অলকানন্দা রায়ের আগের লেখা- দেশের বাড়ির সাপ
ঝড় এসেছে রূদ্ররূপে
অলকানন্দা রায়
সেদিন ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন- পঁচিশে বৈশাখ। সকালবেলা আকাশ আলো করে সূর্য উঠেছিল। কিন্তু বিকেল হতেই আকাশে কালো মেঘের ছায়া, সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ করে একটু দমকা হাওয়া দিল। দু-চার ফোঁটা বৃষ্টির জল ছুঁইয়ে গেল উত্তপ্ত মাটিকে। আমাদের গ্রামের প্রধান ইস্কুল বাটনাতলা হাইস্কুলে খুব সমারোহে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হত। আমি প্রাক্তন ছাত্রী আর বাড়িতে ভাইপো-ভাইঝিরা অনেকেই তখন ওখানকার পড়ুয়া, তাদের সাথেই গিয়েছিলাম। সারাদিন আনন্দে কাটিয়ে বিকেল-বিকেল ফিরে এসে, সন্ধের পরপর খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। সারাদিনের ক্লান্তি আর অল্পবয়েস- ঘুমিয়ে ছিলাম মরার মত। হঠাৎ মায়ের হাতের ঠেলায় উঠে পড়লাম। আরে বাব্বা- কিসের আওয়াজ? গোঁ গোঁ সেই শব্দ যেন অন্ধকার রাতটাকে ফালাফালা করে দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি করে উঠে দেখি ঘরের সবাই উঠে পড়েছে, আলো জ্বলছে। আমার বাবা উৎকন্ঠিত চোখে বাইরে গিয়ে আকাশ দেখছেন। একটু পরেই তীব্রবেগে বিদ্যুৎ চমকালো আর প্রচন্ড বেগে হাওয়া শুরু হল। মাঝে মাঝে বজ্রনির্ঘোষ। মা বললেন যে, রাতে অনেকক্ষণ টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। গ্রাম বাংলার মানুষ চৈত্র বৈশাখ মাসের কালবৈশাখিতে অভ্যস্ত। বিকেল হলেই দু একদিন পর হঠাৎ করে কালো মেঘে ঢেকে যায় আকাশ, দমকা হাওয়া দিয়ে শুরু হয় ঝড়। চারদিকে সামাল সামাল রব ওঠে। গরুরা সব মাঠ থেকে ছুটে ছুটে চলে আসে, রাখাল যে, সেও তার ছোট্ট লাঠিটি নিয়ে ছুটে আসে গরুর পিছন পিছন। সন্ধেবেলা হলে ঘরে ঘরে কাঁসর উলুর সাথে মিশে যায় বাতাসের শব্দ, কেউ হয়তো রান্না চাপিয়েছে- উনানের কাঠ তুলে দিল খানিক জল ঢেলে। কেউ কেউ আবার বড় একট পিঁড়ি উপুড় করে ফেলে দিল উঠোনে, মুখে তার ঝড়ের প্রতি বার্তা- “বাতাস তুই বইয়া পড়।” খানিকক্ষণ দাপাদাপির পরে হয়তো বৃষ্টি নামে, কখনো নামে না; গাছগাছালি ঝাঁকিয়ে দিয়ে চলে যায়। আমগাছের ডাল নাড়িয়ে ফেলে দিয়ে যায় কত আম। বিকেলের ঝড় অনেক সময় সারাদিনের প্রচন্ড গরমের পরে স্বস্তি আনে, শরীর শীতল করে।
কিন্তু আজকের ঝড়ের গতিপ্রকৃতি যে বড় ভয়ানক! গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে টিনের ছাউনি অথবা খড়ের। আমাদের অঞ্চলে পর পর সমস্ত গ্রামগুলিই কৃষি নির্ভর মানুষের বাস। সম্পন্ন গৃহস্থেরও পাকা বাড়ি বেশি নেই। টিনের ছাউনি দেওয়া দোতলা একতলা বাড়ি। আজকের ঝড়ের আগমনী-বার্তা মোটেই সুবিধার নয়। রাত শেষ হয়ে যাছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু বাইরে ঘোর অমানিশা। যত সময় এগোচ্ছে, ঝড়ের গতি ততই বাড়ছে। তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি, বাজের শব্দ- সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আজ পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে! সমস্ত গ্রামে নানা কলরব- কিছু শোনাও যায় না তেমন। তবে মনে হল যেন অনেক লোক ছুটে ছুটে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে। গ্রামের মধ্যে একমাত্র পাকা দোতলা দালান আমার বড় জ্যাঠামশাইয়ের। সময় যত এগোয় ঝড়ের আক্রোশ যেন তত বাড়ে। হঠাৎ ভীষণ শব্দে আমাদের রান্নাঘর আর খাবার ঘরের ওপরে ভেঙে পড়ল কোনো গাছ। মা বারান্দার জানালা দিয়ে দেখে বললেন যে ছোট পুকুরের কোণের বড় জামরুল গাছটা ভেঙে পড়েছে। আবার শব্দ! আমাদের টিনের চালের ওপরে ভেঙে পড়েছে কোনো গাছের বড় ডাল। পুরো বাড়ি তাতে কেঁপে উঠেছে। ভয়ে, আতঙ্কে আমরা শুধু ভগবানকে ডাকছি! আমার বাবা খুব নারায়ণ ভক্ত- সারাক্ষণ নারায়ণ নারায়ণ করে যাচ্ছেন। এরপরে ঘর থেকে বারান্দায় এলাম, ঘড়ি জানান দিচ্ছে সকাল হয়ে একটু বেলাও হয়ে গেছে। কিন্তু বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রবল বৃষ্টি, বজ্রপাত, বিদ্যুতের ঝলক- সব মিলিয়ে এক বিভীষিকা! যখন বিদ্যুৎ চমকায়, তার আলোতে দু’একসময় দেখি- তীব্র বেগে উড়ে যাচ্ছে গাছের ডাল, ঘরের ছাউনি।
আমাদের গোলাঘরের টিন উড়িয়ে নিয়ে গেল। আর একবার বিকট আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি আমার মেজো জ্যাঠার উঁচু পোতার টিনের ঘরের টিনের চাল তীব্র বেগে উড়ে যাচ্ছে। আমরা আর ঘরে থাকতে সাহস পেলাম না। মা, বৌদিরা, ভাইপো- ভাইঝিরা সবাই দৌড়ে গেলাম বড়জ্যাঠামশাইয়ের পাকা বাড়িতে। গিয়ে দেখি বাড়িভর্তি লোকজন। গ্রামের বৌ-ঝিরা বাচ্চাদের নিয়ে চলে এসেছে, পু্রুষমানুষেরা ঘরে রয়ে গেছে। গ্রামের লোকেদের বিশ্বাস, ঘর একদম ফাঁকা রেখে যেতে নেই এসময়ে, তাহলে ঝড়ের বা প্রকৃতির রোষে ঘর ভেঙে পড়বে। বাচ্চারা কান্নাকাটি করছে আর বড়রা সব ঠাকুরদেবতাকে ডাকছে। আমার মেজোজ্যেঠিমাও ঘরের মধ্যে একলা বসে চিৎকার করে কাঁদছেন আর ভগবানকে ডাকছে্ন, “রক্ষা কর, রক্ষা কর, রোষ সম্বরণ কর ঠাকুর।” আমাদের বাড়িতে পুবের পোতায় বড় জ্যাঠার, পশ্চিমের পোতায় মেজ জ্যাঠার আর উত্তরের পোতায় আমাদের ঘর। বাবাও এইসময়ে তাঁর প্রিয় নাতনি মিনুকে কোলে নিয়ে নারায়ণের মন্দিরে গিয়ে ঢুকলেন।
কতটা সময় যে এই আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে বলতে পারি না- মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে চলছে এই তান্ডব- রাতের আঁধার কাটিয়ে দিনের আলো আর দেখব কী না? তার আগেই হয় তো শেষ হয়ে যাবে জীবন। এমন আতঙ্ক সবার মনে। কেউ কেউ বলছে, “ওরে, দালানটা যে নড়ছে! চাপা পড়ে মরে যাবো না তো? সবাই বাইরে চল, উঠানে গিয়ে বসে থাকি। যা হয় হবে!”
কিন্তু তখন উঠানে কে যাবে? মুষলধারে বৃষ্টি সেখানে, বিদ্যুৎ আর হাওয়ার সাথে ডালপালা, ঘরের চালা, টিন প্রচন্ড বেগে উড়ে উড়ে আসছে- আর কী আওয়াজ- গোঁ গোঁ! যেন রুদ্ধ আক্রোশে কোনো দানব হুঙ্কার ছাড়ছে। মনে হচ্ছে সে যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই পৃথিবীটাকে তছনছ করে দেবে। শেষের দিকে ভয়ে, আতঙ্কে কাঁদতে শুরু করেছি। অসহায় মানুষের তখন একমাত্র নির্ভরতার জায়গা- ঈশ্বর।
ঘড়িতে তখন দশটা বাজে- দেখা গেল বৃষ্টি একটু কমে গেছে। তারপরে আস্তে আস্তে হাওয়ার বেগও কমতে শুরু করেছে। দুপুর পেরিয়ে সব শান্ত। আকাশটা একটু পরিষ্কার। সবাই তখন বেরিয়ে পড়ল। কী অবস্থা চারদিকে- পুরো গ্রামটা যেন একটা ধ্বংসস্তূপ! সারি সারি সুপারি গাছ, বড় বড় আম, জাম, শিরিষ গাছ, কোনটা কাৎ হয়ে পড়েছে, কোথাও ডালপালা ভেঙে একাকার! কত ঘরের ছাউনি উড়ে গেছে। কারো ঘরের ওপরে গাছ পড়ে ঘরখানা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। গোয়ালঘরগুলো নীচু এবং একটু ফাঁকা জায়গায় বলে গরুগুলো বেঁচে গেছে। মাঝেমাঝে বড় বড় নারকেল গাছ কাৎ হয়ে পড়ে আছে। গ্রামের সব বাড়ির লোকেরা প্রথমেই সকলের খোঁজখবর নিয়ে দা, কুঠার নিয়ে কাজে নেমে পড়েছে। সেদিন দুপুরে আর রাতে কারো বাড়িতে উনান জ্বলেনি। আমরা মেয়েরাও বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে দেখছিলাম। আমাদের বড় ঘরের পেছনের চালেও বিরাট একটা গাছের ডাল পড়ে তুবড়ে দিয়েছে। পুরুষ- মহিলা সবাই ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে গোছানোর কাজে লেগে পড়েছে। ছোটদের চিঁড়া মুড়ি এসব খাইয়ে দিয়েছে। এই করতে করতেই বিকেল গড়িয়ে এল।
হঠাৎ আবার বিকেলের দিকে পশ্চিম আকাশে মেঘ দেখা গেল। একটু একটু করে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যে যার আশ্রয়ে কোনোরকমে ঢুকে পড়ল। অনেকেই পরণে ভেজা কাপড়, কে একজন বিনাতপুর নদীর ওদিক থেকে এসে বলল, “নদী ফুলছে! সকলে সাবধান হও। এবারে কিন্তু জলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের সব গ্রাম।”
গ্রামে যাদের ঘর ভেঙে গেছে- অনেকেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিল। পুবের ঘর, পশ্চিমের ঘর ও আমাদের ঘর থেকে চিঁড়ামুড়ি খেতে দেওয়া হল। নিজেরাও সবাই তাই খেলাম।
তবে বিকেলে সেই কালো মেঘ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। অল্প সময় একটু একটু ঝোড়ো হাওয়া আর খানিক বৃষ্টি হয়ে সব আবার নিস্তব্ধ। কাল রাত থেকে আজকের সারাদিনে বিধ্বস্ত মানুষগুলো যে যেখানে পারল শুয়ে পড়ল। শরীর মন সব যেন নিথর হয়ে গেছে। সেদিন সন্ধেবেলায় কোনো ঠাকুরঘরে প্রদীপ দেওয়া হয়নি। কোনো ঘরে বাতি জ্বলেনি। চারদিকে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা।
প্রকৃতির ভয়ংকর রুদ্ররূপের সেই দুঃস্বপ্নের রাত জীবনে আরো একবার ফিরে এল ২০২০র ২০ মে। কলকাতা শুধু নয়, পুরো পশ্চিমবাংলাকে তছনছ করে দিল এই দুর্জয় শক্তিশালি ঝড় আমফান। আমরা মানুষেরা যে প্রকৃতির উপরে অত্যাচার করি, প্রকৃতি তাই মাঝেমাঝে বোধহয় তার নিজস্ব ধারায় এইভাবে প্রতিবাদ করে, তার শক্তিপ্রকাশ করে। সেই শক্তির কাছে আমরা বড় অসহায়। কলকাতা শহরের মানুষ অধিকাংশই পাকা বাড়ি ও বহুতল বাড়ির বাসিন্দা। তারা এই ঝড়ের রুদ্ররূপ হয়তো ততটা টের পায়নি। কিন্তু আমার মতন শহরের প্রান্তে থাকা মানুষেরা ঝড়ের প্রত্যক্ষ রূপ কিছুটা হলেও দেখতে পেয়েছে। এখানের প্রতি বাড়িতে দু চারটা গাছ আছে। আমাদের বাড়িতে অনেক গাছ- নারকেল, সুপারি, আম, জাম, কাঁঠাল…এই বড় বড় গাছগুলো ঝড়ের তীব্র আক্রমণে নুইয়ে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে। অতবড় নারকেল গাছগুলো যখন নুইয়ে পড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন তারা সব প্রকৃতির কাছে নত হয়ে প্রাণভিক্ষা চাইছে। মুষলধারে বৃষ্টি, বাতাসের প্রচন্ড দাপট ও গর্জন। মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন তীব্র আক্রোশে ফুঁসছে, মানুষের সমস্ত অহংকার, দম্ভ নির্মূল করে দেবে বলে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করছে। যত রাত বেড়েছে, ততই যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে ঝড়। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে যেন পৃথিবীতে যেন প্রলয় লেগেছে। আমার সেই সময়ে আমার কৈশোরে দেখা ঝড়ের কথা খুব মনে পড়ছিল।
তবে একালের ঝড় বা সুপার সাইক্লোনের সঙ্গে সেকালের ঝড়ের একটা তফাৎ আছে। “আমফান” হোক বা “ফণী” হোক, তার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে রেডিও, টিভি, খবরের কাগজে দেখেছি শিহরণ জাগানো সাবধানবানী, “ সুপার সাইক্লোন আসছে, সুপার সাইক্লোন আসছে… ২০০ কিমি বেগে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে।” মানুষজন একে করোনার তান্ডবে আতঙ্কিত, এমনিতেই সব কিছু বন্ধ। তার মধ্যেও এযুগের প্রশাসন রাজসূয় যজ্ঞের মত আয়োজন করছে এই দুর্যোগ মোকাবিলার। সাগর, নদীর পাড়ের লোকেরা আশ্রয় নিয়েছে পাকা স্কুলবাড়ি বা আশ্রয় সেন্টারে। খাওয়াদাওয়া, ওষুধপত্রের ঢালাও ব্যবস্থা। মুহূর্তে মুহূর্তে আবহাওয়া দপ্তর থেকে ঘোষণা, সরকারি সাবধানবাণী। উপকূলবর্তী এলাকায় টহলরত উপকূল- রক্ষীবাহিনী। এসব দেখেশুনে মনে পড়ে গেল আমার অল্পবয়সে আমাদের বরিশাল-খুলনা জেলায় কী ভয়াবহ ঝড় হয়েছিল! আমি নিজের চোখে সেই ভয়াল দৃশ্য দেখেছি। সে বছর আমাদের দেশে সুপারির আকাল, নারকেলের আকাল, আম, জাম বলতে জৈষ্ঠ্য মাসে কোনো ফল লোকে খেতে পায়নি। আজ থেকে প্রায় ষাট বছরের বেশি আগের ঘটনা। তবে লোকজন খুব বেশি মারা যায়নি। কোনো কোনো এলাকায় গরু বাছুর মারা গিয়েছিল। আমার ইস্কুলের একটি মেয়ে ঘর চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। আজকের মত কোনো আগাম সাবধানবানী, কোনো সরকারি বা অন্যান্য সাহায্যের হাতও পায়নি। সেই বিধ্বস্ত মানুষগুলো নিজেরাই ফের উঠে দাঁড়িয়েছিল নিজেদের কৃচ্ছসাধনে আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। বলা হয় বরিশাল- খুলনার, বিশেষত বরিশালের মানুষ লড়াকু; তাই প্রকৃতির নানা ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল এই দুর্গম বদ্বীপ অঞ্চলে।
ছবি:মৌসুমী