল চন্দ্রকেতুগড়ে একটি মিউজিয়াম তৈরি হয়েছে। এর বেশি কিছুই হয়নি। খনন কাজ বেশি করাও মুশকিল। কারণ তাহলে এগারোটি গ্রামের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, খেত-খামার সব খুঁড়ে ফেলতে হবে।
তবে আই.আই.টি.-র গবেষকরা যদি প্রমাণ করতে পারেন যে চন্দ্রগুপ্ত নন, চন্দ্রকেতুই মেগাস্থেনিজের ‘স্যান্ড্রোকটাস’, তাহলে দেশের ইতিহাস বদলে যাবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ছবি লেখক। শীর্ষচিত্রঃ সম্পাদক