ভ্রমণ হাঁটছি অর্ণব চক্রবর্তী বর্ষা ২০১৭

হাঁটছি আগের পর্ব

bhromonhaantchhi02 পৌরাণিক ক্ষেত্রে, একা ও কয়েকজন

 সীমা গ্রাম ছাড়িয়ে এসেছি, দুপুর ধীরে ঢলে পড়ছে বিকেলের কোলে। ওসলা গ্রামের পাহাড়ি বন্ধু  প্রকাশ জানায় – আরেকটু এগোলেই একটা সুন্দর চারণভূমি আছে, সেখানে তাঁবু ফেলা যাবে। অতএব আমরা এগোতে থাকি এবং শেষ দুপুরে পৌঁছই সেই আয়তক্ষেত্র চারণভূমিতে। সত্যিই সুন্দর এক ক্যাম্পিং মাঠ। যে পথ বেয়ে এসেছি তা ধুসর বিকেলের আলোয় পিছনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। সামনে রাস্তা কিছুদূর গিয়ে উঠে গেছে এক পাহাড়ি রিজের উপর। আগামিকাল আমরা ওই পথে এগোব। তার আগে আজকের দিনটা উপভোগ করি। দেখতে থাকি মেঘ সূর্যের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, মেঘের ঘুলঘুলি বেয়ে নেমে আসছে আলোর বর্শা, উপত্যকার মাথায় শিরস্ত্রাণের মত এক রামধনু জেগে ওঠে। বড়ো নিরাভরণ শান্ত এক প্রকৃতি যেন পা ছড়িয়ে বসে আমাদের সাথে, গালগল্প করে। অজান্তে সন্ধ্যা নেমে আসে ক্রমে।

ঐতিহাসিকভাবে স্বতন্ত্র এই তমসা উপত্যকা। ভারতবর্ষের একমাত্র অঞ্চল, যেখানে দেবরূপে দুর্যোধনের পুজো হয়। গাঙ্গোর, ওসলা গ্রামে দুর্যোধনের বহু প্রাচীন মন্দির আছে। ভাগ্যচক্রে পূরোলায় আমাদের সাথে গাঙ্গোর গ্রামের বিজয় সিং এর আলাপ হয়। আমাদের দলে মালবাহক হিসেবে তার অন্তর্ভুক্তি আমাদের সামনে এনে দেয় এক অনন্য অভিজ্ঞতার সুযোগ। শাকরি গ্রাম থেকে সীমার উদ্দেশ্যে আমরা যাত্রা শুরু করি। কিছু গাঙ্গোরে পৌঁছে নদীর ধারে বিজয়ের কাঠের বাড়িতে থাকার নিমন্ত্রণ অযাচিতভাবে এসে পড়ায়, আমরা আর দ্বিতীয় চিন্তা না করে বিজয়ের আতিথেয়তা গ্রহণ করি। দুপুরের হালকা খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির সামনের পাহাড়ি রাস্তার উপর শুরু হয় ছোটছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা, একটা কাঠের তক্তা আর টোল খাওয়া প্লাস্টিকের বল নিয়েই চলতে থাকে আমাদের দাপাদাপি। এরমাঝেই বিজয়ের ঘরওয়ালি আমাদের জন্য চা নিয়ে আসে। চা শেষ করে বিজয়ের তত্ত্বাবধানে আমরা নদীর অপর দিকে গাঙ্গোর গ্রামের দিকে হাঁটতে থাকি, মুল অভিপ্রায় গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে দুর্যোধনের মন্দিরটি দর্শন করা। প্রচুর উত্তেজনা নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেখি, মন্দির বন্ধ। তবুও আমরা সেই পাথরে তৈরি প্রাঙ্গণে মৃদু চালে হেঁটে বেড়াই, প্রাচীন এক সময় যেন চোখের সামনে ক্রমাগত পাপড়ি মেলতে থাকে, পাষাণে যেন শোনা যায় শত অশ্বক্ষুরের আওয়াজ, প্রতিজ্ঞা আর প্রতিশোধের ইতিহাস যেন নিভৃতে বয়ে চলেছে মন্দিরের আনাচে-কানাচে। এক অজ্ঞাত ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে নিজেদের ধনী মনে হয়, পরিপূর্ণ হয়ে সন্ধ্যার মুখে বিজয়ের বাড়িতে ফিরে আসি। অন্ধকার আর নদীর শব্দের ক্রোড়ে বাড়িটিও যেন এক নতুন চরিত্র হিসেবে ধরা দেয়।

সীমা ছাড়িয়ে বেশ উঁচুতে এক আয়তাকার চারণভূমিতে আমাদের তাঁবু পড়েছে পরের দিন। রাত্রের খাওয়া সেরে তাবুর উষ্ণতায় শরীর এলিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ খুব সামনে অশ্বক্ষুরের দাপট টের পাই। যে নির্বিকার মেরুন-রঙা

ঘোড়াগুলো বিকেলে চারণক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ তাদের শরীরে জেগে উঠেছে যেন  যুদ্ধের দামামা। আমার মনে তখনো জেগে আছে বিকেলের মন্দিরের স্মৃতি, নিদ্রাহীন মনে হয়, যেন কুরুক্ষেত্রের প্রাঙ্গণে শুয়ে আছি অসহায়। ইতিহাসের পরিখার বাইরে এলেই টের পাই, আমার মাথার ঠিক পাশ দিয়ে দামাল ঘোড়াগুলো তাদের তেজি ক্ষুরে লাগানো নালের অহঙ্কার ছড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। ভীতু আমি গায়ে জ্যাকেটটা চাপিয়ে টর্চ নিয়ে তাঁবুর বাইরে আসি। টর্চের আলো মেরুন-রঙা এক মখমলি গাত্রে প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে আসে, আমি তাকে তাড়ানোর চেষ্টা করি, সে আলোর পরিধির বাইরে মিলিয়ে যায়। তাঁবুতে ফিরে এসে স্বস্তির শ্বাস ফেলে চোখদুটি এক করতেই আবার মাথার ঠিক পাশে ধুলো উড়ানো দর্পের অনুভুতি জেগে ওঠে। শঙ্কিত আমি আবার তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে আসি, ইতিমধ্যে বিজয় তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসে। আমার টর্চের আলোকে পিছনে রেখে হুশ হুশ হারারারা করতে করতে ঘোড়ার পিছনে তাড়া করতে থাকে বিজয়। দু-এক মিনিটের মধ্যেই আমার দু-ব্যাটারির টর্চের আলোর পরিধির বাইরে এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে যুগপত সেই ঘোড়ার দল আর বিজয় মিলিয়ে যায়। জেগে থাকে তমসার হাড় হিম করে দেওয়া হাওয়ার গর্জন। তাঁবুতে ফিরে আসি – স্লিপিং ব্যাগের ওমে শরীরটাকে ডুবিয়ে দিয়ে বেশ আরাম হয়। চোখে ঘুম নেমে আসে। স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পাই, হর-কি-দুন উপত্যকা ছাড়িয়ে পান্ডবদল স্বর্গারোহিনী শিখরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্যে উপত্যকা বিদীর্ণ করে দিচ্ছেন দুর্যোধন।

সমস্ত জয়ঢাকি ভ্রমণ একসাথে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s