মিশর বলতে একজন বাঙালি ঠিক কী বোঝে বলুন তো? মাধ্যমিকে ভূগোলে নীল নদ নিয়ে একটা ১০ নাম্বারের প্রশ্ন থাকতো মনে পড়ে? ইতিহাস-ভূগোল না-হয় বাদ দিন, ভাবুন টিনটিনের কথা। সেই ফারাও-এর চুরুট। বা ধরুন কাকাবাবুর মিশর রহস্য। গুপ্তধনের সন্ধানে সোজা পিরামিডের পেটের ভিতরে। শেয়াল দেবতা আনুবিসকে মনে আছে? ফেলুদার শেয়াল দেবতা রহস্য? প্রোফেসর শঙ্কুর আতঙ্কের কথা ভোলেননি নিশ্চয়ই? মোদ্দা কথা, এইসব রসদ নিয়ে প্রায় সব বাঙালির মনে মিশর একটা রহস্যপুরী, যার প্রতিটি ইটে ইতিহাস ফিসফিস করে কথা বলে। তবে বাস্তবে যে মিশর এতটা রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা তা মিশর না গেলে বোঝা অসম্ভব। আমার এই লেখাটা কিন্তু কোনোমতেই ভ্রমণকাহিনি নয়, এটি কিছু জার্নাল, যা মিশরে থাকাকালীন লেখা। কিছু এমন ঘটনা যা এই ভেতো বাঙালির মনকে চরম শিহরিত করেছিল।
মমির অভিশাপ (কায়রো জাদুঘর, কায়রো)
কিছুদিন আগে আমার শাশুড়িমাকে এক মারাঠি মহিলা বশীকরণসিদ্ধ কোন বাঙালি বাবার সন্ধান জিজ্ঞেস করাতে বেজায় হাসি পেয়ছিল। তবে বুঝেছিলাম, আজকের দিনে মূল খেলা হল ‘পারসেপশন’ তৈরি করা। ‘বঙ্গালি’ আর কালা জাদু নোশনটা যত্ন-সহকারে জাতীয় মিডিয়া রিয়া চক্রবর্তীর সময় নির্মাণ করে। ঠিক যেমন আশির দশকে হলিউড অত্যন্ত নিপুণভাবে বিভিন্ন হিট ছবির মাধ্যমে ভারতের ‘land of snake charmers & black magic’ মার্কা একটি ইমেজ তৈরি করেছিল। টিনটিন-স্রষ্টা হার্জকে আমাদের সত্যজিৎবাবু একটি চিঠিতে লিখেছেন এই বিষয়ে।
এখন কথা হচ্ছে, মমির অভিশাপ ও তার পারসেপশন নিয়ে। ইন্ডিয়ানা জোন্স থেকে দা মমি রিটার্নস-এর মতো বহু ছবি ও বই এমন পারসেপশন তৈরি করেছে যে মমি বললেই অভিশাপ কথাটা অজান্তেই মাথায় আসে। তাই এই মিশর রহস্য সমাধান করতেই আমাদের কায়রোর গাইড মহসিনকে অভিশাপের ব্যাপারটা বললাম। শুনে মহসিন একগাল হেসে ভাঙা ইংলিশে বলল, এসব ইংরেজদের ফন্দিফিকির। যাতে নতুন কোনও সমাধি আবিষ্কার হলে ভয়ে কোনও মিশরীয় লোক না ঢুকে তাদের ডাকে।
প্রতিবাদ করে বললাম, কিন্তু তুতেনখামেনের সমাধির ব্যাপারটা? থুড়ি, ওরা আবার বলে ‘তুতানখামুন’। ছোটো থেকে পড়া ইতিহাস তো আর মিথ্যে হতে পারে না। মহসিন যা বলল, আমি সেটাই লিখছি।
“মমি তৈরির প্রক্রিয়াতে সাতরকম তেল লাগে। এই অদ্ভুত জৈব রসায়নিক মিশ্রণের জন্যই মৃতদেহটি হাজার হাজার বছর অক্ষত থাকে। ৫০০০ বছর ধরে বন্ধ ঘরে সেই তেলের বাষ্প আর বিভিন্ন খাদ্যের থেকে নির্গত গ্যাস রাসায়ানিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে দুর্গন্ধ যুক্ত বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করবে, এটাই স্বাভাবিক। লোভের বসে যে-লোক কোনও প্রোটোকল না মেনে দু-দিনের মধ্যে তুতেনখামেনের সমাধিতে ঢুকতে যায়, তার মৃত্যুর কারণ অভিশাপ নয়, বিষক্রিয়া ছিল। কিন্তু কায়দা করে রটানো হল অভিশাপ। বুঝতেই পারছ কেন।”
“কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কারণ, একমাত্র এই সামাধিতেই বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তি ছিল। আগের একটিতেও না। তাই রাজার ঘুম ভাঙানোর গল্প সব বাজে কথা।”
“কিন্তু হাওয়ার্ড কার্টার? তিনি তো মারা গেছিলেন লন্ডন ফিরে।”
“তিনি কিন্তু পাক্কা দুই সপ্তাহ বাদে ঢুকেছিলেন। অভিশাপ জানলে নিশ্চিত তিনি না ঢুকেই ফিরে যেতেন। দু-সপ্তাহে সমাধির ভেন্টিলেশন হয়ে যাবে তিনি জানতেন, বিষাক্ত গ্যাস না থাকলে আর কীসের চাপ? এবার কার্টার সাহেবের বিখ্যাত হওয়ার সময়। এত বড়ো আবিষ্কার বলে কথা। তাই আর কি নতুন জামাকাপড় পরে, দাড়ি কামিয়ে চলে গেলেন রাজার ঘুম ভাঙাতে, সঙ্গে ফোটোগ্রাফার। ছবি উঠল। লন্ডনের নামজাদা কাগজে বের হল সেসব ছবি। সবই ঠিক ছিল, গেরো করল দাড়ি কামানোটা। দাড়ি কামানোর ফলে আমাদের মুখের কিছু ক্ষুদ্র ছিদ্র বা micropore অনাবৃত হয়ে যায়। কিছু ব্যাকটেরিয়া সেই সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে। সেদিন কিন্তু উনি ছাড়া আর কেউ দাড়ি কামায়নি, তার প্রমাণ সেই ছবি। আসলে সাহেব হয়তো নিজের ছবি নিয়ে বড়ো বেশি সচেতন ছিলেন। কার্টার অসুস্থ বোধ করেন, কিন্তু ডাক্তার না দেখিয়ে লন্ডন ফেরত যান। ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ার পর্যাপ্ত সময় পাওয়াতে লন্ডন ফিরেই তাঁর মৃত্যু হয়। রটে যায়, অভিশাপ লন্ডন অবধি ধাওয়া করেছে। অবশ্য যদি ব্যাকটেরিয়াগুলোকে অভিশপ্ত বা মমির পোষ্য ধরা হয়, তাহলে অভিশাপই বটে!
“এরপর মিশরীয় প্রত্নতত্ববিদদের প্রোটোকল বানানো হয়, সমাধি আবিষ্কারের দু-মাসের মধ্যে নো এন্ট্রি। আর তিন মাস চুল-দাড়ি কামানো বন্ধ সবার। এবার বোঝা গেল লোকগুলো জাস্ট আত্মভোলা বলে দাড়ি কামায় না, তা নয়। এমনকি ঋতুমতী মহিলাদেরও প্রবেশ নিষেধ। মজার কথা হল, প্রোটোকল ফলো করার পর থেকে কিন্তু মমির অভিশাপে আর কোনও মৃত্যু ঘটেনি।
“আর যদি সত্যি সমাধিতে ঢুকলে অভিশাপ লাগে, সবার আগে আমার (মহসিনের) লাগা উচিত ছিল। আমি মিশরের সমস্ত সমাধিতে ঢুকেছি শুধু নয়, গার্ডের চোখ এড়িয়ে মমির সারকোফেগাসের (কফিন) মধ্যে শুয়ে সেলফি অবধি তুলেছি কলেজে থাকাকালিন।”
এই ভার্সনটা পুরোপুরি মহসিনের। তাই বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
আপনার পারসেপশন আপনার নিজেরই থাক। পারসেপশন তৈরি করা তো আর আমার কাজ নয়!
তবে যাই বলুন না কেন, লুক্সরে ‘valley of kings’ যখন তুতানখামুনের সামাধির ভিতরে ঢুকে ঘুমন্ত রাজার মমিকে চাক্ষুষ করলাম, বুকটা ধুক করে উঠেছিল।
‘Truth is often stranger than fiction.’
Size Does Matter (গিজা)
সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে যে মানুষ নিদারুণ অসভ্য হয়ে যাচ্ছে, তার নিদর্শন আমরা ইতিহাসে বহুবার পেয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা যে এত প্রাচীন তার ধারণা ছিল না। মিশরের ফারাও কিঅপ্স বা যিনি খুফু নামে পরিচিত, নির্মাণ করেন বিশ্বের বৃহত্তম পিরামিড ‘দা গ্রেট পিরামিড অফ গিজা’, তাও আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে! কিন্তু দেখুন খ্যাতির বিড়ম্বনা, কোথায় খুফু ভেবেছিলেন তাঁর সমাধির জন্য ইতিহাস তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে, কিন্তু সে-গুড়ে বালি।
তাঁর পরবর্তী ফারাওরা এতটাই ঈর্ষাকাতর ছিলেন যে তাঁরা তাঁর অস্তিত্বটাই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে তৎপর হয়ে তাঁর সমস্ত মূর্তি ভেঙে দিলেন। তাঁর বৃহৎ পিরামিডের বুক থেকে চোরেরা সাফ করে দিলে সমস্ত ধনসম্পদ, এমনকি তাঁর মমিটিও! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে গেল গিজার প্রকাণ্ড পিরামিড ও তার নিঃশব্দ প্রহরী।
ভাবুন ব্যাপারটা! বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো পিরামিডের নির্মাতার কোনও মূর্তি নেই!
ভাগ্যিস ১৯০৩ সালে Sir William Matthew Flinders Petrie আবিষ্কার করেন খুফুর একমাত্র মূর্তি! যদিও তাঁর হাতের কার্তুস প্রমাণ করে তিনিই খুফু, কিন্তু মূর্তিটির উচ্চতা ৭.৫ সেমি। ভাবুন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ১৩৮ মিটার উচ্চতার পিরামিডের নির্মাতার একমাত্র অস্তিত্বের উচ্চতা কিনা ৭.৫ সেমি! বর্তমানে কায়রো মিউজিয়ামে আছে তাঁর একমাত্র মূর্তি।
ইতি আনুবিস (আল খালিলি বাজার, কায়রো)
কায়রোর আল খালিলি বাজারের এক দোকান থেকে সংগ্রহ করলাম শেয়াল দেবতা আনুবিসের একটি মূর্তি। মনে পড়ে, ফেলুদা কিছুটা বলেছিল তার ব্যাপারে, সেই থেকেই আগ্রহ। তবে আনুবিসের সম্বন্ধে বিশদে জানাল বিক্রেতা গালাল।
মৃত্যুর দেবতা আনুবিস। আমাদের যমরাজের মতো। পিরামিডের ভিতরের চিত্রকলা বলছে, তিনি নিরপেক্ষ ও কড়া স্বভাবের। মৃত্যুর পর ফারাও-এর বিদেহী আত্মাকে নৌকা করে একটি আগুনের সাগর পার হয়ে যেতে হয় তাঁর কাছে। সেখানে এক বৃহৎ সাপ তাঁর দিকে বিষ নিক্ষেপ করে। জীবনে যা পুণ্য করেছেন তাঁর বিনিময়ে ফারাও নিজেকে রক্ষা করেন। সমস্ত ফারাও-এর সামাধিতে তাই একটি নৌকা সবসময় রাখা হত। এরপর তিনি হাজির হন আনুবিসের দরবারে। সেখানে আনুবিস তাঁর থেকে তাঁর হৃৎপিণ্ড চেয়ে নেবেন। মমির মধ্যে এই কারণেই হৃৎপিণ্ড রেখে দেওয়া হত। তারপর একটি দাঁড়িপাল্লাতে একটি পালকের সঙ্গে হৃৎপিণ্ড ওজন করা হবে। যদি পালকের থেকে হৃৎপিণ্ড হালকা হয় তবে স্বর্গের টিকিট পাকা, কিন্তু যদি হৃৎপিণ্ড ভারী হয়, আনুবিস সেই হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ করবেন। অর্থাৎ বাকি অনন্তকাল তাঁকে নরকে থাকতে হবে, পুনর্জন্মের কোনও সু্যোগ থাকবে না।
আনুবিসকে সঙ্গী করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, এই নিয়ম যদি আজকের নেতাদের উপর চালু থাকত, তাহলে নরকে আজ ভারতের দ্বিগুণ জনসংখ্যা হত।
মরীচিকা
ধু-ধু মরুভূমির বুক চিরে ছুটে চলেছে কালো পিচের হাইওয়ে। যেদিকে দু-চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। নেই বসতি, নেই জনজীবন, নেই আড়ম্বর, নেই উদযাপন। কিছু পাথরের টিলা আর বোল্ডার, সূর্যের তেজে উত্তপ্ত দিগন্ত প্রান্তর। আবু সিম্বল থেকে আসওয়ান ফেরার পথটা এরকমই।
হঠাৎই আমাদের তন্দ্রা কাটিয়ে আমাদের গাড়ি থামল। সামান্য টয়লেট যাওয়া। কিন্তু টয়লেট সেরে যেই মুখ তুলে তাকালাম, স্পষ্ট দেখা গেল হাইওয়ের ও-পারে—জল, না প্রায় জলাশয় বলা যায়। টলটলে জল, হালকা দুলছে।
মিশরে আসার পর থেকে আমার ইতিহাস ও ভূগোল ক্লাসের কথা খুব মনে পড়ছে। কিন্তু আজ মনে পড়ল ফিজিক্স ক্লাসের কথা। পূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রতিফলন বা Total Internal Reflection, সৃষ্টি করে Mirage বা মরীচিকা।
কী অদ্ভুত জিনিস এটা, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। সম্পূর্ণ মিথ্যা জেনেও কোনও জিনিসকে বিশ্বাস করার প্রবল ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে মরীচিকা। আগে নাকি প্রচুর বেদুইন মরীচিকার পিছনে ছুটে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু আজ? আমরা urban nomads-রা কি একদম ছুটি না মরীচিকার পিছনে? অফিসের প্রমোশন, আর একটু বড়ো ফ্ল্যাট, আরেকটা গাড়ি, আরও টাকা এরকম কত মরীচিকার পিছনে রোজ অবিরাম ছুটে চলেছি নিজেদেরই খেয়াল থাকে না। কিন্তু ছুটে যেতেই হবে। অনেকের মতে এই প্রসেসটার নামই জীবন।
‘Enjoy the Journey as the destination is a mirage.’ —Steven Furtick
ভাঙা-ভাঙির গল্প (আবু-সিম্বল)
মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা,
মন্দির ভাঙে ধার্মিকেরা,
তারপর দাবি করে তারা ধার্মিক,
আর যারা ভাঙা-ভাঙিতে নেই,
তারা নাস্তিক ও অধার্মিক!
—হুমায়ূন আহমেদ
ইতিহাস সাক্ষী আছে যে সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে কিছু মানুষ গড়ে আর কিছু ক্ষমতা লোভী মূর্খ সেই সৃষ্টিকে ভেঙে নষ্ট করে। মজার কথা হল ভারতে আজকাল পুরাণ, ইতিহাস, মহাকাব্য, রূপকথা, ওয়াটস অ্যাপ চুটকি মিশিয়ে এমন এক ককটেল সার্ভ করা হচ্ছে যে আমাদের নিজেদেরই সব গুলিয়ে যাবার জো। আর সেই ককটেলের নেশাতে আমরা নির্দ্বিধায় ঐতিহাসিক স্থাপত্য গুঁড়িয়ে দিতে রেডি।
কাল আমরা আবু সিম্বল গেছিলাম। ৩৫০০ বছর আগের শিল্পকলা ও নিখুঁত ভাস্কর্য দেখে আমার মতো আর্ট অজ্ঞেরও হাঁ বন্ধ হতে চাইছিল না। ফারাও রামসেস-২ নিজের মন্দিরের পাশেই বানান তাঁর স্ত্রী নেফারতারির মন্দির। সেখানে আবার রাজা ও রানির মূর্তির সাইজ সেম। এটা মিশরের ইতিহাসে বিরল। এটা প্রেম না ফেমিনিজম তা নিয়ে তর্ক তোলা রইল।
কাট টু ১৯৭০।
প্রেসিডেন্ট নাসির মিশরকে বন্যা ও অনাবৃষ্টি থেকে বাঁচাতে নীল নদের উপর বানাবেন হাই-ড্যাম। কিন্তু গেরো করল আবু সিম্বল মন্দির। এমনিতেই জল ঢুকে অনেকদিন ধরে রঙ নষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু বাঁধ হলে তো পুরো জলের তলায়! কী উপায়?
এবার তাহলে ভাঙাই হোক। কিন্তু গড়ার জন্য। অবিশ্বাস্যভাবে তারা পুরো মন্দিরটাকে টুকরো করে কাটল। বলাই বাহুল্য, অতি সাবধানে। টুকরোগুলো ২ টনের অধিক ওজন। একটি কৃত্রিম পাহাড়ের উপর নিখুঁতভাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াল আবু-সিম্বলের বিরল ভাস্কর্য! নীল নদের বাঁধও হল, মন্দির ভেঙেও ভাঙল না। এইরকমই আসওয়ানের ফিলাই মন্দিরও প্রতিস্থাপিত হয়। মিশর একটি মুসলিম রাষ্ট্র, কিন্তু ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বের মিশরীয় ধর্মের সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে তাদের সোনার সভ্যতার ইতিহাসের। যেটা তাদের গর্বের জায়গা। আর সেটা নিয়ে তারা ভয়ানক পসেসিভ।
লাক্সর মন্দিরে আরেকটি অদ্ভুত জিনিস দেখলাম যেটা না বলে পারলাম না। একটি ১১০০ বছর আগের মসজিদ যার দরজা মাটি থেকে প্রায় ১৪ ফুট উপর। খুব আশ্চর্য। খোঁজ নিয়ে যা জানলাম খুব ভালো লাগল।
৬০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্ট ধর্ম মিশরে আসে। তখন মসনদে রোমানরা। ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ লাক্সরে একটি গির্জা নির্মাণ করে খ্রিস্টানরা। ১৫০ বছর পর সেই গির্জা তছনছ করে রোমানরা। তারপর অনেক স্থাপত্যের মতো মরুভূমির বুকে হারিয়ে যায় এই গির্জা।
কাট টু ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ।
৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অমর ইবন অলসের হাত ধরে ইসলাম আসে মিশরে। আগামী ৩৫০ বছর ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয় প্রচুর মানুষ। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ লাক্সরে অনেক মসজিদ স্থাপন করে তারা। দেখুন মজাটা। করবি তো কর, মসজিদ তৈরি হল একটি টিলার উপরে, যার নীচে ঘুমিয়ে ছিল সেই গির্জা। তাহলে কী দাঁড়াল? ফারাওদের মন্দির, গির্জা ও মসজিদ এক চত্বরে। মসজিদের ঠিক তলায় গির্জা!
কাট টু ১৯৮০।
UNESCO স্বীকৃতি পেয়ছে লাক্সর মন্দির। গোটা মন্দির আবিষ্কার হয়েছে মরুভূমির বুকে। মসজিদের দরজা এখন শূন্যে। কারণ তলায় গির্জা। এখন মিশর কিন্তু ইসলামিক স্টেট। পুরো চত্বরটাকে সযত্নে সাজিয়ে তুলে পুরো পৃথিবীর ভ্রমণ-পিপাসুদের আহ্বান করল মিশর। চাইলেই কিন্তু গির্জা গুঁড়িয়ে ঝা-চকচকে বড়ো মসজিদ আসতে পারত, কিন্তু?
আমার চোখে যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে শিল্পকে ধংস করে তারা বর্বর, ইতর। সে তালিবান হোক বা হনুমান। তাদের ধর্মের কলঙ্ক তারা।
সোবেক ও মিশরীয় উপকথা
মিশর বলে কথা। মানব সভ্যতার আঁতুড়ঘর। এখানে কুমিরের ভগবান হয়ে ওঠাও একটা গল্প।
একটু খেয়াল করে দেখবেন সব সভ্যতাই কিন্তু তাদের আরাধ্য দেবতাদের সৃষ্টি করে সেম থামরুলে। প্রাকৃতিক শক্তি যাদের কাছে ক্রমাগত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে-ই পেয়েছে দেবতার স্ট্যাটাস। যদি তাদের তুষ্ট রাখা যায়! প্রাথমিকভাবে সব সভ্যতাতেই বায়ু, জল, সূর্য ইত্যাদির পূজার প্রবণতা দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে মায়ান সভ্যতার সূর্য দেবতা ‘আহকিন’, ইনকাদের ‘ইনতি’, চিনের ডৌমু ও মিশরীয়দের ‘আমুন রা’।
নীল নদের তীরেই কিন্তু প্রধানত কৃষিগত কারণে মিশরের জন্ম। অর্থাৎ ধু-ধু সাহারা মরুভূমির উপর নীল নদই ছিল মিশরীয়দের একমাত্র অবলম্বন। এক্ষেত্রে অফ টপিক একটি ট্রিভিয়া না দিয়ে পারলাম না। সাহারা কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল মরুভূমি, তাই সাহারা মরুভূমি কথাটা মিশরীয়দের কাছে হাস্যকর।
ফেরা যাক মূল গল্পে।
সমস্যা হল এবার নীল নদের পূর্ব অধিবাসীবৃন্দের সঙ্গে, যারা মানুষের অনেক আগে থেকেই এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। নীল নদের কুমির। নীল নদের বিভীষিকা। শুরু হল মানুষ-কুমির সংঘাত। বলা বাহুল্য, সেই সময় জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা মানুষের জন্য অসম্ভব ছিল। তাই দেবতা-অপদেবতার মাঝামাঝি এলেন কুমিরবদন দেবতা সোবেক। আর কী চাই? একদিকে কুমিরের দৌরাত্ম্য বাড়ছে, অন্য দিকে সোবেকের স্ট্যাটাস ও ফলোয়ার!
এছাড়াও আরেকটা কারণ ছিল যে কুমির সাধারণত বন্যা আঁচ করতে পারে। বন্যার পূর্বাভাস অনুযায়ী তারা দিন পনেরো আগেই গভীর জলে চলে যেত। তাদের এই ব্যবহার থেকেই মানুষ বন্যার প্রস্তুতি নিতে পারত। আর কী, যখন ভবিষ্যৎ বলতে পারে, সে নিঃসন্দেহে ভগবান।
মজার বিষয় হল, সোবেক কিন্তু আবার উর্বরতার দেবতাও। মহিলাদের গর্ভবতী হওয়ার জন্য সোবেক পূজার রীতি ছিল। আরেকটি মজার গল্প হল, কিছু উপকথা সোবেক অপদেবতাকে বলছে যৌন হেনস্থাকারী। যে নগ্ন মহিলাদের চুরি করে নরকের গুপ্ত কুঠিতে যৌনদাসী বানিয়ে রেখে দেয়। মজার কথা দেখুন, নিশ্চয় নীল নদে স্নান করতে গিয়ে বেশ কিছু মহিলা শিকার হন কুমিরের। স্বাভাবিক কারণেই তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাই গুজব আস্তে আস্তে উপকথা হয় গেল।
ইতিহাস সাক্ষী আছে, যে যুগে যুগে রাজনৈতিক নেতারা ধর্ম-ভীতিকে পারফেক্টলি এক্সপ্লোয়েট করেছে। বর্তমান সময়ও এর ব্যতিক্রম নয়। ‘মন্দির ওহি বনেগা’ লজিকে গজিয়ে উঠল। সোবেকের একাধিক মন্দির মূলত সেইসব অঞ্চলে যেখানে কুমিরের উপদ্রব বেশি। এগুলো আবার উৎকৃষ্ট শিল্পকলার নিদর্শনও বটে। যেমন, কোমোম্বোর সোবেক মন্দির। বেশ কিছু ফারাওরা নিজেদেরকে সোবেকের আশীর্বাদপ্রাপ্ত প্রমাণ করার জন্য নিজেদের নাম পরিবর্তন করতে শুরু করেন। যেমন ফারাও সোবেকনেফরু বা সোবেকের সেবক।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে সম্রাট আলেকজান্ডারের হাত ধরে এবার মিশর দখল করল গ্রিকরা। তারা কিন্তু বেশ মানিয়ে গুছিয়ে নিল নিজেদের মিশরীয়দের সঙ্গে। জন্ম হল মিশ্র এক উৎকৃষ্ট সংস্কৃতির। টলেমি রাজবংশের জন্ম যাদের শেষ রানি ক্লিওপেট্রা। অনেকেই যদিও তাঁকে মিশরীয় ভাবে, কিন্তু এটি ভুল ধারণা। এই টলেমি বংশের এক ফারাও-এর ছেলে নদীর তীরে খেলতে গিয়ে কুমির বাবাজির লাঞ্চ হয় যান। বাবা বলে কথা। ক্রুদ্ধ বাবা সব ভুলে আদেশ দিয়ে দিলেন, সব কুমির মারো। হত্যা করা হয় ৩৫০টা মতো কুমির। কিন্তু সোবেকের অভিশাপের ভয় তো আছে! ঘটা করে মমি বানিয়ে কবর দিলেন কুমিরদের ফারাও, কোমোম্বো মন্দিরের ঠিক পাশেই। আজ সেই জায়গায় সোবেক সিমেট্রিতে কুমিরের থুরি ‘সোবেক রা’-এর মমি সংরক্ষিত আছে। মিশর বলে কথা, অদ্ভুত ঘটনা এখানে স্বাভাবিক।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস দেখুন। একদা বিভীষিকা, ভগবান, অপদেবতা ‘দা গ্রেট নাইল অ্যালিগেটর’ এখন একটি ‘endangered species’। তাহলে ভাবুন আসল অপদেবতাটা আসলে কে? ‘Crocodilus nilotictus’, নাকি ‘Homo sapiens sapiens’?
‘The answer my friend is blowing in the wind!’
Let Matriarchy begin
‘Empieza el matriarcado’ বা ‘Let Matriarchy begin’ ডায়লগটা Money Heist নামক ওয়েব সিরিজের দৌলতে আজকাল বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু মিশরের ইতিহাসে মাতৃতন্ত্রের জনপ্রিয়তা কিন্তু ৩৫০০ বছর পুরোনো। সেই সময় এক-একজন ফারাও-এর ৫০-৭৫টা করে স্ত্রী থাকত। একজন অন্তঃসত্ত্বা হলেই ফারাও খুঁজে নিতেন তাঁর পরবর্তী শয্যাসঙ্গিনীকে। আর গর্ভবতী স্ত্রী অপেক্ষায় থাকত পুত্রসন্তানের। প্রথম পুত্রের জননী হলেন রানি।
সেই সময় রাজবংশেও মহিলাদের অবস্থানটা মোটেও সুখকর ছিল না। যেহেতু রাজবংশে বাইরের রক্ত আনতে নারাজ রাজপরিবারেরা, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপন ভাইয়ের সন্তানের জন্ম দিতে হত তাদের। পুত্রসন্তানের জন্মের পর তার রাজা হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে নির্ভর করত রানির সম্মান। শুধু ফারাও-এর মা এবং তাঁর প্রথম পুত্রসন্তানের মায়ের জুটত প্রকৃত রানির মর্যাদা ও ছোটোখাটো একটা পিরামিড। আর বাকিরা হারিয়ে যেত কালের স্রোতে।
১৫০৭ খ্রিস্টপূর্বে জন্ম হয় হাচিপসুর। তাঁর পিতা ফারাও টুটমোস-১। তাঁর ছোটো ভাই ও স্বামী ফারাও টুটমোস-২। পিতার প্রথম সন্তান হওয়া সত্ত্বেও নারী হওয়ার দরুন তাঁর আর রাজা হওয়ার জো নেই। হাচিপসুর প্রথম কন্যাসন্তানের জন্মের পর তিনি আর মা হতে পারেননি। এর মধ্যে ফারাও টুটমোস-২ মারা যান। হাচিপসুর রানি হওয়ার স্বপ্ন তখন অসম্ভব। মসনদে বসবে ফারাও টুটমোস-২-এর পুত্র ফারাও টুটমোস-৩। যেহেতু টুটমোস-৩ নাবালক, তাই তার অভিভাবক হিসেবে শাসন ভার পেলেন হাচিপসু।
যদিও এরকম অভিভাবকের উদাহরণ মিশরের ইতিহাসে অনেক আছে, তবু হাচিপসু অনন্য। এই অভিভাবক থেকেই মিশরের ইতিহাসে অন্যতম মহিলা ফারাও হিসেবে ২১ বছর জাঁকিয়ে শাসন করলেন হাচিপসু। তাঁর শাসনকালে অসামান্য কূটনৈতিক বুদ্ধি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন হাচিপসু। হাত মেলান পুরোহিতদের সঙ্গে। তাদের প্রচারে ফারাও থেকে প্রজাদের নজরে ভগবান হয় উঠে হাচিপসু। তৈরি করেন অনেক মন্দির, খিলান, মূর্তি দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সমস্ত মন্দিরের গায়ে খোদাই করা অসাধারণ শিল্পকলা যা কেবল ফারাও-এর জয়গান গাইতে ব্যস্ত। মজার বিষয় হল, পাছে নারী বলে প্রজারা তাঁকে অবজ্ঞা করে, এই সম্ভবনা এড়াতে নিজের সমস্ত মূর্তির দেহটি একটি বলশালী পুরুষের মতো তৈরি করতেন হাচিপসু। ব্যবহার করতেন ফারাওদের পোশাক, মুকুট ও দাড়ি। কিন্তু অপরূপ সুন্দরী ছিলেন হাচিপসু। তাই মূর্তির মুখগুলো কিন্তু তাঁর নিজের, সুন্দরী নারীর। ইতিহাসের তৎকালীন ইনস্টাগ্রামে এই বিরলভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন হাচিপসু। After all she was a pretty woman you see!
এই ২১ বছরের রাজত্বকালে কিন্তু হাচিপসু বেশ কিছুদিন যুবক রাজকুমার টুটমোস-৩ কে ফারাও হতে দেননি। তাই তার সৎ মায়ের প্রতি প্রগাঢ় ঘৃণা ছিল টুটমোস-৩-এর। হাচিপসুর ঈশ্বরতুল্য জনপ্রিয়তা এই ঘৃণাকে ঈর্ষাতে পরিণত করে। সৎ মায়ের মৃত্যুর পর যখন টুটমোস-৩ ক্ষমতায় আসেন, তখন অধিকাংশ মন্দিরের গা থেকে হাচিপসুর সুন্দরী মুখটিকে ধংস করেন তিনি। অথচ ইতিহাস সাক্ষী আছে, পুরুষতন্ত্র বারংবার ব্যতিক্রমী নারীদের মুছে ফেলতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। লুক্সরের কার্নাক মন্দিরের দেয়ালে হাচিপসু কিন্তু আজও বহাল তবিয়তে দেবতাদের সংসর্গ করছেন। বরং হারিয়ে গেছেন টুটমোস-৩।
পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীবাদের প্রথম পর্যায়ের লড়াইয়ের একটি মাইলফলক বলা যায় হাচিপসুকে। অপরূপ সুন্দরী হওয়ার সঙ্গে তিনি ছিলেন এক দক্ষ প্রশাসক ও কূটনৈতিক। সত্যি, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।
কোশারি নিয়ে দু কথা
বাঙালি যে-দেশেই যাক না কেন খাবার নিয়ে আলোচনা হতেই হবে। মিশরই-বা কেন বাদ যাবে? তবে এখানেই মজার কথা, ভাবতে পারেন কাবাব, স্বারমার জন্য বিখ্যাত দেশের জাতীয় খাবার কিনা নিরামিষ? আমরা তো বাইরে পয়সা দিয়ে ভেজ খেতে গেলেই নাক সিঁটকোই, সেখানে কিনা কাবাবের গন্ধ নাকে নিয়ে কোশারি খাব? কিন্তু মিশরের জাতীয় খাবার নাকি ইতালিয়ান ও আরব্য রন্ধনপ্রণালীর জবরদস্ত ফিউশন। ভাত, অঙ্কুরিত ডাল, কাবুলি ছোলা সঙ্গে মিশে যাচ্ছে পেনি পাস্তা, গরম মেক্সিকান সালসা সস এবং পেঁয়াজের বারিস্তা। উপর থেকে ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে গার্লিক ভিনিগার।
আবু তারেক-এর রেস্তরাঁটা তিনতলা। ভাবতে পারেন, শুধুমাত্র কোশারিই পাওয়া যায় এখানে! দেওয়ালে ছবি দেওয়া বিখ্যাত মানুষদের। ভাবতে অদ্ভুত লাগে, এই খাবারের জন্ম হয়েছে গরিব বেদুইনদের ঘরে। আমিষ কেনার সামর্থ্য নেই, ফ্রিজ আবিষ্কার হয়নি, রুটি বেশ দামি, পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাল, ভাত কিছুই নেই। কী করবেন বাড়ির মহিলারা? টেকনিকটা সেই এক, যা আমাদের মা-মাসিমারা করে থাকতেন। সব মিশিয়ে গরম টমাটোর সস দিয়ে খেয়ে নিন। ব্যাপারটা শুনে অনেকেই ভাবছেন এ আর এমন কী। কিন্তু যখন খাবারটা খাবেন, বুঝতে পারবেন যে কোশারি যে-কোনো আমিষকে বলে বলে গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বারিস্তা ও গরম সস সহযোগে যখন ব্যাপারটা মুখে ঢুকবে তখন মুখের ভিতর এক অদ্ভুত জাদুর খেলা শুরু হয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন, জাতি, ধর্ম, দেশ, কাল, সীমানার সমস্ত গণ্ডি ভেঙে একজন বাঙালি এক মিশরীয় মায়ের হাতের জাদুতে মজে যেতে বাধ্য হবেন। কী মশাই, কী ভাবছেন? এবার পুজোতে তাহলে হোক প্ল্যান?