ভ্রমণ আজটেকদের দেশে(২)-মলয় সরকার-শরৎ ২০২১

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ – ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)

আগের পর্ব–> পর্ব-১

bhroomonaztektitle

১৮/২

আজ বেশ ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি মারলাম। তিনতলার উপর থেকে দিনের প্রথম নরম সূর্যের আলোয়  দেখলাম, শহর  জাগছে। তখনও তার রাতের খোঁয়ারি কাটেনি। চারপাশের সুউচ্চ ক্যাথেড্রাল, প্যালেস এবং প্রাসাদোপম অট্টালিকা থাকায় নীচে রোদ আসতে দেরি আছে। কচি শিশু রোদের বাচ্চা তখন দুষ্টু ছেলের মতো উঁকি দিচ্ছে প্রাসাদের কাঁধের পাশ দিয়ে আর চুরি করে নীচের দিকে ঢোকার রাস্তা খুঁজছে। তাই ক্যাথেড্রালের মাথায়, সামনে থাকা প্রাসাদের স্পর্ধিত চূড়ায়, নতুন বিবাহিতা মেয়েদের মাথায় রক্তাভ সিঁদুরের মতো লাল লজ্জা-মাখা মিষ্টি আলোর আলপনা। আর নীচে আবছায়া আলোতে শুরু হয়েছে সকালের জীবনযাত্রা। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, কিছু কিছু হকার বেরিয়েছে, সাফাইওয়ালারা রাস্তা পরিষ্কার করছে—ঠিক যেন আমাদের দেশের ছবি অন্য একটা দেশের পটভূমিকায়।

নীচের প্লাজাটা এবার ভালো করে, গোটাটা দিনের আলোয় দেখার সুযোগ হল। চারধারে অট্টালিকা-ঘেরা একটা চৌকো পার্কের মতো বাঁধানো জায়গা, যার চারদিকে বেশ অনেক বসার লোহার চেয়ার বা বেঞ্চ আছে। সেখানে অনেক বয়স্করা বা সাধারণ মানুষ এক কাপ কফি নিয়ে এসে সময় কাটাতে পারে। আসলে এটার নাম প্লাজা ডি আরমাস। এর ঠিক মাঝে আছে একটি উঁচু বেদির উপর রট আয়রনের ব্যান্ড-স্ট্যান্ড। এটি ১৯১০ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষে ফ্রান্স থেকে কেনা হয়েছিল। তার চারদিকের মধ্যে একদিকে আমাদের হোটেল, উলটোদিকে গভর্নর প্যালেস, একপাশে ক্যাথেড্রাল। এই জায়গাটাকে বলে হিস্টোরিক সেন্টার। জায়গাটাকে প্লাজা মেয়রও বলে। এটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি। সন্ধ্যাবেলা চতুর্দিকে আলোয় সাজানো জায়গাটা বেশ উপভোগ্য। এই ব্যান্ড-স্ট্যান্ডে প্রতি মঙ্গল, বৃহস্পতি ও রবিবার সন্ধ্যায় মিউজিক ব্যান্ড এসে গানবাজনা করে লোকের উপভোগের জন্য। বেশ সুদৃশ্য নানা কারুকাজ করা স্ট্যান্ডটি অবশ্যই চোখ টানে।

তৈরি হয়ে বের হলাম সকালে। উদ্দেশ্য, একদিনে যতটা দেখা যায় দেখে নিতে হবে। এখানে একটা সুবিধা, দর্শনীয় বলে যা যা আছে তা এত বড়ো শহরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। তাহলে খুবই অসুবিধা হত। সবটাই কাছাকাছি এবং পায়ে হেঁটেই দেখা যায়। আমরা যেভাবে প্ল্যান করে এসেছি, সেইভাবেই গুরুত্ব বুঝে দেখা শুরু করলাম।

প্রথমেই গেলাম ক্যাথেড্রাল দেখতে। যথেষ্ট বড়ো উঁচু এবং নিওগথিক ও স্প্যানিশ স্থাপত্যে গড়া এই ক্যাথেড্রাল।

bhromonaztecderdeshe

প্রাথমিকভাবেই একটা সম্ভ্রম আদায় করার পক্ষে যথেষ্ট। এটির সামনে দু-পাশে দুটি উঁচু চূড়ার মাঝখানে একটি অনেক নীচে ধনুকের মতো আর্চ আছে। ১৫৪১ সালে এটি প্রথম ছোটো আকারে তৈরি হয়। এরপর এটি বার বার অনেক ধাক্কা সহ্য করেছে। ক্রমাগত বিভিন্ন সময়ে বার বার ভূমিকম্প, আগুন লাগা ইত্যাদির ফলে অনেকবার এটির সংস্কার হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনও এটি নষ্ট হওয়ার ভয় যায়নি। চার্চের একটি চূড়া একটু হেলে আছে। এটি শেষ ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করেছে ২০০৩ সালে। তবে এর মূল কাজ সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এটির কারুকার্যের ভিতর রুপো, শ্বেতপাথর ও অন্যান্য বিদেশি রঙিন কাচ ব্যবহার করা হয়েছে। ভিতরের দৃশ্য সত্যি অসাধারণ। এর ভিতরে যে অর্গানটি আছে সেটি মেক্সিকোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো অর্গান।

আরেকটি আশ্চর্য ঘটনা বলি। এখানে একটি কিশোরী মেয়ের দেহ মমি করা আছে একটি কাচের বাক্সে দেখলাম। সাদা সুন্দর লেসের কাজ করা জামা পরে একটি মেয়ে শুয়ে আছে। চামড়ায় কোঁচ পড়েছে, কিন্তু বাকি সব অবিকৃত। আমার কিন্তু দেখে বোধ হল, এটি সত্যি সত্যি মমি নয়। হয়তো মমির রেপ্লিকা বা নকল।

bhromonaztecderdeshe02

কেউ আমাকে অবিশ্বাসী ভাববেন না। কারণ, একটি সত্যি কিশোরী কন্যার দেহ অত ছোটো হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। এটা একটি মোটামুটি বড়ো পুতুলের সাইজের। তা ছাড়া, আজ প্রায় ৩০০ বছর যদি ওই অবস্থায় থাকে, তার তো মাংস-চামড়া সব শুকিয়ে কুঁচকে হাড়ের সঙ্গে লেগে যাবার কথা বা মমি হলেও শুকিয়ে যাওয়ার কথা। এর কিন্তু গাল-মুখ বেশ ফোলা ফোলা। কী জানি, দেবতাদের কীর্তি ঠিক বুঝি না হয়তো। তবে এরকম মমি আমি অন্যান্য বেশ কয়েকটি চার্চে দেখেছি এখানে। কিন্তু গল্পটি চালু আছে এই চার্চের জন্যই। হয়তো এখানেই আসলটি আছে, অন্যত্র সব নকল, তাও হতে পারে।

গল্পটি হল এইরকম—১৭০০ সালের কাছাকাছি কোনও সময়ে একটি বছর পনেরোর কিশোরী মেয়ে ক্যাথোলিক খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়ে সেই ধর্মাচরণ করতে শুরু করে। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে তার নিজের পিতা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার নাম দেওয়া হয় সান্টা ইনোসেন্সিয়া। তার দেহটিকে এখানে মমি করে রাখা হয়েছে। কথিত আছে, প্রতি তিনশো বছর অন্তর সে নাকি চোখ খুলবে। জানি না ২০০০ সালে সে চোখ খুলেছিল কি না। এরকম একটি গল্প আমাদের দেশে গোয়ার একটি চার্চ, বম জেসাস-এও ছড়ানো আছে। ওখানে এক যাজক, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের দেহ রাখা আছে এবং একইভাবে ভবিষ্যতে বেঁচে ওঠার গল্প আছে। এখানে আরও অনেকের দেহও মমি করা আছে। তার মধ্যে সাম্প্রতিক কালে ১৯৯৩ সালে গুয়াদালাহারা এয়ারপোর্টে খুন হওয়া ফাদার Juan Jesús Posadas Ocampo-ও আছেন।

যাক, এই ক্যাথিড্রাল ছিল আমাদের অন্যতম আকর্ষণ। এই ক্যাথিড্রালের সামনে একটি সুন্দর উঁচু বেদির উপর ফুলের মধ্যে ফোয়ারা। একটি ফোয়ারা নয়, একগুচ্ছ সুন্দর ফোয়ারা বিভিন্নভাবে জল ছুড়ে এক আশ্চর্য সৌন্দর্য তৈরি করেছে। চারপাশে অনেক বসার চেয়ার এখানেও আছে। ক্যাথেড্রালের দরজায় দেখি ভিখারি বসে আছে। আমাদের দেশের কালীঘাটের বা তারকেশ্বরের মতো ভিখারির সারি না হলেও পুরোপুরি ভিখারি-শূন্য যে এই জায়গাটা নয়, তা দেখলাম। এখানে অনেকেই গান গেয়ে বা বাজনা বাজিয়ে ভিক্ষা করছে। সামনেই রাস্তার উপর দেখি সুদৃশ্য সাজানো ঘোড়ার গাড়িগুলো পর্যটক আরোহীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ছোটো, আমাদের দেশের মতো গাড়িও আছে, আবার কলকাতার পুরানো দিনের ঘোড়ায় টানা ট্রামের মতো অনেক যাত্রী বসার গাড়িও আছে। এখানে গিজগিজে ভিড়ও নেই, আবার একেবারে ফাঁকা তাও নয়। বেশ কিছু পর্যটক, কিছু ভিখারি আর স্থানীয় মানুষ যাতায়াত করছে। পুরো চত্বরটাই পাথরে বাঁধানো। ফলে ধুলোও নেই, অবাঞ্ছিত ঘাসও নেই।

এর পাশেই হল রোটান্ডা। এটি বেশ উঁচু ঘেরা একটি সাজানো স্থাপত্য যেখানে একটি বড়ো গোলমতো বিশাল এক পাথরের রিং বিশাল বিশাল সতেরোটি থামের উপর রাখা আছে। নীচেটি ছোটো পার্কের মতো সবুজ ঘাসের লনে মোড়া। এর চারদিকে আছে অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত চব্বিশ জন মানুষের প্রমাণ সাইজ মূর্তি।

এর সামনেই দেখি রাস্তার মাঝে সারি দিয়ে ডিভাইডারের মতো ছোটো ছোটো ফোয়ারা। ফোয়ারা দিয়ে রাস্তার ডিভাইডার করার আইডিয়াটা বেশ নতুন লাগল। মজাও লাগল ব্যাপারটায়।

এখান থেকে গেলাম প্যালেস অফ দ্য গভর্নর। এটা একেবারে আমাদের হোটেলের ঠিক উলটোদিকে, প্লাজাটাকে যদি মাঝে রাখা হয়। এখানে এসে ভাবছি, এটা নিশ্চয়ই আমাদের কলকাতার গভর্নর প্যালেসের মতো, আমাদের মতো বাইরের লোকেদের নিশ্চয়ই ঢুকতে দেয় না। সরকারি অফিস নিশ্চয়ই। তাই বাইরে থেকেই এর কারুকার্য দেখছি। বেশ ‘রয়াল রয়াল’ ভাব, অনেকটা আমাদের রাইটার্সের মতো। ও মা! গেটের দুজন উর্দি পরা গার্ড আমাদের একেবারে সাদর আমন্ত্রণ জানাল, ভেতরে আসুন, দেখুন আমাদের সম্পদ। আমরা তো হঠাৎ এই ব্যবহারে আশ্চর্য, অথচ খুশি হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এখানে অনেক আশা নিয়ে ঢুকলাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটু আশাভঙ্গই হল। অনেক কিছু দেখার নেই। কিছু, এখানকার ইলেকশন বা রাজনৈতিক ঘটনার ছোটো মিউজিয়াম। তবে এখানের সবচেয়ে বড়ো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা, তা হল, এই বাড়িতেই ছিল দেশের সবচেয়ে বড়ো এবং বিখ্যাত স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা মিগুয়েল হিডালগোর আবাস, যখন তিনি ১৮১০ সালে দাসত্বের বিরুদ্ধে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই হিসাবে এটি দর্শনীয় ও স্মরণীয় তো বটেই। এ ছাড়া যেটি দেখার মতো, তা হল সিঁড়ি দিয়ে  দোতলায় ওঠার মুখে দেওয়াল জুড়ে রয়েছে নেতা হিডালগো এবং তাঁর স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশাল ম্যুরাল।

bhromonaztecderdeshe03

এটির নাম ‘Lucha Social’ যার অর্থ Social Fight। এখানে হিডালগো মশাল হাতে স্বাধীনতার পথ দেখাচ্ছেন। এটিতে রঙের যে ঔজ্বল্য আছে তা নেই। তবে আঁকার মধ্যে একটা দৃঢ়তা আছে। বেশ সুন্দর। ১৯৩৭ সালে ছবিটি এঁকেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী Jose Clemente Orozco। এঁর শিল্পকর্ম বহু জায়াগায় দর্শনীয় হিসাবে ঠাঁই পেয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে এখানকার মানুষের উপর কীরকম বিদেশিদের দ্বারা অত্যাচার করা হয়েছে। আমার বার বার নিজের দেশের পরাধীনতার ছবি মনে পড়ে যাচ্ছিল। এটি দোতলা থেকে নামার মুখে বা একতলা থেকে ওঠার মুখে সিঁড়ির দেওয়ালে আঁকা। এটি সত্যই দর্শনীয়। মাঝে একটি চৌকো উঠোনকে ঘিরে চারধারে ঘর, এই হিসাবেই দোতলা তৈরি হয়েছে। আমি পরে অনেক বাড়িতেই দেখেছি এই ঢং। আমাদের সেকালের কলকাতার বড়ো বাড়িগুলোর মতো আর কি। চারধারের উপরের বারান্দা থেকেই নীচের উঠোন দেখা যায়। ঘরগুলোও বেশ বড়ো বড়ো। দোতলাতেও হিডালগোর একটি ছবি আছে, তিনি মুক্তির চুক্তিপত্রে সই করছেন। আর যে বিশেষ কিছু দেখার আছে এমন নয়। ভিতরের স্থাপত্যও কিছু আহামরি নয়। সেই হিসাবে একটু হতাশই হতে হল বলা যায়।

এখান থেকে একটু পিছনে গেলেই, গিয়ে পড়লাম টিয়েট্রো ডেগলাডো এবং প্লাজা ডি লা লিবেরাসন-এ। প্লাজা ডি লা লিবেরাসন একটু বড়ো চত্বর। এরকম প্লাজা এখানকার একটা বড়ো ঢং, এখানকার যে-কোনো শহরের। এখানে মানুষ বসে, গল্প করে, মজা করে—জাদুওলা, গাইয়ে, ভিখারি, খাবারওয়ালা সব থাকে। একেবারে সাড়ে বত্রিশ ভাজা। সময় কাটানোর ভালো জায়গা।

bhromonaztecderdeshe04libertadmarket

পাশের দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে বসলেই হল। এখানেও মাঝে দেখলাম একটা নয়, দুটি বড়ো ফোয়ারা। তার মানে প্লাজা মানেই সেখানে এই ফোয়ারাও থাকবে। একধারে বেশ বড়ো করে ইংরাজিতে গোলাপির উপর সাদা দিয়ে গুয়াদালাহারা লেখা আছে ঠিক আমস্টারডামের মতো এখানকার সিম্বল বা আইকন হিসাবে তার সামনে সবাই ছবি তোলে। আমরাও তুললাম। এখানে মাঝে একটা অস্থায়ী মঞ্চ হয়েছে। তাতে অনেক লাইট বাঁধা। হয়তো কোনও গানবাজনা বা বক্তৃতা হয়েছে বা হবে। এই হিসাবেও এই প্লাজাগুলো ব্যবহার হয়। এই প্লাজার একদিকে টিয়েট্রো ডেগোলাডো। এটি ক্যাথিড্রালের পিছন দিক বা বলা যায় ক্যাথিড্রালের পূর্বদিকে আর একদিকে গভর্নর প্যালেসের পিছন দিক। এই প্লাজাটি তৈরি হয়েছিল ১৯৫২-তে। মিগুয়েল হিডালগো মেক্সিকোর দাসত্ব দূরীকরণের জন্য যে লড়াই করেছিলেন, সেটি স্মরণ করে। তাই এর এক ধারে হিডালগো শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলছেন এমনি একটা বড়ো বেশ বীরত্ব ব্যঞ্জনাময় মূর্তি আছে। সামনেই রয়েছে এই টিয়েট্রো ডেগোলাডো। এটি হল একটি থিয়েটার। এর তৈরির স্থাপত্য বেশ সুন্দর। সামনে আটটি থাম এবং তার উপর চালটি ত্রিভুজাকার। পাথরের তৈরি এই থিয়েটারটি তৈরি ১৮৬৬ সালে। এখানে নাচ-গান হয়। আমাদের নন্দন বা রবীন্দ্রসদনের মতো আর কি। যাই হোক, বাইরে থেকেই দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হল। রাস্তাঘাট এত পরিচ্ছন্ন যে বলা যায় না। সব জায়গাতেই  গিয়ে কলকাতার সঙ্গে তুলনা করি, মনে মনে। এরা পারে, চিন পারে, আর আমরা কি কিছুই পারি না! এরা যে খুব বড়োলোক তাও তো নয়, তবে?

আমার মনে হয় মাঝে মাঝে, আমাদের দেশে কত বেকার ছেলে আছে। এদের মধ্যে থেকে যদি বেশ কিছু ছেলে মেয়েকে অন্তত পরিচ্ছন্নতার কাজে লাগানো যেত, বোধ হয় অনেক সমস্যার সমাধান হত।

এখানে পাশেই রয়েছে মারিয়াচি স্কোয়ার। মারিয়াচি গানের জন্য এই জায়গা বিখ্যাত। এখানেই এর জন্ম। এই ছোটো স্কোয়ারে সবসময়েই প্রায় কিছু ছেলে গান করে। লোকে এখানে কিছু সময় কাটায়, বসে কিছুক্ষণ, পয়সা দিয়ে কিছু গান শোনে। তবে বিকাল বা সন্ধ্যার দিকেই এখানে মানুষ বেশি উপভোগ করে। মনে হল, এতদিনের এত অত্যাচার, এত দারিদ্র, অশিক্ষাও আছে অনেক, তার মধ্যেও কিন্তু মানুষ তার ভিতরের মানুষটাকে মরতে দেয়নি, বাঁচিয়ে রেখেছে তার প্রাণের আনন্দ দিয়ে, সংগীতের ধারার মধ্যে দিয়ে, শিল্পসাধনার মধ্যে দিয়ে, এটাও বড়ো কম কথা নয়। এখানেই বোধ হয় ওদের সঙ্গে আমাদের মিল। আমরাও যেমন এত বছরের পরাধীনতার মধ্যেও হারিয়ে ফেলিনি আমাদের প্রাণের সম্পদ বাউল গান, সারি গান, গ্রামের লোকসংস্কৃতি এই সব। বেঁচে আছে আমাদের প্রাণের ধারা। আমাদের বাউল, নতুন রেল লাইন পাতার গানও যেমন লেখে, মহামারীতে ভয়ের মধ্যেও বা সাহেবের অত্যাচারের মধ্যেও গানের সুর খুঁজে পায়। বেঁচে আছে বিভিন্ন লোকনৃত্য, সাধারণ মানুষের ব্রত আচার উপচার শিল্পসংস্কৃতি।

এর সামনেই আছে কোর্ট বা প্যালাসিয়া ডি জাস্টিসিয়া। সেটিও বেশ বড়ো বড়ো জানালা সমেত কারুকার্য করা বেশ ঐতিহাসিক, পাথরের তৈরি বাড়ি। সব বাড়িই কেমন বড়ো বড়ো পাথরের তৈরি। কী করে কোথা থেকে এত পাথর এনে বাড়িগুলো বানিয়েছে ভাবলেই আশ্চর্য লাগে।

এখানে একটি জিনিস দেখে বেশ আশ্চর্য লাগছিল। সেটি হল এখানকার জুতো পালিশের দোকানগুলি। প্লাজাতে বা কোনও অফিসের সামনে কি জনসমাগমের রাস্তায় এদের দেখা পেলাম। এগুলি একটি ছোটো পান দোকানের বা স্টলের মতো। সিঁড়ি দেওয়া উঁচু চেয়ারে উঠে বসার একটি জায়গা রয়েছে। তার মাথায় ছাতা আছে। যাঁর জুতা পালিশের প্রয়োজন হবে তিনি ওই কাঠের সিঁড়ি দেওয়া চেয়ারে উঠে বসবেন বাবুর মতো। উঠেই জুতোসুদ্ধ পা তুলে দেবেন পালিশওয়ালার সুবিধামতো একটা পা রাখার জায়গায়। সে নীচে দাঁড়িয়ে পালিশ করবে। পরপর এরকম স্টল রয়েছে দেখলাম রাস্তার ধারে। কত মানুষ এখানে জুতো পালিশ করে কে জানে।

এবার হাঁটতে শুরু করলাম প্লাজার সামনে রাস্তা দিয়ে। রাস্তা তো নয়, একেবারে সাজানো পার্ক। কমিউনিটি অ্যাপার্টমেন্টের মতো পর পর দোকান বা বাড়ি আর তার মাঝের রাস্তা টানা একেবারে ফোয়ারা, গাছ দিয়ে সাজানো। পথচারীর জন্য মাঝে মাঝে বসার চেয়ার আছে। সাজানো ঘাসের লন, জলের পুল, ফোয়ারা, বেদি, সাজানো গাছের সারি, মাঝে মাঝে কোনও সুন্দর মূর্তি,  ময়লা ফেলার জায়গা। আর তার মাঝে মাঝে মিষ্টি মিষ্টি হকার। হকাররা সবাই সুন্দর সাজিয়ে ছাতা খুলে বসেছে। সন্ধ্যায় তুলে নিয়ে চলে যায়। সারাদিন যত কেনাকাটা, রাত্রে সব ফাঁকা। মিষ্টি মিষ্টি হকার বললাম কেন? এরকম একটা ঝকঝকে পরিষ্কার সুন্দর জায়গায়, সুন্দর ছাতা আর জিনিসপত্র নিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে গোছানো বেশ নয়ন মনোহর। এখান দিয়ে হাঁটাও মজাদার। পসারিদের ব্যবহারটাও চমৎকার। কাজেই মিষ্টি ছাড়া আর কোনও বিশেষণ মনে এল না। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম প্লাজা তাপাতিয়াতে।

অনেক হকার এখানে সুন্দর সুন্দর হার, মালা, দুল ইত্যাদি বিক্রি করছে। সত্যি, হকাররা যে বসেছে দেখার মতো দৃশ্য। আমাদের দেশের হাতিবাগান বা গড়িয়াহাটের মতো একেবারে স্থায়ী, প্লাস্টিক টাঙিয়ে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসা নয়। রোজ আসে, রোজ বসে। ফলে রাস্তাঘাট দখল করে ক্রমশ ফুটপাথ পুরোপুরি দখল করার কোনও ব্যাপার নেই। সেখানেও অসৌন্দর্য নেই। ছাউনি যা আছে রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচার, তাও রোজ খোলা রোজ পাতার। এরকম ব্যবস্থা আমি আমেরিকাতে ফার্মারস মার্কেটেও দেখেছি। সেখানে খাবার দোকানের পাশে বা বাজারের কোনও এক জায়গায় নোংরা ফেলার ড্রামও থাকে। বাজার শেষ হলে সেটিও তুলে নিয়ে চলে গেল। ব্যস, সব পরিষ্কার। পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও তাদের। আমাদের দেশের মতো এ-ওর ঘাড়ে দায়িত্ব দিচ্ছে, আর ও-তার ঘাড়ে, এই ব্যাপারটা বোধ হয় খুব কম দেশেই আছে। ফলে, আমাদের দেশের মতো অপরিষ্কার দেশও কম আছে।

এই প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে এল। সম্ভবত বিখ্যাত নট ও নাট্যকার শম্ভু মিত্রের অভিজ্ঞতা ও লেখা। উনি এক বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছেন। হঠাৎ ট্রেন দিল্লি ঢোকার আগে ভোরবেলা ট্রেনের বাইরে রেল রাস্তার ধারে চোখ পড়তেই দেখেন সারি সারি মানুষ, মেয়ে পুরুষ সবাই প্রকাশ্য দিবালোকে উন্মুক্তভাবে প্রাতঃকৃত্য সারছে। বিদেশি বন্ধুর যাতে চোখে না পড়ে আমাদের দেশের এইসব ছবি, তিনি তার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। লজ্জার একশেষ।

মজা করে চালু একটা কথা তো আমাদের মধ্যে বলাই হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো শৌচালয় কোথায়? ভারতবর্ষের ইন্ডিয়ান রেলওয়ের লাইনের ধার।

এখান থেকে পৌঁছলাম মিউজিও কাবানাস-তে। এখনে আজ ঢুকতে কোনও পয়সা লাগবে না, ফ্রি। ঢোকার মুখে ভদ্রলোকের আমাদের দেখে কী মনে হল কে জানে, জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কোথা থেকে আসছি। বললাম, ইন্ডিয়া থেকে। শুনে একগাল হেসে, হাতজোড় করে বলেন, নমস্তে। আশ্চর্য হয়ে গেলাম শুনে। ভেবেছিলাম, এখানে আর ক’টা লোক জানে আমাদের ছোট্ট ইন্ডিয়ার কথা! এখানে তো ইন্ডিয়া বলতে সবাই বোঝে এখানকার আদিবাসীদের কথা। ও মা, উনি ঠিক বুঝেছেন। বুঝলাম ওঁর সঙ্গে আমাদের ভারতবর্ষের সংস্কৃতির অল্প হলেও হয়তো যোগাযোগ আছে।

bhromonaztecderdeshe04musiocabanas

এটি ১৮১০ সালে তৈরি হয়েছিল একাধারে গরিব, গৃহহীন মানুষদের জন্য হাসপাতাল, হোম, চ্যাপেল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে। ১৭০ বছর ধরে ছিল এর কার্যকারিতা। বর্তমানে এটি প্রদর্শশালা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে কাজ করছে। এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। বর্তমানে এটি ইউনেস্কো হেরিটেজ স্বীকৃতি লাভ করেছে। এর ভিতরে একটি বিশাল পাথরে বাঁধানো ফাঁকা চত্বর রয়েছে। চারধারে সমান দূরত্বের সমান ধনুকের মতো খিলানের থামের উপর রয়েছে চারদিকের বারান্দা। তার পিছনে অনেক বড়ো বড়ো ঘর। ঘরের মধ্যে অনেকগুলো বন্ধ, আবার অনেক ঘরে দর্শনীয় কিছু আছে। এটি বিশিষ্ট চিত্রকর Jose Clemente Orozco-র অনেক ম্যুরালের সংগ্রহশালা। ঢুকতেই সামনেই ডোমের সিলিংয়ে বিশাল এক পেন্টিং, নাম ‘দ্য ম্যান অফ ফায়ার’। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে এটি আঁকা। মোট সাতান্নটি বিখ্যাত ম্যুরাল দিয়ে এই সাজানো প্রদর্শনী। এখানে পুরানো দিনের মেক্সিকোর জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, তাদের উপর বিদেশি অত্যাচার, মুক্তির লড়াই এসবই মূলত দেখানো হয়েছে। ছবিগুলো দেখে আমি আমাদের গ্রাম্য-জীবনের ছবি মেলাচ্ছিলাম। প্রায় একই রকম। ভাবছিলাম, আমাদের দেশের গ্রামের মানুষ আর ওদের দেশের গ্রামের মানুষ, একই রকমের জীবনযাত্রা, একই রকমের বাসনপত্র, সবই ঘরকন্না একই রকমের, কী করে এটা সম্ভব হল! সারা পৃথিবীতে কি সমস্ত মানুষ একইভাবে সভ্যতার ধাপগুলি অতিক্রম করেছে! তাদের মধ্যে পরিচয় বা সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান না থাকলেও কী করে এটা সম্ভব! এই ভবনটি যদিও একতলা, তবু ছাদের উপর একদিকে প্রাসাদের মতো সুন্দর চূড়া সমেত একটি ঘর আছে দেখবার মতো। এছাড়া

bhromonaztecderdeshe05mural

বেশিরভাগ ঘরেই এখানকার সংস্কৃতি বিষয়ক প্রদর্শনী। দেখলাম একটি ঘরে, যত রকমের ভুট্টা হতে পারে সবকিছু মিলিয়ে তার এক প্রদর্শনী। প্রায় আঠারো রকমের ভুট্টা একটি টেবিলে সাজানো আছে। পরপর ভুট্টা দিয়ে চেন করে অনেক চেনের একটি স্ক্রিনমতো করা আছে। এখানে নাকি আসলে ঊনষাট রকমের ভুট্টা হত। বর্তমানে হয় কি না জানি না। ফলে এদের দেশের সংস্কৃতিতে এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে ভুট্টা বা Corn ওতপ্রোতভাবে ঢুকে গেছে এবং এদের খাবারদাবার বেশিরভাগই বিভিন্নভাবে ভুট্টাজাত। উৎসবগুলোও কিছু কিছু ভুট্টা সংক্রান্ত।

(চলবে)

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s