ভ্রমণ-পাহাড়ি গ্রামের গপ্পো-নিশনি-ইন্দ্রনাথ-শীত ২০১৮

পাহাড়ি গ্রামের গপ্পো আগের সব এপিসোড একত্রে 

 

নিশনি

প্রথমটায় আমি আর আমার বন্ধু বুঝতেই পারিনি যে পাহাড়ি ঢালের জঙ্গলে আমরা পথ হারিয়েছি। দিব্যি যাচ্ছিলাম, আমাদের গাইড সাহেবের পিছু পিছু। তিনি উত্তরকাশীর বেশ সুপরিচিত বলবাহাদুর। বল তো আছেই তার ওপর তিনি বাহাদুরও বটে। তো হঠাৎ করেই একটা ঝুপ্পুস ঝোপের সামনে থেমে গিয়ে বাহাদুরসাহেব বললেন, “মনে হচ্ছে রাস্তা গুলিয়েছি।”

এ তো আর শহরের রাস্তা হারানো নয়, যে কাউকে ডেকে বললেই হল যে ওগো, অমুক রাস্তাটা বা অমুক বাড়িটা কোনদিকে বলে দেবে? একে জঙ্গল, তায় জনমনিষ্যিহীন পাহাড়ি এলাকা। অনেক নীচে অসিগঙ্গা বয়ে চলেছে দক্ষিণ দিকে ভাগীরথী নদীর দিকে। জঙ্গলের দিকে খানিক চেয়ে আমি বাহাদুরকে বললাম, একবার ধাঁ করে এই পাহাড়ের ঢাল ধরে বাঁহাতে ওঠো খানিক, জঙ্গল বেশ পাতলা হয়ে এলে ওপর থেকে রাস্তা বুঝতে পাবে। তুমি যাবে, না আমি যাবো? সে উত্তর না করে আমার কথার উল্টোদিকে ডানহাতি ঢালে নীচে নেমে গেল। আমরা অবাক হয়ে দুই বন্ধু এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বাদাম চিবুতে লাগলাম। বেশ খানিক পরে বাঁদিকের ঢালে ওপরে তাকিয়ে দেখি, বাহাদুর হাত পা নেড়ে মুখে আওয়াজ না করে কী বলছে আর আমাদেরও কথা বলতে বারণ করছে।

‘সে কী? ও ওপরে গেল কী করে?’ আমার মাথায় প্রথমেই প্রশ্নটা এল। যাহোক তার হাত পা নাড়া থেকে অর্থ বুঝে নিয়ে আমরা হাঁচড় পাঁচড় করে সেখানে গিয়ে উঠলাম। যা জানা গেল তাতে তো আক্কেল গুড়ুম! বাহাদুর খানিক নীচে নামতেই দেখে একটা মা ভালুক আর ছানা ভালুক ফুট পঞ্চাশ নীচে বসে আছে। ওকে দেখেনি, তাই ও নিঃশব্দে ঝোপের আড়াল নিয়ে ঘুরপথে সরে এসেছে। হাওয়া আমাদের থেকে ভালুকের দিকে বইছিল বলে আর আমাদের সামনে যথেষ্ট ঝোপঝাড় থাকায় এ যাত্রা আমরা বেঁচে গেছি। ছানা সঙ্গে থাকলে ভালুক মায়েরা মোটেই স্বস্তিতে থাকে না, বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যাবে, এই ভেবেই আক্রমণ করে বসে মানুষকে।

দিন চারেক বাদে, সীমা বুগিয়াল ছাড়িয়ে একটা পাহাড়ের ধারের ওপর বসে গল্প করার  ফাঁকে রাজনকে  একথা বলতে সে প্রথমে একটু

আতঙ্কের ভাব দেখিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল।

‘হাসছ যে?’

‘না, তোমাদের মুখগুলো ভাবার চেষ্টা করছি।’ বলেই আরেকপ্রস্থ হো হো।

‘যত্তোসব!’ বলে আমার বন্ধুটা খানিক তফাতে গিয়ে বসল পাথরের ওপরে।

‘আজ আমাদের গ্রামে থাকো।’

‘কোনটা তোমাদের গ্রাম?’

‘ওই তো, নীচে, টিনের চালা দেওয়া খান চল্লিশ পঞ্চাশ ঘর দেখছ না, ওইটেই আমাদের গ্রাম।’

‘বেশ বড়ো তো!’

‘বটেই তো, আর চাষের জমিও অনেকখানি। ওই যে আর একটু নীচে তাকাও, এখান থেকে মেরেকেটে দু-আড়াই কিলোমিটার হবে, ওইই হনুমানচটি।’

‘তার মানে যমুনোত্রী যাবার রাস্তায় পৌঁছে গেছি?’

‘হ্যাঁ দাদা। ওইই নদীর ওপাশে হনুমানজির মন্দির রয়েছে।’

রাজনের গ্রামটা বেশ ছড়ানো। ভালো করে তাকিয়ে দেখি চারপাশের পাহাড়ে যতদূর চোখ যায়, ধাপ কাটা চাষের জমি। যেন ভূগোল বই থেকে উঠে আসা ধাপচাষ পদ্ধতি চোখের সামনে মেলে ধরা রয়েছে।

রাজনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। সে, এমনিই, গ্রামের ওপরে এইদিকে পাহাড়ের ধারে উঠে এসেছিল, তার চরে বেরানো গরুগুলো দেখতে। অমনিই করে ওরা। গরু মোষ নিয়ে এসে ছেড়ে দিয়ে যায়, তারা দিনের পর দিন ঘাস খায়, এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে বসে বিশ্রাম নেয়। যার গাই-বলদ সে দিন কতক পরপর এসে তদারকি করে যায়। গ্রামের কাছে হলে, এমনটা। আর বেশি দূরে হলে কখনো ছানবাড়ি বানিয়ে গরু মোষ চরায় তারা; দুমাস, তিনমাস, চারমাস। তো রাজন আমাদের সঙ্গেই চলল। আর চলল এক সারমেয়। ভাগীরথীর তীর থেকে যে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছিল। কেন? না একটা বিস্কুট ভালবেসে দিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতা জানাতে সে সারাটা রাস্তা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এল, তা কিন্তু কম ভেবো না, প্রায় তিন দিনের পথ। আমাদের তাঁবুর পাশে আগুনের ধার ঘেঁষে শুয়ে রইল, খাবার ভাগ করে খেল। পথ দেখিয়ে নিয়ে এল, দুরূহ ঢালে দাঁড়িয়ে রইল, ঠিকমতো পার হচ্ছি কিনা দেখার জন্য।

‘শিউজি আপকা সাথ আয়া হ্যায়।’ খইনির টিপ বানাতে বানাতে রাজন সিং চৌহান বলে। ‘এমন কুকুর, দাদা, এ তল্লাটে নেই। এমন সোনালি গায়ের রঙ, এমন উঁচু! আর চোখটা দেখেছেন? আপনার দিকে তাকাচ্ছে কেমন করে দেখুন, কী ভালই না বাসছে আপনাকে! আমার কাছে থাকলে রেখে দেব দাদা।’

আমরা পায়ে পায়ে রাজনের গ্রামের গোড়ায়। এখান থেকে মাটি-পাথরের রাস্তাটা সোজা ঝাঁপ দিয়েছে নীচের পিচ রাস্তায়। মাত্তর দু কিলোমিটার।

‘আজ থেকে যাও দাদা, আলু খাওয়াব। হরেক কিসিম কা।’

‘মানে? সে আবার কী? আলু তো রোজই খাই।’

‘এ আলুর স্বাদ মুখে লেগে থাকবে দাদা। এই পাহাড়ি আলুর জাতই আলাদা। দেরাদুন দিল্লি বম্বে কোথায় না যায়! জমি থেকে তোলবার আগেই সব বিক্রি হয়ে যায়। পাহাড়ে থাকে না। ট্রাকে লোড হয়ে সব চলে যায় সমতলে।’

‘এত চাহিদা?’

‘আমরা কুলিয়ে উঠতে পারি না সাপ্লাই দিয়ে। গেল বছর মার খেয়েছে, তো এবারে ঢেলে হয়েছে আলু।

‘এবারে এত ফলন হয়েছে যে হাঁফিয়ে উঠেছি আমরা ফসল তুলে গোছ করে রাখতে। অত জায়গা কোথায়। ফলে জলদি জলদি বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। সমতলের আড়তদাড়েরা এই মওকায় দারুণ মুনাফাও করে নিচ্ছে।’

‘তোমাদের? কেমন হয়েছে? চাষ।’

‘খুব ভালো। হনুমানচটিতে বাসস্ট্যান্ডের পাশেই আমার গোডাউন, সেখানে লোডিং হচ্ছে। দেখবেন। রাস্তায় আলু গড়াগড়ি যাচ্ছে।’

রাজনের গ্রামে আমরা থাকতে পারিনি। আমাদের যমুনোত্রী যাবার কথা, বাহাদুরের বাড়ি ফেরবার তাড়া। ওদিকে যমুনোত্রী মন্দির বন্ধ হতে আর দুদিন মাত্র হাতে ছিল। রাজন একটু মনখারাপ করলেও পরক্ষণেই হাসিমুখে বলল, ‘আগলেবার জরুর আনা দাদা।’

ঘন্টা দুয়েকের আলাপে এমন আপন হয়ে যাবার ম্যাজিক আমরা

কেন যে দেখাতে পারি না! অথচ রাজনরা তুড়ি মেরে হর-হামেশাই এটা করে।

পিচ রাস্তায় নেমেই বাহাদুর ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাড়ি যাবার বাসের খোঁজ করতে যাবে বলে, বিদায় নিয়ে সে চলে যেতে, আমরা রাস্তার পাশে দুই মক্কেল থেবড়ে বসি। বাস আসতে কম সে কম ঘন্টা খানেক দেরী। যাব জানকীচটি। যমুনোত্রী সেখান থেকে ছ কিলোমিটার পথ মাত্র।

হনুমানচটিতে চারপাশে আলুময়। বস্তা বস্তা আলু বোঝাই হচ্ছে গাড়িতে। বাপরে! এত আলুর পাহাড় দেখিনি কখনো। রাজন বলেছিল, আশপাশ থেকে চার পাঁচটা গ্রামের আলু একত্রিত হয় এখানে। তারপর আড়তদারের হাত বদল হয়। বস্তাবন্দি হয়ে ট্রাকে ট্রাকে ট্রাকে নেমে যায় সমতলে।

রাজন একটা পোঁটলা গুঁজে দিয়েছিল। খিদে খিদে লাগাতে, খুলে দেখি মান্ডুয়ার আটা দিয়ে তৈরি রুটি আর আলু পোড়া। একটু নুন ছুঁইয়ে খেলাম। ওহো! কী অপূর্ব স্বাদ!

‘কী নাম তোমার গ্রামের?’ আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল।

‘নিশনি।’ বলে ভুরু নাচিয়ে রাজন বলেছিল, ‘এর মানে কী জানো?’

দুদিকে ঘাড় নাড়াতেই ও বলে, নিশ্‌ন মানে হল এদিককার গাড়োয়ালি ভাষাতে চড়াই। আর হনুমানচটি থেকে চড়াই ভেঙে প্রথম যে গ্রাম তার নামই নিশনি।’

সেকথা আবার মনে পড়ে যাওয়াতে আমরা দুজনেই মুখ তুলে পাহাড়ের ওপরে রোদ্দুরমাখা নিশনির দিকে তাকালাম।

ভ্রমণ সব এপিসোড একত্রে

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s