হাঁটছি আগের পর্ব
আকাশের মাঠ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দুই আটপৌরে বেড়িয়েছি সেবার। উত্তরকাশির গঙ্গা ঘাটে বসেছি। শান্তনুদার একটি তথ্যে হকচকিয়ে গেলাম একেবারে। গঙ্গা নদী এখানে উত্তরবাহিনী – অর্থাৎ সে এইখানে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের বৈচিত্রের আরেক উদাহরণ যেন। উত্তরকাশির কিঞ্চিৎকর হোটেলেও এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল সেবার। রাত্রে শোয়ার সাথে সাথে শান্তনুদা ঘুমের জগতে। কিন্তু আমার আর ঘুম আসে না। নতুন পথে হাঁটার উত্তেজনায় আমার দু’চোখের পাতা যেন আর বোজে না। হঠাৎ কীসের যেন খুটখুট আওয়াজ। চোর এল নাকি?
আলো জ্বালিয়ে দেখি, না, দরজা ঠিকঠাক বন্ধ আছে। শব্দটাও আর নেই। আলো নেভাই। কিছুক্ষণ বাদে আবার আওয়াজ। কিন্তু আলো জ্বাললেই আবার সব নিস্তব্ধ। বালিশের পাশে টর্চটা নিয়ে শুলাম এবার। যেই আবার আওয়াজ হয়েছে, টর্চ জ্বালাতেই ধরা পড়ে গেল। একটি মূর্তিমান ধেড়ে ইঁদুর। টেবিলের উপর রাখা কিছু খাবার প্যাকেটের লোভে সে যারপরনাই উদগ্রীব। প্রমাদ গুনলাম আমি। অন্যায় জেনেও ফাঁকা জলের জাগটি ছাড়া অস্ত্র আর কিছু পেলাম না। এক পরম মুহূর্তে সে যখন মনোযোগ সহকারে আমাদের বিস্কিটের প্যাকেটটা ফুটো করতে ব্যস্ত, দিলাম জাগটি উল্টো করে চাপা দিয়ে। তার উপর চাপিয়ে দিলাম একটা ভারি জুতো। এরপর সেই মহামহিম বহু চেষ্টা চালিয়েছিল জাগটিকে উল্টোনোর। তারপর একটা সময় সব নিশ্চুপ হয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে ঘুম নেমে আসে চোখে, ঘুমের আগে একবার দেখি পাশে শুয়ে থাকা যোগী মানুষটিকে, ঘটনাটি তিনি জানতি পারলেন না এক বিন্দু।
যাত্রা শুরু করলাম উত্তরকাশি থেকে এক গাইড আর একজন নেপালি মালবাহক বন্ধুকে সঙ্গী করে। দায়ারা বুগিয়াল থেকে ডোডিতাল, তারপর দারোয়া পাস অতিক্রম করে হনুমানচটি নেমে যাব – এই ছিল পরিকল্পনা। তার মাঝে পথটিকে একটু রোমাঞ্চকর করার লক্ষে ঠিক করেছিলাম বন্দরপুঞ্ছ শিখরের পার্শ্ববর্তী একটা রিজ ধরে কিছুটা ঘুরে নামব ডোডিতালের আগে মাঞ্ঝি বলে জায়গাটিতে।
পথ শুরু হয়েছিল চমৎকার। দায়ারা বুগিয়ালের অতুলনীয় রূপে বুকের মধ্যে ঢেউ খেলে গেল। মনে হল অবলীলায় পেরিয়ে যাব পরিকল্পিত পথ। কিন্তু দায়ারার পরের ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পথে এসে বোঝা গেল আমাদের গাইডমশাইয়ের এই পথের সঠিক সন্ধান জানা নেই। বেশ আশঙ্কিত হয়ে পড়লাম আমরা দুজনেই। এইরকম এক সময় ঘন জঙ্গলের মধ্যে আমাদের দাঁড় করিয়ে গাইডমশাই সামনের রাস্তা খুঁজতে গেলেন। আমাদের মালবাহক বন্ধু তখন অনেক পেছনে।
দুজন দুজনের দিকে তাকাই আর চারপাশে ঘার ঘুরিয়ে দেখি কোন বিপদ উদয় হয় কিনা। কারণ আমাদের জানা ছিল এই জঙ্গল হিংস্র শ্বাপদে ভরা। এইরকম বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ গাইডমশাই-এর ডাক কানে আসে। আমরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করি তিনি যেদিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, ডাক আসছে তার উল্টোদিক থেকে। সম্বিত ফিরে পেয়ে আমরা দুজন হুড়মুড় করে কাঁটাঝোপ, গাছের ডাল অগ্রাহ্য করে তার কাছে পৌঁছলাম। তারপর কোনক্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে সেই জঙ্গলের অঞ্চল অতিক্রম করে একটা ফাঁকা ঘাস জমিতে পৌঁছে তাঁবু টাঙানো হল।
একটু ধাতস্ত হওয়ার পর সেদিনের দুপুরের গল্প শুনতে গিয়ে আমরা তাজ্জব হয়ে যাই। রাস্তা খুঁজতে গিয়ে গাইড মশাই এক ভয়ানক দর্শন ভাল্লুকের প্রায় সামনে পড়ে গিয়েছিলেন। কোনক্রমে তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর তার থেকেও বড়ো ব্যাপার, সেই ভাল্লুক আমাদের খুব কাছেই ছিল, কিন্তু আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।
সে যাত্রায় অল্পের জন্য আমরা বেঁচে গেলাম আর ঠিক করে নিলাম আর ঘুরপথ নয়, সোজা নেমে যাব মাঞ্জি, যেখানে পথ অনেক পরিচিত, অজানা অচেনা বিপদের ভয় অনেক কম।
মাঞ্জি পেরিয়ে তারপর পৌঁছলাম ডোডিতাল। তালের সামান্য আগে একটি বড় পাকা ঘর নগণ্য ভাড়ায় পেয়ে গেলাম থাকার জন্য। ঘরের সামনে একটা ঘাসে ছাওয়া প্রায় সমতল উঠোন। বুক চিরে তার বয়ে যাচ্ছে একটি শীর্ণ কিন্তু স্রোতস্বিনী নালা – একেবেঁকে। ঘরের দাওয়ায় বসে দেখলাম একদল সেনানীর গাছে উল্টো করে ঝুলিয়ে একটি খাসি কাটার কসরত। একটু বিকেল গড়িয়ে এলে নেপালী মালবাহক বন্ধুটিকে নিয়ে ওই স্রোতস্বিনীর বুকে নেমে পড়লাম, মাছ ধরার জন্যে। সেই ব্যর্থ চেষ্টা বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে তারপর ইতিউতি ক্যামেরাটা নিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি, দু-একটি ছবি আঁকা, ধীরে রাত নেমে এল সেই অরুপরতন ঘাটিতে।
পরদিন সুয্যিমামা ওঠার আগেই পাকদণ্ডী পথ চলা শুরু, বেদম চড়াই, অবশেষে দারোয়া পাসের মাথায় উঠে আসি। অপর দিকে ঢেউ খেলে নেমে গেছে বুগিয়াল। নামার পথ ধরি। নেমে আসি কানশার বুগিয়ালে। হিমালয়ের বেশ কিছু বুগিয়ালের সৌন্দর্য নিয়ে মানুষকে দেখেছি উচ্ছ্বসিত হতে, গুণগানে মুখর হয়ে উঠতে। কিন্তু এই কানশার সম্বন্ধে তো সেরকম শুনিনি। শুনিনি সীমা বুগিয়াল সম্বন্ধে। কিন্তু জোর গলায় বলতে পারি – হিমালয়ের যে কোন বুগিয়ালের সাথে এরা কাঁধে কাঁধে টক্কর দেবে। অন্যদিকে ভাবি, যতদিন সর্বগ্রাসী মানুষের মন ও মননের বাইরে এই বুগিয়ালগুলি রোদে-ঝড়ে- বৃষ্টিতে আপন খেয়ালে জেগে আছে, ততদিন আমাদের মত একলাচোরা মানুষদের জন্য ভাল।
আমরা তাঁবু ফেলব অসীম সবুজের এই সমারোহে, বন্দরপুঞ্ছ শিখর থেকে অভিসম্পাতের মত ধেয়ে আসা হিমেল হাওয়া নাড়িয়ে দেবে আমাদের খুঁটি, সেই অসহনীয় ঠাণ্ডার সাথে যুঝে থাকার জন্য রাতের পর রাত আমরা জ্বেলে রাখব প্রণম্য আগুন। এক সমদর্শী বয়স্ক মানুষ তাঁবু ছাড়া বিধ্বস্ত অবস্থায় এসে পৌঁছবেন এই উপনিবেশে। এক কাপ গরম চা এগিয়ে দিয়ে সেই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটির সাথে হেঁটে যাব তাঁর যুবা সময়ে, যে’সময় তিনি উমাপ্রসাদবাবুর সান্নিধ্যে পাহাড়কে চিনতে শিখছেন। আমরা রোমাঞ্চিত হব, আমাদের শ্বাস ঘন হয়ে আসবে, সমমনস্ক মানুষদের মধ্যে গড়ে উঠবে এক আত্মিক যোগসূত্র।
ক্রমে শীতার্ত রাত্রি শেষ হয়ে আসে, সীমা বুগিয়াল ছেড়ে আমরা নীচে নিশনি গ্রাম হয়ে হনুমানচটির পথ ধরি। পরবর্তী কাকভোরে আমরা দুই আটপৌরে এগিয়ে যাই যমুনোত্রী মন্দিরের দিকে। দূরে মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। হিমালয়ের গহনে স্নেহ নিয়ে, মমতা নিয়ে, মুক্তি নিয়ে মা যমুনা আমাদের প্রতীক্ষায় অধিষ্ঠিত আছেন ওই মন্দির গর্ভে।