আগের পর্ব
যে কবিতাটি হারিয়ে গেল
একটা কবিতা হারিয়ে গেল। শুধু মনে আছে কবির নামটি – অমিতাভ দাশগুপ্ত, আর সেই রাতটার কথা। অনন্য এক টুকরো প্রায় সমতল মাঠের উপর আমাদের তাঁবু পড়েছে। রাত প্রায় আটটা হবে। রাতের খাওয়া সেরে আমরা নিজেদের স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শুয়ে ঘুমনোর আগে গুলতানি করছি, হঠাৎ সেই ঘন নিস্তব্ধতার আলোয়ান খসিয়ে ভেসে এল উদাত্ত কণ্ঠের গলা – ‘…আজ যদি হাওয়া জ্যোতিষীকে জিগ্যেস কর…’। সম্ভবত এইটিই ছিল প্রথম লাইন। আমরা মোহিত হয়ে শুনতে লাগলাম। এক অনবদ্য কবিতার রেণু ধীরে ধীরে আমাদের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেল। কিন্তু…সেই কবিতাটা তারপর হারিয়ে গেল আমার থেকে। সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ।
চোদ্দ বছর আগে আমরা ছ’জনের দল গিয়েছিলাম তথাকথিত রহস্যময় রুপকুন্ডের রাস্তায়। এদিক সেদিক ঘেঁটে রুপকুন্ডের রহস্যময়তার গল্প, বৈদিনী বুগিয়ালের অপরূপ সৌন্দর্য, ত্রিশূল আর নন্দাঘুন্টি শিখরের ঔদ্ধত্যের আলেখ্য জোগার করেছিলাম। সকলের মধ্যেই ছিল দারুন উন্মাদনা। ট্রেকের প্রথমপর্বে বৈদিনী আর আলি বুগিয়ালের সান্নিধ্যে দুটি অসাধারণ দিন কাটিয়ে রওনা দিলাম বৈদিনী বুগিয়ালের উত্তর-পূর্ব রিজ ধরে।
বেলা কিছুটা গড়াতেই সকালের ঝকঝকে মেজাজ বিগড়ে যেতে শুরু করল। কৈলু-বিনায়ক পার হতেই শুরু হল তুষার ঝড়। শুরু হল তীব্র হাওয়া আর গায়ে চোখে সোজাসুজি এসে বিঁধতে লাগল বরফকণা। কোনরকমে সামলে বরফে ঢেকে যাওয়া পাহাড়ি ঢাল বেয়ে এগোতে লাগলাম। দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, ওয়ান গ্রামের ছোটুকে আগে পাঠিয়ে দেওয়া হল কোন ছান বা ঘর থাকলে তার দখল নেওয়ার জন্য। দুপুর নাগাদ এক এক করে আমরা পৌঁছলাম ছোটুর দখল নেওয়া ঘরে। তবে নাম আর কাঠামোতেই ঘর, তার না আছে উপযুক্ত ছাদ, এবড়োখেবড়ো পাথরের মেঝে, দরজাহীন। তার ওপর পাশের লাগোয়া রান্নাঘরে যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তাও বের করা হল বাইরের তুষারঝড় এড়ানোর জন্য। একটা ছোট গর্ত দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওই গর্ত পেরোতে হত। এরই মাঝে রাজা দরজার প্লাস্টিকটা সরিয়ে ওর থার্মোমিটারটা বাইরে বের করল। কিন্তু পারদের দুরন্ত অধোগতি দেখে আঁতকে উঠে দ্রুত ঢুকিয়ে নিল। সব শেষে পৌঁছেছিল সুমিতদা। আর ঢুকেই সমস্তকিছু চকিতে পর্যালোচনা করে বলে উঠেছিল -‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা, তারই নাম বগুয়াবাসা’। জায়গাটার নাম যে বগুয়াবাসা।
রুপকুন্ড থেকে ঠিক দুটি দিনের আগের জায়গা এই বগুয়াবাসা, এরপর হুনিয়াথর এবং বিপজ্জনক বরফ চড়াই পেরোলেই রুপকুন্ড। কিন্তু প্রচুর বরফ পড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের গাইডমশাই শ্রী নাথু সিং বিস্তের পরামর্শ মত আমরা বগুয়াবাসা থেকে ফেরার সিন্ধান্ত নিই। পরদিন আবহাওয়ার মেজাজ আবার ঠিক হয়ে গেল। সাদা বরফের উপর দুষ্টু রোদ্দুর খেলা করা শুরু করল আপনমনে। আর আমরা ফিরতি পথে কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিতে লাগলাম ত্রিশূল আর নন্দাঘুন্টি শিখর আর রুপকুন্ডের পথরেখা। আমরা বিনা বাক্যব্যায়ে নাথুজিকে অনুসরণ করতে লাগলাম। মনে মনে যখন বৈদিনী বুগিয়ালে পৌছনোর কথা ভাবতে শুরু করেছি, হঠাৎ দেখলাম নাথুজি পাথর-নাচূনী পেরিয়ে উঠে যাচ্ছেন একটা উঁচু রিজের দিকে। অনুসরণ করে আমরাও এক সময় উঠে এলাম সেই রিজের উপর আর চোখের সামনে খুলে গেল এক দারুণ পটভুমি, দূরে ডানদিকে অনেক নীচে কানোল গ্রাম আর বাঁদিকে বৈদিনী বুগিয়ালের ঢেউ খেলানো প্রান্তর চোখ জুড়িয়ে দিল।
এইসব মন ভাল করে দেয়া পাহাড়ের রূপ দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখলাম উপস্থিত হয়েছি পথহীন এক ঘাস আর পাথরে পূর্ণ কঠিন পাহাড়ি ঢালের সামনে। নাথুজির নির্দেশমত অতি সাবধানে নামা শুরু করলাম। ঘাসের নিচে লুকোনো পাথরের থেকে পা বাঁচিয়ে নেমে এলাম সেই ঢাল বেয়ে। আর উপস্থিত হলাম প্রায় সমতল একটা ক্রিকেট মাঠের মত জায়গায়। একটু শ্বাস নিয়ে চোখ তুলতেই শরীরে শিহরণ খেলে গেল, যেন নন্দাঘুন্টি শিখরের ঠিক পদতলে এসে দাঁড়িয়েছি আজ আমরা। সেই মাঠ মত জায়গাটা সামনে গিয়ে হঠাৎ যেন ঝাঁপ দিয়েছে অতলে আর তার পরেই জেগে আছে দুই বৈভব শিখর। এতটাই আমরা আত্মহারা হয়ে গেলাম যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম দুটি দিন আলস্যে সেই জায়গায় কাটানোর।
প্রান্তরটির একদিকে চড়ে বেড়াচ্ছে দুটি ঘোড়া। হাওয়ায় উড়ছে তাদের কেশর। এক পাথরের চাতালে আমি আর রাজ্যশ্রী আঁকছি সেই ঘোড়াদুটিকে। শান্তনুদা সুর তুলছে তার বাঁশিতে। সমরেশদা কিচেনে পাহাড়ি বন্ধুদের সাথে গল্পে মজেছে। আমাদের পিছনের সবুজ পাহাড়ি ঢাল ক্রমান্বয়ে উপরে উঠে মিশে গেছে আজ নীল আকাশের সীমানায়। আর সামনে আমাদের, জেগে আছে মৌন ঋষির মত হিমালয়। দুটি নিজের মত দিন, সমস্ত যান্ত্রিকতার বাইরে , সমস্ত শহুরে হিসেব-নিকেশের বাইরে দুটি দিন যাপন। ওই জায়গা ছেড়ে আসার আগের দিন রাত্রে এক অদ্ভুত ভালো লাগা নিয়ে যখন তাবুর মধ্যে শুয়েছি, নির্জনতার ঘেরাটোপ ভেঙে ভেসে এল …’ আজ যদি হাওয়া জ্যোতিষীকে জিগ্যেস কর…’ । প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে উঠে সেই রূপকথার চরাচরে নিজেকে সামাল দিতে পারেনি সুমিতদা। হলুদ পাতা ছেড়ে উঠে এসে অমিতাভ দাশগুপ্তের কবিতা ঘোড়ার কেশরের মত নীরব দর্পে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সেই রূপকথার চরাচরে। আর নিশ্চুপে আমরা স্নাত হতে লাগলাম সেই অনন্ত রাত্রের মূর্ছনায়। কিন্তু সেই দিনের পর, সেই কবিতা আর আমার কাছে ফিরে আসেনি। সে নিভৃতে রয়ে গেছে ওই দেউলডুঙ্গার পরিসরে।
[ক্রমশ]