ভ্রমণ হাঁটছি অর্ণব চক্রবর্তী শরৎ ২০১৭

আগের পর্বগুলো  প্রথম পর্ব    দ্বিতীয় পর্ব   তৃতীয় পর্ব    চতুর্থ পর্ব  পঞ্চম পর্ব

হিমালয়ের কলঙ্ক, হিমালয়ের চ্যাঙ্গাব্যাং

আমি যখন বেশ ছোট, পাহাড় বলতে বুঝতাম পুরুলিয়া। আর হিমালয় বলতে সন্দকফু। ক্লাস এইট হবে তখন আমার। প্রথমবার সন্দকফুর ট্রেকার্স হাটে পৌঁছেছি । মনে অদম্য উত্তেজনা – কাল সকালে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শিখরের উপর সূর্যোদয় দেখব। কাঞ্চন রঙে ভেসে যাবে আমার কাঞ্চনজঙ্ঘা। ট্রেকার্স হাটের খাওয়ার ঘরে মোমের আলোয় গরম নুডলস খাচ্ছিলাম, হঠাৎ পাশের অন্য একটি দলের কথাবার্তা কানে এল। ওই দলের এক মধ্যবয়স্ক বেশ গাম্ভীর্যের সাথে তার বিবিধ হিমালয় ভ্রমণের আখ্যান শোনাচ্ছিলেন। কান খাড়া করে শুনতে শুনতে হঠাৎ দুটি শিখরের নাম সজোরে ধাক্কা দিল, বরফে মোড়া শিখরের নাম এরকম হয় নাকি। আমার প্রথম ট্রেকিং, কাঞ্চনজঙ্ঘার কপাল থেকে গড়িয়ে নামা সোনা রঙের স্রোত, পাখি গাছ-গাছালির মধ্যে খুঁজে পাওয়া অচেনা জগৎ, কিন্তু এতোসবের মধ্যেও, ওই দুটি নাম মাঝে মাঝেই ঘা দিতে লাগল মনে, যেন সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম – একদিন পৌঁছতে হবে এদের আঙিনায়, দেখতে হবে কী আছে তাদের রূপের গহনে, যার কারণে এই অপ্রচলিত নামের ভার তারা যুগ যুগ ধরে বহন করে চলেছে।

ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। অল্পবিস্তর হিমালয়ে যাতায়াত শুরু করেছি। হঠাৎ একদিন ভ্রমণ পত্রিকাটির একটি পাতায় চোখ আটকে গেল। পাতাজোড়া সাদা-কালোয় ছবি, অনুষঙ্গে অল্প করে পরিচিতি আর যাওয়ার পথের বিবরণ। আচম্বিতে আমার সেই ছোটবেলার ট্রেকার্স হাটের স্মৃতি ফিরে এল। পুরোনো এক শপথের কথা মনে আবার তোলপাড় শুরু করে দিল। প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম অল্পবিস্তর। অবশেষে একদিন পাঁচ বন্ধু মিলে জোশীমঠ থেকে জিপে রওনা দিলাম জুম্মার উদ্দেশ্যে। রাস্তার ডানদিক দিয়ে প্রবল পরাক্রমে বয়ে চলেছে অলকানন্দা। তার রূপ দেখে একরকম সম্ভ্রম মিশ্রিত ভয় জাগে। এই নদীটিকেই নীচের দিকে মানুষেরা সভ্যতার উল্লাসে বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে কষে বেঁধেছে। সেই যন্ত্রণাই যেন এখানে এসে আক্রোশের রূপে পরিবর্তিত।

এক সময় পৌঁছে গেলাম জুম্মা। চারিদিকে পাহাড় আর পাথর ভেঙে সভ্যতার জন্য রাস্তা হচ্ছে। রাস্তা এগিয়ে যাবে ভারতের শেষ গ্রাম মালারীর দিকে, তারপর কাঁটাতারহীন সীমানা পেড়িয়ে পৌছবে শীতল বরফের দেশ তিব্বত। হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমরা অলকানন্দার উপরের ঝোলা পুল ধরি, পেড়িয়ে আমাদের পৌঁছতে হবে রুইং গ্রাম। তারপরের তিনটি দিন আমরা কখনো জঙ্গল, কখনো ধ্বসা পাহাড় আবার কখনো দিগন্ত বিস্তারি পাথরের রাজ্য পেড়িয়ে পৌঁছে যাব লোঙ্গাতোলি ক্যাম্পিং মাঠের অনতিদূরে। আমাদের তাবু পড়বে ইতস্তত ছড়ানো পাথরের রাজ্যের মধ্যিখানের একটুকরো সমতলে। আমাদের চারিদিকে তখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ধুসর পাথরের দেয়াল। দেয়ালের কোন কোন অংশ তীক্ষ্ণ ক্ষতের মত জেগে আছে ধ্বসা মাটি পাথরের বাহুল্যে। এক গতিমান গ্লেসিয়ারের রূপ প্রথমবার চাক্ষুষ করে শরীরে শিহরণ খেলে গেল। এই রূপ আদিম, বন্য – এর দিনরাত্রির কাব্য অচেনা ছন্দে লেখা।

বিশ্রামের দিনটিতে পিঠের বোঝাহীন হালকা চালে আমরা পাঁচজন বেরিয়ে পড়লাম গ্লেসিয়ারের আঁতুড়ঘর দেখার বাসনায়। প্রথমেই বহু ধারায় বয়ে যাওয়া এক খরস্রোতা, অন্যপাড়ে তার কিছু আনমনা বন্য ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে। স্রোতাটিকে পেড়িয়ে ধীরে উঠে এলাম এক দিগন্ত বিস্তৃত প্রায় সমতল মাঠে। এই উচ্চতায় এরকম বিশাল ঘাসে ঢাকা মাঠ আমাদের কল্পনার বাইরে। সেই ঘোর কাটতে না কাটতেই দেখি মাঠটির শেষপ্রান্তে ধ্যানমগ্ন ঋষির মত জেগে আছে এক ত্রিভুজাকৃতি বরফে মোড়া শিখর। উপস্তিতির সাথে যেন সাযুজ্য রেখেই নামকরণ তার – ঋষি। সেই মাঠটি ধরে যত এগোতে থাকি আমাদের ডানদিকে উন্মুক্ত হতে থাকে আদিম গ্লেসিয়ারটির রঙ্গমঞ্চ। এদিকে মাঠটির বাঁদিকের পাহাড় থেকে বরফের নদী নেমে এসে বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করেছে আলপনা। কখনো সখনো সেই ঝুরো বরফের উপর দিয়ে পেড়িয়ে যাচ্ছি সন্তর্পণে। যত এগোচ্ছি, গ্লেসিয়ারটির রূপ যেন তত জাগ্রত হচ্ছে।

যেন মাটি পাথর আর প্রাগৈতিহাসিক ধুসর বরফের এক প্রলয় হঠাৎ কোন অভিসম্পাতে থমকে গেছে। সমস্ত শরীরে তার দগদগে ক্ষতের মত বরফ ফাটল। এক অচেনা শঙ্কা ঘিরে ঘিরে আসে। ভয়ানক প্রকৃতির রোষের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করতে করতে একসময় মাঠটির শেষ প্রান্তে নুড়ি পাথরের দেয়ালটির পদতলে এসে পৌছয়ই। একটু বিশ্রাম নিয়ে সেই ভঙ্গুর দেয়াল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকি। কখনো হড়কে নেমে যাই, আবার কখনো পা হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায় নরম মাটিতে। হাতে ক্যামেরা, তাই খুব সন্তর্পণে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাই। মনের কোন এক গহীনে একটা রিনিঝিনি অনুভব করি। এতোদিন ধরে তো এই দিনটির অপেক্ষায় আছি। আজ আকাশ অসম্ভব পরিষ্কার। বাতাস প্রায় নেই বললেই চলে। আকাশের কোন প্রান্তেই মেঘের কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু সামনে তো কালো পাথরের এক পাহাড়ি ঢাল। কোথায় সেই যুগল। তাহলে যে সন্দকফুর ট্রেকার্স হাটের ভদ্রলোক বলেছিলেন, ভ্রমণ পত্রিকা একপাতা জুড়ে ছবি ছেপেছিল – তাহলে কোথায় তারা। আমি ধৈর্যচ্যুত হয়ে একরকম হাচোড় পাচোড় করে দমছুট উঠে আসি বেশ কয়েক কদম, আর নিমেষে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। নীল আকাশের আঙিনায় সাদা বরফ আর কালো গয়নার সাঁজে সুঠাম দাঁড়িয়ে আছে সে – হিমালয়ের কলঙ্ক, আর তার কাধের উপর দিয়ে দৃপ্ত উপস্তিতিতে – হিমালয়ের চাঙ্গাব্যাং। দুটি শৃঙ্গ, দুটি ঐশ্বর্যময় বয়ান – বরফ পাথরের স্থাপত্যে আঁকা।

নিমেষে যেন আমি ফিরে গেলাম সেই বহু বছর আগের সন্দকফুর ট্রেকার্স হাটে, মোমের আলোর রহস্যময়তার মধ্যে কিছু নীচু স্বরের কথাবার্তা এ-দেয়াল সে-দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। কানে আসছে পাহাড়ী গ্রামের গল্প, পাহাড়ী রাস্তার গল্প, দুর্গমতার গল্প। আমি হাটু মুড়ে বসি, হঠাৎ রাতের সেই রহস্যময় অন্ধকার বাগিনী গ্লেসিয়ারের ঝকঝকে নীলাকাশের আলোয় মিলিয়ে যায়। চোখের সামনে জেগে ওঠে দুটি ঋজু শিখর।

সমস্ত জয়ঢাকি ভ্রমণ একসাথে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s