১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ – ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)
বহুদিন থেকে আমার ইচ্ছা ছিল, যদি মেক্সিকোয় ঘুরে আসতে পারি বেশ হয়। কেন এমন ইচ্ছা ঠিক বলতে পারব না, তবে মনে হয়, এর আগে একবার মেক্সিকো যাবার সব ঠিকঠাক হয়েও যাওয়া হয়নি। সেজন্য সুপ্ত ইচ্ছাটা থেকেই গিয়েছিল। আসলে মেক্সিকো জায়গাটার উপর আকর্ষণ আরো অনেক দিনের পুরোনো। যখন এরিক ফন দানিকেনের, দেবতাদের ধারণা ও উৎপত্তি নিয়ে লেখা বিখ্যাত বইগুলো পড়ি, তখন এই মেক্সিকো সম্বন্ধে নানা কথাও জেনেছিলাম, যে এখানেই এমন সমস্ত প্রাচীন সমস্ত বস্তু আছে যার নির্মাণ ও সভ্যতা সম্বন্ধে আজকের মানুষ সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। সেখানকার আজটেক, ইনকা, মায়া সভ্যতা আজকের মানুষের কাছে এক বিস্ময়ের বস্তু। মেক্সিকোর মতো ঠিক এমনটিই বিখ্যাত পেরুর বিলুপ্ত ইনকা সভ্যতার কেন্দ্রস্থলে মাচুপিচু। এই তিনটি সভ্যতার ব্যাপারেই আমার ভীষণ আকর্ষণ। আসলে ঐতিহাসিক যে-কোনো কিছুর উপরেই আমার ভীষণ একটা আন্তরিক টান অনুভব করি। যার এই টানেই ছুটে গিয়েছি সুদূর রোম থেকে তুরস্ক, কম্বোডিয়া থেকে মেক্সিকো। আমার নিজের দেশ ভারতবর্ষেরও মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা থেকে গুজরাটের মধেরা, আসামের শিবসাগর থেকে মণিপুরের লোকতাক লেক কিছুই বাদ দিইনি। এ ব্যাপারে সবসময়ই যেন একটা বারমুখী টান অনুভব করি। আমার সঙ্গে যেন এ যুগের নয়, নাড়ি বাঁধা আছে সেই অতীতের সঙ্গে। আর তার টানেই ছুটে চলি দেশ থেকে দেশান্তরে। মন কেবলই বলে ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনোখানে…’। একটা বাউল, একটা বেদুইন যাযাবর বোধ হয় লুকিয়ে থাকে আমার মনে পাকাপাকিভাবে। হয়তো অনেকেরই থাকে এমনই।
আমার মনে হয়, মানুষের যে প্রাগৈতিহাসিক প্রবৃত্তি ঘুরে বেড়ানোর, তা বোধ হয় মানুষকে ছেড়ে যায়নি আজও। ভেতরে কোথাও লুকিয়ে থাকে, আর সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। না-হলে কেন মানুষ সুখের নিশ্চিন্ত আবাস ছেড়ে প্রাণ পর্যন্ত তুচ্ছ করে পাড়ি দেয় অজানিত অনিশ্চিত বিপদের মুখেও?
কাজেই সেই সমস্ত আশ্চর্য দেশের আকর্ষণ আমার ভেতরে ভেতরে সুপ্ত হয়েই ছিল বহুদিন ধরে। এবারে সেই সুযোগ এসে গেল যখন, তখন এককথায় লুফে নিলাম।
ছেলের কাছে সানিভেল, ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়েছিলাম ২৩শে জানুয়ারি ২০২০। তার প্রায় একমাস পরে হঠাৎ ছেলে বলল, “সে-বারে তো হল না, চলো মেক্সিকো ঘুরে আসি। যাবে তো এখনই প্ল্যান শুরু করো, এক সপ্তাহের প্ল্যান। আমার একেবারে সময় হবে না কিছু করার।”
ব্যস, খাতাপত্র আর কম্পিউটারের সামনে ঝুঁকে পড়লাম। টিকিট কাটা হল। ১৭ই ফেব্রুয়ারি স্যান হোসে এয়ারপোর্ট থেকে গুয়াদালাহারা। সেখান থেকে মেক্সিকো। সেখান থেকে পুয়েব্লা। পুয়েব্লা থেকে মেক্সিকো এয়ারপোর্ট হয়ে স্যান হোসে ফেরা ২৪শে ফেব্রুয়ারি। বলল, “এইটুকু সময়ই আমার ছুটি আছে, এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ব।”
কাজেই, যা পাওয়া গেল তাই-বা কম কী। যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ওয়াহাকা পর্যন্ত। কিন্তু সময় কম, হবে না।
আমরা সাধারণত কোনো দেশ দেখতে গেলে বা কোনো জায়গাতে বেড়াতে গেলে খুব প্রয়োজন না পড়লে কোনো ভ্রমণসংস্থা, আজকাল যে-সব কোম্পানি হয়েছে, সেগুলোর সাহায্য না নিয়ে নিজেরাই পুরো ঘোরাটার ব্যবস্থা করি। অবশ্য তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে হয়। যথেষ্ট পড়াশোনা, ম্যাপ দেখা, ঘোরার পুরো প্ল্যান, দেশটার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জানা, কারেন্সি, হোটেল, খাবারদাবার, যানবাহনের ব্যবস্থা, দেশের বিশেষ নিয়মকানুন, ভিসা ইত্যাদি সব ভালো করে দেখে লিখে নিতে হয়। কোনো কোনো সময় বেশ অসুবিধেতেও যে পড়তে হয় না তা নয়। সে আমার মতো এইরকম যাঁরা ঘোরা-পাগল পর্যটক আছেন, তাঁদের কমবেশি অভিজ্ঞতা প্রত্যেকেরই আছে। তবু তা আমাদের দমিয়ে বা থামিয়ে রাখতে পারে না।
আমেরিকার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় হওয়ার পর থেকে কিন্তু মেক্সিকো সম্বন্ধে আরো রহস্যময়তার সঙ্গে একটা অন্যরকমের ভীতিও কাজ করেছিল। আসলে, আমেরিকা এসে আরো বেশি করে জেনেছিলাম, ও-দেশের মানুষেরা এখানে ড্রাগের প্রধান রপ্তানিকারক। দরিদ্র মানুষগুলো শুধু খুন-জখম আর ড্রাগের ব্যাবসাতেই লিপ্ত। কানকুন বা ওখানের নানা সমুদ্রতীরগুলো খুন-জখম, চুরি-ছিনতাইয়ের জন্য বিখ্যাত। এইসব নানা নেতিবাচক কথা। সেই দেশগুলোর ভালো দিকটা, ইতিহাসের সমৃদ্ধ দিকটা যত না জেনেছি, লোকমুখে খারাপ দিকটাই বেশি জেনেছি। তখন থেকেই আমার বেশ ভয় ভয় লাগত জায়গাটা সম্বন্ধে। ভাবতাম, যে দেশগুলোর ইতিহাস এত উন্নত, তারা এত খারাপ হয় কী করে। কী জানি, হবে হয়তো।
পরে অবশ্য একবার গিয়েছিলাম মেক্সিকোর ঠিক ধার ঘেঁষে আমেরিকার একেবারে শেষ সীমানায় নিউ মেক্সিকোয়। গিয়ে প্রকৃত মেক্সিকোতে যাবার ইচ্ছাটা আবার যেন নতুন করে জেগে ওঠে। এটা আমি ঠিক বিশ্বাস করতে চাইতাম না যে, যে দেশ এত উন্নত সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতিতে, যেখানকার মানুষ গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, অক্টাভিও পাজ, কার্লোস ফুয়েন্তেস, দিয়েগো রিভিয়েরা, ফ্রিডা কার্লো, অ্যান্থনি কুইন-এর মতো মানুষদের সংস্পর্শে এসেছে, তারা কী করে এত খারাপ হতে পারে? আবার মনে হত, আমাদের দেশও তো রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ কিংবা এত বৈজ্ঞানিক, শিক্ষিত, সাধুসন্তের জন্মদাত্রী, তাও কেন আমাদের দেশ সবকিছুতে এত পিছনে? এটা বোধ হয় সত্যিই সম্ভব।
এই মেক্সিকো নামটার উচ্চারণ নিয়ে একটা ব্যাপার আছে। ইংরাজিতে Mexico-র উচ্চারণ সাধারণভাবে মেক্সিকো। কিন্তু স্পেনে এটাকেই বলে মেহিকো। ওরা এক্সকে হ-এর মতো উচ্চারণ করে। অথচ মেক্সিকোতে যদিও স্প্যানিশ ভাষাই চলে এবং এখানে বহুদিন রাজত্ব করেছে স্প্যানিশরা, এরা নিজেরা মেক্সিকোতে কিন্তু ‘মেক্সিকো’ নামটাতেই বেশি পছন্দ করে। যদিও Oaxaca-কে বলে ওয়াহাকা। আর ইংরাজি ‘J’ অক্ষরটিকে বলে ‘হ’ আর আর ‘অ’-এর মাঝামাঝি একটা উচ্চারণে। যেমন, স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে Mujeres উচ্চারণে কিন্তু মুহারেস আবার San Jose লিখলেও উচ্চারণে স্যান হোসে হবে, কিংবা Guadalajara হবে গুয়াদালাহারা। ঠিক একইভাবে বিখ্যাত গল্প Don Quixote-কে আমরা অনেকেই বলি ‘ডন কুইক্সোট’ কিন্তু যাঁরা সঠিক উচ্চারণ করতে চান, তাঁরা লেখেন, ‘ডন কিহোতে’। আমরা ওখানে যাবার আগেই কয়েকটি কথা চটজলদি জেনে নিয়েছিলাম। যেমন, হ্যাঁ বোঝাতে ‘সি’, না বোঝাতে অনেকটা বাংলার মতো ‘না’; ধন্যবাদ দিতে ‘গ্রেসিয়াস’, সুপ্রভাত- বুয়েনস দিয়াস কিংবা শুভরাত্রি- বুয়েনস নচেস ইত্যাদি। এই বুয়েনস কথাটা থেকেই মাথায় এল এইজন্যই আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ারস অর্থাৎ সুন্দর বাতাস (ওখানেও তো এই স্প্যানিশেরই রমরমা)। এইধরনের কিছু কিছু চটজলদি কাজ চালাবার মতো দু-চারটে কথা শিখে নিয়েছিলাম। এছাড়া তো নিতেই হয়েছিল মোবাইলে ট্রান্সলেশনের অ্যাপ। সেটিই ছিল অগতির গতি। যখন হাত-পা নেড়ে কিংবা ইশারায় কাজ হচ্ছে না তখন এই মোবাইলের অ্যাপ হল অগতির গতি মধুসূদন। চিন ঘোরার সময় এই অ্যাপই আমাদের ভীষণভাবে বাঁচিয়েছিল। সে-কথা পরে জায়গামতো বলব।
প্ল্যান তো হল। এখন প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হলেই হয়। ঠিক হল, ১৭ই ফেব্রুয়ারি প্রথমে যাব গুয়াদালাহারা। সেখানে একদিন থেকে পরদিন মেক্সিকো। মেয়ে আসবে সোজা মেক্সিকো এয়ারপোর্টে। তাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হোটেলে। সেখান থেকে ২৩ তারিখে যাব পুয়েব্লা। সেখানে একরাত থেকে ২৪শে পুয়েব্লা থেকে সোজা মেক্সিকো এয়ারপোর্টে এবং সেখান থেকে ফেরা আমেরিকা। যদিও ব্যাপারটার জন্য হয়তো একটু সময় কম হয়ে যাবে, তবু মোটামুটি একটা দর্শন তো হবে। আমার ঠিক মনে পড়ল বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের ‘ঝাঁকিদর্শন’-এর কথা। বেশি সময় না দিয়ে পুরোহিত বিগ্রহের সামনে একটি পর্দা অল্প সময়ের জন্য খুলেই আবার বন্ধ করে দেন। অধীর আগ্রহে থাকা দর্শকরাও ওইটুকু দর্শন পেয়েই ধন্য হয়। এক্ষেত্রে আমিও তো কখনো ভাবিনি যে মেক্সিকো যেতে পারব, তা সেটা যখন হঠাৎ এভাবে সামনে হাজির হল, তখন হোক গে ঝাঁকিদর্শন, তাই ভালো। আমার মা বলতেন, ‘ভালো জিনিসের অল্পই ভালো।’ আর ঠাকুমা বলতেন, ‘মোটে মা রাঁধে না, তার তপ্ত আর পান্তা।’ কাজেই যা পাওয়া যাচ্ছে তাই ভালো বলে সোনা সোনা মুখ করে ভালো ছেলের মতো খুশিতেই তৈরি হলাম।
যাওয়ার আগে ইতিহাস-ভূগোল যতটা পারলাম জানতে চেষ্টা করলাম। আর নোট করতে চেষ্টা করলাম। আজকাল কম্পিউটার বা গুগল দাদার কল্যাণে তো ‘দুনিয়া মুঠঠি মেঁ’। তবে এত তাড়াতাড়ি কতটা দেখে নিতে পারব সেটাই বড়ো কথা। বেড়াতে যাবার আগে প্রথমত এল বেড়াতে গিয়ে কী কী দরকার লাগবে সেগুলো, তাপমাত্রা কেমন, কী কী জামাকাপড় লাগবে, কত টাকা লাগবে, সমস্ত ওষুধের ব্যবস্থা, রুট প্ল্যান, ম্যাপ, কীসে যাব, যানবাহনের ব্যবস্থা কী আছে শহরে, কী কী দেখব, কতটা সময় পাব ইত্যাদি সমস্তটাই তো দেখে নিতে হবে। তারপর সময় থাকলে ইতিহাস-ভূগোল। কাজেই বেড়ানোর প্ল্যান, ম্যাপ ডাউনলোড করতেই অনেক সময় গেল।
দেখতে দেখতে নির্দিষ্ট দিন তো এসেই গেল। আমরা একটু আগেই পৌঁছলাম এয়ারপোর্টে। স্যান হোসে এয়ারপোর্ট আমাদের বাসস্থান থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের রাস্তা। তবু আমি আবার কোনো কিছু শেষমুহূর্তে করা পছন্দ করি না, বিশেষ করে তা যদি কোনো গাড়ি ধরার ব্যাপার বা পরীক্ষা ইত্যাদি হয়। আমি পছন্দ করি, একটু আগে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় নিশ্চিন্ত মনে পৌঁছে বিশ্রাম নেওয়া অনেক ভালো। আমরা তো অনেক বেলাবেলিই পৌঁছলাম, বেলা ১২টায়। কী জানি, ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে অন্তত ২-৩ ঘণ্টা আগে যেতে বলে। ওমা, ‘আমি যাই বঙ্গে, তো আমার কপাল যায় সঙ্গে’। গিয়ে শুনি ফ্লাইট আড়াই ঘন্টা দেরি। কী আর করা যায়। চেয়ারে বসে কফি ধ্বংস করা ছাড়া বসে বসে কী আর করি। লোকে কত আদরে কুকুরকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে তাই অনিমেষ নেত্রে দেখি। আর কখনো কখনো যদি পাশের কাচের দেওয়াল ভেদ করে দৃষ্টি আরো একটু দূরে চলে যায়, দেখি সারি সারি বিশাল ডাইনোসর যুগের পাখির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক-এক বিচিত্র বিমান আর যার যখন ডাক পড়ছে, পেটে তার রসদ ভরে এক-এক করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ডানা মেলছে। সব চলেছে কোন সুদূরের পানে, কোন অসীম লক্ষ্যে। যেন ঈশ্বরের রাজ্য থেকে আসা স্বর্গীয় দূত আবার ফিরে যাচ্ছে ঈশ্বরের রাজ্যে। কখনো দেখি কোন শ্বেতাঙ্গিনী মায়ের কোন শ্বেতসন্তান কোনো কিছুর বায়না ধরেছে, অথচ মা দেবে না। তাই শিশুটি মাটিতে পড়ে কান্নাকাটি আর গড়াগড়ি। কিন্তু আশ্চর্য, মা তাকে তোলেও না, বকেও না, আবার মাটিতে নোংরা লাগার জন্য ঝেড়েও দেয় না। ভারি আশ্চর্য লাগল দেখে। রবীন্দ্রনাথের শিশুর চোখে দেখা, ছেলেবেলার কথায় ভরা কবিতাটা মনে পড়ে গেল। আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানসিকতায় যেন এটা নিতে পারছিলাম না। এইরকম আরেকটি ঘটনা দেখেছিলাম টিওটিহুয়াকান পিরামিড দেখতে গিয়ে। যথাস্থানে সে-কথা বলব।
সবকিছুরই শেষ আছে। সেরকম আমাদের অপেক্ষারও শেষ হল একসময়। ডাক পড়ল যাত্রীদের। গুটি গুটি গিয়ে ঢুকলাম যন্ত্রপক্ষীর বিশাল উদরের মধ্যে। অল্প সময়ের যাত্রা। তাই এর মধ্যে খাবারদাবার আর বিশেষ কিছু দেয়নি যাত্রাপথে। গুয়াদালাহারা এয়ারপোর্টে নেমে উবেরে সোজা পৌঁছলাম হোটেলে। তখন রাত প্রায় ন’টা। আমাদের হোটেলের নাম হোটেল ওয়ান। এটি একেবারে সেন্ট্রাল গুয়াদালাহারাতে, চার্চের সামনেই। হোটেল থেকে প্রায় পাঁচ পা এগোলেই চার্চ বা গুয়াদালাহারা ক্যাথিড্রাল, যা আমাদের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে একটি। শুনেছি এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো সব এখান থেকে কাছে কাছেই। যে জায়গায় হোটেলটা তার উলটোদিকেই একটা সুন্দর প্লাজা। রাতের আলোতে সুন্দর সেজে রয়েছে ঐতিহাসিক চার্চ। প্লাজা চত্বরটা ঘেরা। সেখানে কোনো যানবাহন চলে না। তবে লোকেরা বসে আছে, গল্প করছে নিশ্চিন্তভাবেই। রাত ন’টাতেও কোনো ভয় নেই। সে-কথা আরো জানা গেল হোটেলের রিসেপশনিস্ট মেয়েটির মুখে। প্লাজাটি ছোটো হলেও সুন্দর সাজানো। বেশ গরম রয়েছে এখানে। এমনিতেই মেক্সিকোতে প্রায় সবসময়েই গরম।
এই গুয়াদালাহারা পশ্চিম মেক্সিকোয় জেলিস্কো রাজ্যের একটি বড়ো শহর। বড়ো যে, সেটি মালুম পেয়েছি এয়ারপোর্ট থেকে আসার সময়ই। এয়ারপোর্ট থেকে বেশ দূরে এবং সুন্দর রাস্তা দিয়ে আসতে হল। তথ্য অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ঘনত্ব ১০৩৬১ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বা তার থেকেও বেশি। সেই হিসাবে এটি মেক্সিকোর দ্বিতীয় ঘনবসতিপূর্ণ শহর বলা যায়। ব্যাবসা, শিল্প সমস্ত কিছুতেই এই শহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য কথা বলার আগে এটা নিশ্চয়ই বলা দরকার যে, এখানে গুয়াদালাহারা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হল ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল; আমেরিকার সর্বাপেক্ষা বড়ো বইমেলা গুয়াদালাহারা ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার এখানেই হয়। ১৯৭০ এবং ১৯৮৬-এর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের খেলা এখানেই হয়। মেক্সিকো এবং ল্যাটিন আমেরিকার যে সবচেয়ে বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ গুয়াদালাহারা এবং ইউনিভার্সিড্যাড অটোনমা দে গুয়াদালাহারাও এখানেই। সেই হিসাবে গুয়াদালাহারাকে গ্লোবাল সিটিও বলাই যায়। লোকে বলে এখানকার মারিয়াচি (Mariachi), টেকুইলা (Tequila) ও বিরিয়া (Birria)-র আস্বাদ যে না নিয়েছে তার এখানে আসাই অসম্পূর্ণ।
মারিয়াচি হল এখানকার বিশেষ ধরনের সঙ্গীত যা একটি ব্যান্ড হিসাবে বাজানো হয়।
টেকুইলা হল এখানকার এক বিশেষ মদ্য বা পানীয় এবং বিরিয়া হল এখানকার বিশেষ ধরনের মাটন বা পাঁঠার ঝোল, যা গরুর বা শুয়োরের মাংস দিয়েও হয়। আমরা মাঝেরটি বাদে আমাদের ওই স্বল্প সময়ে বাকি দুটির স্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম।
আমরা হোটেলে যেতেই সুন্দরী রিসেপশনিস্ট আমাদের জিজ্ঞাসা করল, ইংলিশ না স্প্যানিশ? আসলে এখানে অনেক জায়গাতে দুটোই চলে, আর হোটেলে তো সারা পৃথিবী থেকে লোক আসে, কাজেই ওরা দুটো ভাষাতেই কথা বলে। মেয়েটি অল্পবয়সী আর বেশ সুন্দরী। তার কথা বলার ধরনটি আরো সুন্দর। কেমন যেন কথা বললেই মনে হয় যেন কতদিনের চেনা, পুরোনো অনেক পরিচিত।
এখানে হোটেলের ঘরে মালপত্র রেখেই আমরা আগে গেলাম এখানকার বিখ্যাত হোটেল ‘লা ছাতা’য়। র্যামন ক্যারোনা ক্যালেতে বা রাস্তায়, লা ছাতার মতো খাওয়ার হোটেল তখনো ভিড়ে ভর্তি। ওদিকে রাস্তায় দোকানপাট অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রাডিশনাল ঢঙে হাতে আঁকা টালি দিয়ে সাজানো, উজ্জ্বল হলুদ রঙের হোটেলটির হলুদ বেশবাস পরা সার্ভিং বয়রাও যথেষ্ট তৎপর এবং পরিবেশনে বেশ অভিজ্ঞ। প্রথমে যে টর্টিলা ও সালসা দিয়ে গেল খাবার সার্ভ করার আগেই, তাই এত সুস্বাদু যে আমরা সবাই অনেকখানি করে খেয়ে ফেলেছি। আবার চাইতে আবার দিয়ে গেল। এটা বোধ হয় হিসাবের বাইরে, খাওয়ার স্টার্টার। আমরা জোর করে সেটা খাওয়া থামালাম যে, এরপর আসল মেন কোর্স খাবার এলে আর খেতে পারব না। খাবার এল, মোলে কন পোল্লে (বা পোয়ে) ও আরেকটি খাবার (নাম মনে নেই)। এখানকার নাচোস, ফ্রেস গুয়াকামোলে, পোজোলে খুবই সুন্দর। মোলে কন পোল্লে হল একটা বড়ো মুরগির ঠ্যাং রোস্টমতো এবং তার সঙ্গে চকোলেট রঙের বিনের বিশেষভাবে তৈরি গ্রেভি দিয়ে তৈরি খাবার।
আমরা তো সব খেয়ে ফেললাম হা-ঘরের মতো। প্লেটে যা পরিমাণ ছিল তা যথেষ্ট বেশি। খেয়ে বেশ পেট ভরে গেল। ওরা বলে আর কিছু নেবেন না? অন্তত হরছাতা খেয়ে যান। এখানে যখন এসেই পড়েছেন, এটা না খেলে খুব মিস করবেন। কী আর করি, বললাম, দাও। দিয়ে গেল দই বা ঘোলের মতো দুধের তৈরি। তবে এই দুধ অবশ্যই গরুর বা কোনো প্রাণীজাত নয়। সয়াবিন বা ওই জাতীয় কোনো উদ্ভিজ দুধ সম্ভবত। এখানে গরুর দুধ খাওয়ার বোধ হয় চল কম। এখন হয়তো মেক্সিকোতে বিভিন্ন মল বা দোকানে দুধ পাওয়া যায়, তবে আমার বিশ্বাস এদের কোনো খাবারেই প্রায় দুধের চল নেই। এদের মিষ্টির দোকানেও ঢুঁ মেরেছি। কিন্তু দুধের মিষ্টি পাইনি। তবে যাই হোক, হরছাতা খেয়ে মন ভরে গেল। লোভে পড়ে খেয়ে ফেললাম ফ্ল্যানও। অনেকটা কাস্টার্ডের মতো অল্প মিষ্টি দেওয়া খুব সুন্দর জিনিসটা। আবার কখনো খাওয়ার ইচ্ছা রইল। এত খেয়েও দাম কিন্তু খুব বেশি হয়নি। তুলনামূলকভাবে এখানে বাজারদর আমেরিকার থেকে সস্তা।
পেট ভর্তি করে হোটেলে যখন ফিরলাম রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা। ফাঁকা রাস্তার লালরঙা সিগন্যাল আপন মনেই জ্বলছে, নিভছে। প্লাজায় কয়েকটি কবি জাতীয় মানুষ বা ভবঘুরে বেঞ্চে বসে আছে। নরম অন্ধকারের মোলায়েম চাদর জড়ানো নিস্তব্ধ পরিচ্ছন্ন সন্ধ্যামাখা শহরে যেন প্রথম দর্শনেই প্রেম জন্মে গেল। আর বিপরীতে ক্যাথিড্রাল নানা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে যেন ঈশ্বরকে মর্তে নেমে আসার জন্য আলো দেখাচ্ছে। এইরকম একটা পরিবেশে এখন বেশ চুপ করে পার্কে বসে নিস্তব্ধ রাতের চোঁয়ানো আমেজটা উপভোগ করতে খুব ইচ্ছা করছিল। কিন্তু নানা কারণে তা আর সম্ভব হল না।
অনেক সময়ই মন যা চায়, বাস্তবে কি আর তা পারি বা সম্ভব হয়? কিন্তু মনের তো কোনো বাঁধন নেই, সম্ভব-অসম্ভবের চিন্তাও নেই। তাই যত অসম্ভবের সঙ্গেই তার দোস্তি। কবিগুরুও বলেন, ‘… মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে…’।
(চলবে)