অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
পাহাড়, বরফ, সবুজে মাখামাখি হয়ে রয়েছে চতুর্দিকে। এভারেস্ট, লোতসে, নুপসে, আমাদাবলাম সহ অনেক পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গগুলো আকাশ ক্যানভাস জুড়ে আছে। হাতটা খানিক লম্বা করে দিলেই যেন ছোঁয়া যায় এদের। গ্রামের পাহাড়ের ঢালে সোনালি রোদ মেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ধানের শিষ। আলু আর রাইয়ের পাতা হয়ে ওঠে ঘন সবুজ।
বরফগলা শেষ হতেই পাহাড়ের ঢালে ফুটে ওঠে রঙের খেলা আর হালকা সৌরভ। নানা রঙের প্রজাপতি, পাখি ও ফুলে ফুলে ভরে ওঠে খাড়া ঢাল – আর আসে ওরা। বসন্তের নীল আকাশের গায়ে ফুটে ওঠে কালো রেখার মতো ওদের আনাগোনা। ওরা আসে রডোডেন্ড্রনের ফুলের আকর্ষণে। না ঠিক ফুল নয় আসে ওরা ফুলের মধুর টানে। পাহাড়ের গায়ের পাথুরে কন্দর হয়ে ওঠে ওদের বাসস্থান। তবে ওদের কাছে পৌঁছন সহজ নয় মোটেই। পাহাড়ের খাড়াই ঢাল বেয়ে জঙ্গলের গাছপালার খোঁচা খেতে খেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে তবে পৌঁছন যায় ওদের ডেরায়।
তিন সেন্টিমিটার লম্বা এই বন্য মৌমাছিদের, বৈজ্ঞানিক নাম এপিস ডরসটা ল্যাবরেসিয়া। চায়না, জাপান, কোরিয়া সহ বহু দেশে এই মধুর খুব চাহিদা। কারণ এর ঔষধিগুণ।
পাহাড়ের খাড়া পাথুরে দেওয়ালে চাক বাঁধে এই মৌমাছিরা। আর এই মধু সংগ্রহ করাটা বিপদজনক পেশার একদম চূড়ায়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হতেই থাকে এখানে বরফগলার দিনগুলোতে। পিঠে ভারী বোঝা নিয়ে রডোডেন্ড্রনের ঝোপ পেরিয়ে, মাইলের পর মাইল জঙ্গলের চড়াই ভেঙে গাছের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে, একের পর এক খরস্রোতা ঝোরা পার হয়ে তবে পৌঁছোনো যায় এদের ডেরায়। তার আগে চলে দেখাশোনার পালা। মানে মধু ঠিক মতো মৌচাকে জমেছে কিনা, ঠিক কোথায় কোথায় চাক বেঁধেছে। যেসব ঢালে চাক বেঁধেছে সে পাহাড়ের মাথায় কোন পথ দিয়ে উঠতে হবে, ঢালের মাথায় শক্তপোক্ত গাছ বা বড় পাথর আছে কিনা। কারণ যে-ঢালে চাক বাঁধে এই বন্য মৌমাছিরা সেটা হয় ‘ওভারহ্যাং’-এর ভেতরে।
অর্থাৎ পাহাড়ের ঢাল এখানে ভেতরে সেঁধিয়ে আছে। সেই চাকের কাছে পৌঁছানোটাই দুঃসাধ্য। গুটিকয় মানুষ এখনও আছেন যারা প্রাণ হাতের মুঠোয় ধরে সেই মধু সংগ্রহে পিছপা নন। যতটা না অর্থের টানে, তার থেকেও বেশি অ্যাডভেঞ্চারের টানে ও যুগ যুগ ধরে চলা প্রথা, তথা জীবিকাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। পাহাড়ের খাঁজে মৌমাছির পালের সৃষ্ট চাক থেকে মধু সংগ্রহ, কয়েক যুগ বা কয়েক শতাব্দীর প্রথা নয়। এই প্রথা চলে এসেছে পৃথিবীর অন্য অনেক প্রান্তে, হাজার হাজার বছর ধরে। যার অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত। স্পেনের এক গুহাকন্দরের আট হাজার বছরের পুরনো এক গুহাচিত্র সে কথাই বলে।
কিছু কিছু পর্যটন সংস্থা মুষ্টিমেয় কিছু পর্যটককে এই মধু সংগ্রহ অভিযান দেখাতে নিয়ে গেলেও, মধু সংগ্রহের সত্যিকারের অভিযানে অংশ নেওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ কবে ও কখন যে মউলিরা দড়িদড়া নিয়ে বেরোবেন তার তো ঠিক নেই! দুঁদে মউলিরা দূর থেকে চাকের রঙ ও গড়ন দেখে ঠিক করেন যে কখন চাক ভাঙা হবে। তবে মধু সংগ্রহের প্রস্ততি চলে বরফগলা শুরু হতে না হতেই। গাছের ছাল-বাকল ও লতা দিয়ে লম্বা দড়ি পাকানো শুরু হয়ে যায়, লম্বায় আট ফুটের মতো হালকা মজবুত বাঁশ ‘ট্যাঙ্গো’ পাথর আর টিনে তৈরি ঘরের বাইরের দেওয়ালে প্রস্তুত থাকে। দড়ির গায়ে ছোট ছোট বাঁশের টুকরো জুড়ে তৈরি হয় দড়ি-মই। তারপর চলে সেই দড়ি পরীক্ষার পালা। মই বা দড়িতে কোন খুঁত থাকলেই জীবনহানির সম্ভবনা। এই দড়িই তো জীবন-সুতো। কোনো কারণে ছিঁড়ে গেলে পাহাড়ের গা বেয়ে ২০০-৩০০ ফুট উঁচুতে শূন্যে ঝুলে থাকা শরীর আছড়ে পড়বে বহু নীচে পাথরের গায়। মাথাটা ফেটে ঘিলু বেড়িয়ে যাবে একটা কাঁচা ডিম হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে যেভাবে ওর কুসুম বেড়িয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে সেভাবে। কিম্বা ঝুলতে থাকা শরীরটা সোজা গিয়ে পড়বে কয়েক হাজার ফুট নীচ দিয়ে বয়ে চলা প্রচণ্ড গতিতে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী বা ঝোরার বরফ ঠাণ্ডা জলে। স্রোতের টানে সে শরীর যে ভেসে কোথায়, কোন পাথরের ফাঁকে গিয়ে আটকাবে কে জানে!
মধু সংগ্রহে সামান্যই সরঞ্জাম প্রয়োজন। দড়িদড়া, লাঠি, লম্বা ছুড়ি, ধারালো বাঁশের চোঁচ, বেতের ঝুড়ি, আর কিছু বালতি-হাঁড়ি। শুধু একটা সরঞ্জাম সংগ্রহ করা নয়, সেটা হোল সাহস। এটা মউলির নিজস্ব সম্পদ। দড়ি আর মইতে দীর্ঘক্ষণ ঝুলে থাকার ফলে পেশীতে টান ধরে শরীরের অনেক অংশ অসাড় হয়ে থাকে খানিকক্ষণ। দড়ির ঝুলন্ত মইয়ে দোল খেতে খেতে, দড়ির ডগায় মৌচাকের কোনাকে মাছ ধরার বঁড়শির মতো করে লটকিয়ে, লম্বা বাঁশের লাঠির মাথায় বল্লমের ফলার মতো বাঁধা বাঁশের চোঁচ বা ছুরি দিয়ে পাহাড়ের খাঁজে ঝুলন্ত মৌচাক কাটার জন্য দরকার শিকারির অকুতোভয় ঠাণ্ডা মাথা।
প্রবল হাওয়া, বৃষ্টির ধারার সাথে ধেয়ে আসে লম্বা, হৃষ্টপুষ্ট মৌমাছির হুলের দংশন। শিক্ষিত সেনার মতো আগুণ আর ধোঁয়ার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মৌমাছিরা আক্রমণ শানায়। এক একটা দংশনে লংকা বাটা চামড়ায় লাগলে যে রকম জ্বলুনি হয় সেই রকম জ্বলুনি শুরু হয় শরীরে। সেই জ্বলুনি সহ্য করে দড়িতে ঝুলে ঝুলে লম্বা বাঁশের মাথায় মাথায় ছুরি চালাতে পারে একমাত্র পোড় খাওয়া মৌলীরাই। আর এই পোড় খাওয়া মউলি হবার শুরুটা হয় ওই দড়ি আর দড়ির মই বওয়া থেকে। দলের সদস্য হয়ে শিখতে হয় মৌমাছিদের জীবনযাত্রার ধরণ ধারণ। জানতে হয় মৌমাছিদের চরিত্র। তারা কোথায় কখন বাসা বাঁধে, কখন তাদের ডিম ফোটে। রাখতে হয় রডোডেন্ড্রন ঝাড়ের হদিশ। এমনকি শিখতে হয় কী করে বাঁচিয়ে রাখতে হয় মৌমাছির ঝাঁককে। চাক ভাঙার সময় আগুণ আর ধোঁয়ায় হাজার হাজার মৌমাছি মাড়া পড়লেও, কিছু মৌমাছি তো বেঁচেই যায় আর তাদের বাঁচিয়ে না রাখলে তো আগামীতে আর মৌমাছিও আসবে না, চাক হবে না, মধু পাওয়া যাবে না। মার খাবে জীবিকা। এই মউলিরাই একদিকে মৌমাছিদের মারলেও আর এক দিকে তাদের প্রতিপালক। তাই এক তৃতীয়াংশ মৌচাক ভাঙা হয় না।
মধু শিকারের সময় মউলিদের কোন বিশেষ পোশাকও থাকে না। একটা ফুল প্যান্ট, মাথায় নেপালি টুপি, একটা জামা তার ওপর একটা জ্যাকেট বা সোয়েটার- যা তাদের সারা বছরের সঙ্গী।
বছরে দু’বার মধু সংগ্রহ করে এরা। গ্রীষ্ম আর বসন্তে।
মধু সংগ্রহ অভিযানে বেরোনোর আগে মউলির দল ও তাঁদের পরিবার পাহাড়-দেবতাকে তুষ্ট রাখতে মোরগ বা ভেড়া বলি দেন। এতে যোগ দেন গ্রামের অন্য পরিবাররাও। বিশ্বাস, মধু সংগ্রহে গিয়ে লোক মাড়া যাবার প্রধান কারন যাত্রা শুরুর আগে ঠিকমতো পাহাড় দেবতার বন্দনা না করা।
যে সব ঢালে চাক আছে, সেখানে পৌঁছে প্লাস্টিক ও লতাপাতা দিয়ে অস্থায়ী আস্তানা বানিয়ে শুরু হয় মধু সংগ্রহের প্রস্তুতি। যেখানে চাক আছে তার মাথায় পৌঁছে শুরু হয় শক্তপোক্ত গাছের খোঁজ। গাছের গুঁড়িতে দড়ি ও মইএর প্রান্ত বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় নীচে। গাছের লতা ও বাকল থেকে পাকিয়ে তৈরি হয় আরও প্রয়োজনীয় দড়ি। প্রস্তুতিতেই কেটে যায় আট-দশদিন। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা কাঠ জ্বালিয়ে তৈরি হয় ডাল আর ভাত। এই তাদের খাদ্য।
অবশেষে আসে মই বেয়ে ওঠার দিন। দেবতাকে স্মরণ করে চাকের ঢালের নীচে আগুণ জ্বালাতেই চারপাশ ঢেকে যায় ধোঁয়ায়। বাসা ছেড়ে বেড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মৌমাছির দল আকাশ ছেয়ে ফেলে। ঝাঁপিয়ে পড়ে মউলিদের শরীরের ওপর। পাশাপাশি ফেলা দড়ির ঝুলন্ত মই বেয়ে উঠতে থাকে দক্ষ মউলিরা। পাশেপাশে কাঁচা লতার দড়ি বেয়ে ধোঁয়া ওগরাতে ওগরাতে উঠতে থাকে জ্বলন্ত আধ শুকনো লতাপাতা। চাকের গায়ে বুলিয়ে দিতে হবে আগুণের শিখা।
একার কাজ নয় মৌচাক কেটে নীচে নামানো। একজন যখন চাক কাটতে থাকে তখন অন্য এক বা দু’জন ব্যস্ত থাকে সেই চাককে দড়ির ফাঁদে আটকে ঝুড়িতে চাপিয়ে নীচে নামাতে। দীর্ঘক্ষণ সার্কাসের ট্রাপিজ খেলোয়াড়ের মতো দুলন্ত দড়ির মইয়ের সরু বাঁশ কাঠের ফালিতে অসাড় হয়ে আসে পা। মউলির মস্তিষ্ক পায়ের আঙুলকে আদেশ দেয় দড়ি আঁকড়ে ধরতে।
হাত পায়ের বাঁধন ছেড়ে গেলেই মৃত্যু। পর্বতারোহীদের মতো এদের কোমরে কোন ‘পতন-রোধী’ দড়ি বাঁধা থাকে না।
এত পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেবার পর একএক জনের ভাগ্যে মধু বেচে জুটবে সত্তর-আশি ডলার! যদিও এই মধুর দাম অনেক। কিন্তু উপায়ই বা কী? পিঠে মাথায় মধু চাপিয়ে তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়, বারো পনেরো দিনের পথ হেঁটে শহরে গিয়ে মধু বিক্রি করা।
এক চাক কেটে অন্য চাকের দিকে উঠতে গিয়ে ষাট বছরের বাহাদুর গুরুঙ্গের চোখে নেমে আসে সংশয়। এটাই শেষ অভিযান নয়তো? নবপ্রজন্ম আর এই ঝুঁকির কাজে আসতে উৎসুক নয়। তার প্রজন্মই হাজার হাজার বছরের পুরনো মধুশিকারের পদ্ধতি অবলম্বন করা শেষ মধু শিকারি নয়তো?
চিত্র সৌজন্য – সঞ্জয় কাফলা, আন্ড্রু নেওয়ে, অরিন্দম দেবনাথ ও ইন্টারনেট
বিচিত্র দুনিয়া সমস্ত লেখা একত্রে