ভ্রমণ সব এপিসোড একত্রে
সংঘমিত্রা মিত্র
কোলকাতা। আরেক নাম ‘City of Joy’। কিন্তু কেন এই নাম ? এই প্রশ্নটা সবারই মনে আসে। যদি একটু কাছ থেকে ঘুরে জানার চেষ্টা করা হয় তাহলে হয়তো পাওয়া যাবে এই কেন-র উত্তর। কোলকাতার কাছে প্রায় সবই আছে, সে ইতিহাসই হোক বা খাদ্য, রোমাঞ্চ হোক বা ঐতিহ্য সেটা ছোটো বা বড়, নতুন বা পুরনো সবাই একে আপন করে নিতে পারে।
আমি কোলকাতায় থাকি। কিন্তু কোলকাতাকে চেনার কথা বা কাছের থেকে জানার কথা হয়তো কখনও ভাবিনি বা ভাবতামও না যদি আমার সাথে একজন Travel Freak অর্থাৎ খুব ঘুরতে ভালবাসে এমন একজন মানুষের সাথে পরিচয়টা না হত। ব্যপারটা হল একদিন তার সাথে কথা বলতে গিয়ে সে আমায় স্পষ্ট ভাবে বলে – ‘I don’t like Kolkata and the people because they are so selfish.’
এইটা শুনে আমার খারাপ লাগলেও কিছু বলার ছিল না, কারন আমি তো নিজে সত্যি SELFISH এর মত নিজের শহরকে না চিনে বাইরের যায়গা চেনার কথা ও ঘোরার কথা ভাবি।তাই তাকে কোনও উত্তর না দিয়ে একটি ধন্যবাদ জানালাম। তার জন্যই আমি আমার শহরকে চেনার কথা প্রথমবার একটু ভালোভাবে ভাবলাম।
তারপর থেকে কোলকাতার উপর বিভিন্ন বই আর বিভিন্ন লোকের লেখাগুলো পড়া শুরু করলাম, কিন্তু তাতে করে তো শুধু জায়গার নাম পাচ্ছি,কাছের থেকে তো চিনতে পারছি না, তাই ঠিক করলাম কোলকাতা গিয়ে, কোলকাতার রাস্তায় হেঁটে চিনবো এই শহরকে আর এটাও জানবো কেন এর আরেক নাম ‘City of Joy’ । আর সেখান থেকেই শুরু হল আমার ‘কোলকাতা…হাঁটি হাঁটি ,পা পা’ এই পথ চলা।
Day-1
(11/08/2018)
আজ আমার কোলকাতা ঘুরে দেখার জন্য বেরোনোর প্রথম দিন। আজ আমি একাই বের হলাম। কারণ কে কতটা যেতে পারবে বা আমি কতটা কি ঘুরব বা কোথায় যাব কিছুই জানি না। আর একদিক থেকে হয়তো আমি একটু নিজেকে চিনবো আর কি করে নিজের সাথে সময় কাটাতে হয় সেটাও জানার প্রয়োজন ছিল। এই সব অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক করলাম শিয়ালদহ পৌঁছে যেই জায়গার বাস আগে পাব সেখান থেকেই শুরু হবে আমার কোলকাতা ঘোরার প্রথম দিনের।
শিয়ালদহ থেকে বেরিয়ে মানিকতলার দিকে যাওয়ার বাস পেলাম। আর তাতেই উঠে বসলাম। মানিকতলায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম একটা বাড়িতে লেখা – CALCUTTA POLICE MUSEUM,113 A.P.C ROAD। নামটা পড়েই কৌতূহলবশত ওইখানে যাওয়ার ইচ্ছা হল। কী আছে এর ভেতরে? কী বা এর ইতিহাস? কেন এই বাড়িটাকে মিউজিয়াম-এ পরিণত করা হল? এই বাড়ির ভেতর কি সাধারণ মানুষ যেতে পারে? এইসব প্রশ্ন নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। গেটের কাছে একজন পুলিশ কাকু বসে আছেন। তার সাথে কথা বলে যখন এই বাড়ি সম্পর্কে জানলাম আমার নিজের ভাগ্যর ওপর বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এত দারুণ একটা স্থানে আমি অজান্তেই এসে পড়েছি।
এই বাড়িটি আসলে রাজা রামমোহন রায়ের। ১৮১৪ সালের শেষের দিকে ডিগবি সাহেব অবসর নিয়ে ইংল্যান্ড ফিরে গেলে রাজা রামমোহন রায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কোলকাতায় ফিরে এসে ফ্রান্সিস মেন্ডেস সাহেবের থেকে ১৩,০০০ টাকার বিনিময়ে ২৫ বিঘা জমিতে ফলের বাগানসহ এই বাড়িটি কিনেছিলেন। ১৮১৪ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত ইনি এখানে ছিলেন। শোনা যায়, কিছু আর্থিক সংকটের কারনে বাড়িটি পরে তিনি এই বাড়িটি বিক্রি করে দেন। তবে এই বাড়িটি কি করে মিউজিয়াম হল তা এখনও অজানা।
বাড়ির ভিতর ঢুকলাম।ভিতরে ঢুকে দেখলাম বিভিন্ন রকমের ব্যাচ যা দিয়ে পুলিশদের সম্মানিত করা হয়,সেই সময়কার অস্ত্র-সস্ত্র কি রকম হয়,আরও অনেক কিছু জানলাম আর সেখান থেকেই খোঁজ পেলাম Amherst street এ রাজা রামমোহন মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের ব্যপারে।
সে-দিকে যাবার আগে একটা মিষ্টির দোকানে অনেক লোকের আনাগোনা দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। দোকানের ওপরে বড় বড় করে অক্ষরে লেখা ‘গীতিকা’। আর খিদেও পেয়েছিল বেশ, তাই সেখান থেকে কচুরি আর ক্ষীর শিঙাড়া খেলাম। আহা কী দারুণ খেতে, খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
খাওয়া শেষ হলে আবার হাঁটা শুরু করলাম রাজা রামমোহন মিউজিয়ামের দিকে। এই মিউজিয়ামটা নিয়ে শুনেছি মতভেদ আছে। কিছু লোক ভাবেন এটা রাজা রামমোহনের বাড়ি আবার কেউ ভাবেন এটা তাঁর ছেলের বাড়ি। বাড়ির পাশের রাস্তার নাম ‘সিমলা’ থেকে এই বাড়ির নাম পড়েছে ‘সিমলা বাড়ি’।
এই বাড়িটি সম্পূর্ণ ঔপনিবেশিক ধাঁচে তৈরি। কী সুন্দর দেখতে! বাড়িটির ছাদ ছিল কড়িবরগার কিন্তু তা প্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় থাকায় ছাদ ঢালাই করে দেওয়া হয়েছে, তবুও বাগানে একটা কড়ি-বরগার ছাদ দেওয়া জায়গা আছে। এই বাড়িতে গিয়ে রামমোহন রায়ের ব্যাপারে খুব ভালোভাবে জানা যায়। তাঁর লেখা বই,তাঁর পছন্দ আর তাঁর জীবন যাপন সম্পর্কেও জানলাম। এমনকি তাঁর পোশাকের ও নিদর্শন ছিল একটা ঘরে।
এইভাবে ঘোরাফেরায় বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিলো দারুণভাবে। তাই ঠিক করলাম, যাব চিৎপুরের রয়্যাল হিন্দুস্থানের বিরিয়ানি খেতে। শুনেছি এই বিরিয়ানি নাকি দারুন স্বাদের। তাই হাঁটা লাগালাম। ঐ দিকে যেতে গিয়ে আমি একটা ৩১৫ বছর পুরনো কালীবাড়ির সামনে এসে পড়লাম। কালীবাড়িটির নাম ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি।এটি এই জায়গার জাগ্রত কালীবাড়ি। এখানে মঙ্গলবার আর শনিবার প্রচুর লোক পুজো দিতে আসেন। ঠাকুর প্রণাম সেরে আবার হাঁটা লাগালাম চিৎপুরের দিকে। এখানের বিরিয়ানি খেয়ে বুঝলাম কেন এর এত নামডাক।
এখানে একটা দারুন মিষ্টি পাওয়া যায় সেইটা হল ‘শাহি টুকরা’,এইটা খেয়ে পেটের তৃপ্তি এসে গেল আরও।এই বিরিয়ানি আর মিষ্টির টানে আমি আবার আসব এখানে এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কলেজ স্ট্রিটের জন্য।
মধ্য কোলকাতার ১.৫ কিমি লম্বা রাস্তা জুড়ে আছে কলেজ স্ট্রিট। এই জায়গায় হেন কোন বই নেই যে পাওয়া যাবে না, সে ১৫০ কি ২০০ বছর পুরনো বই হোক কিংবা সদ্য বেরোনো কোনো বই, সব পাওয়া যায়। একটু দরদাম করলে নিজের আয়ত্তের দামে বই পাওয়া যায়। এখানেই আছে বিখ্যাত ‘কফি হাউস’। ১৮৭৬ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই কফি হাউস।
এই কফি হাউসকে নিয়ে মান্না দে গান লিখেছিলেন, ‘কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। এখানে কৃষ্ণ মিত্রের বাড়ি দেখলাম। এই কৃষ্ণ মিত্র ছিলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষের মেসোমশাই। অরবিন্দ ঘোষের জীবনে ও স্বাধীনতার ইতিহাসে এনার অবদান অপরিসীম। বর্তমানে বাড়িটির ভেতরে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। অরবিন্দ ঘোষ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে থেকেছিলেন। এই বাড়ির পাশে একটা অতি পুরনো পানের দোকান আছে যেখানে ৫ থেকে ৫০১ সব দামেরই পান পাওয়া যায়। লোভ সামলাতে না পেরে আমিও একটা পান খেলাম আর সেই ফাঁকেই এই বাড়ির ইতিহাসও জেনে নিলাম।
বেলা গড়িয়ে এল। বাড়ি ফিরতে হবে, তাই আজকের দিনের ইতি টানতে এগিয়ে গেলাম আমার
আজকের শেষ গন্তব্যে, প্যারামাউন্ট। মোটামুটি ৯৪ বছর থেকে এখানের শরবত আপামোর বাঙ্গালির রসনার তৃপ্তি করে আসছে। যদিও এর ডাব সরবত খুব বিখ্যাত, আমি খেলাম ক্রিম গ্রিন ম্যাঙ্গো।
এটা আমার দিনটাকে আরও দারুন করে দিল। ইতি টানলাম আজকের ‘কোলকাতা…হাঁটি হাঁটি ,পা পা’ এর। একটা ছোট্ট দিনের ঘোরা ফেরায় কোলকাতা আমার মনে ঘর করে নিল এক নিমেষেই।
ছবিঃ লেখক
Besh lagche.paye paye choluk
LikeLike
Nischoi cholbe.. 😊
LikeLike
Bes bes
LikeLike
Kono ak hati hati pa e songi howar prostab rakhlam
LikeLike
Ekdom hobe..
LikeLike
Osadharon 💕💕💕
LikeLike