মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
তারা নয়, গ্রহ
পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় এমন গ্রহগুলির মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল গ্রহ হল শুক্র। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ভেনাস (Venus)। দীপ্তিময়ী এই গ্রহটিকে বছরের কিছু সময় ভোরবেলা পূর্ব আকাশে এবং অন্য সময় সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিম আকাশে দেখতে পাওয়া যায়। ভোরে ‘শুকতারা’ এবং সন্ধ্যায় ‘সন্ধ্যাতারা’ বা ‘সাঁঝতারা’ নামে এটি পরিচিত। নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে বলে আমরা অনেকেই গ্রহটিকে ভুল করে তারা বলে মনে করি। ভোরে বা সন্ধ্যায় দেখা গেলেও একে কখনোই মাঝরাতে আকাশে দেখা যায় না। একসময় মনে করা হত ভোরে ও সন্ধ্যায় আকাশে উদয় হওয়া শুক্র গ্রহ দুটি আলাদা তারকা। তাই তাদের নামও দেওয়া হয়েছিল পৃথক। গ্রিকদের কাছে ভোরে পূর্ব আকাশে উদয় হওয়া শুক্র গ্রহ ‘ফসফরাস’ (Phosphorus) নামে এবং সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে দেখতে পাওয়া শুক্র গ্রহ ‘হেসপেরাস’ (Hesperus) নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে গ্রিক পণ্ডিতরা বুঝতে পারেন যে পূর্ব ও পশ্চিম আকাশে উদয় হওয়া জ্যোতিষ্ক দুটি পৃথক কোনও তারকা নয়, শুক্র গ্রহকেই আকাশে দু-বার দুই সময়ে দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাস এই ভ্রান্তি দূর করেছিলেন।
প্রাচীন ধারণা
প্রাচীনকালে মানুষের হাতে উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। তাঁরা খালি চোখে আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে প্রাপ্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করতেন। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হত নানা কল্প-কাহিনি। শুক্র গ্রহকে নিয়েও অনেক পৌরাণিক কাহিনি আছে। এইরকমই একটি গল্প হল কৃষ্ণ-পুত্র প্রদ্যুম্ন ও অসুর কন্যা মায়াবতীকে নিয়ে। মায়াবতী ছিল প্রদ্যুম্নের অনুরাগিণী। কিন্তু কোনও কারণে একসময় প্রদ্যুম্ন ও মায়াবতীর পিতার মধ্যে কলহ হয়। আর তাতে রেগে গিয়ে প্রদ্যুম্ন মায়াবতীর পিতা অসুর সম্বরকে হত্যা করে। এই ঘটনায় মায়াবতী খুব দুঃখ পায় এবং শুক্র গ্রহ হয়ে আকাশে গিয়ে বসবাস শুরু করে। তাই আমাদের প্রাচীন পুরাণে শুক্র গ্রহকে এক রূপসী নারীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
শুধু আমাদের দেশেই নয়, রোমানদের পুরাণেও ভেনাস অর্থাৎ শুক্র গ্রহ প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী। গ্রিক পুরাণেও একে প্রেম, সৌন্দর্য ও উর্বরতার দেবী ‘অ্যাফ্রোডিতে’-র সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে।
নানা নামে শুক্র গ্রহ
আগেই বলেছি, প্রাচীনকালে আমাদের দেশের লোকেরা শুক্র গ্রহকে ‘শুকতারা’ এবং ‘সন্ধ্যাতারা’ নামে চিনত। গ্রিকরা গ্রহটির নাম রেখেছিল ‘ফসফরাস’ ও ‘হেসপেরাস’। রোমানদের দেওয়া নাম ছিল ‘ভেনাস’। এছাড়াও আরও অনেক নাম ছিল গ্রহটির। ব্যাবিলনীয়রা এই গ্রহটি সম্পর্কে খুবই উৎসাহী ছিল। তারা যে গ্রহটিকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করত তার প্রমাণ পাওয়া যায় আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারে রাখা কিছু নিদর্শন থেকে। পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া ২১ বছরের ফলাফল নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত একটি ফলকে নথিভুক্ত করা আছে। পরীক্ষা করে জানা গেছে, ওই পর্যবেক্ষণগুলি করা হয়েছিল ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ব্যাবিলনীয়দের কাছে শুক্র গ্রহ ‘নিনডারান্না’ (Nindaranna) নামে পরিচিত ছিল। আসিরিয়রা গ্রহটির নাম রেখেছিল ‘ডিল-বাট’ (Dil-bat) বা ‘ডিল-ই-পাত্’ (Dil-i-pat)। মিশরে শুক্র গ্রহের নাম রাখা হয়েছিল দেবতাদের মাতা ‘ইশটার’ (Ishtar)-এর নামে। চিনের লোকেরা একে চিনত ‘জিন জিঙ্গ’ (Jin Xing) নামে। জাপানি, কোরিয় এবং ভিয়েতনামিজ সংস্কৃতিতে এই গ্রহের নাম বলা হয় ‘ধাতব তারা’। সম্ভবত পৃথিবী সৃষ্টিকারী পাঁচটি মৌলিক উপাদানের নাম থেকে এই নামের উদ্ভব।
আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে শুক্র গ্রহ
সূর্য থেকে দূরত্বের বিচারে শুক্র হল সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ। আকৃতির দিক থেকে পৃথিবীর সঙ্গে অনেক মিল থাকায় শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর ভগিনী গ্রহ বা সিস্টার প্ল্যানেট বলা হয়। সৌরজগতের আর কোনও গ্রহের সঙ্গে আকৃতির দিক থেকে এতটা মিল নেই। এর কারণ দুটি গ্রহের ব্যাসের গড় দৈর্ঘ্য প্রায় সমান। আমরা জানি পৃথিবীর গড় ব্যাস ১২,৭৫৬ কিলোমিটার। শুক্রের গড় ব্যাস পৃথিবীর গড় ব্যাসের তুলনায় মাত্র ৬৫২ কিলোমিটার কম, অর্থাৎ শুক্রগ্রহের গড় ব্যাস ১২,১০৪ কিলোমিটার।
শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর ভগিনী গ্রহ বলার আরও একটি কারণ আছে। এই গ্রহটি পৃথিবীর যতটা কাছে আসতে পারে, আর কোনও গ্রহ তা পারে না। পৃথিবী থেকে শুক্রের দূরত্ব ৫ কোটি ২০ লক্ষ কিলোমিটার, কিন্তু এটি যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে তখন গ্রহ দুটির মধ্যে ব্যবধান দাঁড়ায় ৪ কোটি কিলোমিটারের কাছাকাছি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে এই সময় শুক্র গ্রহকে আরও উজ্জ্বল দেখাবে। কিন্তু না, এই সময়ে শুক্রের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটা পৃথিবীর দিকে ফেরানো থাকে বলে পৃথিবীর মানুষ গ্রহটিকে তখন দেখতেই পায় না।
পৃথিবী ও শুক্র গ্রহের মধ্যে আরও অনেক মিল আছে। যেমন শুক্রের ভর পৃথিবীর ভরের ৫ ভাগের ৪ ভাগ, অভিকর্ষ বল পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের ১০০ ভাগের ৮৮ ভাগ, ঘনত্ব প্রায় সমান। পার্থক্য খুবই সামান্য (মাত্র ০•৩২)।
শুক্র গ্রহের দিন-রাত্রি
সৌরজগতে শুক্র ব্যাতীত অন্য গ্রহগুলোর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। শুক্রের সূর্য পরিক্রমণ কক্ষপথটি প্রায় গোলাকার। গ্রহটি সূর্য থেকে ১০ কোটি ৯০ লক্ষ দূরে অবস্থান করছে। এটি তার সবচেয়ে দূরের অবস্থান। আর যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে তখন এর দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় ১০ কোটি ৭৪ লক্ষ কিলোমিটার। মজার কথা হল, শুক্র গ্রহ একটি দিন-রাত শেষ করতে যে সময় নেয়, বছর শেষ হয়ে যায় তার আগে। পৃথিবীর হিসেবে সূর্যকে এক পাক দিতে শুক্র গ্রহের সময় লাগে ২২৫ দিনের মতো। অর্থাৎ পৃথিবীর যেখানে ৩৬৫ (প্রায়) দিনে বছর সেখানে শুক্রের একটি বছর শেষ হয় ২২৫ (প্রায়) দিনে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু দিনের হিসেব করতে গেলেই সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। শুক্র গ্রহের অক্ষ তার কক্ষপথের সঙ্গে ২•৭০ হেলানো অবস্থায় আছে এবং গ্রহটি নিজের অক্ষের চারপাশে অত্যন্ত ধীর গতিতে ঘোরে। একপাক ঘুরতে সময় নেয় ২৪৩ দিনের মতো। তাই শুক্রগ্রহের কোনও অঞ্চল ১১৭ দিন সূর্যের আলো পাওয়ার পর ১১৭ দিন রাতের অন্ধকারে ডুবে থাকে। সুতরাং বলা যায়, শুক্র গ্রহে ১১৭ দিন পর পর সূর্যোদয় হয়। এই কারণেই শুক্র গ্রহে বছরে দু-বার সূর্যোদয় হয়। আরও একটা মজার ঘটনা হল, এখানে সূর্যোদয় হয় পশ্চিমদিকে আর অস্ত যায় পূর্বদিকে। অর্থাৎ নিজের অক্ষের ওপর গ্রহটির ঘূর্ণন পৃথিবীর ঠিক বিপরীতমুখী।
শুক্র গ্রহের আবহাওয়ামণ্ডল
পৃথিবীর মতো শুক্র গ্রহেও আবহাওয়ামণ্ডল আছে। তবে এই আবহাওয়ামণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় ৯৬ শতাংশ এবং নাইট্রোজেন আছে ৩ শতাংশের মতো এবং বাকি ১ শতাংশ হল সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, আর্গন, নিয়ন ইত্যাদি বিবিধ গ্যাস। অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্পের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। শুক্রের আবহাওয়ামণ্ডল সৌরজগতের অন্য যে-কোনো গ্রহের আবহাওয়ামণ্ডলের তুলনায় বেশ ভারী। এর চাপও খুব বেশি। পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলীয় চাপের চেয়ে ৯০ গুণ বেশি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় চাপ যেখানে ১০১ কিলো পাসকেলস সেখানে শুক্রের বায়ুমণ্ডলের চাপ ৯১২২ কিলো পাসকেলস। শুক্রের আবহাওয়ামণ্ডল এতটাই পুরু যে শুক্রের পৃষ্ঠদেশে কখনও কোনও প্রাণের উদ্ভব হলে বা কোনও মানুষের পদধূলি পড়লে তারা ওই ঘন গ্যাসীয় মেঘ ভেদ করে আকাশের তারা দেখতে পাবে না। এই মেঘ প্রধানত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের যাতে মিশে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সালফারের ধূলিকণা। বিজ্ঞানীদের মতে, শুক্রের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফারের উপস্থিতির কারণ গ্রহটিতে থাকা আগ্নেয়গিরিগুলি থেকে ক্রমাগত অগ্ন্যুৎপাত।
শুক্রের বায়ুমণ্ডলের বিচিত্র পরিচলন
শুক্র গ্রহের আবহাওয়ামণ্ডল বিচিত্রভাবে গড়ে উঠেছে। এর পরিচলন অন্যান্য গ্রহদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং খুবই অদ্ভুত। গ্রহটি নিজের অক্ষে অত্যন্ত ধীর গতিতে ঘুরলেও এর আবহাওয়ামণ্ডলের উপরিতলের গ্যাসীয় মেঘ দূরন্ত গতিতে গ্রহটিকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাক খাচ্ছে। এই গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রায় চারদিনে গ্রহটিকে একবার প্রদক্ষিণ করে। আয়লা বা আমফান ঝড় আমরা দেখেছি। শুক্রের এই গ্যাসীয় মেঘের গতিবেগের কাছে সেগুলি একেবারে শিশু। এমনকি পৃথিবীর দ্রুততম টর্নেডোর তুলনায় দ্রুততর শুক্রের এই মেঘ। তবে বিস্ময়ের কথা হল, গ্রহটির পৃষ্ঠতল থেকে এই মেঘের উচ্চতা যত কমত থাকে এর গতিবেগও তত কমতে থাকে। এই গতিবেগ গ্রহটির পৃষ্ঠতলের কাছাকাছি ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটারের বেশি হয় না। শুক্রের আবহাওয়ামণ্ডলের এই খামখেয়ালির কারণ এখনও আমাদের অজানা।
শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠতলের কাছাকাছি আবহাওয়ামণ্ডলে অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলে মেঘের (গ্যাসীয় মেঘ) অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এই নির্মেঘ অঞ্চলটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তর। এর ওপরে রয়েছে ২০ কিলোমিটার অবধি বিস্তৃত ধুলো ও সালফিউরিক অ্যাসিড দ্বারা গঠিত এক ঘন মেঘের আস্তরণ। এই মেঘ এতটাই ঘন যে তা ভেদ করে সূর্যের আলো শুক্রপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে না। ফলে গ্রহটিতে সৃষ্টি হয় এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। সবশেষে এই স্তরটির ওপরে রয়েছে আরও ২০ কিলোমিটার অবধি প্রসারিত একটি বিক্ষিপ্ত পাতলা বায়ুমণ্ডলের স্তর।
শুক্র গ্রহের ভূমিরূপ ও পরিবেশ
শুক্র গ্রহ ও পৃথিবীকে বলা হয় যমজ গ্রহ। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে দুটি গ্রহের ভূমির পরিস্থিতি প্রায় একই ধরনের। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফিউরিক অ্যাসিডের ঘন মেঘের চাদরে ঢাকা শুক্র গ্রহের ভূমি সম্বন্ধে বিশদভাবে জানা এখনও সম্ভব হয়নি। যেটুকু জানা গেছে তা সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো ‘ভেনেরা’ মহাকাশযান এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো ‘পাইওনিয়ার-ভেনাস’ মহাকাশযানের ভূমিভিত্তিক রাডার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।
উত্তপ্ত ও শুষ্ক এই গ্রহটির ভূমিরূপ বেশ বৈচিত্র্যময়। এখানকার ৮০ শতাংশ ভূমি প্ল্যানিশিয়া (Planitia) অর্থাৎ, নিম্ন সমতল আগ্নেয়গিরি অঞ্চল দ্বারা আবৃত। আর বাকি ২০ শতাংশ উচ্চ এলাকা মধ্যে আছে টেরা (Terra) বা রিজিও (Regio) এবং টেসেরা (Tessera) জাতীয় অঞ্চল। গ্রহটিতে যে আগ্নেয়গিরিগুলি আছে সেখান থেকে উদ্গীরিত লাভা বহু জায়গায় জমাট বেঁধে রয়েছে। কোনো-কোনো অঞ্চলে এই জমাট বাঁধা লাভার ব্যাস ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি। শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠদেশ এখনও পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। অনুমান করা হয়, শুক্র গ্রহের অভ্যন্তর অনেকটা পৃথিবীর অভ্যন্তরের মতোই। তাই মনে করা যেতে পারে প্রথমদিকে পৃথিবীর পরিবেশও এমনটাই ছিল।
শুক্র গ্রহ যেন এক তপ্ত গোলা
এক ঘন মেঘের আস্তরণে শুক্র গ্রহ আবৃত। এই মেঘের প্রায় ৯৬ শতাংশই কার্বন ডাই-অক্সাইড যা তাপকে বেশি পরিমাণে ধরে রাখতে পারে। ফলে পুরো গ্রহটাই গ্রিন হাউসে পরিণত হয়েছে। গ্রিন হাউস সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত আলোক শক্তিকে প্রবেশ করতে দিলেও তাপের বেশিরভাগ অংশ আটকে রেখে দেয়, বাইরে বেরিয়ে আসতে দেয় না। এই কারণেই গ্রহটি এত উত্তপ্ত। কতটা উত্তপ্ত তা বোঝাতে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গ্রহটিতে কোনও সীসার দণ্ড নিয়ে গেলে তা সহজে গলে যাবে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, শুক্রের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে এবং সেখানে দিনে ও রাতে তাপমাত্রার তেমন কোনও হেরফের হয় না। যে কারণে গ্রহটির তাপমাত্রা সারাবছরই প্রায় সমান থাকে।
শুক্র গ্রহে জল ও প্রাণের অস্তিত্ব
শুক্র গ্রহে জীবের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য জলের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা গ্রহটিতে জলের খোঁজ এখনও সেভাবে পাননি। এছাড়াও তীব্র তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলের অত্যধিক চাপের জন্য শুক্রপৃষ্ঠে প্রাণের অস্তিত্ব না থাকারই সম্ভাবনা বেশি। তবে শুক্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে মেঘমণ্ডলের পরিবেশ অনেকটাই ভিন্ন ধরনের। সেখানকার তাপমাত্রা অনেকটাই পৃথিবীর মতোই নাতিশীতোষ্ণ এবং বায়ুচাপও খুব বেশি নয়। বিজ্ঞানীদের অনুমান, শুক্রপৃষ্ঠের তাপের পরিমাণ অত্যধিক হওয়ায় সেখানকার সমস্ত জল বাষ্পীভূত অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করছে। কোনো-কোনো বিজ্ঞানী প্রশ্ন তুলেছেন, তাই যদি হবে তাহলে তো গ্রহটির মেঘে জলীয় বাষ্পের অস্তিত্ব ধরা পড়ার কথা। কিন্তু পড়ছে না তো! এ-ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে জানা গেছে যে, অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্পের বিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ফরম্যালডিহাইড গ্যাস। এবারে প্রশ্ন উঠল, এই ধরনের বিক্রিয়ায় ফরম্যালডিহাইড গ্যাসের সঙ্গে কিছু অক্সিজেনেরও সৃষ্টি হওয়ার কথা। তাহলে সেই অক্সিজেন গেল কোথায়? শুধু তাই নয়, গ্রহটিতে ফরম্যালডিহাইড গ্যাসেরও কোনও খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানী ভিল্ট এই প্রশ্নগুলির একটা যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর খাড়া করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কথায়, যেহেতু অক্সিজেন অতি সক্রিয় গ্যাস তাই তপ্ত শুক্র গ্রহে বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে নানান যৌগিক পদার্থ সৃষ্টি করা অসম্ভব ব্যাপার নয়। আর গ্রহটির আবহমণ্ডলে ফরম্যালডিহাইড গ্যাস খুঁজে না পাওয়ার উত্তরে তিনি বলেছেন, এই গ্যাস জলের সংস্পর্শে এলে যে মেঘের সৃষ্টি হয় তাতে জলকণার পরিবর্তে অসংখ্য প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থের কণা তৈরি হয়।
শুক্র গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের নতুন আশা
শুক্র গ্রহে অক্সিজেনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। যে সামান্য পরিমাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে তাতে সেখানে প্রাণের উপস্থিতি একরকম অসম্ভব। এছাড়াও আছে শুষ্ক গ্রহটির উচ্চ তাপমাত্রা। তাই একসময় বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে শুক্র গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজতে যাওয়া সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সম্প্রতি গ্রহটির পৃষ্ঠের ৫০ কিলোমিটার ওপরে আবহমণ্ডলে বা গ্যাসীয় মেঘমালায় একটি গ্যাসের অস্তিত্ব শনাক্ত করার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহটিতে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা ভাবতে শুরু করেছেন। এই গ্যাসটির নাম ‘ফসফিন’। পৃথিবীতে ফসফিন হচ্ছে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি গ্যাস। কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে ফসফরাসের সঙ্গে হাইড্রোজেনের মিলন ঘটিয়ে এই গ্যাস তৈরি করে (একটি ফসফরাস পরমাণু আর তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমন্বয়ে ফসফিন গ্যাসের একটি অণু তৈরি হয়ে থাকে)। তাহলে কি শুক্রের মেঘমালায় কোনও জীবাণুর অস্তিত্ব আছে? এই প্রশ্নটাই এখন মহাকাশবিজ্ঞানীদের অন্যতম ভাবনা।
শেষকথা
শুক্র পৃথিবীর যমজ গ্রহ হলেও সময় এবং অন্যান্য হিসেবনিকেশের ক্ষেত্রে বর্তমানে পৃথিবীর মানুষের কাছে শুক্র গ্রহের তেমন গুরুত্ব নেই। কিন্তু অতীতে মায়া সভ্যতায় পঞ্জিকা তৈরি হয়েছিল এই গ্রহটি পর্যবেক্ষণ করেই। তাদের অন্যতম আবিষ্কার হল শুক্রবর্ষ। অর্থাৎ শুক্র গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরতে যে সময় নেয় সেই সময়কাল। এদের হিসেবমতো এই সময় ৫৮৪ দিন। আধুনিক হিসেব ৫৮৩•৯২ দিন। দুটি হিসেবের মধ্যে গরমিল প্রতিমাসে মাত্র ৬ মিনিটের মতো। মনে রাখতে হবে যে মায়াদের হাতে এখনকার মতো উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। এমনকি উন্নত ঘড়িও ছিল না। বড়োজোর সূর্য ঘড়ি (সান ডায়াল)-র ব্যবহার হয়তো জানত। তা দিয়েই কি এত সূক্ষ্ম পরিমাপ তারা করেছিল? ভাবতে অবাক লাগে, তাই না?
মায়ারা শুক্র গ্রহ সম্পর্কে যতটা আগ্রহী ছিল, অন্যান্য গ্রহ সম্পর্কে ততটা ছিল না। পৃথিবী থেকে খালি চোখে পাঁচটা গ্রহ দেখতে পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখায় শুক্র গ্রহকে। এছাড়াও একেদিনে দু-বার দেখা যায়—একবার সূর্যাস্তের পরেই, আরেকবার সূর্যোদয়ের পূর্বে। এই কারণেই হয়তো তারা এই গ্রহটি সম্পর্কে বেশি আগ্রহী ছিল।
তথ্যসূত্র
- মহাবিশ্ব/ রমাতোষ সরকার/ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা।
- মহাবিশ্বে আমরা কি নিঃসঙ্গ/ শঙ্কর চক্রবর্তী/ বেস্ট বুকস, কলকাতা।
- The Cambridge Planetary Hand Book/ Michael E. Bakich/ 2000 Cambridge University Press.
- Wikipedia -> https://en.wikipedia.org › wiki › Venus
- https://www.britannica.com › Science › Astronomy
‘বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে