মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
বিশাল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য তারাজগৎ বা গ্যালাক্সি। প্রতিটি তারাজগতে আছে কোটি কোটি নক্ষত্র, যেগুলি আকারে আয়তনে আমাদের সূর্যের মতো কিংবা সূর্যের চেয়ে বড়ো বা ছোটো। নক্ষত্রগুলি যেমন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে তেমন তারাজগৎগুলিও নানা প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন কুণ্ডলিত তারাজগৎ, উপবৃত্তাকার তারাজগৎ, উভ-উত্তল তারাজগৎ, বামন বর্তুলাকার তারাজগৎ, অনিয়মিত তারাজগৎ ইত্যাদি।
‘সেন্টেরাস এ’ গ্যালাক্সি:
১৮২৬ সালে স্কটিস জ্যোতির্বিদ জেমস ডানলপ দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশে কিন্নর নক্ষত্রমণ্ডলে (Constellation Centaurus) একটি গ্যালাক্সি খুঁজে পান। এটির নাম সেন্টেরাস এ। অপর নাম এন.জি.সি ৫১২৮ (NGC 5128)। পৃথিবী থেকে এই গ্যালাক্সিটির দূরত্ব ও আকৃতি নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বিতর্ক আছে। একদল বিজ্ঞানীর মতে এই দূরত্ব ১ কোটি আলোকবর্ষ, অন্যদলের মতে ১ কোটি ৬০ লক্ষ আলোকবর্ষের কম তো নয়ই, বরং কিছু বেশি হতে পারে। আকৃতির ব্যাপারে কারো মতে এটি লেন্টিকুলার (Lenticular) আবার কারো মতে এটি উপবৃত্তাকার। এই অতিকায় গ্যালাক্সিটির ভর সৌরভরের এক লক্ষ কোটি গুণ।
এই গ্যালাক্সিটির কেন্দ্রে একটি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে। যার ভর প্রায় ৫.৫ কোটি সৌরভরের সমান। গ্যালাক্সিটির কেন্দ্র থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে এক্স-রশ্মি ও রেডিও তরঙ্গ সমন্বিত প্লাজমা স্রোত। প্রায় ১০ লক্ষ আলোকবর্ষ দীর্ঘ এই মহাশক্তিশালী প্লাজমা স্রোতের বেগ আলোর বেগের প্রায় অর্ধেক। গ্যালাক্সিটির মধ্যভাগের বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ধুলো-গ্যাসের অন্ধকার অঞ্চল দেখে বিজ্ঞানীদের অনুমান অতীতে হয় দুটো গ্যালাক্সির সংঘাতের ফলে অথবা এন.জি.সি ৫১২৮-এর মতো একটি বড়ো গ্যালাক্সির একটি ছোটো গ্যালাক্সি গ্রাসের ফলে সেন্টেরাস এ-এর উৎপত্তি। এই গ্যালাক্সিতে বিজ্ঞানীরা প্রায় ১০০টি সক্রিয় নক্ষত্রসৃষ্টিকারী অঞ্চল খুঁজে পেয়েছেন।
এম ৮২ বা সিগার গ্যালাক্সি:
আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল (Constellation Ursa Major) দেখেনি এমন লোক খুব কমই আছে। কম্পাস আবিষ্কারের আগে সমুদ্রে জাহাজের নাবিকরা ধ্রুবতারা দেখে দিকনির্ণয় করত। আর ধ্রুবতারা খুঁজতে এই সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাহায্য নেওয়া হত। এবারে একটু উঁকিঝুঁকি মারা যাক এই নক্ষত্রমণ্ডলের গভীরে। এখানে রয়েছে জ্বলন্ত সিগারেটের মতো বিচিত্রদর্শন একটি অনিয়তাকার গ্যালাক্সি যার নাম সিগার গ্যালাক্সি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এটি এম-৮২ নামে পরিচিত। আকৃতি অনিয়তাকার হলেও এর দুটি সুষম সর্পিলাকার বাহু রয়েছে।
এম-৮২-র কেন্দ্রে রয়েছে একটি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর যার ভর সৌরভরের প্রায় ৩ কোটি গুণ বেশি। একে ঘিরে প্রায় ১৬৩০ আলোকবর্ষ পরিমিত স্থান জুড়ে অবিরাম নক্ষত্রসৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে।
আর্প ২৪৪ বা অ্যান্টেনা গ্যালাক্সি:
মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে এবারে ঢুকে পড়া যাক কোরভাসমণ্ডলে (Constellation Corvus)। এখানে ঘোরাঘুরি করলে দেখা পাওয়া যাবে অদ্ভুত সুন্দর দুটি গ্যালাক্সির। এরা এখন যুগলে থাকলেও ১২০ কোটি বছর আগে এরা আলাদা ছিল। এদের মধ্যে বড়োটি দণ্ডাকৃতি সর্পিলাকার গ্যালাক্সি এবং অপেক্ষাকৃত ছোটোটি সর্পিলাকার গ্যালাক্সি। প্রায় ৯০ কোটি বছর আগে এদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে ধীরে ধীরে উভয়ের চেহারাই পালটাতে থাকে। এই সংঘাত এখনো চলছে। বিজ্ঞানীদের মতে প্রায় ৪০ কোটি বছর পর দুটি গ্যালাক্সির কেন্দ্র দুটি পরস্পর মিশে যাবে। তখন গ্যালাক্সি দুটির আর আলাদা অস্তিত্ব থাকবে না। তৈরি হবে অতিকায় এক উপবৃত্তাকার গ্যালাক্স। তখন সেখানে আর কোনো নতুন নক্ষত্র তৈরি হবে না। বিজ্ঞানীরা আরো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা বলেছেন। সম্প্রতি সেখানে দুটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটেছে। চন্দ্র এক্স-রশ্মি টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা জানা গেছে ওই গ্যালাক্সিতে প্রচুর পরিমাণে নিয়ন, ম্যাগনেশিয়াম এবং সিলিকন আছে।
যুগল গ্যালাক্সি আর্প ১৪২:
এই অদ্ভুত সুন্দর গ্যালাক্সি যুগলের দিকে তাকালে মনে হবে মহাকাশে ভাসমান দুটি ডলফিন যেন একটি বল নিয়ে খেলায় মত্ত। বৈজ্ঞানিকরা এই গ্যালাক্সি যুগলের একটির নাম রেখেছেন এন.জি.সি ২৯৩৬ (NGC 2936) এবং অপরটির এন.জি.সি ২৯৩৭ (NGC 2937)। এনজিসি ২৯৩৬ সর্পিলাকার গ্যালাক্সি। নক্ষত্র সৃষ্টি হওয়ার কারণে একে পৃথিবী থেকে নীলচে-সাদা দেখায়। আর অপরটি, অর্থাৎ এন.জি.সি ২৯৩৭ গ্যালাক্সিটি হল উপবৃত্তাকার। এর তীব্র অভিকর্ষীয় টানে গ্যালাক্সি দুটির মধ্যে গ্যাসের স্রোত সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে ৩২ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সি দুটিকে ডলফিনের মতো দেখতে লাগে।
আর্প ১৪৭ (Arp 147):
তিমিমণ্ডলের (Constellation Cetus) গভীরে থাকা এই গ্যালাক্সির পৃথিবী থেকে দূরত্ব ৪৪ কোটি আলোকবর্ষ। মহাকাশে এই অদ্ভুতদর্শন গ্যালাক্সিটিকে ১৮৯৩ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টেফান জাভেল খুঁজে পান। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস প্রায় ৪ কোটি বছর আগে একটি সর্পিলাকার গ্যালাক্সি ও একটি উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘাতের ফলে এই গ্যালাক্সিটির সৃষ্টি। এখান থেকে ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমটার বেগে বেরিয়ে আসছে নক্ষত্র সৃষ্টিকারী এক তরঙ্গ। এই নক্ষত্রবলয়ের মধ্যে ন’টি কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের প্রতিটির ভর ১০ – ২০ সৌরভরের কাছাকাছি।
মূষিক গ্যালাক্সি (Mice galaxies):
এবারে একটু ঘুরে আসা যাক বেরেনিকাস নক্ষত্রমণ্ডলীতে (Constellation Coma Berenicas)। এখানে রয়েছে দুটি গ্যালাক্সি। এদের পোশাকি নাম এন.জি.সি ৪৬৭৬এ (NGC 4676A) এবং এন.জি.সি ৪৬৭৬বি (NGC 4676B) হলেও এদের একত্রে মূষিক গ্যালাক্সি (Mice galaxies) বলা হয়। গ্যালাক্সি দুটির লেজের মতো গ্যাসের স্রোত লক্ষ করে এবং হিসেবনিকেশ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে প্রায় ২৯ কোটি বছর আগে এদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়েছিল। নিয়মানুযায়ী সাধারণত এইধরনের গ্যাস-স্রোতের মাথার দিকটা হলদেটে এবং লেজের দিকটা অর্থাৎ শেষপ্রান্ত নীলাভ হয়ে থাকে। এন.জি.সি ৪৬৭৬বি-র গ্যাস-স্রোত নিয়মমতো হলেও এন.জি.সি ৪৬৭৬এ-র গ্যাস-স্রোত বিপরীতধর্মী। এমনটা কেন হল তা এখনো সঠিক জানা সম্ভব হয়নি। পৃথিবী থেকে মূষিক গ্যালাক্সির দূরত্ব প্রায় ২৯ কোটি আলোকবর্ষ।
মেসিয়ার ৮৭ (Messier 87) বা এম ৮৭:
এই অতিকায় উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিটি রয়েছে পৃথিবী থেকে ৫.৩ কোটি আলোকবর্ষ দূরে কন্যারাশির (Constellation Virgo) গভীরে। এর অপর নাম ‘ভার্গো এ’ বা এন.জি.সি ৪৪৮৬ (Virgo A or NGC 4486)। এর মাঝে রয়েছে অতিকায় একটি কৃষ্ণগহ্বর। এই অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের তীব্র আকর্ষণ শুধু গ্যালাক্সির দশ হাজার নক্ষত্রকেই নয়, পুরো একটি গ্যালাক্সিগুচ্ছকে বেঁধে রেখেছে। এই গ্যালাক্সিটির মধ্যে প্রায় ১৩০০০ বর্তুলাকার নক্ষত্রস্তবক (Globular cluster) রয়েছে। এ যাবৎ জানা যা অন্য কোনো গ্যালাক্সির পক্ষে সর্বাধিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের গ্যালাক্সি অর্থাৎ ছায়াপথে এইধরনের নক্ষত্রস্তবক মাত্র ১৫০টি রয়েছে। প্রতিটি নক্ষত্রস্তবকের গড় ভর প্রায় ২ লক্ষ সৌরভরের সমান।
আলোকচিত্র-হাব্ল্। আর্প ১৪৭ এর আলোকচিত্র ‘চন্দ্র’ মহাকাশ দুরবিন।
শেষ ছবিটি ভাদিন সাবোৎস্কি-র আঁকা।
বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে